শাবান-রমযান ১৪৩৯   ||   মে-জুন ২০১৮

তিনটি গল্প তিনটি কথা

রিদওয়ান

গল্প এক : মুসফিরা। একজন বিবাহিতা। বছর চারেক হল তার একটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। আদর করে নাম রাখে- সোহাগ। বয়স চার। সোহাগ জন্মাবার পর থেকেই মুসফিরার একটা অভিযোগ- ‘বাচ্চাকে খাওয়াতে তার জান বের হবার দশা। ওকে নিয়ে সে আর পারছে না।’ বাধ্য হয়েই মুসফিরা এখন তার বাচ্চাকে টিভি ছেড়ে খাওয়ায়। টিভিতে কার্টুন চলতে থাকে; লাল-নীল-হলুদ-সবুজ নানা রঙের কার্টুন নড়তে চড়তে থাকে। সোহাগ খুব আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। এ সুযোগে মুসফিরা ওর মুখে খাবার পুরে দেয়। সোহাগ যে কার্টুনটাকে বড্ড পছন্দ করে তা হচ্ছে ডোরেমন। এ কার্টুন শুরু হলেই সোহাগ একদম পুতুলের মতো হয়ে যায়। ডোরেমনের বুকে থাকে ছোট্ট একটি পকেট। পকেট থেকে সে বের করে হরেক রকমের জিনিস। অত ছোট্ট পকেটে এতো কিছু থাকে কীভাবে? অনেক সময় পকেট থেকে দশগুণ বড় জিনিসও ডোরেমন বের করে ছাড়ে। সোহাগের মা এগুলোকে কিছুই মনে করে না।

একদিন সে বায়না ধরে- আম্মু! আমাকে ওরকম একটা প-প-প-পকেট দাও। আমি তা থেকে অনেক অনেক খেলনা বের করব। ওই পকেট সব দিতে পারে। সোহাগের কচি মুখে এ কথা শুনে ওর মা ‘থ’ হয়ে যায়।

গল্প দুই : আলাউদ্দিন। ছোট্ট দুটো পুত্রসন্তানের জনক- মাহফুজ ও মাহবুব।  বয়স দশ ছুঁই ছুঁই। স্কুল সেরে বাসায় এসেই রিমোর্ট হাতে নিয়ে ঠাকুমার ঝুলি দেখে। প্রতিটি পর্বই খুব মনোযোগ দিয়ে টা-ন চোখে গেলে। সুস্থ মানুষ হঠাৎ রাক্ষস হচ্ছে। কখনো একজন মানুষ কোনো ফুল বা কোনো জন্তুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এরপর নানা কিসিমের চড়াই-উতরাই পার করে আবার মানুষের রূপ ধরছে।

তারা যে শুধু ঠাকুমার ঝুলিই দেখে, তা নয়। বেন টেনসহ আরো হাবিজাবি কী কী দেখে। তাদের স্কুল ব্যাগেও বেন টেন-এর ছবি আছে। ‘বেন’ তাদের মতোই ছোট। নানা পরিস্থিতিতে সে মানুষ-শ্রেণি থেকে বের হয়ে অন্য শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়। কখনো দৈত্য কখনো...। একদিন বিজ্ঞান-টিচারের কাছে তারা ডারউইনের সেই প্রসিদ্ধ থিউরিটা শুনে- ‘মানুষ একসময় বানর ছিল। বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ হয়েছে।’ মাহফুজের মাথায় কথাটি গেড়ে বসে।

একদিন মাহফুজ মাহবুবকে বলে- আমরা মনে হয় আগে বানরই ছিলাম!

মাহবুব- নাহ!  মানুষ আবার বানর থেকে কীভাবে হয়?

মাহফুজ- হতেও তো পারে। দেখিস না কার্টুনে- মানুষ এটা-ওটা জন্তু-জানোয়ার কত কিছু হয়। তো বানর থেকে মানুষ হওয়া আর অসম্ভব হবে কেন?

