শাবান-রমযান ১৪৩৯   ||   মে-জুন ২০১৮

মুমিন বেপরোয়া হতে পারে না

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বাণীটি দিয়েই শুরু করি। তিনি বলেছিলেন-

أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الْإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَالْأَمْنُ مِنْ مَكْرِ اللهِ، وَالْقُنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللهِ، وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ.

সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে শিরক করা, আল্লাহ্র পাকড়াও থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া আর আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হয়ে পড়া। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৯৭০১; শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস ১০১৯; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৮৭৮৪

হাদীসের ভাষ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই- আল্লাহ তাালার সঙ্গে শিরক করা যেমন অনেক বড় একটি গোনাহ, আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হয়ে পড়াও যেমন একটি বড় গোনাহ, তেমনি আল্লাহ তাআলার শাস্তি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকা, তাঁর পাকড়াওয়ের বিষয়ে বেপরোয়া হয়ে যাওয়াও একটি বড় গোনাহ। ‘রাহীম, রাহমান, গাফফার’ যেমন আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম, তেমনি ‘কাহ্হার’ও তাঁর গুণবাচক নাম। সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহ যেমন সীমাহীন, দান ও করুণা যেমন অফুরান, তেমনি তাঁর শাস্তির কঠোরতাও বর্ণনাতীত। আখেরাতে যাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন, তাকে নিজ শানমোতাবেকই পুরস্কৃত করবেন। আবার যাকে শাস্তি দেবেন, সেই শাস্তিও হবে তাঁর কুদরত ও ক্ষমতানুসারে। মুমিন বান্দার পুরস্কার নিয়ে যত বর্ণনা কুরআন ও হাদীসের পাতায় পাওয়া যায় সবকিছুর সারকথা তো এই একটি হাদীসেই আমরা পেয়ে যাই-আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ.

আমি আমার নেক বান্দাদের জন্যে এমন কিছু প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোনো চোখ কখনো দেখেনি, কোনো কান যার কথা কখনো শোনেনি, এমনকি কোনো হৃদয় যা কখনো কল্পনাও করে নি!

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করে শোনান-

فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّاۤ اُخْفِیَ لَهُمْ مِّنْ قُرَّةِ اَعْیُنٍ.

তাদের জন্যে চোখ-জোড়ানো কত কিছু যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে তা কেউ জানে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৪৪

মুমিন বান্দাদের পুরস্কারের ক্ষেত্রে যেমন তিনি তাঁর কুদরতের প্রকাশ ঘটাবেন, অকল্পনীয় সব পুরস্কারে তাদের ভূষিত করবেন, একইভাবে তাঁর কুদরত প্রকাশিত হবে কাফেরদের শাস্তির ক্ষেত্রেও। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে জাহান্নামের অনেক রকম শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। কোথাও জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা ও ভয়াবহতার কথা, কোথাও জাহান্নামিদের কষ্টদায়ক খাদ্য ও পানীয়ের কথা, কোথাও শাস্তি বেশি ভোগ করার জন্যে তাদের বিশালাকৃতির শরীরের কথা। সবকিছু মিলিয়ে সেখানেও একই কথা-জাহান্নামের শাস্তির আসল রূপও আমাদের চিন্তা ও কল্পনার বাইরে।

এ তো মৃত্যু-পরবর্তী জগতের কথা। সেখানকার যাবতীয় ক্ষমতা কেবলই আল্লাহ্র। দুনিয়াতে আল্লাহ কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট কোনো এলাকার রাজা বানিয়ে দেন। সামান্য ক্ষমতা তিনি দিয়ে থাকেন। কিন্তু সে জগতে সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ক্ষমতা একমাত্র তাঁর হাতেই থাকবে। সকল রাজত্ব সেদিন তাঁরই।

আর এই দুনিয়ার জগতে তিনি যে কিছু মানুষকে সামান্য কিছু ক্ষমতা দিয়ে থাকেন, এখানকার আসল ক্ষমতাও তাঁরই হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দিয়ে থাকেন, যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন। জগতের যাবতীয় কিছুর চাবি তো তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা-

قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِی الْمُلْكَ مَنْ تَشَآءُ وَ تَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَآءُ  ، وَ تُعِزُّ مَنْ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنْ تَشَآءُ  ،  بِیَدِكَ الْخَیْرُ ،    اِنَّكَ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْرٌ، تُوْلِجُ الَّیْلَ فِی النَّهَارِ وَ تُوْلِجُ النَّهَارَ فِی الَّیْلِ،  وَ تُخْرِجُ الْحَیَّ مِنَ الْمَیِّتِ وَ تُخْرِجُ الْمَیِّتَ مِنَ الْحَیِّ،  وَ تَرْزُقُ مَنْ تَشَآءُ بِغَیْرِ حِسَابٍ.

বলো, হে আল্লাহ! সকল রাজ্যের মালিক! আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন, যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন, আপনার হাতেই তো কল্যাণ, নিশ্চয় আপনি সর্বশক্তিমান। আপনি রাতকে দিনে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতে প্রবেশ করান, আপনি প্রাণবান থেকে প্রাণহীনকে বের করে আনেন এবং প্রাণহীন থেকে প্রাণবানকে বের করে আনেন, আর যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিজিক দান করেন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ২৬-২৭

এগুলো তো আমাদের চোখে দেখা বাস্তবতা। এমন আরও অনেক কিছুর কথাই বর্ণিত হয়েছে পাক কুরআনে, যেগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরতের বিষয়টি দেখিয়ে দেয়। এখানে স্বাভাবিকভাবে যা ঘটে সেগুলোও আল্লাহ তাআলারই কুদরত, তিনিই দুনিয়ার এসব আসবাব-উপকরণের ভেতর এসব যোগ্যতা ও শক্তি নিহিত রেখেছেন। আবার অস্বাভাবিক যা কিছু ঘটে, সেগুলোও তাঁরই ইঙ্গিতে সংঘটিত হয়। এমন অসীম কুদরতের অধিকারী যিনি, তিনি যদি কাউকে শাস্তি দিতে চান, কাউকে তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করতে চান, ধ্বংস করে দিতে চান, তাহলে কি আর বেশি কিছু লাগে? পবিত্র কুরআনই আমাদেরকে জানায় খোদায়ী শক্তির দাবিদার ফেরাউনকে পানিতে ডুবিয়ে মারার কাহিনী। প্রসঙ্গক্রমে কুরআনে আলোচিত হয়েছে এ উম্মতের ‘ফেরাউন’ আবু জেহেলের নেতৃত্বাধীন কুরাইশ কাফেরদের পরাজয় এবং তাকেসহ সত্তরজন কাফেরের নিহত হওয়ার ঘটনাও। কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি, কাড়ি কাড়ি অর্থের মালিক কারুনের করুণ পরিণতির কথাও। জগতের সব ফেরাউন আর কারুণকে যিনি চোখের পলকে ধ্বংস করে দিতে পারেন, তাদের বড়াই-অহংকারের প্রাসাদকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারেন নিমিষে, কোনো মুমিন কি সেই মহান সত্তার শাস্তির বিষয়ে বেপরোয়া হতে পারে? না, পারে না। মুমিন যেমন আল্লাহ্র রহমতের আশায় বুক বেঁধে রাখে, তেমনি আল্লাহ্র শাস্তির ভয়েও সে সদা প্রকম্পিত থাকে। আল্লাহ পাকের সীমাহীন কুদরত দুনিয়াতে প্রত্যক্ষ করার পরও যারা তাঁর শাস্তির বিষয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়ে, অবিরাম পাপ যারা করতেই থাকে, তারা যে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে-এ নিয়ে আর কোনো দ্বিমত থাকতে পারে! তাদের এ ক্ষতিগ্রস্ততার কথাও স্বয়ং মহান প্রভু আল্লাহ্রই। লক্ষ করুন-

