শাবান-রমযান ১৪৩৯   ||   মে-জুন ২০১৮

আমার মুহসিন কিতাব-৭

মাওলানা আবদুস সালাম নদভী রাহ.

[মাওলানা আবদুস সালাম নদভী রাহ. ৮ রবিউস সানী ১৩০০ হিজরী/১৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৩ সালে আযমগড় জেলার আলাউদ্দীন পট্টিতে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি নিজ এলাকা আযমগড়েই মৌলভী সায়্যিদ ইমদাদ আলী ও মাওলানা আবদুল্লাহ ছাহেবের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কানপুর, আগ্রা ও গাজীপুরে। সেখানে তার আসাতিযায়ে কেরামের মধ্যে ছিলেন মৌলভী বখশিশ আহমাদ, মৌলভী মুহাম্মাদ রমযান, মৌলভী লা’ল মুহাম্মাদ ও মাওলানা শিবলী জয়রাজপুরী রাহ.। এরপর বিভিন্ন কারণে দুই বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকে। ১৯০৬ সালে তিনি ভর্তি হন দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায়। ১৯০৯ সালে ফারেগ হওয়ার পর সেখানেই তাকমীলে আদব শাখায় দাখেলা নেন। ১৯১০ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সমাপ্ত করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে নদওয়াতেই তিনি আরবী সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে বেশ কিছুদিন দরস-তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। তাঁর প্রতি আল্লামা শিবলী নোমানী রাহ.-এর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি তার প্রতিভার খুব প্রশংসা করতেন। তার সার্বিক অবস্থা দেখে তিনি বলেছিলেন- এই ছেলে বড় মুসান্নিফ হবে। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। শিবলী নোমানী রাহ.-এর জীবদ্দশায়ই তিনি ‘আন-নদওয়া’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হয়েছিলেন। পরবর্তীতে হয়েছিলেন সম্পাদক।

১৯১২ সালে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ একরকম জোর করেই তাকে কলকাতা ডেকে নেন। সেখানে মাওলানা আযাদের সঙ্গে তিনি ‘আল-হেলাল’ এর সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেন।

১৯১৪ সালে দারুল মুসান্নিফীন প্রতিষ্ঠাকালে সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রাহ.-এর আহ্বানে সেখানে চলে যান এবং আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত থাকেন।

তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল কবিতা ও সাহিত্য। তবে ইতিহাস শাস্ত্রেও ছিল তাঁর গভীর পড়াশোনা। তাঁকে হিন্দুস্তানের খ্যাতিমান মুসান্নিফ হিসেবে গণ্য করা  হত।

তাঁর রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে- শে‘রুল হিন্দ, উসওয়ায়ে সাহাবা, উসওয়ায়ে সাহাবিয়্যাত, সীরাতে উমর ইবনে আবদুল আযীয, ইমাম রাযী, ইকবালে কামেল, তারীখে আখলাকে ইসলামী, আলকাযা ফিল ইসলাম ও হুকামায়ে ইসলাম ইত্যাদি।

২৮ সফর ১৩৭৬ হিজরী/৪ অক্টোবর ১৯৫৬ ঈসাব্দে আযমগড়ে তিনি ইনতিকাল করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রতিষ্ঠান দারুল মুসান্নিফীনের আঙ্গিনায় তার উস্তায মাওলানা শিবলী নোমানী রাহ.-এর পাশেই তিনি সমাহিত। -অনুবাদক]

 

আমি আমার মা-বাবার খুব আদরের ছিলাম। এরচে’ বেশি আদরের ছিলাম দাদার। বাবা ছিলেন দাদার একমাত্র ছেলে। তিনি ছাড়া আরো সাত মেয়ে ছিল তাঁর। তাদের একজন ছাড়া সবাই আমার বাবার ছোট। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই তিনি আমার বাবা ও আমাদের ভাইবোনদের খুব ভালোবাসতেন। ওদিকে আমার বাবার প্রথম তিন সন্তান হয়েছে মেয়ে। এরপর আমি। অতএব ভেবে দেখুন, যার ঘরে সাত কন্যা, একমাত্র ছেলের ঘরেও তিন কন্যা, তার পরিবারে ছেলের প্রতি আগ্রহ কী পরিমাণ! এমন মুহূর্তে যখন আমার জন্ম হল তখন দাদাজানের আনন্দ নতুন রূপ পেল।

