রজব ১৪৩৯   ||   এপ্রিল ২০১৮

প্রোপাগাণ্ডা : ইসলাম, সন্ত্রাস ও নারী-অধিকার

আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী

১৯৮৬-এর জানুয়ারি। ভারতে রাজিব গান্ধির প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতি চলছিল। তালাকপ্রাপ্তা নারীর অধিকার সংক্রান্ত একটি বিল তখন পার্লামেন্টে ছিল। ঐ সময় এক তামিল পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমাদের আইনের চেয়ে ইসলামী আইনে নারীর স্বার্থ ও অধিকারের নিরাপত্তা বেশি রয়েছে।

১৯৯৩-এর অক্টোবরে অক্সফোর্ডের ইসলামিক সেন্টারে বৃটেনের প্রিন্স চার্লস বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে আমাদের পশ্চিমাদের  এক সংকীর্ণতা হচ্ছে, কোনো কোনো জায়গার কিছু প্রান্তিক ঘটনাদৃষ্টে বলতে থাকি, ইসলাম নারীর অধিকার গ্রাহ্য করেনি, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আজ থেকে ১৪ শ বছর আগেই কুরআন নারীদের অধিকার দিয়েছে। মিরাছের অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার, নিজের সম্পদ ব্যবহারের অধিকার, তালাকের ক্ষেত্রে সদাচার প্রাপ্তির অধিকার এবং এধরনের আরো অনেক অধিকার, যা আমার দাদীর সময় পর্যন্তও বৃটেনে একেবারে অভিনব ব্যাপার ছিল।

যুবরাজ চার্লসের  পুরো বক্তৃতা প্রকাশিত হয় জিদ্দার ইংরেজি দৈনিক আরব নিউজে। তা পড়ে বোঝা যায়, তার অধ্যয়ন সামান্য নয়। তিনি ইসলামী জাহান সম্পর্কেও অবগত, কুরআন-হাদীসেরও কিছু কথা তার  জানা। স্বভাবও বাস্তব-প্রিয়। ঐ বক্তৃতাতেই তার এ স্বীকারোক্তিও  আছে যে, ‘পশ্চিমারা লেবাননের গৃহযুদ্ধ এবং অল্পকিছু মানুষের চরমপন্থার আলোকেই ইসলামকে চিনতে চায়। এটা এক ভয়াবহ রকমের ভ্রান্তি।

আমরা কি পছন্দ করব যে, বৃটেনে সংঘটিত অপরাধ, হত্যা-ধর্ষণ-অপহরণ ও মাদকের বিস্তার দেখে কেউ বলুক, এইসব বৃটেনের ধর্ম ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব?’

তবে এই স্বীকারোক্তি কি ঘটনাচক্রের ব্যাপার, না বিশেষ দুরভিসন্ধিমূলক বোঝা কঠিন। কারণ ঠিক এ সময়েই বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের একটি সরকারি চিঠি কীজানি কীভাবে হস্তগত করে এক উর্দু সাময়িকী প্রকাশ করে দিয়েছে। ঐ চিঠিতে তিনি তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘ইউরোপের যে দেশগুলো কমিউনিজমের পাঞ্জা থেকে মুক্ত হয়েছে ঐসব দেশে ইসলাম শক্তিশালী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনটা ঘটলে তা হবে কমিউনিজমের চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার।

লাহোর থেকে প্রকাশিত মাসিক এশিয়ায় এই পত্রের ফটো ও তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। এটি যদি সঠিক হয় -বাহ্যত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম- তাহলে জন মেজর সাহেব যেন ইকবালের ভাষায় ইবলীসের প্রতিনিধিত্ব করেছেন-

الحذر  آئین پیغمبر  سے سوبار  الحذر

সাবধান! পয়গম্বরের আইন থেকে শত বার সাবধান!!

আর দ্বিতীয় পংক্তি যেন যুবরাজ চার্লসের বক্তব্যের প্রতিনিধিত্ব করছে-

حافظ ناموس زن مردآزما  مرد آ فريیں

অর্থাৎ পয়গম্বরের আইন যেমন নারীর ইজ্জত-আব্রু রক্ষাকারী, তেমনি পুরুষের পৌরুষ নির্মাণকারী।

প্রিন্স চার্লস বা রাজিব গান্ধির স্বীকারোক্তির প্রতি আমাদের আলাদা কোনো মোহ নেই। এইসকল স্বীকারোক্তিকে আমরা ইসলামের জন্য ‘সনদ’ও মনে করি না। সূর্যকে সূর্য বলা তো আপন চক্ষুষ্মানতারই প্রমাণ দেওয়া। তাছাড়া এইসকল স্বীকারোক্তি দ্বারা ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ ষড়যন্ত্রেও কোনো হেরফের হয় না। ভারতে রাজিব গান্ধির এই স্বীকারোক্তির আগে পত্র-পত্রিকার যে ইসলাম-বিরোধী অবস্থান ছিল এখন তাতে হ্রাস নয় বৃদ্ধিই ঘটেছে। বৃটেনে মৌলবাদী ইসলামের যে জুজুর ব্যাপক প্রচার হয়েছে, অন্যান্য দেশেও রফতানি করা হয়েছে, তাতেও ক্রমবৃদ্ধিই ঘটে চলেছে। এসবের একমাত্র কারণ ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা নয়। নিছক অজ্ঞতাবশত হয়ে থাকলে তাদেরকে ইসলামের সঠিক রূপ দেখিয়ে দেয়া সম্ভব ছিল। বাস্তবতা হচেছ, এরা খুব ভালো করেই জানে এবং বোঝে। প্রিন্স চার্লসের ভাষায়- আমরা ভালো করেই জানি, ইসলামে প্রান্তিকতা নেই। আর যে অর্থে ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম বলা হয় তাতে মুসলমানদের কোনো ইজারাদারি নেই, অন্যান্য ধর্ম, যেমন খ্রিস্টধর্মেও তা আছে। অধিকাংশ মুসলমান এমন, যারা ধর্মের মৌলিক নিয়মকানুন পালন করেও জীবনের সাধারণ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে খুবই ভারসাম্য রক্ষাকারী। তারা ধর্মে মধ্যপন্থার (امت وسط) প্রবক্তা।

কুরআনে কারীমের বাণী কতই না সত্য-

وَ جَحَدُوْا بِهَا وَ اسْتَیْقَنَتْهَاۤ اَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَّ عُلُوا

তারা অন্যায় ও অহংবশত একে অস্বীকার করেছে। এদের অন্তর তা সত্য বলে বিশ্বাস করলেও। -সূরা নাহ্ল  (২৭) : ১৪

[মাওলানা আবদুল্লাহ আব্বাস নদভীর কলামসমগ্র থেকে অনূদিত। অনুবাদে : ইবনে নসীব]

 

 

advertisement