এক পেয়ালা দুধ
কে না চেনে তাকে! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাক যবানের পবিত্র বাণী শুনতে গেলে প্রায়ই কানে বাজে তাঁর প্রিয় এই সাহাবীর নামটি। তোমরা যারা হাদীসের তালীমে বস, নিশ্চয় শুনেছ তার নাম। তার নাম মোটামুটি সবারই জানা। হাঁ, প্রিয় নবীর সেই প্রিয় সাহাবীর নাম- আবু হুরায়রা (রাযিআল্লাহু আনহু)। তুমি কি তাঁর নাম শুনে ‘রাযিআল্লাহু আনহু’ বলেছ?
নবীজীর কোনো সাহাবীর নাম শুনলে বলতে হয়- ‘রাযিআল্লাহু আনহু’। রাযিআল্লাহু আনহু অর্থ- আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন!। এটি সাহাবী হওয়ার মর্যাদা। নবীজীর সান্নিধ্যের কারণে আল্লাহ্ তাঁদের এ মর্যাদা দান করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত যে-ই তাঁদের নাম শুনবে বলবে- ‘রাযিআল্লাহু আনহু’।
আবু হুরায়রা রা. নবীজীকে পেয়েছেন মাত্র তিন থেকে চার বছর। অথচ নবীজীর হাদীস তিনিই সবচে’ বেশি বর্ণনা করেছেন। এত কম সময়ে এত বেশি হাদীস তিনি কীভাবে শিখলেন তা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক-
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, আমাদের মুহাজির ভাইদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল; তাদের বাজারে যেতে হত। আর আনসারী ভাইদের ছিল ক্ষেত-খামার; তাদের ওখানে সময় দিতে হত। কিন্তু আমি ছিলাম ছুফ্ফার এক মিসকীন! আমার না ছিল ক্ষেত-খামার, না ব্যবসা-বাণিজ্য; না ছিল ধন-সম্পদ, না ঘর-সংসার- কিছুই ছিল না আমার। আমি খেয়ে না খেয়ে নবীজীর দরবারেই পড়ে থাকতাম। কিছু জুটলে খেয়ে নিতাম, নইলে উপোস থাকতাম। যখন যা জুটত তাতেই তুষ্ট থাকতাম; তাঁর খেদমত করতাম, তাঁর সাথে সাথে থাকতাম। যখন অন্যরা অনুপস্থিত তখনও আমি উপস্থিত থেকেছি, যাতে নবীজীর কোনো হাদীস আমার থেকে ছুটে না যায়। যাতে আমি নবীজীর সব হাদীস শুনতে পারি। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৪৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮৩৭)
তিনি আরো বলেছেন, আমার এমন সময়ও গিয়েছে, ক্ষুধার কারণে মিম্বর ও হুজরা মুবারকের মাঝে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতাম। লোকেরা ভাবত, বোধহয় মৃগী রোগের কারণে আমি এভাবে পড়ে আছি। তাই তখনকার নিয়ম অনুসারে তারা আমার হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমার ঘাড়ে পা চেপে ধরত। কিন্তু হায়! আমার মৃগী রোগ ছিল না; ক্ষুধার কারণে এভাবে পড়ে থাকতাম! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৩২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৬৭
দেখ, কেমন ছিলেন নবীজীর এই মহান সাহাবী; ক্ষুধার কারণে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকছেন কিন্তু কারো কাছে হাত পাতছেন না। মুখ ফুটে অন্যের কাছে তা প্রকাশ করছেন না। কারণ অন্যের কাছে হাতপাতা নবীজী পছন্দ করতেন না।
যাইহোক এবার জানবো নবীজীর হাদীস গ্রহণের জন্য আবু হুরায়রা রা. কত কষ্ট করেছেন। তাঁদের কষ্টের কারণেই তো আমরা আজ নবীজীর হাদীস জানতে পারছি, দ্বীন শিখতে পারছি। ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করতে গিয়ে একবার যে অভাবনীয় ঘটনা ঘটল সেটি এবার বলি-
একদিন প্রচ- ক্ষুধায় টিকতে না পেরে আবু হুরায়রা রা. রাস্তায় বেরুলেন। দেখলেন, হযরত আবু বকর রা. আসছেন। সরাসরি ক্ষুধার কথা তো বলতে পারেন না। তাই কুরআনে কারীমের একটি আয়াত জিজ্ঞাসা করলেন। আয়াত জানাটা উদ্দেশ্য ছিল না; উদ্দেশ্য ছিল, মলিন চেহারা দেখে ও ধরা কণ্ঠ শুনে যেন হযরত আবু বকর রা. তার কষ্টটা আঁচ করতে পারেন। কিন্তু না, আবু বকর কিছুই বুঝলেন না! উত্তর দিয়ে চলে গেলেন।
একটু পর এলেন হযরত উমর রা.। তাঁকেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না। একটি আয়াত জিজ্ঞাসা করার ছুতোয় তাঁরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন। ওমর রা.-ও বুঝতে পারলেন না। বুঝবেন কীভাবে, সামনে যে অপেক্ষা করছিল এক আলৌকিক ঘটনা! তাই হযরত উমরও প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর দেখলেন, রহমতের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসছেন। এবার তাঁর মনে একটু আশা জাগল, ক্ষুধার্ত মলিন চেহারাটা একটু উজ্জ্বল হল। আবু বকর-ওমর বুঝতে না পারলেও নবীজী ঠিকই চেহারা দেখেই বুঝে ফেললেন তাঁর প্রিয় সাহাবীর মনের কথা। মুচকি হেসে বললেন-
- আবু হুরায়রা?!
