দুর্ঘটনা : উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা
সহমর্মিতা মানুষের এক মানবিক বৈশিষ্ট্য, অন্যের দুঃখ কষ্ট তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। বিশেষত সেখানে যদি থাকে আপনত্বের কোনো দিক। এই চেতনা ও সংবেদন মানুষকে দেয়া আল্লাহ তাআলার এক বড় দান, মানবতার এক বড় বৈশিষ্ট্য। গত ১২ মার্চ সোমবার দুপুরে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর গোটা দেশেই নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। ইউএস বাংলার ঐ বিমানটিতে ৪ জন ক্রু ও ৬৭ জন যাত্রী ছিলেন। ৩২ বাংলাদেশী, ৩৩ নেপালী ছাড়াও ছিলেন মালদ্বীপের ১ জন ও চীনের ১ জন নাগরিক। সর্বমোট ৭১ জনের মধ্যে ৫১ জনই ঐ দুর্ঘটনায় নিহত হন। আহতদের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশী, ৯ জন নেপালি ও ১ মালদ্বীপের নাগরিক। দুর্ঘটনায় বিমানটির পাইলট ও কো-পাইলট দুজনই নিহত হন। বলা হচ্ছে, ১৯৮৪ সালের পর থেকে এটিই কোনো বাংলাদেশী যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের বড় দুর্ঘটনা।
সঙ্গত কারণেই এই দুর্ঘটনার পর নানাবিধ আলোচনা পর্যালোচনা হচ্ছে। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনাগত নানা সীমাবদ্ধতা সেই আলোচনায় উঠে এসেছে। একে তো বিমানবন্দরটি পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয়ত প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকেও তা দুর্বল। বাংলাদেশী উড়োজাহাজটির বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে এই বিষয়টিও আলোচনায় আসছে।
দুর্ঘটনা কখনো কাম্য নয় এবং তা অবহেলা করার মতো বিষয়ও নয়। এর সঠিক কারণ নির্ণয় করে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এক্ষেত্রে আত্মসমালোচনাও অতি প্রয়োজন।
বিমান দুর্ঘটনার সূত্রে অন্যান্য যানবাহনের দুর্ঘটনাও আলোচিত হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোতে আনিসুল হক লিখেছেন... সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শঙ্কা সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবীতে বিমান দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৯, ২০১৬ সালে ২৫৮ আর ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৪ সালে ৬৯১। সূত্র : স্টাটিস্টা ডটকম। এটা সারা দুনিয়ার হিসাব। আর ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে শুধু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২২৯৭ জন। এটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে বের করা হিসাব। ২০১৬ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬ হাজার ৫৫ জন। ২০১২ পর্যন্ত ১৪ বছরে মারা গেছে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ। এটা রীতিমতো গণহত্যা কিংবা মহামারির পর্যায়ে গেছে। ... (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬-০৩-১৮)
এরপর তিনি নৌপথে দুর্ঘটনা ও ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুরও একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন। তার শেষ প্যারাটি এরকম- ‘জয় গোস্বামীর একটা কবিতা আছে- ‘এই মালঞ্চ নিয়তিময়, ফুল ধরেছে মৃত্যুগাছে, বাইরে যাওয়ার রাস্তা কোথায় শুধাও না ঝাউ পাতার কাছে।’ ঝাউগাছের পাতার কাছে শুধোলে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। সমাধান তাদেরই বের করতে হবে, যাদের উপর ভার দেওয়া হয়েছে। তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শক্তি ... (প্রাগুক্ত)
দায়িত্ব পালনে অবহেলা একটি পাপ আর অদক্ষ ও অযোগ্য লোকের উপর দায়িত্ব অর্পণ আমানতে খিয়ানত। অথচ সর্বত্র যেন এরই চর্চা। এই পাপাচারের কুফল ভুগতে হচ্ছে গোটা জাতিকে।
এখন প্রত্যেকে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার, অরাজকতা ও অব্যবস্থাপনার এই সর্বগ্রাসী বিস্তার কেন আমাদের উপর চেপে বসেছে, যা হরণ করেছে আমাদের সুখ-শান্তি-নিরাপত্তা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّ اللهَ لَا یُغَیِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتّٰی یُغَیِّرُوْا مَا بِاَنْفُسِهِمْ.
