ইসলাম ও মানবাধিকার
কুয়েত ইউনিভার্সিটির তত্ত্বাবধানে ‘ইসলামে মানবাধিকার’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত ছয় দিনব্যাপী ওয়ার্কশপের উদ্বোধনী প্রবন্ধে জনাব আইকে রুহি বলেন, মানবাধিকারই হচ্ছে ইসলামী আইনের মূল ভিত্তি। প্রবন্ধে জনাব আইকে রুহি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের ভাষণকে মানবাধিকারের সর্বপ্রথম ঘোষণা হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ইসলাম শুধু মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথাই ঘোষণা করেনি মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্বের ব্যাপারেও অবহিত করেছে। তিনি মানবাধিকারের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আলকুরআন হচ্ছে ফুরকান-সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। কুরআন মানুষকে সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করতে শেখায়। কুরআন মানুষকে কল্যাণ ও আলোর পথ দেখায়। মানুষের অধিকার আদায়ে সত্যের পক্ষে থেকে পাপাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। তিনি পশ্চিমা প-িতদের সমালোচনা করে বলেন, তারা মানবাধিকারকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। এর বিপরীতে ইসলাম শুধু মানবাধিকারের রূপরেখাই পেশ করেনি, আল্লাহ তাআলার হুকুম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা হিসাবে ঘোষণা দিয়ে তা মানার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে এবং সেসকল অধিকার পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করেছে। (দৈনিক জঙ্গ ১৫ ডিসেম্বর ১৯৮০)
মানবাধিকারের রূপরেখা পেশ করা এবং তার ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে ইসলামের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, পৃথিবীর কোনো আইন ও সংবিধান, কোনো ধর্ম ও মতবাদ, কোনো প-িত ও বিজ্ঞজন যা অস্বীকার করতে পারবে না। ইসলামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলাম মানবাধিকারের সীমাকে এত প্রশস্ত করেছে যে, পুরো জীবন এর মাঝে এসে পড়ে। পিতা-মাতার হক, বন্ধু-বান্ধবের হক, শ্রমিক-মালিক এবং শাসক ও জনগণের হক, সরকারের হক, শ্রমজীবী মানুষদের হক, দুর্বল ও অসহায়দের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, সাধারণ মানুষের হক ইত্যাদি।
শুধু মানুষেরই নয় ইসলাম চতুষ্পদ জন্তু ও অবলা প্রাণীর অধিকারও নিশ্চিত করেছে। গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, বান্দার হক এবং আল্লাহ্র হক আদায় করার নামই হচ্ছে ইসলাম।
ইসলামের আরেক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলাম মানুষকে অধিকার আদায়ের চেয়ে অধিকার প্রদানের বিষয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে। বর্তমান সমাজের বড় একটি দুর্বলতা হচ্ছে, সমাজের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধিকারের তালিকা হাতে নিয়ে তা আদায়ের স্লোগান দেয়। কিন্তু অন্যদের যেসকল হক তার উপর রয়েছে তা আদায়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ গাফেল। যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজের অধিকার উসুলে ব্যস্ত থাকবে কিন্তু অন্যের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে থাকবে গাফেল তখন সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা হবে তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল, যা বর্তমান পৃথিবীতে একেবারেই স্পষ্ট। ইসলাম প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গুরুত্বের সাথে অন্যের হক ও অধিকার আদায়ের অনুভূতি জাগ্রত করে। কারণ, কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
