জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩১   ||   জুন ২০১০

রাহবার যদি রাহজান হয়!

ইসহাক ওবায়দী

অনেক দিন পর বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবতপ্রাপ্ত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মাওলানা নূরুল্লাহ সাহেবের সাথে সাক্ষাত হল। ছাত্রজীবনে তিনি হযরত মাওলানা সূফী নূর বখশ রাহ.-এর প্রিয় খাদেম ছিলেন। সূফী নূর বখশ রাহ. হলেন হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর অন্যতম খলীফা এবং ফেনী শর্শদী মাদরাসার বানী ও প্রতিষ্ঠাতা। হযরতের ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য খলীফা ও জামাতা হযরত মাওলানা নযীর আহমদ শহীদ রাহ.-এর সোহবত ও খিদমতের সৌভাগ্যও তিনি অর্জন করেন এবং পরে তাঁর বড় জামাতা হন। এই দুই বুযুর্গ ছাড়াও কলাকোপা মাদরাসার বানী হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ ছাহেব রাহ. এবং ওলামাবাজার মাদরাসার মরহুম মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব রাহ.-এর তাওয়াজ্জুহ ও নেক দোয়াও তার প্রতি ছিল। করাচির হযরত মাওলানা হাকীম আখতার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম তাকে খিলাফত দান করেছেন। তাঁর সাথে অধমের পরিচয় হয়েছিল প্রায় ৩৫ বছর পূর্বে, ঢাকায়। পরে তিনি লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করায় তাঁর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ইদানীং চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর মাঝে মধ্যে দেশে আসা আরম্ভ করেছেন। ক’দিন আগে তার সাথে সাক্ষাত হল। অনেক কথার মাঝে তিনি একটি ঘটনা বললেন যে, প্রায় ১৫/২০ বছর আগের কথা। লন্ডনে আমার মসজিদে নামায পড়ার পর পাকিস্তানের এক আলেমের সাথে পরিচয় হল। এই আলেম সাহেব একজন দক্ষ হাকীম ও ভালো শায়ের। বর্তমানে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর সাথে রাজনীতি করেন। জামাতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে পুরা যুক্তরাজ্যে প্রায় আটটি ইসলামিক সেন্টার রয়েছে। এসবের অডিট ও পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাকে লন্ডন পাঠানো হয়েছে। আমি তাকে চায়ের দাওয়াত দিলাম। হাকীম সাহেব তা গ্রহণ করলেন এবং জামাতের ১২/১৩ জন কর্মকর্তাসহ আমার বাসায় এলেন। আমি একপর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, যুক্তরাজ্যে আপনাদের কাজের পরিধি ও অগ্রগতি কেমন দেখলেন? হাকীম সাহেব ঐ ভরা মজলিসেই একটি আজিব শে’র আবৃত্তি করলেন, যার অর্থ, যাদের রাহবার ও পথপ্রদর্শক ভেবেছিলাম, তারাই তো লুণ্ঠন ও রাহজানীতে লিপ্ত। তাহলে কার উপর ভরসা করতে পারি? শে’রটি তার স্বরচিত নাকি অন্য কারো তা আমার জানা নেই, তবে শে’রটি পড়ার পর দুঃখ করে শুধু বললেন, ‘কিছুই হচ্ছে না। হচ্ছে শুধু নিজ নিজ আখের গোছানোর কাজ।’ এই ঘটনা উল্লেখ করে কারো প্রতি কটাক্ষ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার উদ্দেশ্য আত্মসমালোচনা। উপরে যে অবক্ষয়ের কথা বলা হয়েছে তা কি শুধু বিশেষ কোনো দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? না আমাদের নিজেদের মধ্যেও তা রয়েছে? আমরা কি আমাদের দ্বীনী খেদমতে সততার পরিচয় দিচ্ছি? না দুনিয়ার যশ-খ্যাতিই আমাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে? আমাদের কর্ম ও কর্মধারা কী প্রমাণ করে? আমি কি আমার লেখায় সৎ? আমরা প্রত্যেক উস্তাদ কি তাঁর শিক্ষকতায় আমানতদার? প্রত্যেক ওয়ায়েজ কি তার ওয়াজে মুখলিস ও যিম্মাদার? প্রত্যেক ইসলামপন্থী রাজনীতিক কি সত্যিই ইসলামের জন্যই রাজনীতি করছেন? এভাবে আরো যত অঙ্গন আছে সকল অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গকেই এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আজ ভাবতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে, আমরা কি সত্যিই রাহবার, না শায়েরের সেই রাহজান? আমাদের নীতি-নৈতিকতার যে পতনোন্মুখ অবস্থা এতে গোটা জাতির পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। আরো এক ধাপ এগিয়ে স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমাদের অধঃপতনই গোটা জাতির মাঝে বিরাজমান নানান অধঃপতনের অন্যতম কারণ। আমরা শুধরে গেলে গোটা জগতটাই শুধরে যাবে। আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ কাজের মধ্যে চিন্তা করা আবশ্যক, আমি কি আমার দ্বীনী কাজে রাহবারী করছি, না রাহজানী করছি? আমরা উজার হয়ে গেলে গোটা জগতটাই উজার হয়ে যাবে। আমরা যেহেতু জগতের কাণ্ডারী, দ্বীনের কিশতীর মাঝি-মাল্লা, তাই দাঁড় ঠিক রাখা আমাদেরই কাজ। আমরা যদি উদাসীন হয়ে যাই তাহলে আরোহীরা কোনোদিন গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। তখন আমরাও ধ্বংস হব, সাথে আরোহীরাও ধ্বংস হয়ে যাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দ্বীনী খেদমতের সব ক’টি শাখায় দু’-এক জন করে খাঁটি লোক অবশ্যই আছেন। তাদের কারণেই নানা প্রতিকূলতার মাঝেও দ্বীনী কাজ হচ্ছে। তা না হলে পরিসি'তি আরো নাজুক হত। কিন' কথা হচ্ছে, এই দু’-একজনই কি যথেষ্ট? না। দ্বীন-প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ গতি সঞ্চার করতে হলে দ্বীনের রাহবারদের এক শ’তে একশজনকেই সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। দ্বীনের কাণ্ডারীকে কাণ্ডারীই থাকতে হবে। তাদের অবক্ষয়ে জগতের পতন অনিবার্য। তাদের বিন্দু পরিমাণ অবক্ষয়ও জাতি ও জগতের মহা ক্ষতির কারণ হতে পারে। আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ, অধঃপতন কিংবা রাহজানী নয়, তিনি যেন রাহবারদেরকে রাহবারীতেই নিয়োজিত রাখেন। আমীন।

 

advertisement