وَ لَوْ اَنَّ اَهْلَ الْقُرٰۤی اٰمَنُوْا وَ اتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَیْهِمْ بَرَكٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الْاَرْضِ وَ لٰكِنْ كَذَّبُوْا فَاَخَذْنٰهُمْ بِمَا كَانُوْا یَكْسِبُوْنَ، اَفَاَمِنَ اَهْلُ الْقُرٰۤی اَنْ یَّاْتِیَهُمْ بَاْسُنَا بَیَاتًا وَّ هُمْ نَآىِٕمُوْنَ، اَوَ اَمِنَ اَهْلُ الْقُرٰۤی اَنْ یَّاْتِیَهُمْ بَاْسُنَا ضُحًی وَّ هُمْ یَلْعَبُوْنَ، اَفَاَمِنُوْا مَكْرَ اللهِ،  فَلَا یَاْمَنُ مَكْرَ اللهِ اِلَّا الْقَوْمُ الْخٰسِرُوْنَ.

সেসব জনপদবাসী যদি ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই তাদের জন্যে আকাশ ও জমিনের সমূহ বরকত উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা অস্বীকার করেছে, তাই তাদের কৃতকর্মের কারণে আমি তাদের পাকড়াও করেছি। জনপদবাসী কি তাদের কাছে রাতের বেলা তারা ঘুমে থাকা অবস্থায় আমার আজাব আসা থেকে নির্ভয় হয়ে গেছে? আর জনপদবাসী কি তাদের কাছে প্রভাতে তারা খেলাধুলায় থাকা অবস্থায় আমার আজাব আসা থেকে নির্ভয় হয়ে গেছে? তারা কি আল্লাহ্র কৌশল থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে? আল্লাহ্র কৌশল থেকে তো ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া আর কেউ নিশ্চিন্ত হয় না। -সূরা আ‘রাফ (৭) : ৯৬-৯৯

আল্লাহ যদি কারও ওপর অসন্তুষ্ট হন, তাহলে তিনি ছোট কিংবা বড় কোনো শাস্তি দেয়ার জন্যে কোনো বড়সড় আয়োজনের প্রয়োজন হয় না। এ জগতের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে যারা অবাধ্যতার সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল, তাদেরকে বিভিন্নভাবে তিনি পাকড়াও করেছিলেন। এর কিছু কাহিনী পবিত্র কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে। হযরত নূহ আলাইহিস সালামের জাতিকে তিনি প্লাবন দিয়ে ডুবিয়ে মেরেছেন। আদ জাতিকে ধ্বংস করেছেন হিম-শীতল বাতাস দিয়ে। ছামুদ জাতি আর মাদয়ানবাসীকে ধ্বংস করেছেন বিকট আওয়াজের মাধ্যমে। আর লূত আলাইহিস সালামের জাতিকে তো মাটিসুদ্ধ উল্টিয়ে দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। মূসা আলাইহিস সালামকে ধাওয়া করতে গিয়ে যখন ফেরাউন পানিতে ডুবে মারা যায়, তখন তার সঙ্গে বিশাল সৈন্যবাহিনীও ছিল। এদের সবাইকেই আল্লাহ এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, যেন এ পৃথিবীতে তাদের কোনো অস্তিত্বই কখনো ছিল না। অথচ তারা ছিল অনেক অর্থবিত্তের মালিক, অনেক শক্তি ও প্রভাবপ্রতিপত্তির মালিক, প্রচুর শারীরিক শক্তিরও মালিক। এরপরও তারা এ জগৎ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা বলছেন-

اَلَمْ یَرَوْا كَمْ اَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِمْ مِّنْ قَرْنٍ مَّكَّنّٰهُمْ فِی الْاَرْضِ مَا لَمْ نُمَكِّنْ لَّكُمْ وَ اَرْسَلْنَا السَّمَآءَ عَلَیْهِمْ مِّدْرَارًا، وَّ جَعَلْنَا الْاَنْهٰرَ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهِمْ فَاَهْلَكْنٰهُمْ بِذُنُوْبِهِمْ وَ اَنْشَاْنَا مِنْۢ بَعْدِهِمْ قَرْنًا اٰخَرِیْنَ.