অর্থাৎ মানুষকে দেয়া সুখ-শান্তি ও অন্যান্য নিআমত ঐ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত মানুষ নিজে তার বিশ্বাস ও কর্মকে পরিবর্তন না করে। এটা আল্লাহ তাআলার এক সাধারণ নীতি। মানুষ যখন ঈমানের বদলে কুফর, আমানতের পরিবর্তে খিয়ানত এবং ইতাআত-আনুগত্যের বদলে ফিস্ক ও নাফরমানী অবলম্বন করে তখন তার জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তার বদলে শঙ্কা ও অশান্তি নেমে আসে। এ নিয়ম ব্যক্তি জীবনে যেমন সত্য তেমনি সত্য সমষ্টিগত জীবনেও। আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অশান্তি-অবক্ষয় সম্পর্কে কমবেশি সকলেই উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়-অব্যবস্থাপনার বিস্তার এখন অতি আত্মকেন্দ্রিক মানুষকেও শঙ্কিত করে তুলছে।
এই অবস্থায় আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজের দিকে তাকানো, এরপর সমাজের দিকে তাকানো। আমাদের কর্মে ও বিশ্বাসে কী কী পরিবর্তন আমরা এনেছি তা একটু চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। তাহলেই বোঝা যাবে, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও এই সর্বগ্রাসী অরাজকতা আর সেই অরাজকতার ফলশ্রুতিতে ‘গণহত্যা’ বা ‘মহামারি’র পর্যায়ের প্রাণহানী আর দাবানলের মতো অশান্তি কেন আমাদের ঘিরে রেখেছে।
এই জীবন ও জগৎ যাঁর সৃষ্টি, যাঁর ইচ্ছায় তা পরিচালিত, তাঁরই আনুগত্যের দিকে আবার আমাদের ফিরতে হবে। তাহলে আবারো আমাদের জীবনে ফিরে আসতে পারে তাঁর দানসমূহ।
মূল প্রসঙ্গে আসি। ইউএস বাংলার উড়োজাহাজটির পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ছিলেন একজন দক্ষ পাইলট। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ২০ বছর চাকরি করার পর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে যোগ দেন ২০১৫ সালের ৬মে। তিনি এই বিমান সংস্থার ড্যাশ এইট কিউ ৪০০ উড়োজাহাজের পাইলট দলের প্রধান ছিলেন। পাশাপাশি এ উড়োজাহাজের পাইলটদের প্রশিক্ষকের দায়িত্বেও ছিলেন। নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে তিনি শতাধিক বারেরও বেশি বিমান নিয়ে ওঠানামা করেছেন। অথচ এখানেই তিনি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারালেন।
মানুষের কখনো নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি ও যোগ্যতার উপর পূর্ণ আস্থাশীল হওয়া উচিত নয়। যোগ্যতার পাশাপাশি সতর্কতা ও নিয়মকানুন মেনে চলাও কাম্য। সর্বোপরি আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং তাঁর দয়া ও করুণার প্রত্যাশী থাকা অতি প্রয়োজন। একমুহূর্তের জন্যও তিনি যদি বুদ্ধি ও চেতনায় পর্দা ফেলে দেন তাহলেই মানুষ শেষ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের এই মর্মান্তিক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় যারা আহত-নিহত হয়েছেন তাদের সবার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা। যে মুসলিম ভাই-বোন এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তাদের জন্য আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে মাগফিরাত প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তাদের মাফ করে দিন এবং তাদের আখিরাতের জীবনকে শান্তিময় করুন।
এই দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সমবেদনা জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন। পত্রিকায় দেখলাম, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও বাংলাদেশের নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। তাদের শোক ও সমবেদনা প্রকাশের প্রতি মর্যাদা রেখেই বলতে ইচ্ছে হয়, এই একান্ত মানবিক বিষয়গুলোও কি কারো জীবনে একটা নিয়মসর্বস্ব অভিনয়ে পরিণত হতে পারে? বাংলাদেশের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি সমবেদনা জানানোর সময় পুতিনের কি মনে পড়েছে সিরিয়ার শত শত অগ্নিদগ্ধ নারী-শিশুর কথা, যারা রাশিয়ান আর্মির বিমান থেকে ছোড়া বোমার আঘাতে মর্মান্তিকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন? শত শত আহত শিশুর অশ্রু ও রক্তমাখা নিষ্পাপ মুখগুলো কি তার দেখার সুযোগ হয়েছে? সুযোগ হয়েছে বাশার আলআসাদের, যিনি নিজেকে মনে করেন ঐ জাতির, ঐ ভূখণ্ডের ‘নেতা’ ও রাষ্ট্রনায়ক?
কথা শুধু দীর্ঘই হয়ে যায়! আমাদের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রসঙ্গে আনিসুল হক লিখেছেন, ‘৫১ তো সংখ্যা নয়। ৫১ জন মানুষ। তাদের প্রত্যেকের আছে জন্মের ইতিহাস, প্রথম হাসা, প্রথম কাঁদা, প্রথম কথা বলা, প্রথম হাঁটা। স্কুলে যাওয়া, আছেন বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, দূরের বন্ধু, কাছের বন্ধু, আমরা সইতে পারি না। তাদের জন্য বুকটা ভেঙ্গে আসে, হৃদয় বিদীর্ণ হয়। যাঁরা বেঁচে আছেন তাদেরও কত কষ্ট করতে হচ্ছে, কেউবা স্বজন হারিয়েছেন, কেউবা অগ্নিদগ্ধ হয়ে যন্ত্রণা সইছেন। আরও একটা ভাবনা চলে আসে। ওই ফ্লাইটে আমিও থাকতে পারতাম।
লেখককে ধন্যবাদ, এইটুকু মমতা ও মানবিকতা তো একজন মানুষের থাকতেই হবে। শুধু এইটুকু নিবেদন যে, এই মানবিকতা যেন মিয়ানমার, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, সিরিয়ায় ও অন্যান্য ভূখণ্ডের মানুষগুলোর ক্ষেত্রেও আমাদের মনে জাগে। তারাও তো মানুষ। তাদেরও প্রত্যেকের আছে জন্মের ইতিহাস...।
কেন যেন মনে হয়, আমাদের অনেকেরই মমতা ও মানবিকতায় কিংবা তার প্রকাশে সংকীর্ণতার ছায়াপাত ঘটছে। যাইহোক, আহত-নিহত সকলের জন্য আবারো গভীর সমবেদনা জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।