অবক্ষয় : বেপরোয়া বাস-চালকের কাণ্ড
দুই বাসের প্রতিযোগিতায় হাত হারান রাজিব। ঘটনাটি যে-ই পড়েছেন তারই বুক চিরে বের হয়েছে ‘আহ্’ ধ্বনি। দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে দুই বাসের মাঝে আটকে থাকা বিচ্ছিন্ন হাতটির বীভৎস ছবি। এটি গত ৩ এপ্রিল মঙ্গলবারের ঘটনা। বাংলামোটর থেকে ফার্মগেটমুখী বিআরটিসির একটি দোতলা বাসে ছিলেন রাজিব। সেটি সার্ক ফোয়ারার কাছে পান্থকুঞ্জের পাশে সিগন্যালে এসে থামে। এ সময় একই দিক থেকে আসা স্বজন পরিবহনের একটি বাস দ্রুত গতিতে দোতলা বাসের ফাঁক দিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। ঐসময় চাপা খেয়ে রাজিবের ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই বাসের মাঝে ঝুলতে থাকে।
এটি কি নিছক দুর্ঘটনা, না পরোয়াহীনতা। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই পরোয়াহীনতার সংস্কৃতিই প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। এখন চালকেরা বেপরোয়া। ঢাকার সড়কগুলোতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অর্থহীন প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া ওভারটেকিং এখন সড়কের নিত্যদিনের দৃশ্য। দুটি বাসের মধ্যে যখন বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের প্রক্রিয়া চলতে থাকে তখন বাসযাত্রীদের মাঝে তৈরি হয় ইয়া নাফসীর হালত। এই ধরনের অবস্থার সাথে ঢাকা শহরের বাসযাত্রী কমবেশি সকলেই পরিচিত।
রাজিবের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সপ্তাহ পেরুনোর আগেই আরেক ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে শয্যশায়ী আয়েশা খানম। ঢাকার নিউমার্কেট সংলগ্ন চন্দ্রিমা মার্কেটের সামনের রাস্তা দিয়ে রিক্সায় করে মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ঐসময় আজিমপুরের দিক থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে যাওয়া দুটি বাসের মধ্যে চলছিল বেপরোয়া পাল্লাপাল্লি। এই প্রতিযোগিতার মাঝখানে পড়ে রিকশা থেকে ছিটকে পড়েন আয়েশা। তার মেরুদ- ভেঙ্গে যায়। অপারেশনে তা জোড়া দেয়া হলেও দেহের কোমর থেকে নিচের অংশে কোনো সাড়া নেই।
এখানে কে দায়ী আর কে দায়ী নয় তা বলা কঠিন। গোটা ব্যবস্থাটাই অবক্ষয়ের শিকার। মালিক-চালক একে অপরকে দোষারোপ করছে। আসলে দোষ অনেকের এবং অনেক জায়গায়। আন্তজেলা বাস চালক সমিতির একজন নেতা বলেছেন, ‘মহাসড়কে ড্রাইভারদের জন্য ঘণ্টাপ্রতি গতিসীমা বেধে দেওয়া আছে, কিন্তু ঢাকার রাস্তায় চলছে নৈরাজ্য। লোকাল বাসগুলো প্রতিযোগিতা করে বাস চালায়। সেজন্য দুর্ঘটনা ঘটে। চালকদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। তার ওপর মালিকদের দ্বারা তারা চাপে থাকে। কারণ মালিকদের ক্যাশ কম হলে অনেক ড্রাইভারের চাকরি চলে যায়।’
ট্রিপ প্রতি একজন চালক ও কন্ডাক্টর ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পায়। ফলে তাদের লক্ষ্য থাকে যত বেশি সম্ভব ট্রিপ দেওয়া।
অন্যদিকে মালিকপক্ষ দুষছেন চালকদেরই। বিনা কারণে পাল্লাপাল্লি আর মাদকাসক্তির অভিযোগ তুলছেন তারা।
অনেকে বাসচালকদের এই বেপরোয়া আচরণের পিছনে উচ্চপর্যায়ের প্রশ্রয় ও শাস্তি না থাকাকেও কারণ হিসেবে দেখছেন। আসলে সবগুলোই কারণ। বাসমালিকেরাও চান ঢাকার সড়কে বাস নামিয়ে সর্বোচ্চ অর্থোপার্জন। চালক-কন্ডাক্টারেরাও তা চায়। কিন্তু একথা কেউই বুঝতে চায় না যে, শৃঙ্খলা ও উন্নত সেবাদানের মাধ্যমেও অর্থোপার্জন হতে পারে। সেই উপার্জনটা হয় অনেক বেশি স্বস্তি ও সম্মানের। এদেশের অনেকের মাঝেই পশ্চিমাদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি মুগ্ধতা থাকলেও কেন যেন ওদের ভালো দিকগুলোর চর্চা দেখা যায় না। উন্নত ব্যবস্থাপনা, মানসম্মত সেবা ইত্যাদি বিষয়ে অনুকরণের তেমন কোনো আগ্রহ চোখে পড়ে না।
গাড়ির চালকদের শিক্ষা-দীক্ষা, মানবিক বোধের বিপর্যয়টিও অতি ভয়াবহ। এই আদর্শিক অবক্ষয়ের প্রকাশ শুধু সড়কে বেপরোয়া দুর্ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়েই ঘটছে না, সুযোগ পেলেই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, গুম-খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধের মাধ্যমেও প্রকাশিত হচ্ছে। ৮ এপ্রিল রোববার রাতেও সাভারগামী একটি বাসে ড্রাইভার ও সহযোগীদের মাধ্যমে একজন নারীর ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় পাঁচজন গ্রেফতার হয়েছে। এই অবক্ষয়-অব্যবস্থাপনা থেকে উত্তরণের উপায় আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। উত্তরণের জন্য যেমন ব্যবস্থাপনাগত সংস্কার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সর্বস্তরে নৈতিকতা ও মানবিকতার বিস্তার।
সমাজের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সর্বস্তরে অর্থলিপ্সার পরিবর্তে তাকওয়া-পরহেযগারির বিস্তার অতি প্রয়োজন। ইমাম-খতীব ও দায়ীগণ যদি বিশেষভাবে এই দিকে মনোযোগ দেন তাহলে অবস্থার ক্রমোন্নতি আশা করা যায়।