জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাও যেভাবে নেক আমল হয়
[বিগত ১৫ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৯ হিজরী/৪ মার্চ ২০১৮ ঈসায়ী তারিখে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার মিরপুরের ভবনে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের নিয়ে দিনব্যাপী একটি দ্বীনী শিক্ষা মজলিস। এতে বিভিন্ন কার্যক্রম ছিল। এই মজলিসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচনা হয়েছে। তন্মধ্য থেকে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর আমীনুত তালীম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের মূল্যবান বয়ানটি এখানে উপস্থাপিত হল। এতে মাদরাসার তালিবুল ইলম ও জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকারী উভয় শ্রেণির জন্য রয়েছে অতি প্রয়োজনীয় পথনির্দেশনা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এর পূর্ণ কদরদানী করার তাওফীক দান করুন- আমীন।]
হামদ ও ছানার পর
أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ، بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ.
اَلرَّحْمٰنُ، عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ، خَلَقَ الْاِنْسَان، عَلَّمَهُ الْبَیَان، اَلشَّمْسُ وَ الْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ، وَّ النَّجْمُ وَ الشَّجَرُ یَسْجُدٰنِ.
-সূরা আররহমান (৫৫) : ১-৬
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শোকর আদায় করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকাল থেকে আল্লাহর যিকির এবং ফিকির নিয়ে বসার, আলোচনা করার, আলোচনা শোনার তাওফিক নসীব করেছেন, আলহামদু লিল্লাহ।
জরুরি অনেক কথা হয়েছে। সামনে আরো জরুরি আলোচনা হবে; উলামায়ে কেরাম আছেন। কিছু আমলি মশ্ক হবে ইনশাআল্লাহ। আমি সংক্ষেপে দুটি কথা পেশ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। প্রথম কথা হল, আমরা ছাত্র। জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অন্বেষণকারী ছাত্র। ছাত্র হিসেবে কিছু আদব, নিয়ম-কানুন পালন করা জরুরি। এ বিষয়ে দু-একটি কথা আরজ করব ইনশাআল্লাহ। আর একটি হাদীস বলার চেষ্টা করব। হাদীসটি এখনই বলে রাখি।
أَرْبَعٌ إِذَا كُنّ فِيكَ فَلَا عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنَ الدنْيَا: حِفْظُ أَمَانَةٍ، وَصِدْقُ حَدِيثٍ، وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ، وَعِفّةٌ فِي طُعْمَةٍ.
-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ৬৬৫২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪৪৬৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৮৭৬
সংক্ষিপ্ত একটি হাদীস। হাদীসটির আলোকে কিছু কথা শেষে বলব ইনশাআল্লাহ। শুরুতে যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছি তা হল, আমরা ছাত্র। দ্বীনী মাদরাসায় যারা পড়াশুনা করি আমাদের নাম তালিবে ইলম। তালিবে ইলম মানে ইলম অন্বেষণকারী। ইসলামের পরিভাষায় ইলম বলা হয় ইল্মে ওহীকে। ওহীর ইলম, ওহীর জ্ঞান- ওহীর মাধ্যমে যে জ্ঞান মানুষ পেয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। কুরআন ও সুন্নাহ্র ইলমকে বলা হয় ইলম। তালিবে ইলম সে, যে ঐ ইলম অন্বেষণ করে; ঐ ইলম নিয়ে মেহনত করে। আর একটা হল জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান। এই জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে যারা মেহনত করে, এটা শিখতে চায়, শেখে তারাও তালিবে ইলম। এক প্রকারের তালিবে ইলম। কিন্তু পরিভাষার বিষয় আছে। যেহেতু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট আসল ইলম হল ওহীর ইলম, কুরআন সুন্নাহ্র ইলম তাই ইলম বললে ওটাকেই বুঝায় এবং তালিবে ইলম বললে- যারা কুরআন-সুন্নাহর ইলম শেখে থাকে তাদেরকে বুঝায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, যারা জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করে তাদের এই কাজটা কোনো কাজ নয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে, ইসলামের দৃষ্টিতে এমন ধারণা করা একেবারেই অন্যায় ও ভুল। বরং জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান যারা চর্চা করে, তাদেরও যদি নিয়ত সহীহ থাকে এবং পদ্ধতি সঠিক হয় তাহলে তাদের এ চর্চাও আমলে সালেহ তথা নেক আমল।
জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্বেষণ এবং এ নিয়ে চর্চা করা, মেহনত করা এটাও নেক আমল- আমলে সালেহ। শর্ত কী? নিয়ত হতে হবে সহীহ এবং পদ্ধতি হতে হবে সঠিক। সহীহ নিয়ত এবং সঠিক পদ্ধতি যদি হয় তাহলে ওটাও নেক আমল। আর যদি নিয়ত সহীহ না হয়, তাহলে যে নিয়তে জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আপনি অর্জন করেছেন তাই পাবেন।
আমলে সালেহ হতে হলে নিয়ত সহীহ হতে হবে- এ কথা শুধু জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য না। আমাদের এই ইল্মে নবুওত, ইল্মে ওহী হাসিল করার জন্য যারা মাদরাসায় পড়ে তাদের জন্যও একই কথা। পড়ছে কুরআন-সুন্নাহ্র ইলম, দ্বীনী ইলম, কিন্তু আল্লাহর দরবারে তার এই মেহনত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত শর্ত। সহীহ নিয়ত হতে হবে। এখানে যদি সহীহ নিয়ত জরুরি হয়, জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জরুরি হবে না?
