শাবান-রমযান ১৪৩৯   ||   মে-জুন ২০১৮

নৃশংসতা : মাদরাসায় হামলা

আব্দুল্লাহ নসীব

আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশের একটি মাদরাসায় হামলা চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হতাহত করল সে দেশেরই সরকারি বাহিনী। মাদরাসাটিতে হিফ্য সমাপনকারী শিশুদের দস্তারবন্দী মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। হাফেয শিশুদের সাথে তাদের অভিভাবকেরাও উপস্থিত ছিলেন ঐ মজলিসে। এরই মধ্যে সরকারি বাহিনী হেলিকপ্টার গানশিপ নিয়ে তাতে আক্রমণ করে এবং বোমা বর্ষণ করে মসজিদ ও মাদরাসাটি ধ্বংস করে দেয়। সরকারি বাহিনীর বোমাবর্ষণে নিহত হয় হিফ্য সমাপনকারী ফুটফুটে অনেক শিশু, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে। নিহত হন দস্তারবন্দী মাহফিলে অংশগ্রহণকারী অনেক অভিভাবক ও সাধরণ মানুষ।

একটি মুসলিম দেশের নিজস্ব বাহিনীর হাতে এভাবে দেশের নিষ্পাপ হাফেয শিশুদের নিহত হওয়ার মতো দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও ন্যক্কারজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে?

এখন অনেক মুসলিম ভূখ-েই এ বিষয়টি ঘটছে। মুসলিমরাই হত্যা করছে নিজেদের ভাই ও সন্তানদেরকে। মুসলিম ভূখ-ের ক্ষমতাসীনেরা যেন বিস্মৃত হয়েছে যে, শত্রুরা তাদের ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র কাজে ব্যবহার করছে। আফগানিস্তানে অধিকাংশ বিমান হামলা মার্কিনিরা পরিচালনা করলেও এই হামলাটি করেছে আফগান বিমানবাহিনী। নিজ দেশের নাগরিক ও নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করে আফগান বিমান বাহিনী কি ভিনদেশী ভিন জাতির সা¤্রাজ্যবাদীদের বাহবা পেতে চেয়েছে? খবরে এসেছে, মার্কিন বাহিনী এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে। কিন্তু কে না জানে আফগান আর্মি মার্কিন সেনাবাহিনীরই একটি বর্ধিত রূপ। তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র সবই আসে মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা অভিযান পরিচালনা করে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করে। এই নৃশংস ঘটনাটিও যে তাদের সহায়তায় পরিচালিত হয়েছে তা কাউকে বলে দিতে হয় না।

হাজী গোলাম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী আলজাযিরাকে বলেন, আমি আমার খামারে কাজ করছিলাম। যখন হেলিকপ্টার জেট বিমানগুলোকে মাদরাসায় বোমাবর্ষণ করতে দেখি তখন নতুন হাফেযদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হচ্ছিল। তিনি বলেন, যখন মাদরাসার ভেতরে পৌঁছি তখন অনেক শিশুই মারা গিয়েছিল। আহত হয়ে চিৎকার করছিল অনেক শিশু। আমি আমার জীবনে এমন  বিভৎস দৃশ্য কখনো  দেখিনি। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। কুরআনের হাফেযদের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল মেঝে। আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।

এই নৃশংস হামলার পর আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপত্র মোহাম্মাদ রাদমানিশ তা-ই বলেছেন, যা আজকাল এই ধরনের ঘটনার পর বলা হয়ে থাকে। তিনি বলেছেন, ওটা ছিল তালেবান প্রশিক্ষণকেন্দ্র। ওখানে কোনো বেসামরিক লোক ছিল না। বিমান হামলায় অন্তত ৩০ তালেবান যোদ্ধা নিহত হয়েছে। ...কিন্তু পরে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বলেন, আফগান ন্যাশনাল আর্মি তাদের কাছে থাকা ‘সঠিক তথ্য’ অনুযায়ী তালেবানদেরকে ধ্বংস করে জনগণকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের আক্রমণে বেসামরিক জনগণও হতাহত হয়েছে।

এই ধারাটা পশ্চিমারা খুব সাফল্যের সাথেই মুসলিম ভূখ-গুলোতে চালু করতে সক্ষম হয়েছে। নিজ দেশের নাগরিকদের উপর নৃশংস থেকে নৃশংসতম হত্যাকা- সংঘটিত করার পরও শুধু ‘ওটা ছিল তালেবান প্রশিক্ষণকেন্দ্র’ কিংবা ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র’ বলে দেয়াই হত্যাকা-ের সাফাইয়ের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। কোনো মুসলিম কি সত্যিই এত নীচে নেমে আসতে পারে? নিজ জাতি-গোষ্ঠীর প্রতি এত নির্লিপ্ত, এত নির্মম হতে পারে?

বাস্তবেই কেউ যদি অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে সুষ্ঠু বিচার ও তদন্তের মাধ্যমে তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনো অপরাধীকে -যদি সে বাস্তবেই অপরাধী হয়ে থাকে- শাস্তি দেয়ার জন্য অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানী ঘটানোর কোনোরূপ বৈধতা কি ইসলামে আছে? মানবাধিকারের পশ্চিমা ধারণা এই অন্যায়কে বৈধতা দিতে পারে, ইসলাম কখনো একে বৈধতা দেয় না।

মুসলিম দেশগুলোর সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, ভিনজাতির প্ররোচণায় ও মন্ত্রণায় নিজ জাতি-গোষ্ঠীর ও নিজ নাগরিকদের রক্ত ঝরানো কখনো মর্যাদা ও বীরত্ব হতে পারে না। এটা খুবই নীচু স্তরের মানসিকতা ও মেরুদ-হীনতার প্রকাশ। আজ আমাদের উজ্জীবিত হতে হবে ভ্রাতৃত্ব ও স্বকীয়তার চেতনায়। পরস্পর রক্ত ঝরানোর পরিবর্তে আমাদের একত্র ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে নিজেদের নিরাপত্তা ও সা¤্রাজ্যবাদী প্রতারক শক্তির মোকাবেলায়।

মুসলিম ভূখ-ে এই ভ্রাতৃঘাতী ও আত্মঘাতী ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক এই প্রত্যাশা।

 

 

advertisement