সত্যের অবহেলিত একটি দিক
সত্য আলো। মিথ্যা অন্ধকার। সত্য ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। মিথ্যা অন্যায়ের পথ দেখায়। সত্য মুক্তি দেয়। মিথ্যা ধ্বংস করে। সত্য নিয়ে যায় জান্নাতে। মিথ্যা টেনে নেয় জাহান্নামে। তাই সত্য সর্বদা গ্রহণীয়। আর মিথ্যা সর্বদা পরিত্যাজ্য।
সত্য-মিথ্যার বিপরীতমুখী সমীকরণের অকাট্য বাস্তবতা আমাদের জানা থাকলেও জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে আমরা সত্যকে অবলীলায় পরিত্যাগ করে থাকি। বেমালুম মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলি।
জীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্র এমন রয়েছে, যেখানে আমরা দেদারছে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করছি। অথচ চিন্তাও করছি না, বিলক্ষণে আমরা অন্যায় গ্রহণ করে চলেছি। সাথী-সঙ্গীদের সাথে হাসি-তামাশা ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঠাট্টা- কৌতুক যেন মিথ্যা ছাড়া জমেই না। সমবয়সীরা একে অপরকে ‘ডস’ দিয়ে ‘এনজয়’ করে, যা স্পষ্ট ধোঁকা ও প্রতারণা।
বড়রা ছোটদের সাথে রসিকতার ছলে বিভিন্নভাবে তাদেরকে প্রতারিত করে। বিবেকে এতটুকু বিঁধে না যে, এভাবে সে নিঃসঙ্কোচে মিথ্যা ও অন্যায় করে যাচ্ছে। উপরন্তু এক্ষেত্রে যে যত ‘মিথ্যার নিপুণতা’ প্রদর্শন করতে পারে, সে তত বাহবা পায়। মিথ্যাকে অবলম্বন করে সে ‘কৃতিত্ব’ অর্জন করে।
মনে রাখতে হবে, শরীয়তের সকল নির্দেশনা সত্যের পক্ষে, মিথ্যার বিপক্ষে। হাসি-আনন্দ ও কৌতুক করতে শরীয়ত নিষেধ করে না। তবে এক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
যাইহোক, এখানে আমরা সত্যের এমনই একটি অবহেলিত দিক নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করব- ইনশাআল্লাহ।
আমাদের সমাজে নিষ্পাপ অবুঝ শিশুদেরকে বশে আনার জন্য সাধারণত নানাভাবে ধোঁকা দেওয়া হয়। নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে বাগে আনা হয়। এটা ওটার বায়না ধরলে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়। এমনকি বিভিন্নভাবে রসিকতার ছলে প্রতারিতও করা হয়। মোটকথা, তাদের সাথে নানা সময় নানাভাবে ‘মিথ্যা’ চলে। এক্ষেত্রে কেউ সতর্ক করলে উত্তরে বলা হয়, ‘আরে, বাচ্চা মানুষ। সমস্য নেই। কিচ্ছু হবে না।’ ফলে যখন ‘সমস্যা নেই’ মানসিকতা নিয়ে এ কাজটি করা হয় তখন আর এ সমস্যার সমাধানের চিন্তাও মাথায় আসে না।
অথচ খেয়াল করা হচ্ছে না, এভাবে একটি কোমলমতি শিশুর উর্বর হৃদয়ভূমিতে মিথ্যা ও প্রতারণার বিষবৃক্ষের বীজ অতি সন্তর্পণে বপন করে দিচ্ছি। শিশুর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মিথ্যা-বৃক্ষের শেকড়ও মজবুত হতে থাকে। এভাবে একটি শিশু অজান্তে মিথ্যাকে গ্রহণ করে ফেলে। মিথ্যাকে তখন আর তার কাছে মিথ্যা মনে হয় না।
এছাড়া সে মিথ্যাপূর্ণ আচরণ দেখতে দেখতে এটাকে স্বাভাবিক আচরণ মনে করে। ফলে অন্যের সাথেও সে সত্য বিবর্জিত আচরণ করে। এভাবে সমাজ থেকে সত্য বিলুপ্ত হতে থাকে। দেখা গেল, একটি সমস্যাকে সমস্যা মনে না করার কারণে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের সাথে এহেন আচরণকে অত্যন্ত গর্হিত দৃষ্টিতে দেখতেন। হাদীসে এমনই একটি ঘটনা বিবৃত হয়েছে-
হযরত আমের ইবনে রবী‘আ রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ঘরে বসা ছিলেন। মা তখন আমাকে ডাকলেন। আব্বু, এই যে আস, আস! এই যে নিয়ে যাও! (এভাবে কিছু দেওয়ার ভঙ্গিতে প্রলোভন দেখিয়ে ডাকলেন।) নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তাকে কী দিতে চাচ্ছ?
- খেজুর দিব। ইয়া রাসূলাল্লাহ!
- যদি কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমলনামায় মিথ্যার গোনাহ লেখা হত। -সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস : ৪৯৯১
মোটকথা, জীবনের পদে পদে সত্যকে গ্রহণ করার সাথে সাথে এসকল অবহেলিত দিকগুলোর ক্ষেত্রেও সচেতন থাকতে হবে। বিশেষ করে শিশুকে আদর্শবান করে গড়ে তুলতে একটি সত্যনিষ্ঠ পরিবেশ তাকে উপহার দিতে হবে। তাদের সাথে আচরণ হতে হবে অত্যন্ত মার্জিত ও শোভন। মিথ্যা, প্রতারণা ও ছলচাতুরিপূর্ণ আচরণ পরিপূর্ণ পরিহার করতে হবে। তবেই ভবিষ্যত প্রজন্ম আলোকিত হবে, আলোদানকারী হবে।