কী নিয়ত? আমরা যারা স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে পড়াশুনা করছি, কেন করছি? আমাদের নিয়তটা কী? কী নিয়ত হলে সহীহ নিয়ত হবে, কী নিয়ত হলে স্থূল নিয়ত হবে, কী নিয়ত হলে একবারেই গলত এবং নাজায়েয নিয়ত হবে- এটা জানতে হবে। নিয়ত তিন ধরনের হতে পারে:
১. সহীহ নিয়ত ২. স্থূল নিয়ত আর ৩. একেবারেই গলত নিয়ত।
স্থূল নিয়ত কী?
আগে ওটাই বলি। স্থূল নিয়তই মনে হয় মানুষের মাঝে বেশি; আমি জানি না। স্থূল নিয়ত হল, পড়াশুনা না করলে ভবিষ্যতে করবে কী? ভবিষ্যতের একটা ব্যবস্থার জন্য, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর জন্য, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পড়াশোনা করতে হবে। ছেলে যদি পড়াশুনা করতে না চায় তাকে উদ্বুদ্ধ করা হয় এই কথা বলে- করবি কী? কী করে খাবি? কী করে খাবে তুমি ভবিষ্যতে?
ঠিক এই ভাষায় হয়ত বলে না, কিন্তু এ ভাষাও ব্যবহৃত হয়। বাকি বিষয়টা মাথায় থাকে। নিজের পায়ে নিজেকে দাঁড়াতে হবে। ভবিষ্যতে কিছু একটা করতে হবে। তাহলে তোমাকে শিখতে হবে। এটা হল একবারেই স্থূল নিয়ত। এই নিয়তটার মধ্যে ভদ্রতা নেই। ভালো রুচির পরিচয় নেই। এই নিয়তের মধ্যে কোনো গভীরতা নেই। একেবারে স্থূল একটা চিন্তা।
কেন এই নিয়ত স্থূল, এটা বেশি ব্যাখ্যা করতে হবে না। সংক্ষেপে বলি, এই যে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর কথা বলছি, প্রথম কথা হচ্ছে, আপনি কীভাবে বললেন, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবেন? কে দান করেছেন এই পা? আল্লাহ দান করেছেন। এই পায়ের নিআমত কত বড় নিআমত। কখন বুঝা যায়? এক্সিডেন্ট হয়ে যদি পা ভাঙে তখন বুঝা যায়, এটা কতবড় নিআমত আল্লাহর পায়ের নিআমত তো আল্লাহ দান করেছেন। চলা-ফেরার তাওফীক আল্লাহ দিচ্ছেন। কিন্তু এখন আপনি পায়ের বিষয়টা একেবারেই ফয়সালা করে ফেলেছেন। এটা আমার পা। নিজের পা। দাঁড়ানোটা? দাঁড়াতেই হবে, দাঁড়ানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো এত সহজ! যিনি পা দিয়েছেন তাঁকে ভুলে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে যাব আমি!! নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো এটা তো সুন্দর কথা হল না। আশাটাও তো সুন্দর না- নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো।
তেমনিভাবে- ‘ভবিষ্যত’। ভবিষ্যতে কী করব, ভবিষ্যতের চিন্তায় পড়াশুনা করতে হবে আমাকে। কোনো না কোনো বিষয়ে আমাকে পণ্ডিত হতে হবে। কাকে বলে ভবিষ্যত? ভবিষ্যত কী জিনিস? একজন আল্লাহর বান্দার ভবিষ্যত এত সীমিত কেন? ভবিষ্যত কার? আমার, আমার সংসারের! কত দিন পর্যন্ত? কবরে যাওয়া পর্যন্ত! ব্যস, সীমিত ভবিষ্যত! মুমিনের দৃষ্টি এত সীমিত হয়? আমি তো আল্লাহ্র মুমিন বান্দা, আমার দৃষ্টি এত সীমিত কেন? আমার ভবিষ্যত মৃত্যু পর্যন্ত? আমার ভবিষ্যত মানে আমি আর আমার পরিবার? একজন মুমিনের ভবিষ্যত হবে পুরো উম্মতের ভবিষ্যত। পুরো উম্মতের ভবিষ্যত তার নিজের ভবিষ্যত। আর তার ভবিষ্যত মউত পর্যন্ত নয়; তার ভবিষ্যত তো শুরু হয় মউতের পর থেকে। মউতের আগ পর্যন্ত তো আজ। যখন থেকে কাল শুরু হবে (মউতের পর) সেটা আগামীকাল। কুরআন মাজীদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ لْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ ، وَ اتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ.