তারা কি দেখেনি, তাদের পূর্বে আমি এমন কত জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম, যেমনটি তোমাদেরকে করিনি; আর তাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম এবং নহরসমূহ সৃষ্টি করেছিলাম, যা তাদের নীচ দিয়ে বয়ে যায়। এরপর তাদের পাপের কারণে আমি তাদের ধ্বংস করেছি এবং তাদের পরে অন্য জাতি সৃষ্টি করেছি। -সূরা আনআম (৬) : ৬

নির্ভয় ও বেপরোয়া হওয়ার এই হল পরিণাম। আল্লাহ্র দেয়া নিআমত নিয়ে যেখানে কৃতজ্ঞতায় সেজদাবনত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে যারা অহংকারে আকাশে উড়তে চায় কিংবা মাটি ফাটিয়ে দিতে চায় তাদের পরিণাম যুগে যুগে এমনই হয়েছে। আল্লাহ্র শাস্তি সম্পর্কে বেপরোয়া হওয়ার মূলেই রয়েছে এই অহংকার। কেউ যখন ভাবতে শুরু করে- আমার এত এত ক্ষমতা, কাড়ি কাড়ি এই অর্থসম্পদ, আমাকে ধরবে কে? তখনই সে অপরাধের পথে এগিয়ে যায় এবং একসময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এটা শুধু আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কৃত অপরাধের কথা নয়; বরং দুনিয়ার জগতের বাস্তবতাও এমনই। অপরাধ করলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে- এ কথা তো সবাই জানে। কিন্তু মানুষ যখন ক্ষমতা লাভ করে, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে, তখন সে ভাবতে থাকে- আমার অন্যায়ের হিসাব নেয়ার সাধ্য কার? অথচ দুদিনের ব্যবধানে যখন ক্ষমতার পালাবদল হয় তখন সেই হিসাব ঠিকই বেরিয়ে আসে। দাপুটে শাসক হয়ে পড়েন চার দেয়ালের বন্দী। কথা হল, কেন এমন হয়? আইনের কথা জেনেও কেন মানুষ অপরাধে জড়ায়? উত্তর একটাই- বেপরোয়া ও নির্ভয় মানসিকতা। এ মানসিকতা যেমন মানুষের দুনিয়ার জীবন ধ্বংস করে, একইভাবে বরবাদ করে তার দ্বীন ও পরকালকেও।

যারা বেপরোয়া হয়ে যায়, আল্লাহ তাদেরকে অনেক সময় একটু ছাড় দেন। দুনিয়ার ধনসম্পদের প্রাচুর্যে তাকে ভরিয়ে দেন। অর্থসম্পদ সম্মান মর্যাদা দিয়ে থাকেন। জানা কথা, পার্থিব ধনসম্পদ আর প্রভাব-প্রতিপত্তি আল্লাহ তাআলার বিচারে ভালোমন্দ কিংবা গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি নয়। এগুলোর কোনো মূল্য তাঁর কাছে নেই। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَوْ كَانَتِ الدّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ اللهِ جَنَاحَ بَعُوضَةٍ مَا سَقَى كَافِرًا مِنْهَا شَرْبَةَ مَاءٍ.

আল্লাহ্র নিকট দুনিয়ার যদি একটি মাছির ডানার সমান মূল্যও থাকত, তাহলেও তিনি কোনো কাফেরকে এক ঢোক পানি খাওয়াতেন না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩২০

তিনি কাউকে এ সম্মান-সম্পদ দিয়ে থাকেন নিআমতস্বরূপ, কাউকে দেন অবাধ্যতায় আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার ছাড়স্বরূপ। এরপর একসময় তাকে আকস্মিকভাবে ধ্বংস করে দেন।  পবিত্র কুরআনের বর্ণনা-

فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُكِّرُوْا بِهٖ فَتَحْنَا عَلَیْهِمْ اَبْوَابَ كُلِّ شَیْءٍ،  حَتّٰۤی اِذَا فَرِحُوْا بِمَاۤ اُوْتُوْۤا اَخَذْنٰهُمْ بَغْتَةً فَاِذَا هُمْ مُّبْلِسُوْنَ، فَقُطِعَ دَابِرُ الْقَوْمِ الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا ، وَ الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.