সৌভাগ্যক্রমে সেসময় আমাদের খান্দান অনেকটাই পেরেশানীমুক্ত ছিল। পূর্বপুরুষদের থেকে চলে আসা কৃষিকাজ আর তেল-চিনির ব্যবসাই তখন তাদের পেশা। এজন্য গ্রামীণ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের খান্দানকে ধনী খান্দান হিসাবে গণ্য করা হত। এছাড়া আমার দাদা ছিলেন একজন সামর্থ্যবান ও দানশীল ব্যক্তি। তাই আমার জন্মকালে তিনি অনেক বেশি আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। গরীব ও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচুর পয়সা-কড়ি ও কাপড়-চোপড় বিতরণ করেছেন। গ্রামের সবাইকে দাওয়াত করেছেন। এসব থেকে সবাই এ ফলাফলে উপনীত হতে পারেন যে, ভাইবোনদের মধ্যে আমিই আম্মা-আব্বার সবচে’ প্রিয় ছিলাম। আমাকেই সবচে বেশি ভাগ্যবান মনে করা হত। জন্মের দিন থেকেই আমার এই সৌভাগ্যের হিসেব করা হত। আলহামদু লিল্লাহ, এখনো বিভিন্ন দিক থেকে আমি অন্যান্য ভাইবোনদের চেয়ে বেশি ভাগ্যবান ও অনন্য। এজন্য আমি আল্লাহ তাআালার শোকর আদায় করি। সেইসঙ্গে এই আফসোসও করি, আমার ভাইবোনদেরও যদি অন্তত আমার মত ভাগ্য হত! আগের এবং বর্তমানের সৌভাগ্যকে যদি মানতেকের কায়দা অনুযায়ী সুগরা কুবরা ধরা হয় তাহলে কমপক্ষে কল্পনার হিসাবানুযায়ী এই ফলাফল বেরিয়ে আসে যে, ইনশাআল্লাহ কিয়ামতের দিনও আমি সৌভাগ্যবানদের মধ্যে গণ্য হব।

ايں دعا از من، واز جملہ جہاں آمين باد

এই হলো আমার দুআ। সারা দুনিয়া এতে আমীন বলুক।

যাইহোক, এই সৌভাগ্যের মধ্যে একটি কষ্টও যোগ হয়েছিল। কয়েক বছর পরই দাদা ইনতিকাল করেন। তখনও আমি অনেক ছোট। তাই দাদার চেহারাটা শুধু মনে পড়ে। তাঁর কোনো কথা, ঘটনা, স্মৃতি মনে পড়ে না। তবে ইনতিকালের পরের একটি ঘটনা মনে পড়ে।

দাদার দাফন যেখানে হয়েছে সেখানে ছোট একটি বাগান। সেটিই আমাদের পারিবারিক কবরস্থান। দাদার কবরের উপর একটি আমগাছ ছায়া বিস্তার করে আছে। একবার আমের মৌসুমে গোরস্থানে গেলাম। দেখলাম, দাদার কবরের উপর একটি পাকা আম পড়ে আছে। যার সঙ্গে গিয়েছিলাম তিনি আমটি এনে (কৌতুক করে) বললেন, নাও তোমার দাদা তোমাকে দিয়েছেন। তাতে আমি এত খুশি হয়েছিলাম, যার অনুভূতি এখনো আমাকে নাড়া দেয়।

দাদার জীবদ্দশায় আমার পড়াশোনা শুরু হয়নি। আব্বাই আমার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন।

আরেকটি কথা এখানে বলে নেওয়া ভালো, আমার দাদা ছিলেন একজন নিরক্ষর গ্রাম্য মানুষ। কৃষিকাজ আর ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমেই অনেক সম্পদ করেছিলেন। চাকুরি এবং অন্যান্য পেশার সঙ্গে আমাদের খান্দান পরিচিত ছিল না।

আমার আব্বা পড়াশোনায় কিছুটা উন্নতি করেছিলেন। মক্তবে ফারসী শিখেছেন। ব্যবসার প্রয়োজনে হিন্দি শিখিছেন। পুরোনো হিন্দুয়ানা হিসাবও শিখেছেন এবং এ বিষয়ে তিনি অনেক দক্ষ ছিলেন। মানুষ কাগজ, কলম, দোয়াত, পেনসিল নিয়ে হিসাব করত, তিনি সবকিছু হিসাব করতেন মুখে। কিন্তু এটাই স্বাভাবিক যে, এই সাদাসিধা গ্রাম্য শিক্ষায় কোনো সরকারি চাকুরি মিলত না। এজন্য তিনিও পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া কৃষি ও ব্যবসাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মোটকথা, এই সংক্ষিপ্ত পড়াশোনার পরও আমাদের খান্দান চাকুরি থেকে দূরেই থেকে গেল।