-সূরা হাশর (৫৯) : ১৭
অর্থাৎ, আল্লাহকে ভয় কর। তোমাদের প্রত্যেকে যেন ভাবে- আগামীকালের জন্য কী পাঠিয়েছে। আগামীকালের জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছে।
আগামীকাল আমরা কোথায় থাকব? আখেরাতে। তো আখেরাতের জন্য কোনো সঞ্চয় কি আছে আমাদের? ওখানে পাঠিয়েছি কিছু? আল্লাহ বলছেন, প্রত্যেককেই এটা ভাবতে হবে, আগামীকালের জন্য আমি কী প্রস্তুতি নিয়েছি, কী পাঠিয়েছি। আগামীকাল- মৃত্যুর পর থেকেই আগামীকাল। এর আগ পর্যন্ত পুরোটা আজ।
তো মুমিনের ভবিষ্যত তো মৃত্যুর পর থেকে। আমি কীভাবে ভবিষ্যত-চিন্তা করছি; মৃত্যুর পরের জীবনকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যত চিন্তা করছি? এটা তো একেবারেই সংকীর্ণতা হয়ে গেল। এজন্য ওটা স্থূল নিয়ত। ঐ নিয়তে কোনো গভীরতা নেই।
গলত নিয়ত কী?
গলত নিয়ত হল- আরে জ্ঞান তো এটাই; আর কোনো জ্ঞান আছে নাকি! জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান যে শিখবে সেই তো জ্ঞানী। এর বাহিরে তো কোনো জ্ঞান নেই!! যারা অন্য কিছু শিখে তারা তো জ্ঞানী না। দেখেন না পত্র-পত্রিকায়? আমার অবশ্য প্রায় ১০ বছরের মত হয়ে গেছে পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয় না; পড়ি না- ঠিক এ ভাষায় বললাম না। পড়ার সুযোগ হয় না। আগে যে সময় পড়তাম, ঐ সময় দেখতাম আলেমদের মধ্যে দুই ভাগ করা হয়; বুদ্ধিজীবিরা দুই ভাগ করে- শিক্ষিত আলেম আর অশিক্ষিত আলেম। জ্ঞানী আলেম আর মূর্খ আলেম। এর মানে কী? এর মানে এই যে, মাদরাসার যে ইলম এটা ইলমই না!! এটা কোনো জ্ঞানের হিসেবেই আসে না। জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখলেই সে জ্ঞানী হবে, নচেৎ জ্ঞানী হবে না। সেজন্য মূর্খতা থেকে বাঁচতে হলে কী করতে হবে? এই পড়া-শুনা করতে হবে। এই নিয়তে যদি কেউ জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাস্তা অবলম্বন করে, এটা হবে গলত নিয়ত। ‘গলত নিয়ত’ হালকা ভাষায় বললাম; এটা আসলে বেঈমানী নিয়ত। কুফরি নিয়ত। সহীহ নিয়ত নয়।
সহীহ নিয়ত কী?
সহীহ নিয়ত হল, আমরা আল্লাহর বান্দা, আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আখেরাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু থাকতে দিয়েছেন দুনিয়াতে। এই জগতে। এই জগতে কেন থাকতে দিলেন?