- লাব্বাইক, ইয়া রাসূলাল্লাহ।
- চলো।
নবীজী সামনে চলতে লাগলেন। আবু হুরায়রা চললেন পিছুপিছু। নবীজী ঘরে প্রবেশ করলেন।
হযরত আবু হুরায়রাও অনুমতি নিয়ে নবীগৃহে প্রবেশ করলেন।
নবীজী ঘরে গিয়ে দেখেন, এক পেয়ালা দুধ। জিজ্ঞাসা করলেন-
- এটা কোত্থেকে এল?
-অমুক আমাদের জন্য হাদিয়া পাঠিয়েছে। ভেতর থেকে আওয়ায আসল।
নবীজী আবু হুরায়রাকে ডেকে বললেন-
ছুফ্ফায় যারা আছে সবাইকে ডেকে আনো।
মসজিদে নববীর ছুফ্ফাবাসী সকলেই ছিলেন ইসলাম ও মুসলমানদের মেহমান। তাদের কোনো ঘর-সংসার ছিল না। নবীজীর দরবারেই পড়ে থাকতেন; হাদীস শিখতেন, ইলমের চর্চা করতেন। নবীজীর নিকট কোনো ছদকা এলে সবটুকু তাদের দিয়ে দিতেন। আর কেউ হাদিয়া পাঠালে নিজে কিছু গ্রহণ করে অন্যদেরও তাতে শরিক করতেন।
তো এই এক পেয়ালা দুধে ছুফ্ফার সাবাইকে শরিক করার জন্য নবীজী আবু হুরায়রাকে বললেন- ছুফ্ফার সবাইকে ডেকে আনো।
এ কথা শুনে আবু হুরায়রা ভেতরে ভেতরে একটু দমে গেলেন। এক পেয়ালা দুধ! আবার সবাইকে ডাকতে বলছেন! আমাকেই তো বলবেন- সবাইকে পান করাও। সবাই পান করার পর আমার কপালে কি কিছু জুটবে?! কিন্তু যত যাই হোক এ যে আল্লাহ্র রাসূলের নির্দেশ! তা পালন করার মাঝেই কল্যাণ।
আবু হুরায়রা রা. সবাইকে ডেকে আনলেন। নবীজী বললেন-
আবু হুরায়রা! সবাইকে পান করাও।
আবু হুরায়রা রা. একজন একজন করে সবার কাছে পেয়ালাটি পেশ করছেন। প্রত্যেকে নিজের চাহিদামতো তৃপ্তিভরে পান করছেন আর তা দেখে আবু হুরায়রার গলা আরো শুকিয়ে আসছে; এই বুঝি পেয়ালার সব দুধ গেল শেষ হয়ে!
কিন্তু না, একে একে সবাই তৃপ্তিভরে পান করার পরও শেষ হল না পেয়ালার দুধ। এবার আবু হুরায়রা পেয়ালা এগিয়ে ধরলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে। নবীজী পেয়ালা হাতে নিলেন। মাথা তুলে তাকালেন আবু হুরায়রার দিকে। মুচকি হেসে বললেন-
আবু হুরায়রা! আর কে বাকি, আমি আর তুমি?
- জ¦ী, ইয়া রাসূলাল্লাহ।
- আচ্ছা, তাহলে বস। আগে তুমি পান কর।
হযরত আবু হুরায়রা রা. পান করলেন। নবীজী বললেন- আরো পান কর। তিনি আরো পান করলেন। নবীজী বললেন- আরো। তিনি আরো পান করলেন। আর পারছেন না।
- নবীজী বললেন, আরো।
এবার আবু হুরায়রার পরাজিত বাক্য-
ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঐ সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন, আর পারছি না!
এত মানুষ পান করার পরও পেয়ালাতে যতটুকু দুধ ছিল ততটুকুই থেকে গেল। নবীজী বললেন- এবার আমাকে দাও। নবীজী পেয়ালা হাতে নিলেন। আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে চুমুক দিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩৭৫, ৬২৪৬, ৬৪৫২; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৭৭
দেখলে, যে এক পেয়ালা দুধ একজনেরই হবার কথা ছিল না। হযরত আবু হুরায়রা রা. যেখানে শঙ্কিত ছিলেন- তার নিজেরই এতে পেট ভরবে না, সেখানে কতজন পান করলেন সে দুধ! আসহাবে ছুফফা সকলেই পান করলেন! একেবারে তৃপ্তিভরে পান করলেন! তবুও দুধ ফুরোলো না!
বল, আল্লাহ তাআলার অপার কুদরত ছাড়া কি এটা হতে পারে? এটাই আল্লাহ তাআলার কুদরত এবং আমাদের প্রিয় নবীজীর মুজেযা।
বন্ধুরা! যে অলৌকিক ঘটনাটি তোমরা শুনলে, এ ধরনের ঘটনাকে কী বলে জানো? এটাকে বলা হয়- ‘মুজেযা’। নবীদের হাতে আল্লাহ যে অলৌকিক ঘটনা ঘটান তাকেই বলে ‘মুজেযা’।
আমাদের নবীজীর এরকম অসংখ্য মুজেযা রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা.-কে ঘিরেও রয়েছে প্রিয় নবীজীর অনেক মুজেযা। ইনশাআল্লাহ, অন্য কোনোদিন আমরা সেগুলো শুনব।