আর তাদেরকে যা দিয়ে উপদেশ দেয়া হয় তারা যখন তা ভুলে গেল, আমি তখন তাদের জন্যে সবকিছুর দুয়ার উন্মুক্ত করে দিই। একপর্যায়ে যখন তাদের যা দেয়া হয়েছে তা নিয়ে তারা উল্লসিত হয়ে পড়ে তখন তাদেরকে আকস্মিকভাবে আমি পাকড়াও করি। তখন তারা নিরাশ হয়ে পড়ে। আর জালেম সম্প্রদায়কে সমূলে উচ্ছেদ করা হল। সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহ্র। -সূরা আনআম (৬) : ৪৪-৪৫

আল্লাহ্র শাস্তির বিষয়ে নির্ভয় ও বেপরোয়া না হওয়ার এই যে শিক্ষা, এটা কেবল পাপীষ্ঠদের জন্যেই নয়, বরং যারা দ্বীন-ধর্ম মেনে চলেন, সদা ভয় জাগ্রত রাখতে হবে তাদের মনেও। এক মুহূর্তের একটি পদস্খলন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে জীবনের সকল অর্জন। সারা জীবনের পুণ্যের কাজ হারিয়ে যেতে পারে জীবনের শেষভাগে একটি অপরাধের সামনে। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنّ الرّجُلَ لَيَعْمَلُ الزّمَنَ الطّوِيلَ بِعَمَلِ أَهْلِ الْجَنّةِ ثُمّ يُخْتَمُ لَهُ عَمَلُهُ بِعَمَلِ أَهْلِ النّارِ.

কারও এমন হতে পারে, দীর্ঘজীবন সে নেক কাজ করে গেল, কিন্তু তার জীবন শেষ হল কোনো গোনাহের কাজ দিয়ে, (ফলে সে জাহান্নামে যাবে)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৫১

আল্লাহকে যারা বিশ্বাস করে না, তারা আল্লাহ্র পাকড়াওকে ভয় করবে না- এটাই স্বাভাবিক। যারা পরকালই মানে না, পরকালের শাস্তি তারা মানবে কোত্থেকে? কিন্তু যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আল্লাহ্র শাস্তির কথা মনে রাখতেই হবে। শয়তান কখনো ভুলিয়ে দিতে পারে, ধোঁকা দিয়ে কুপথে নিয়ে যেতে পারে, কুমন্ত্রণা দিয়ে সরল পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু যখনই মনে হবে, তখনই ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ তাআলার রহমতের আশায় বুক বেঁধে কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে হবে, অনুতপ্ত হতে হবে। মুমিন হিসাবে এ বিশ্বাস আমাদেরকে রাখতেই হবে- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একদিকে যেমন ‘আযীযুন’, ‘যুনতিকাম’ বা পরাক্রমশালী, শাস্তিদাতা, আবার তিনিই ‘তাওয়াবুর রাহীম’ বা তওবা কবুলকারী, দয়াময়। আর তাঁর আশ্বাসবাণী তো আছেই-

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوْبِهِمْ ،   وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللهُ،   وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ، اُولٰٓىِٕكَ جَزَآؤُهُمْ مَّغْفِرَةٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَ جَنّٰتٌ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا ،  وَ نِعْمَ اَجْرُ الْعٰمِلِیْنَ.

আর যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের ওপর জুলুম করে বসলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাদের পাপের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া পাপ মোচন করার আর কে আছে? তারা যা করেছে জেনেশুনে তাতে তারা জেদ ধরে থাকে না। তাদেরই প্রতিদান তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং এমন উদ্যানরাজি, যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ বয়ে যায়। তাতে তারা চিরকাল থাকবে। আমলকারীদের প্রতিদান কত উত্তম! -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫-১৩৬

 

 

advertisement