আমার এক চাচাত চাচা আমার আব্বার চেয়েও বেশি পড়াশোনা করেছিলেন। সম্ভবত তিনি পড়েছিলেন শরহে জামী পর্যন্ত। এরপর হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও তরজমা পড়ে পড়ে যোগ্যতাকে আরো বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। একসময় ছোট ছোট কিছু রিসালাও লিখেছেন। সেগুলোর হস্তলিপি এখনো সংরক্ষিত আছে। এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের খান্দান ইলমের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। এই পরিচিতি হয়েছে আরবী ও ফারসী ভাষার মাধ্যমে। কারণ, সেসময় এই দুই ভাষারই চর্চা ছিল বেশি।

আব্বা দুই তিন মাইল দূরের মক্তবে গিয়ে পড়াশোনা করলেও আমার জন্য একেবারে ঘরের পাশেই একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে ফারসী জানেন এমন একজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। সেই মক্তবের উসিলায় আমাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের অনেকেই পড়াশোনা শিখতে পেরেছে। আমার আনন্দের বিষয় হল, আমার অসিলায় সেসময় প্রাথমিক শিক্ষার কিছুটা প্রচার প্রসার হয়েছে।

প্রাথমিক ফারসী কিতাবাদি আমি এমন একজন শিক্ষকের কাছে পড়েছি, যাঁকে সেই যামানার পরিভাষায় ‘মিয়াঁ ছাহেব’ বলা হত। সেসময় আমি ‘নেসাবে তালীম’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। বরং সমকালীন নিয়ম অনুযায়ী আমদনামা, সফওয়াতুল মাসাদির, কারীমা, মা মুকীমাঁ, আল্লাহ খোদায়ী, বুস্তাঁ, গুলিস্তাঁ, আখলাকে মুহসিনী ইত্যাদি কিতাবগুলো মিয়াঁ সাহেবের কাছে পড়েছি।

আমি যখন তেরো চৌদ্দ বছরের বালক তখন সেকালের প্রথামত আমার বিয়ে হয়ে গেল। সৌভাগ্যক্রমে আমার শ্বশুর বড় আলেম ছিলেন। মাওলানা আবদুল হাই ফিরিঙ্গি মহল্লী রাহ.-এর কাছে তিনি দরসী সব কিতাব পড়েছেন। এরপর বিভিন্ন জায়গায় দরস তাদরীসের খেদমতও আঞ্জাম দিয়েছেন। সেসময় তিনি অবসর যাপন করছিলেন বলে নিজ বাড়িতেই একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে আল্লাহ্র ওয়াস্তে নিজের খান্দান ও গ্রামের বাচ্চাদের পড়ানোর খেদমত করছিলেন। এই সুযোগে আমি দুই বছর শ্বশুরালয়ে থেকেই ‘আনওয়ারে সুহাইলী’, ‘সেকান্দারনামা’, ‘বাহারে দানেশ’, ‘মীনাবাযার’, ‘শবনম শাদাব’, ‘দেওয়ানে গনী’ এবং ‘দেওয়ানে হেলালী’ ইত্যাদি ফারসীর শেষ কিতাবগুলো পড়েছি। এরপর শুরু হয়েছে আরবী পড়া। যদিও আমার সুযোগ ছিল শ্বশুরালয়ে থেকে শ্বশুরের কাছেই আরবী পড়ার, তবে অন্যত্র গিয়ে পড়াশোনার বেশ কিছু উপলক্ষও তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