এই জগতে থেকে আমরা আখেরাতের প্রস্তুতি নিব। এই জগৎটা তো কোনো অর্থহীন বিষয় নয়। এই জগতে থাকতে দিয়েছেন কেন? ‘তাযাওয়াদু লিল আখিরাহ’-আখেরাতের পাথেয় গ্রহণ কর। অনেক আয়াত ও হাদীসে এই মর্মটা এসেছে যে, আখেরাতের প্রস্তুতি তোমরা এই দুনিয়া থেকেই গ্রহণ করো। এই জগতে থাকতে হলে মানুষের দুই ধরনের জ্ঞানের দরকার।
১. ওহীর মাধ্যমে যে হেদায়েত আল্লাহ তাআলা দান করেছেন; হালাল, হারাম, জায়েয, নাজায়েয, ঈমান, আমল যাবতীয়। একজন মুমিন একজন মুসলিম তার ঈমানী জিন্দেগী, তার ইসলামী জিন্দেগী কীভাবে গড়বে, গড়ে তুলতে হবে- সেই ইলম।
২. মানুষের দুনিয়াবি যত জরুরত আছে তার জ্ঞান। এই দু’ধরনের জ্ঞানের সমন্বয়ে একজন মানুষ জগতে বাস করতে পারে।
ধরুন, নামায-সালাত আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর ফরয করেছেন। সালাতের জন্য কী কী শর্ত আছে আপনারাও জানবেন। কিছু না কিছু পড়েছেন। আমল তো করেনই। অনেক কিছু জানাও আছে। কিছু জিনিস আছে জানা থাকে না, কিন্তু আমল ঠিকই করা হচ্ছে। বলতে গেলে হয়ত বলতে পারছে না। যেমন- সতর ঢাকা সালাতের একটি শর্ত। সতর ঢাকবে কী দিয়ে? পোশাক দিয়ে। জায়গা পাক হতে হবে নামায পড়তে হলে। এটা একটা শর্ত তাই না?- জায়গা পাক। জায়গা পাক যে হবে, জায়গাটা কোন্ জায়গা। নামাযের মূল জায়গা, আসল জায়গা কোন্টা? মসজিদ। মসজিদেই তো নামায পড়ব। মসজিদ তো একটা স্থাপনা, একটা ঘর। তো আপাতত এই দুই শর্তের কথাই বলি। এখন সালাতের জন্য যে পোশাক পরতে হবে, পোশাক আসবে কোত্থেকে? পোশাক কে তৈরি করবে?
জ¦ী, পোশাক তৈরি করতে হবে না? তাহলে পোশাকের শিল্প এটা জরুরি কি জরুরি না? জরুরি। এই পোশাকশিল্পের জ্ঞান কে অর্জন করবে? মসজিদ যে বানাবে এটার জন্য কয়েক প্রকার জ্ঞানের দরকার। ইঞ্জিনিয়ার দরকার, আবার মিস্ত্রী দরকার। আরো কত পর্ব আছে। ওটার ছামানাগুলো তৈরি করবে কারা? একটা ঘর তৈরি হওয়ার জন্য কতটা শিল্পের জরুরত। তো শরীয়ত আমাদেরকে পোশাক পরতে বলে- বিবস্ত্র থাকা যাবে না। নামায ছাড়াই তো পোশাক পরা জরুরি। সতর ঢাকা ফরয না?! নামায ছাড়াই তো সতর ঢাকা ফরয। তো শরীয়ত পোশাক পরা ফরয করেছে তাহলে পোশাকশিল্প কি শরীয়তে নিষিদ্ধ হবে?
মসজিদ নির্মাণ করার ফজিলতও আছে-
مَنْ بَنَى لِلهِ مَسْجِدًا بَنَى اللهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنّةِ.
যে আল্লাহ্র জন্য একটি মসজিদ বানাল আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে বাড়ি নির্মাণ করবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯১
মসজিদ নির্মাণের ফযিলতের কথাও আছে, সওয়াবের কথাও আছে। উদ্বুদ্ধও করা হয়েছে। কিন্তু এই শিল্প নিষেধ! এই বিজ্ঞান নিষেধ! এটা হয়?! কখনো হয় না।
জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে শরীয়ত কখনো নিষেধ করে না। চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহ তাআলা রোগ দেন আবার রোগ দূর করেনও। তো আল্লাহ কোন্ জিনিসে শিফা রেখেছেন- এটার নিশ্চিত বাস্তবিক ইলম আল্লাহ ছাড়া কারোরই নেই। শুধু সাধারণ একটা জ্ঞান ডাক্তারদেরকে আল্লাহ তাআলা দান করেছেন। সে হয়ত ঠিক ঠিক ঔষধ প্রয়োগ করতে পারে। শেফা হয় আল্লাহর হুকুমে । এই যে ডাক্তারী বিষয়টা- রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসেও রয়েছে। হাদীসের কিতাবে একটা অধ্যায়ের শিরোনাম ‘আততিব’। শিরোনাম কী? আততিব। তিব মানে চিকিৎসা বিজ্ঞান। একজন তালিবে ইলম, একজন ছাত্র যখন জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের লাইনে যাবে এবং সেই বিষয়ে পণ্ডিত্য অর্জন করবে তার নিয়ত কী হবে? নিয়ত হবে, আমি এর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মাখলুকের সেবা করব।