মাহবুব চুপ হয়ে যায়। আসলেও তো! বানর থেকে মানুষ হওয়া তো খুবই সম্ভব!

তার চোখে ঠাকুমার ঝুলি ও বেন টেন-এ মানুষের বিভিন্ন জন্তুতে রূপান্তর আবার সেই জন্তু থেকে মানুষ হওয়ার চিত্রগুলো ভাসতে থাকে।

গল্প তিন : প্রফেসর আবিদ। তার একটি মেয়ে। নাম- জোছনা। বয়স বারো পেরিয়ে তেরতে এল। প্রিয় কাজ- হিন্দি ছবি দেখা। বয়স যখন সাত-আট তখন থেকেই সে বাবা-মা’র সঙ্গে হিন্দি ছবি দেখতে থাকে। তার পরিবারটি শুধুই ইসলামের নাম নিয়ে বেঁচে আছে। দেখতে দেখতে আবেদ সাহেবের মেয়ে বেশ বড় হয়ে উঠেছে। যতই বড় হচ্ছে ততই যেন তার পোশাক-আশাকে শালীন ভাবটা হারিয়ে যাচ্ছে। ভারতের নায়িকাদের মতো ড্রেস পরা শুরু করেছে। জামা-কাপড়ের ব্যাপার তো আছেই। মেয়ে কথায় কথায় হিন্দি শব্দ বলে। দশটির মধ্যে দুটি শব্দই হিন্দি। আবেদ সাহেব মনে মনে বলেন-

এমন হিন্দি-বাংলার জন্যই কি আমরা ভাষা-আন্দোলন করেছিলাম? আমার মেয়ের কথা এমন হিন্দি শব্দের কাগজে মোড়ানো কেন? তার পোশাক এমন ছোট ছোট কেন? আবেদ সাহেব তার এমন হতাশাজড়ানো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরেন। তিনটি গল্প বললাম।  এবার তিনটি কথা বলি :

এক. আমাকে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমার সন্তানের কোমল হৃদয়ের উর্বর ভূমিতে আমি কেমন ফসল ফলাতে চাই। আমি তাওহীদের শিক্ষার বীজ রোপণে ইচ্ছুক, নাকি শিরকের। ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা- সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ‘আল্লাহ’। এটাকে মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

.وَ خَلَقَ كُلَّ شَیْءٍ

তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। -সূরা আনআম (৬) : ১০১

اَللهُ خَالِقُ كُلِّ شَیْءٍ

আল্লাহ প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। -সূরা যুমার (৬৪) : ৬২

শিশু যখন কোনো অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে একের পর এক নানারকমের জিনিস বের হতে দেখবে, তখন তার শিশুমনে এর কী প্রভাব পড়বে? সে ভাববে, ডোরেমনের মতো কার্টুন পর্যন্ত পকেট থেকে কত কিছু সৃষ্টি করে বের করতে পারে! আমরা হয়ত বলব, ‘কার্টুনচরিত্র’ তো সত্য নয়। এসব সত্য হলে একটি কথা ছিল। কিন্তু এ যে ‘অসত্য’ তা আপনি ক’টা বাচ্চাকে বুঝাতে পারবেন? সে কি বুঝে সত্য-অসত্যের ধাঁধাঁ? তারা যদি বুঝতই- এসব ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়, তাহলে তো কার্টুন দেখে তারা আর এত মজা পেত না।

এ ধরনের কার্টুনের মাধ্যমে খুব সুচারুভাবে আল্লাহ্র একক গুণ সৃষ্টিক্ষমতার সঙ্গে অন্য কাউকে জড়ানো হচ্ছে। এ বিষক্রিয়া একদিনে ধরা পড়বে না। এর প্রতিক্রিয়া আপনার সন্তানের মননে মানসে আস্তে আস্তে ফুটে উঠবে।