আমার ভগ্নিপতি মৌলভী মাহবুবুর রহমান কালীম কানপুর মিশন কলেজে এফএ ক্লাশে পড়তেন। সেসময় কানপুরই ছিল আরবী পড়াশোনার মূল কেন্দ্র। মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব ও মাওলানা আহমাদ হাসান ছাহেবের ওসিলায় ‘জামিউল উলূম’ ও ‘ফয়যে আম মাদরাসা’র খ্যাতিও ছিল। কিন্তু আমি কিংবা আমার আব্বাজান তো কানপুরের এই ইলমী কেন্দ্রিকতার খবর জানতাম না। সেজন্য মৌলভী মাহবুবুর রহমান কালীমের সঙ্গে থাকা যাবে বলে আব্বা আমাকে তার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। তবে আমি কানপুরের কোনো মাদরাসায় পড়াশোনা করিনি। আমাদের এলাকার মৌলভী বখশিশ আহমাদ ছাহেব, যিনি সেসময় মাদরাসায়ে ইসলাহুল মুসলিমীন সরাইমীর-এ শিক্ষকতা করতেন। কানপুর মিশন স্কুলেও তিনি শিক্ষকতা করেছেন। তিনি মৌলভী মাহবুবুর রহমান ছাহেবের সঙ্গে থাকতেন। আমি তাঁর কাছে এবং ফয়যে আম ও জামিউল উলূম মাদরাসার ফারেগ কয়েকজন তালিবুল ইলমের কাছে মীযান, মুনশাইব, যুবদাহ, সরফেমীর, নাহবেমীর, হিদায়াতুন্নাহু, কালা আকূলু, সুগরা, কুবরা, মীযানে মানতেক, শরহে তাহযীব ইত্যাদি কিতাবাদি পড়েছি। তবে যে কিতাবই পড়েছি পুরো পড়েছি। কোনো কোনো কিতাব আগাগোড়া মুখস্থও করেছি।

মৌলভী মাহবুবুর রহমান ছাহেব যখন এফএ পাশ করার পর আগ্রা সেন্ট জন’স কলেজে ভর্তি হয়ে গেলেন তখন আমিও গেলাম তার সঙ্গে। তখন আগ্রা জামে মসজিদে কোনো রকম একটি মাদরাসা ছিল। সেখানে শিক্ষক ছিলেন মৌলভী মুহাম্মাদ রামাযান। আমি তাঁর কাছে কাফিয়া, শরহে জামী, কুদুরী ইত্যাদি কিতাব পড়ি। এরপর মৌলভী মাহবুবুর রহমান ছাহেব এফএ পাশ করে আলীগড় চলে গেলেন। আমি চলে গেলাম গাযীপুর। সেখানে ছিল মাদরাসায়ে চশমায়ে রহমত। ঐ মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন আমাদের প্রিয় ভাই মুহতারাম মৌলভী শিবলী ছাহেব। আমি তাঁর কাছে কুতবী, মীর কুতবী, শরহে বেকায়া, মাইবুযী, নুরুল আনওয়ার, হাদিয়ায়ে সাদিয়্যাহ, মোল্লা হাসান ইত্যাদি কিতাবাদি পড়েছি। প্রতিটি কিতাব আগাগোড়া পড়েছি। আমি আমার শিক্ষদের মধ্যে সবচে’ সেরা পেয়েছি তাঁকে। কিন্তু তখনো আমি কোনো মাদরাসায় ভর্তি হয়নি। তাঁর বাড়িতেই তাঁর কাছে পড়তাম। এছাড়াও চশমায়ে রহমত মাদরাসায় আমাদের জেলার আরেকজন আলেম মৌলভী লা’ল মুহাম্মাদ ছাহেব ছিলেন প্রধান শিক্ষক। আমি তাঁর দরসে অনিয়মিতভাবে শরিক হতাম। এভাবেই ‘মীর যাহেদ’ ও অন্যান্য কিতাবের বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু অংশ শুনেছি। এইসব ঘটনা থেকে বুঝা যায়, আমার পড়াশোনা মূলত মাদরাসার চার দেয়ালের বাইরেই হয়েছে। অনেকটা পুরনো যুগের তরিকায়। সেজন্য এখনো আমার কাছে ঘরে পড়াই উত্তম মনে হয়। কিতাবের নির্বাচিত অংশের পাঠদান আমার কাছে শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য প্রাণসংহারক বিষ মনে হয়। প্রতিটি কিতাবই পুরো পড়া উচিত।