দ্বীন-ঈমান এবং শরীয়তের অনেক বিধি-বিধান আছে, যেগুলোর সাথে জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্পর্ক। উম্মাতে মুসলিমার সফলতা দুইটা মিলে। মূল সফলতা ঈমানের মধ্যে। সফলতা কিন্তু মুমিন হিসেবে। সে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে তার জাগতিক অনেক কিছুরই প্রয়োজন হয়ে যাচ্ছে। আমি ঐ অংশটা পুরা করব। আমি ঐ দিকের তাকাযাটা পুরা করব। মুফতী সাহেব বলবেন, নামাযের জন্য তোমাকে পোশাক পরতে হবে, তোমার পোশাক পবিত্র হতে হবে আর আমি বলব এই নাও পোশাক। হুযুর বলবেন, মসজিদের এই ফযিলত এবং বাসস্থান এটা আল্লাহর নিআমত। আমার স্ত্রীকে, আমার সন্তানকে সুন্দর নিরাপদ বাসস্থানে রাখা আমার অবশ্যকর্তব্য। এই মাসআলা হুযুর বলবেন। এখন ঘরটা নির্মাণ হবে কীভাবে? এই বিষয়ে আমি সহযোগিতা করব।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সাহাবী অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে পাঠাতেন। হারেছ ইবনে কালাদা আছছাকাফির কাছে পাঠাতেন। নিজেও চিকিৎসা দিতেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিকিৎসারও অনেক জ্ঞান ছিল। অনেক কিছুর ক্ষেত্রে তিনিও ব্যবস্থাপত্র বলে দিতেন। ব্যবস্থাপত্র লিখে তো দিতেন না, কিন্তু বলে দিতেন অনেককে। আল্লাহর রাসূল তো রাসূল ছিলেন। প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে চিকিৎসারও অনেক জ্ঞান ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের।
কিন্তু যে বিষয় জানা নাই সে বিষয়ের বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতেন। ডাক্তারের কাছে পাঠাতেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিকিৎসার জন্য হারেছ ইবনে কালাদা’র কাছে পাঠাতেন । হারেছ ইবনে কালাদা মুসলিম ছিল না। তখন যদি মদীনায় কোনো মুসলিম ডাক্তার থাকতেন, তার কাছে পাঠাতেন না? তো আপনি বলবেন যে আমার মুসলিম ভাইয়ের যাতে জরুরতের জন্য কোনো খ্রিস্টানের কাছে যেতে না হয় আমি সেই ঘাটতিটা পুরা করব। আমি এমন ফার্মাসিস্ট হব যে, ঔষধের ক্ষেত্রে অমুসলিম ফার্মাসিস্টদের মুখাপেক্ষী হতে না হয় মুসলিমদের। এই ঘাটতি আমরা পুরা করব। এটা হল নিয়ত। আল্লাহর মাখলুকের সেবার জন্য এবং জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে আল্লাহর দ্বীনের যে যে খেদমত করা যায় সেই খেদমতের জন্য আমি এই লাইনে পড়া-শোনা করব। তাহলে মাদরাসার ছাত্রের মনযিল আর আমার মনযিল এক। সেও আল্লাহর রেজামন্দির জন্য আল্লাহকে খুশি করার জন্য করছে আমিও আল্লাহকে খুশি করার জন্য করছি। সে মূল বিষয়ে মানুষকে হেদায়েত দিবে। কিন্তু সে হেদায়েতের উপর আমল করার জন্য মানুষের যেসমস্ত জাগতিক জরুরত হবে সেই জরুরতটা আমি পুরা করব- ইনশাআল্লাহ। এটা নিয়ত। এই নিয়তে যদি কেউ স্কুলে পড়ে, কলেজে পড়ে, ভার্সিটিতে পড়ে তাহলে তার এটা আমলে সালেহ হবে না? অবশ্যই হবে আমলে সালেহ। কোনো সন্দেহ নেই- এটা আমলে সালেহ।
আরেকটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, একটি হীনম্মন্যতা আমাদের মধ্যে কাজ করে যে, আমি যে শাস্ত্রে পড়াশুনা করছি এই শাস্ত্রে আমি পণ্ডিত্য অর্জন করব, সবার আগে যাব, আমি সবাইকে পিছে ফেলব; শুধু মেহনত করে। শুধু মেহনত। মাদরাসার ছাত্রদের কিন্তু এভাবে বলা হয় না এবং বললে অবাস্তব কথা হবে। কী বলা হয়, তুমি সর্বোচ্চ মেহনত কর। সময়ের অপচয় করো না। মেহনত পুরা কর। কিন্তু আল্লাহ্র সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো থাকতে হবে। জ্ঞান দান করবেন কে? আল্লাহ। যে কথা মাদরাসার ছাত্রের জন্য সেই কথাটাই জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্যও প্রযোজ্য কি প্রযোজ্য না? -জিজ্ঞাসা করি আপনাদেরকে- অবশ্যই প্রযোজ্য। তার কারণ, মনে করুন, একজন মাদরাসার ছাত্র হাদীসের ওপর উচ্চতর পড়াশুনা করছে। এই বিষয়ে তাকে পাণ্ডিত্য দান করবেন কে? আল্লাহ। সে মেহনত করতে পারে কিন্তু দান করবেন কে? আল্লাহ তাআলা। আপনি ডাক্তার হতে চাচ্ছেন, কতজনই তো ডাক্তারি পড়ে, কিন্তু সব ডাক্তারের দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য কি সমান? এই যে মেধার ও প্রতিভার বিকাশ যে ঘটছে, একরকম ঘটছে না, তারতম্য হচ্ছে, কোত্থেকে হয়? কেন হয়? সমান সমান মেহনত করছে, দু’জনের মেধা একরকম, তারপরও পার্থক্য হয় কি হয় না? হয়। কেন? দান করছেন আল্লাহ। একজনকে বেশি দান করেছেন আরেকজনকে কম। জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে যারা অগ্রসর হচ্ছে তারা বিশ্বাস করুক আর না করুক দান করছেন কে? দান করছেন আল্লাহ তাআলা।
কিন্তু বুদ্ধিমান ছাত্র সে, যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে সম্পর্ক রাখে। ভালো সম্পর্ক রাখে। সে এ বিশ্বাস করে- আমাকে দান করবেন আল্লাহ। এজন্য আমরা যে যেই বিষয়েই পড়ি- একজন অংক নিয়ে পড়ছি, একজন কোনো এক ভাষার উপর পড়াশুনা করছি আর বিজ্ঞানের তো বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আছেই; একেকজন একেক দিক নিয়ে পড়ছি; যে যেই দিক নিয়েই পড়ি আমাকে বিশ্বাস রাখতে হবে, আমি যে বিষয়ে আছি এ বিষয়ে আমাকে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হলে, সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে হলে একমাত্র আল্লাহ্ই আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আল্লাহ্ই দান করতে পারেন। এজন্য আমি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখব।
কী সম্পর্ক রাখব আল্লাহর সাথে? আমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে, আমি আল্লাহ্র বান্দা। আল্লাহ্র বন্দেগী করা ভুলব না। ফরয ভুলব না। আল্লাহ যে সমস্ত ইবাদত ফরয করেছেন এটার জন্য আমাকে সময় বের করতেই হবে। ঘুমের জন্য আমি সময় বের করি না? ঘুমের জন্য সময় বের করি। তো ঘুম কি ফরয? খাওয়া-দাওয়ার জন্য সময় বের করি না? এটা কি ফরয? দৈনিক গোসল করি, গোসলের জন্য সময় বের করি না? এটা কি ফরয? এটা কে তো আমি জরুরি মনে করি। আমার দেহের জন্য জরুরি। আমার শারীরিক চাহিদা এগুলো। শারীরিক চাহিদাগুলো আমি জরুরি মনে করছি। এগুলোর জন্য সময় বের করেই ফেলছি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করছি।
শারীরিক চাহিদার জন্য আমি সময় বের করছি। এরকম আমার দিলেরও তো কিছু চাহিদা আছে। দিল ও কলব এবং রূহ ও আত্মার কিছু চাহিদা আছে। আমার রূহ যাতে সুস্থ থাকে, আমার রূহ যাতে শক্তিশালী হয়, আমার কলব যাতে পাক-পবিত্র থাকে, শক্তিশালী থাকে- এজন্য এগুলোর কিছু চাহিদা আছে। কলব আলোকিত হওয়ার জন্য কিছু চাহিদা আছে। সেটা কী? ঈমান, নেক আমল, গুনাহ থেকে বাঁচা, ইবাদত-বন্দেগী করা।