বলছিলাম ডোরেমন কার্টুনের কথা। সমস্যা শুধু ডোরেমন কার্টুন নিয়েই নয়। আমাদের চারপাশে অহর্নিশ এমন অনেক কিছুই নীরবে ঘটে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত শান্তভাবে ইসলামী রুচি-সাংঘর্ষিক ধ্যান-ধারণা আমাদের মন-মানসে রোপণ করছে। এখন আমাদের মায়েরা হয়ত প্রশ্ন তুলবেন- তাহলে বাচ্চাকে খাওয়াব কীভাবে? হাঁ এটা একটা প্রশ্ন। বাচ্চাদের খাওয়ানো নিয়ে মায়েরা যে কষ্টে পড়েন তা হেলাফেলা করার মতো নয়। কিন্তু মমতাময়ী মাকেই তো চিন্তা করতে হবে তার আদরের সন্তানের রুচি ও বিশ্বাসের কথা। আমার বিশ্বাস, মায়েরাই পারেন এই সমস্যার উত্তম সমাধান বের করতে। শুধু প্রয়োজন বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা।

দুই. মাহফুয ও মাহবুব। ডারউইনের হাস্যকর তথ্যটি তাদের অপক্ব বিবেকে যৌক্তিক মনে হয়েছে। এর মূল ইন্ধন ওই ঠাকুমার ঝুলি ও বেন টেন কার্টুন। এগুলো দেখেই তাদের হৃদয়ে বিবর্তনবাদের যৌক্তিকতার কালো রেখা অঙ্কিত হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় ধোকাগুলোর একটা- বিবর্তনবাদ। বস্তুবাদকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করার একটি মোক্ষম অস্ত্রও বটে!

ধর্ম মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে দেখায়। ধর্ম আমাদের শেখায়- পৃথিবীর সবকিছু মানুষের জন্য সৃষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন-

هُوَ الَّذِیْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِی الْاَرْضِ جَمِیْعًا

পৃথিবীর সবকিছুকে তিনি তোমাদের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৯

পৃথিবীটাই আমাদের শেষ নয়। এর পাঠ চুকিয়ে আমাদের চলে যেতে হবে অনন্ত অসীম এক সময়ের অধীনে। অন্য একটি জগতে, একেই বলে আখিরাত।

বস্তুবাদ, বিবর্তনবাদ বা ডারউইনবাদ নিয়ে আলোচনায় আমরা যাব না। তবে এটুকু বলি- বস্তুবাদ তথা ডারউইনবাদ যা ধারণা দেয়, তা থেকে বোঝা যায়- মানুষ মূলত বিশেষ কোনো সৃষ্টি নয়। সে একটি ক্ষুদ্র এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হতে হতে আজকের আধুনিক মানুষ বা ‘উন্নত পশুমাত্র’। এই বস্তুবাদের আরো ধারণা হলো- পরকাল বলতে কিছুই নেই। এ পৃথিবীই শেষ। এরপর আর কোনো জীবন নেই।

এই বস্তুবাদকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্তরে স্তরে পৌঁছে দিতে বিবর্তনবাদকে তারা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখব- বস্তুবাদের দখলে থাকা বিজ্ঞানী মহল এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন চক্র খুব কৌশলে পাঠ্যবইয়ে, ম্যাগাজিনে, পত্রিকায় এমনকি ছবি বা কার্টুনে বিবর্তনবাদকে এমনভাবে উপস্থাপন করছে যেন তা পুব দিকে সূর্য ওঠার মতোই নিত্য।

যে কার্টুনগুলোর কথা আমরা একটু আগে বলে এসেছি, আমরা বলছি না- এগুলো বিবর্তনবাদকে উসকে দেওয়ার জন্যেই তৈরি। আমরা বলি- এর মাধ্যমে কী জীবানু ছড়াচ্ছে, বোদ্ধামহল যদি একটু ভেবে দেখতেন!