কানপুর, আগ্রা ও গাযীপুরে নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা ছাড়া সাহিত্যের কিছু পড়াশোনাও আমার অব্যাহত ছিল। প্রিয়ভাজন মৌলভী মাহবুবুর রহমান কালীম ছিলেন কবি। তার সংশ্রবে আমিও কিছু কাব্যচর্চা শুরু করেছিলাম। এমনকি তার ছদ্মনামের সূত্র ধরেই আমি আমার জন্য ‘শামীম’ ছদ্মনাম বেছে নিই। সেসময় ‘পয়ামে ইয়ার’, ‘পয়ামে আশেক’, ‘দামনে গুলচীঁ’ ইত্যাদি কবিতার কাগজ বের হত। সেগুলোতে অনেক কবিদের নির্বাচিত কবিতা ও গযল প্রকাশিত হত। কাগজগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। সেখানে অনেক কবিতা-গযল পাঠাতাম। পাঠানোর আগে মৌলভী মাহবুবুর রহমান ছাহেব থেকে সংশোধন করিয়ে নিতাম। এরপর যখন গাযীপুর এলাম তখন মাদরাসায়ে চশমায়ে রহমতের পরিচালক এবং গাযীপুরের সবচেয়ে বড় কবি মৌলভী আবদুল আহাদ শমশাদ সাহেবের কাছ থেকে সংশোধন করে নিতাম।

মৌলভী আবদুল আহাদ শমশাদ সাহেবের একটি কুতুবখানা ছিল। সেখানে তিনি ফারসি ও উর্দূ প্রচুর কিতাব সংগ্রহ করেছিলেন। সেখানে তালিবুল ইলম ও আসাতিযায়ে কেরামকে খুবই উদারতার সঙ্গে কিতাবাদি দেখতে দিতেন। আমি তাঁর সেই কুতুবখানা থেকে উর্দূ-ফারসি বিভিন্ন কিতাব ও দিওয়ান নিয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে মুতালাআ করতাম। সেসময় পর্যন্ত আমার জানা ছিল না আমার মুহসিন কিতাব কোনগুলো। একথাও ভাবনায় ছিল না, কোনো একসময় আমাকে এই বিষয়ে লিখতে বলা হবে। এখন মনে হচ্ছে আমার মুহসিন কিতাবের মধ্যে রয়েছে, ‘সেকান্দারনামা’, ‘দেওয়ানে গনী’, ‘দেওয়ানে হেলালী’ ও ‘আখলাকে মুহসিনী’ ইত্যাদি। ফারসি দেওয়ান বোঝার ক্ষেত্রে এগুলো থেকে অনেক সহায়তা লাভ করেছি। এছাড়া কবিতার সৌন্দর্য, উপমা, ইঙ্গিত, সুকুমারবৃত্তি ও সৃজনশীলতা বোঝা এবং মুগ্ধতা লাভের বেলায় কিতাবগুলো আমাকে নীরবে উপকার বিলিয়ে গেছে। সেসময় পর্যন্ত আমার গদ্য মুতালাআ হয়েছে খুবই সামান্য।

মৌলভী মাহবুবুর রহমান কালীম প্রবন্ধ নিবন্ধও লিখতেন। তার সান্নিধ্যে স্যার সায়্যিদ, মাওলানা হালী, মৌলভী আবদুল হালীম শরার প্রমুখের নাম অনেক শুনতাম।

মাওলানা শিবলী মরহুম তো আমাদেরই এলাকার। তাঁর সম্পর্কে আগে থেকেই জানতাম। তাঁকে দেখার খুব আগ্রহ ছিল। সৌভাগ্যক্রমে কানপুরে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে তাঁর সংক্ষিপ্ত একটি বয়ানও শোনার সুযোগ হয়। তখনো আমি এই ‘আদীবে হিন্দ’-এর কোনো কিতাব মুতালাআ করিনি। এরপর আগ্রা থাকাকালে তাঁর ‘আলফারূক’ প্রকাশিত হল। তখন ‘আগ্রা’ পত্রিকার সম্পাদক এই কিতাবের রিভিউ লেখার জন্য মৌলভী মাহবুবুর রহমান ছাহেবকে দিলেন। তিনি কিতাবটি ঘরে নিয়ে এলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। সেদিনই সর্বপ্রথম আধুনিক রচনাবলীর মধ্যে হিন্দুস্তানের সবচেয়ে বড় ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিকের সেরা একটি রচনা আমার দৃষ্টিগোচর হল। সেসময় ‘রাসায়েলে শিবলী’ সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। সেটিও খুব আগ্রহের সাথে পড়লাম।