কলব ও রূহের চাহিদা; এই চাহিদাগুলোর জন্য যদি আমি সময় বের করি, এগুলো যদি যথাযথভাবে আদায় করি তো আল্লাহ্র সাথে আমার সম্পর্ক ভালো থাকবে। আমি আল্লাহ্র দরবারে দুআ করব, যিকির করব, কুরআন তিলাওয়াত শিখব, তিলাওয়াত করব। লম্বা সময়ের দরকার নেই। আমরা মাদরাসার ছাত্রদেরকে বলি, তোমরা কমপক্ষে তিন পারা করে তিলাওয়াত কর। আপনাদেরকে বলব, আপনি দৈনিক এক পারার চার ভাগের এক ভাগ তিলাওয়াত করবেন। এক পৃষ্ঠা করে তিলাওয়াত করবেন।
ইনসাফের সাথে কি বলবেন- আপনাদের পড়াশুনার জন্য বেশি গভীরতা দরকার, না আমাদের পড়াশুনার জন্য? ধারণা নেই আপনাদের- বলবেন কীভাবে। আমাদের যে পড়াশুনা- ইলমে ওহী, এটা অনেক বিস্তৃত, অনেক গভীর। এটার জন্য একাগ্রতা বেশি দরকার। এটা আপনাদের ধারণা থাকবে না। এজন্য আমি বলে দিলাম; আশা করি বিশ্বাস করবেন। আমরা মনে করি, আমরা যতই মেহনত করি, যতই সময় ও শ্রম ব্যয় করি, যদি আমি কুরআন তিলাওয়াত ঠিকমত না করি, যিকির-দুআ না করি, ফরয-সুন্নতের পাশাপাশি দুই-চার রাকাত নফল নামায না পড়ি, একটু আল্লাহ্র দরবারে মুনাজাত না করি, দু-চার ফোঁটা চোখের পানি না ফেলি তাহলে আমরা যতই মেহনত করব ইলমের লাইনে অগ্রসর হতে পারব না। আপনি বলবেন, ব্যস্ততার কারণে পারি না। ব্যস্ততা তো আমাদের বেশি। কারণ আমাদের এই বিভাগটা সময়ের দাবি রাখে। একাগ্রতার বেশি দাবি করে। কিন্তু ওটাতে বরকত আসবে কোত্থেকে? এই দুআর মাধ্যমে, যিকিরের মাধ্যমে। এজন্য যারা স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটির ছাত্র তারাও নিজের লাইনে অগ্রসর হওয়ার জন্য, ভালো ডাক্তার বনার জন্য, ভালো ইঞ্জিনিয়ার বনার জন্য ভালো নামাযী হতে হবে। তিলাওয়াত শিখে, তিলাওয়াত করতে হবে দৈনিক; কম করেন আর বেশি করেন। যিকির, দুআ, দুই-চার রাকাত নফল নামায পড়া। সালাতুল হাজত একটা নামায আছে, হাজতের নামায। মানে আমার যা প্রয়োজন, নামায পড়ে আল্লাহর কাছে তা চাওয়া। পরীক্ষার জন্য যাচ্ছি, ভালো ফলাফলের জন্য দুই রাকাত নামায পড়ে হলে যাব। একটু মুনাজাত করে হলে ঢুকব।
যখন আমার মধ্যে এই অনুভূতি আসবে, আমি যে লাইনে আছি এই লাইন গলত লাইন নাকি সহীহ লাইন। তখন আমার হিম্মত বাড়বে কি বাড়বে না? হিম্মত বাড়বে। যখন আমি আমার লাইনে থেকে আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক মজবুত করব, আমার হিম্মত বাড়বে। একজন মাদরাসার ছাত্র আল্লাহর ন্তুষ্টি চাচ্ছে, আমিও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি চাচ্ছি। তাহলে আমার হিম্মত বাড়বে কি বাড়বে না? বাড়বে। আমি কখনো হীনম্মন্যতার শিকার হব না। এজন্য এই নিয়ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাথে সাথে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখা। সম্পর্কের মাধ্যম বললাম- ইবাদত-বন্দেগী, যিকির, দুআ এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
কিসের থেকে বাঁচা? গুনাহ থেকে বাঁচা। গুনাহ সবকিছু বরবাদ করে দেয়। মাদরাসার তালিবে ইলম হোক আর স্কুলের ছাত্র, যে গুনাহতে লিপ্ত হবে সে আর বরকত পাবে না। জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলেন, মাদরাসার পড়াশুনার কথা বলেন, গুনাহ সব ধরনের পড়াশুনার বরকত নষ্ট করে দেয়। নূর নষ্ট করে দেয়। দেখেন না লেখা থাকে- আলোকিত মানুষ চাই। আলোকিত মানুষ চাইতে হলে, আলোর সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে হবে। আলো সৃষ্টি করেছেন কে? আল্লাহ। وَ جَعَلَ الظُّلُمٰتِ وَ النُّوْرَ (তিনি সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো)। আলোকিত মানুষ হয়ে যাবে- আলোর স্রষ্টাকে না চিনে! আলোদানকারীর উপর ঈমান না এনে! তাঁর আনুগত্য স্বীকার না করে? অসম্ভব!
