সহিষ্ণুতা : ধৈর্য ও বিচক্ষণতার অনন্য নজির
পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদির অনন্য ভূমিকার কথা ইতিমধ্যে পাঠকেরা জেনেছেন। উগ্র হিন্দুদের হাতে তাঁর নিরীহ কিশোর ছেলেটি নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পরও তিনি যেভাবে হাজার হাজার উত্তেজিত মুসল্লীকে শান্ত করেছেন এবং একটি রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ দাঙ্গা থেকে নিজ এলাকাকে রক্ষা করেছেন তা নিঃসন্দেহে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্তে যেমন প্রকাশিত হয়েছে ইসলামের ক্ষমা ও উদারতার আদর্শ তেমনি প্রকাশিত হয়েছে আলিমসুলভ বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা। আমরা অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাঁকে মোবারকবাদ জানাই এবং দুআ করি, আল্লাহ তাআলা যেন তাঁকে দুনিয়া-আখিরাতে উত্তম বিনিময় দান করেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, আসানসোলে রামনবমীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মাঝে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ আরম্ভ হয়েছিল। মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি আসানসোলের নূরি মসজিদের ইমাম। তার ১৬ বছরের কিশোর ছেলে সিরাতুল্লা রাশিদি হৈ চৈ শুনে কৌতুহলী হয়ে বাইরে বের হলে সন্ত্রাসীরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার ও শনাক্ত করা হয়। মাওলানা অভিযোগ করেছেন যে, ছেলেটিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তার আরেক ছেলে পুলিশকে ঘটনা অবহিত করেন কিন্তু পুলিশ তাকে দীর্ঘক্ষণ থানায় বসিয়ে রাখে।
এটা সোমবার সন্ধ্যার ঘটনা। মঙ্গলবার বিকেলে তার জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। আসানসোলের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাসিম আনসারী বলেন, জানাযার ময়দানকে কারবালার ময়দান বলে মনে হচ্ছিল। যুবকদের চোখে মুখে ছিল প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা। আমি প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, নাহ, আসানসোলকে আর রক্ষা করা গেল না। কাউন্সিলর বলেন, জানাযা শুরুর আগে নিহত কিশোরের বাবা ইমাম ইমদাদুল্লাহ রাশিদি কিছু কথা বললেন। তাঁর বক্তব্য শুনে সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশ অদ্ভুতভাবে ঠা-া হয়ে যায়। জানাযা শেষ হয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যান। মাওলানা ফিরে যান মসজিদে। (দৈনিক যুগান্তর ৩০-৩-২০১৮)
ঐ বক্তৃতায় মাওলানা কী বলেছিলেন তা-ও সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। শুভ্র কাফনে আবৃত ছেলের মৃতদেহ সামনে নিয়ে মাওলানা বলেছেন, আল্লাহ আমার সন্তানের যতদিন আয়ু রেখেছেন ততদিন সে বেঁচেছে। আল্লাহ্র ইচ্ছায় তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে যারা হত্যা করেছে আল্লাহ তাদের কিয়ামতের দিন শাস্তি দিবেন। কিন্তু আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার আপনাদের নেই। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য একটিও মানুষের উপর আক্রমণ করা চলবে না। একটিও মানুষকে হত্যা করা যাবে না। বাড়িঘর, দোকানপাট কোথাও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাট করা যাবে না। ...আপনারা যদি আমাকে আপন মনে করেন তাহলে ইসলাম নির্দেশিত শান্তি বজায় রাখবেন। তিনি আরো বলেন, যদি আপনারা শান্তি বজায় রাখতে না পারেন তাহলে ভাবব, আমি আপনাদের আপন নই। আমি আসানসোল ছেড়ে চলে যাব। (দৈনিক যুগান্তর)
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ ধৈর্য ও বিচক্ষণতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ভারতে মুসলমানদের এটাই প্রথম দৃষ্টান্ত নয়। যুগ যুগ ধরে মুসলিমগণ এভাবেই ক্ষমা ও উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এসেছেন। অন্যদিকে বারবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচার ও উসকানীর ঘটনা ঘটছে। ভারতে হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রাগুলো থেকে বিদ্বেষ ও উসকানীমূলক বক্তব্য ও আচরণ একটি সাধারণ রীতি। বিশেষত মুসলিম বসতি বা মসজিদ-মাদরাসার পাশ দিয়ে যাবার সময় এ ধরনের আচরণ প্রায়ই প্রকাশিত হয়। ধর্মীয় শোভাযাত্রায় এ ধরনের সাম্প্রদায়িক আচরণ-উচ্চারণের বিষয়ে তেমন কোনো উচ্চাবাচ্যও হয় না। না ভারতে, না পাশ্ববর্তী মুসলিম দেশে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপলব্ধি করতে হবে যে, এভাবে তারা নিজ ধর্মেরই অবমাননা করছেন।
বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে। পশি^মবঙ্গেও এর আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে। আলোচ্য ঘটনায় মাওলানা একথাও বলেছেন, আমি আসানসোল শহরকে চিনি। ৩০ বছর যাবৎ এখানে আছি। কোনো দিন এধরনের ঘটনা ঘটতে দেখিনি। এটি একটি চক্রান্ত বলেই মনে হচ্ছে।
গোটা পৃথিবী ‘রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার’ শিরোনামে যারা সোচ্চার ভারতে বিজেপির রাজনীতি ও শাসনের ব্যাপারে তাদের তেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যায় না। মুসলিম দেশগুলোর মিডিয়া-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ও কালেভদ্রে দু-একটি দায়সারা বক্তৃতা-উপসম্পাদকীয় দ্বারাই দায়িত্ব শেষ করেন। এই একচক্ষু আচরণ যেমন ন্যায় ও শান্তির অনুকূল নয় তেমনি তা এ জাতীয় শান্তিবাদীদের শান্তির সদিচ্ছাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায় ও সুবিচার অপরিহার্য। শুধু আদালতের সুবিচার নয়, মূল্যায়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সুবিচারও। আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলকে সঠিক মূল্যায়নের সাহসিকতা অর্জন করতে হবে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় পক্ষপাত ও হীনম্মন্যতা থেকে উঠে আসতে হবে। সমাজের ভালো দৃষ্টান্তগুলোর যথার্থ মূল্যায়ন এসব দৃষ্টান্তের বিকাশ ও বিস্তারে সহায়ক হয়ে থাকে।
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও দূরদর্শিতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং বিভিন্ন জনপদে মুসলিমগণ ক্ষমা ও উদারতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন এ প্রসঙ্গে আরো যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, উদারতা ও সহনশীলতার এই ধারা শুধু দুর্বল ও ক্ষমতাহীন মুসলিমেরাই প্রদর্শন করছেন তা নয়, মুসলিমেরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনও অমুসলিমদের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করেছেন। এই ভূখ- তো মুসলিমেরাও শাসন করেছেন। আজ ভারতের বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর উপস্থিতিই প্রমাণ করছে, এই ভূখ-ে মুসলিম শাসনের নীতি ও আদর্শ কী ছিল। তো শাসক ও শাসিত, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন উভয় অবস্থাতেই মুসলিম উম্মাহ্র সাধারণ নীতি ও অবস্থানদৃষ্টেও যদি কারো অন্যায় পক্ষপাত দূর না হয়, ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি না জাগে তাহলে তার বা তাদের জন্য আল্লাহ্র দরবারে দুআ করা ছাড়া আমাদের আর কী-ইবা করার আছে।