এরপর আশ্চর্য রকমের এক দুর্ভাগ্যের কারণে কিছু আরবী কিতাব মুতালাআর সুযোগ হল। হিন্দুস্তানে ভয়ংকর এক মহামারি দেখা দিল এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। মহামারির ভয়ে আমি পড়াশোনা ছেড়ে ঘরে বসে রইলাম। তবে এই অবসর আমার জন্য উপকারী হল। ঘনিষ্ঠজনের মধ্যে কয়েকজন আলেম ছিলেন। তাদের সংগ্রহে বেশ কিছু কিতাব ছিল। তার মধ্যে দরসী কিতাবই বেশি। সেই ছোট্ট কুতুবখানা থেকে আমি মানতেক ফালসাফার কয়েকটি কিতাব চেয়ে আনলাম। তারমধ্যে ছিল, ‘শরহে মাতালে‘’, ‘মোল্লা জালাল’, ‘হামদুল্লাহ’, ‘মীর যাহেদ’, ‘উমুরে আম্মাহ’ ইত্যাদি। এগুলো মুতালাআ করতে শুরু করলাম। অনেকগুলোর মধ্যেই ছিল মাওলানা আবদুল হাই ফিরিঙ্গী মহল্লীর হাশিয়া। তিনি তাঁর অগাধ ইলম ও অসাধারণ উপস্থাপনাশৈলীতে বড় চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন মূল কিতাবের পাঠ। হাশিয়াগুলোর সহায়তায় খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম কিতাবগুলো। সেই সময় ‘তাফসীরে কাবীর’ও পুরোটা মুতালাআ করেছি। ইমাম রাযী রাহ. যেহেতু জটিল বিষয়কেও খুব সহজভাবে তুলে ধরেন তাই সেগুলোও খুব সহজেই বুঝতে পারছিলাম। এই কিতাবগুলোর মুতালাআ আমার মধ্যে এই প্রভাব ফেলল যে, চিন্তা ও গবেষণাজাত বিষয়ের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হল। তখন কেবল সেইসব কিতাবই পছন্দ হতে লাগল যেগুলো গবেষণাধর্মী। অর্থাৎ যেখানে দাবি, দলীল, কারণ ইত্যাদি আলোচনা হয়। আমার সেই রুচি এখনো বাকি আছে। ইতিহাস, সাহিত্য ও দ্বীনী- সব কিতাবেই আমি এইসব বিষয় খুঁজতে থাকি।

দুই বছর পর যখন মহামারির ভয় কিছুটা কমে আসে তখন ঐ সময়গুলোর জন্য খুব আফসোস হল। তখন নদওয়াতে আমাদের এলাকার বেশ কয়েকজন ছিলেন। বিশেষত ঊর্ধ্বতন পদে। যেমন, মাওলানা হাফীযুল্লাহ ছাহেব ছিলেন মুহতামিম। মাওলানা শিবলী নোমানী রাহ. শিক্ষাসচিব। দুজনই আমাদের এলাকার। এজন্য নদওয়ার প্রতি আগ্রহ হল। তাই মাওলানা হাফীযুল্লাহ ছাহেবের কাছে চিঠি লিখলাম। তিনি মেহেরবানী করে আমাকে ডেকে নিলেন। সেখানে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। যদিও মাওলানা শিবলী নোমানী রাহ. আসার পর নদওয়ার নেসাবে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল তবুও পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যে কিতাবগুলো দরসে ছিল সেগুলো আমার সাহিত্য ও চিন্তাজাত রুচির অনুকূলই ছিল। ‘শরহে হেকমাতুল আইন’, ‘শরহে হেকমাতুল ইশরাক’, ‘তাওযীহে তালভীহ’, ‘হেদায়া’, হামাসাহ’, ‘সাবয়ে মুআল্লাকাত’, ‘মুতানাব্বী’, ‘নকদুশ শের’, ‘দালায়েলুল ইজায’ ইত্যাদি কিতাবগুলো আমার খুবই পছন্দ হল। সেজন্য এগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। কখনো কখনো মাওলানা হাফীযুল্লাহ ছাহেবের মধ্যে কাদীম তালীমী নেসাবের জোশ সৃষ্টি হলে ‘হামদুল্লাহ’, ‘কাযী মোবারক’ ও ‘সদরা’ ইত্যাদি কিতাবের সবকও শুরু হয়ে যেত। এই কিতাবগুলোর মাধ্যমে আমার চিন্তা ও সাহিত্য রুচির আরো উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়। এছাড়াও কুতুবখানা থেকে ‘শরহে মাকাসেদ’, ‘শরহে মাওয়াকেফ’ ও ‘শরহে তাজরীদ’ ইত্যাদি ধার নিয়ে মুতালাআ করতে শুরু করলাম। উর্দূ কিতাবাদির মধ্যে সেসময় মাওলানা শিবলী নোমানীর ‘ইলমুল কালাম’ ও ‘আলকালাম’ প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু দুটি কিতাবই গবেষণাধর্মী এজন্য আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে কিতাবদুটি মুতালাআ করি।