তিন. মানুষের একটি সাধারণ অভ্যাস হলো- অনুকরণ। সে কাউকে না কাউকে অনুকরণ করে চলে। চলতে চায়। সৃষ্টিগতভাবে মানুষের মধ্যে অতি প্রশংসনীয় গুণ এটি। কিন্তু প্রাপ্ত এ নেয়ামতকে আমি কোন কাজে ব্যয় করছি ভেবে দেখা উচিত। আমাদের দেশে এখন হিন্দি সিরিয়ালের রমরমা অবস্থা। সাধারণ জনগণের ঝোঁক-মনোযোগ বহুলাংশে ওদিকেই। সমাজের প্রায় সব স্তরেই এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সেমতে একটা চিত্রই ফুটে উঠেছে তৃতীয় গল্পে। এখানে জোছনার অশালীন কাপড় পরা, কথায় কথায় হিন্দি শব্দ প্রয়োগ, এসব দেখে আমরা কী বুঝি?

আমরা অনেক অভিভাবক এমনও আছি- সন্তানের সামনে টিভিতে হাবিজাবি অনেক কিছুই দেখি। এর মাধ্যমে আমার সন্তানের মধ্যে কী বাজে প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে কখনো কি ভেবেছি? যে মেয়ে উঠতি বয়স থেকেই টাইটফিট জামা পরে সে যখন বড় হবে তার অবস্থা কেমন হবে? হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি যদি এখন থেকেই সে লালন করে তাহলে ভবিষ্যতে স্বধর্মত্যাগের কোন স্তরে গিয়ে সে ঠেকবে? যদি কোনো আদর্শ মুসলিম পুরুষ এর স্বামী হয় তখন সে স্বামীর অবস্থা কী হবে? তাত্থেকে আগত সন্তানদের দ্বীনি রূপ কেমন হবে? এমন আরো অনেক প্রশ্ন রইল আলাউদ্দিন সাহেবের মতো মানুষের কাছে।

ডোরেমন বা এ জাতীয় কার্টুন চাইনিজদের তৈরি। চাইনিজরা অধিকাংশই কমিউনিস্ট। তাদের তৈরি কার্টুন তাদের বিশ্বাসের উপর দাঁড়াবে- এই তো স্বাভাবিক। ঠাকুমার ঝুলি হিন্দুয়ানি কার্টুন। এতে হিন্দুদের হরেক রকমের বিশ্বাসের ছাপ থাকবে- এই তো যৌক্তিক। কখনো ভগবানের বিষয় আসবে। কখনো হিন্দুদের দেব-দেবি-মূর্তিদের নড়তে দেখা যাবে। কখনো যোগীদের হাতে নানা ঢঙের কা-ও চোখে পড়বে। এ ধরনের অগুণতি নির্ভেজাল কুফরি বিশ্বাসমিশ্রিত কার্টুন একের পর এক গিলছে আপনার আমার মুসলিম সন্তান। এ ধরনের কার্টুন ইত্যাদি যারা তৈরি করে তাদের কাছে এ বিষয়গুলি বিবেচ্য না-ও হতে পারে। তাই বলে আমরাও কি চোখবুজে তাদের ভেলায় চড়ব? আমার মনে হতে পারে- এগুলো ছাড়া বাঁচি কী করে? আমাদের সন্তানরা তাহলে কী নিয়ে থাকবে? এমন অনেক প্রশ্নজটলায় আমাদের বিবেকের গলিঘুচিতে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম আর জ্যাম। এ ধরণের কার্টুন-টার্টুন যখন ছিল না তখন কি মানুষ বাঁচেনি?  তখন কি মানুষ সময় পার করেনি? আল্লাহর রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম এবং তৎপরবর্তী মনীষীগণের জীবনচরিতে, আমার এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর রয়েছে।

তাই আসুন! যোগ্য আলেমদের পরামর্শে তাঁদের বর্ণাঢ্য জীবনচরিত থেকে আমরা এসব প্রশ্নের সমাধান বের করি এবং সেগুলো বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করি।

 

 

advertisement