নারীদের কী কী অধিকার পুরুষের উপর আছে সে ব্যাপারে ইসলাম পুরুষদের সচেতন করে; কিন্তু নারীদেরকে অধিকার আদায়ের নামে রাস্তায় নামার উস্কানি দেয় না। স্ত্রীদেরকে স্বামীর হকের কথা মনে করিয়ে দেয়; স্বামীকে নিজ হক আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করতে বলে না। ইসলাম শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার পারিশ্রমিক আদায় করে দেয়ার জন্য মালিককে উৎসাহিত করে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ ছেড়ে রাস্তায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে প্ররোচিত করে না। মোটকথা ইসলামে প্রতিটি মানুষকে তার উপর অন্যের যে হক রয়েছে তা আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক ঠিক ঠিক আদায় করছে কি না সে ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। এভাবে ইসলাম পুরো দেশ ও পুরো সমাজকে একশ ভাগ অধিকার প্রদানকারী হিসাবে দেখতে চায়। অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শতভাগ সরব কিন্তু অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নীরব- সমাজের এ দৃশ্য ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান সমাজে যে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে তা ইসলামের এ শিক্ষা ও আদর্শ থেকে বিমুখ হওয়ারই অবশ্যম্ভাবী ফলাফল।
ইসলামের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দায়িত্ব ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ইসলাম শুধুই আইন ব্যবহার করে না; বরং মানুষের হৃদয়ে এমন বোধ ও চেতনা জাগ্রত করে, যা ব্যক্তির মাঝে দায়িত্ব পালনের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি সৃষ্টি করে। ফলে শুধু আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়; বরং আল্লাহ্র সন্তুষ্টির আশা ও অসন্তুষ্টির ভয় এবং কিয়ামতের ময়দানে জবাবদিহিতার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে নিজ থেকে সকলের হক ঠিক ঠিকভাবে আদায় করে দেয়।
ইসলাম বলে, দুনিয়াতে কেউ যদি অন্যের কোনো ক্ষতি করে তাহলে কিয়ামতের দিন প্রতিটি অণু-পরমাণুর হিসাব নেয়া হবে; কড়ায় গ-ায় সকল হক শোধ করতে হবে। এমনকি কোনো শিংওয়ালা বকরি যদি শিং ছাড়া বকরিকে দুনিয়াতে আঘাত করে থাকে তাহলে কিয়ামতের দিন উভয়কে জীবিত করে শিংহীন বকরির বদলা দেয়া হবে। যখন বিবেকহীন প্রাণীদের মাঝে পর্যন্ত ইনসাফ করা হবে, প্রত্যেককে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হবে তাহলে যেসকল মানুষ সজ্ঞানে ও জাগ্রত বিবেকে অন্যের হক আত্মসাৎ করেছে তাদের সাথে কেমন আচরণ হবে?
মোটকথা ইসলাম তার পবিত্র শিক্ষার মাধ্যমে মানবাধিকারকে এ পরিমাণ সংরক্ষণ করেছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হক্কুল্লাহ্র তুলনায় হক্কুল ইবাদকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম মুসলমানদের মাঝে এই অনুভূতি সৃষ্টি করতে চায় যে, কারো মনে যেন অন্যের হক নষ্ট করার চিন্তাও না থাকে। ভুলবশত কারো হক নষ্ট হয়ে গেলে তা শোধরানো পর্যন্ত মনে শান্তি না আসে।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও দীক্ষাপ্রাপ্ত সাহাবায়ে কেরাম রা. মানুষের অধিকার আদায়ে ছিলেন শতভাগ সচেতন। তাই তাঁদের যুগে সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার যে দৃশ্য পৃথিবী দেখেছে মানবেতিহাস এর নমুনা পেশ করতে অক্ষম। বর্তমান সময়ে নিজ দায়িত্ব পালনে ও অন্যের অধিকার প্রদানে মুসলমানদের মাঝে যে শিথিলতা দেখা যায় তা মূলত ইংরেজ-সভ্যতা ও ইহুদী-খ্রিস্টানদের চিন্তানৈতিক দাসত্বের প্রভাব। এই অভিশপ্ত সভ্যতার প্রভাবে মুসলমানদের মাঝে দ্বীনী ব্যাপারে শিথিলতা শুরু হওয়ার পর থেকে বিভেদ, ধর্মহীনতা ও অন্যের প্রাপ্য না দেয়াকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করা শুরু হয়েছে।
‘ইসলাম ও মানবাধিকার’ বিষয়টি শুধু প্রবন্ধ রচনার কিংবা কনফারেন্স আয়োজনের বিষয় নয়। বরং ইহুদী-খ্রিস্টানের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের আদর্শ বানিয়ে দ্বীনকে নিজের জীবনে ধারণ করাই হচ্ছে সময়ের বড় প্রয়োজন।
অনুবাদে : শাহাদাত ছাকিব