লেখার ধাঁচ ও শৈলীর ক্ষেত্রে আমাকে মাওলানা শিবলী নোমানীর মুকাল্লিদ মনে করা হয়। এই মনে করা ঠিক না ভুল জানি না। তবে এটা হয়ত প্রথম জীবনে তাঁর রচনাবলী মুতালাআর কারণেই। এটা তাঁর কিতাবাদিরই ইহসান। যাইহোক, আমি তাঁর রচনাবলীকে আমার মুহসিন ও রাহবার মনে করি। মাওলানা শিবলী নোমানী রাহ. ছাড়া অন্য মুসান্নিফদের লেখা আমার খুব পছন্দ হত না। মাওলানা নযীর আহমাদ ও মাওলানা আবদুল হালীম শরারের লেখা তো আমার একেবারেই পছন্দ হয় না। স্যার সায়্যিদের লেখার ধাঁচও আমার কাছে খুব উঁচু মানের মনে হয় না। তবে উর্দূ রচনাশৈলীর উপর তাঁর এই ইহসান রয়েছে যে, তিনি পুরনো ছাঁচ ও মৌলভীয়ানা ধাঁচ ছেড়ে সাদামাটা সাবলীল ধাঁচের প্রচলন করেছেন। কিন্তু আমি তার রচনাশৈলীতে রঙ ও লাবণ্য খুঁজে পাই না। বিষয়বস্তুও একটু বেশি তর্কঘেঁষা মনে হয়। কোথাও কোথাও অতিরঞ্জন ও অনর্থ ধরা পড়ে। মোটকথা, তাঁর রচনার ভালো কোনো প্রভাব আমার মধ্যে পড়েনি। মাওলানা হালীর লেখায়ও সেই সৌন্দর্য, রঙ, লাবণ্য এবং উৎকর্ষ নেই। তবে তিনি ‘সমালোচনা শাস্ত্র-এ’ অনেক বড় ব্যক্তি। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে ‘মুকাদ্দামায়ে শের ও শায়েরী’, ‘হায়াতে সাদী’ এবং ‘ইয়াদগারে গালিব’ -এর এই দিকগুলোর ইহসান আমার উপর অনেক। এমনকি সমালোচনা শাস্ত্রে তাঁর কিতাবগুলোকে আমার মুহসিন ও রাহনুমা মনে করি।

আমি উপন্যাস পড়েছি খুব কম। তবে হারদুঈর হাকীম মুহাম্মাদ আলীর লেখা কয়েকটি উপন্যাস পড়েছি। তার বর্ণনা- সৌন্দর্য আমার মধ্যে খুব প্রভাব ফেলেছে। মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন আযাদের রচনাশৈলীকে যদিও আমি পছন্দ করি তবে তাঁর রচনাবলীকে খুব উঁচু মাপের, মজবুত এবং শক্তিশালী মনে করি না। মাওলানা আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদীর রচনাবলীর মধ্যে ‘ফালসাফায়ে ইজতিমা’, ‘ফালসাফায়ে জযবাত’, ‘তারীখে আখলাকে ইউরোপ’ কিতাবগুলো বিষয় ও উপস্থাপনার দিক থেকে আমার খুব পছন্দ। তথ্য ও গদ্য উভয় বিচারেই কিতাবগুলো যেন মাওলানা শিবলী নোমানীর রচনাবলীর পূর্ণ নমুনা। সেজন্য বলা যায়, আমি এবং তিনি মূলত একই চেরাগের পতঙ্গ।

আধ্যাত্ম ও সাহিত্য এই দুই দিক থেকে সহীহ বুখারী দ্বারা আমি অনেক বেশি প্রভাবিত। কিন্তু এই দিকগুলোর ক্ষেত্রে ফিকহী কিতাবাদিকে আমি প্রভাবক হিসাবে পাইনি ।১

অনুবাদ : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 

 

advertisement