যাই হোক, আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বস্তুত যে চায় যে, নিজের খালিক ও মালিক, নিজের রব ও মা‘বুদ, যিনি তাকে হাজারো নিআমত দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন, দয়া ও করুণায় ঘিরে রেখেছেন, যে চায় তাঁর শোকর গুজার বান্দা হবে, তাঁর অবাধ্য বান্দা হবে না, তাঁর বিদ্রোহী হবে না, তার জন্য আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করা এবং সেই সম্পর্কের উপর অটল-অবিচল থাকা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই। সে মাদরাসার তালিবে ইলম হোক বা স্কুলের ছাত্র; সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জরুরি।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, তাআল্লুক মাআল্লাহ যেটা, সেটার জন্য সবচেয়ে জরুরি হল ঈমান শেখা। আজ ঈমান শেখার বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি নেই। ঈমান শেখার অর্থ কী? ঈমান শেখার অর্থ হল-
১. আমাদেরকে ইসলামী আকায়েদ শিখতে হবে এবং মনেপ্রাণে সেগুলোর বিশ্বাস ধারণ করতে হবে।
২. কী কী চিন্তা ও মতবাদ এবং কী কী কথা ও কর্ম ইসলামী আকায়েদের সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলো জানতে হবে। অর্থাৎ যেসব কারণে ঈমান বিলুপ্ত হয়ে যায় সেগুলোর ইলম হাসিল করতে হবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৩. শুআবুল ঈমান, ঈমানের শাখা-প্রশাখা কী কী সেগুলো জানতে হবে।
৪. ইসলাম যেসকল মৌলিক বিধিবিধান শিক্ষা দিয়েছে এবং যে সকল ফরয ও হুকুক (আল্লাহ ও সৃষ্টির হকসমূহ) শিক্ষা দিয়েছে সেগুলো জানতে হবে এবং সেগুলো পালনের চেষ্টা করতে হবে।
৫. হালাল-হারামের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৬. যেসব কারণে ঈমান দুর্বল হয়ে যায় সেগুলো জানতে হবে এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এজন্য জানতে হবে, কোন্ কোন্ কাজ গুনাহ ও অন্যায়; আল্লাহ তাআলার নাফরমানী এবং আখেরাতে আযাবের কারণ।
৭. কুরআনে উল্লেখিত মুমিনদের চরিত্র ও গুণাবলি জানতে হবে এবং সেই গুণে গুণান্বিত হওয়ার ও সেই চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
৮. কাফির, ফাসিক ও মুনাফিকদের মন্দ কাজ ও মন্দ অভ্যাস, যেগুলোর বিষয়ে কুরআন মাজীদে সতর্ক করা হয়েছে সেগুলো জানতে হবে এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৯. যেসব আমলের কারণে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং ঈমান তাজা হয় ও মজবুত হয় সেগুলোর বিষয়ে গুরুত্ববান থাকতে হবে।
১০. ঈমান রক্ষা ও ঈমান নবায়নের দ্বীনী পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে জেনে সেগুলো নিজের জীবনে গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে।
এমনিতে তো ঈমান শেখা, ঈমান রক্ষা করার বিষয়ে সচেতন থাকা সবার উপরই ফরয। কিন্তু যারা এমন পরিবেশে থাকে, যেখানে ঈমানের কদর নেই, যেখানে পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে পাঠ্যব্যবস্থা সবকিছুতেই ঈমানের প্রতিকূল পরিবেশের যেন আধিপত্য, সেরকম পরিবেশে যারা থাকে তাদের তো নিজের ঈমানের বিষয়ে যত্নবান থাকা আরো বেশি জরুরি।
জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ভালো জিনিস এবং প্রয়োজনীয়ও বটে, কিন্তু সেগুলোর পাঠ্যক্রম রচনা, পাঠ্যব্যবস্থা নির্র্ধারণ এবং সেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিশ্বব্যাপী এমন লোকদের আধিপত্য, যারা জগতের জ্ঞান ও বিদ্যাকে জগতের স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তৎপর। তাদের সর্বনিম্ন অপরাধ হল-
یَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ هُمْ عَنِ الْاٰخِرَةِ هُمْ غٰفِلُوْنَ
তারা পার্থিব জীবনের প্রকাশ্য দিকটাই জানে, আর আখেরাত সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ গাফেল। -সূরা রূম (৩০) : ৭
یَعْرِفُوْنَ نِعْمَتَ اللهِ ثُمَّ یُنْكِرُوْنَهَا وَ اَكْثَرُهُمُ الْكٰفِرُوْنَ۠
তারা আল্লাহর নিআমতসমূহ চেনে তবুও তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ। -সূরা নাহল (১৬) : ৮৩
আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বিষয়বস্তু যেটাই হোক উপস্থাপনার এমন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে যে, অবচেতনেই ছাত্রের মন-মস্তিষ্ক থেকে ইসলাম ও শাআয়েরে ইসলামের গুরুত্ব ও মর্যাদা কমে যায়। এছাড়া সুস্পষ্ট বাতিল এবং বেঈমানী কথাবার্তাও জায়গায় জায়গায় লিখে দিয়েছে। এজন্য কোনো ছাত্র যদি দ্বীন ও শরীয়ত এবং ঈমান ও আমল শেখার বিষয়ে যত্নবান না হয় এবং সময়ে সময়ে নেককারদের ছোহবত অবলম্বন করে ঈমানী মানস গঠন না করে তাহলে এমন পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যব্যবস্থায় পড়াশোনা করে, এমন পরিবেশে অবস্থান করে নিজের ঈমান কীভাবে রক্ষা করবে?
তো আপনারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখুন। দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে বাতিল ও আপত্তিকর বিষয়বস্তু যেসব বইয়ে আছে এবং যেসব বই ঈমান বিরোধী চিন্তা-চেতনা থেকে রচিত, সেগুলো হাতে নেওয়ার আগে আপনারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। বলবেন, আয় আল্লাহ! আমরা তোমার মুমিন বান্দা। সব ধরনের কুফুর, নিফাক এবং সব রকম বাতিল ও আপত্তিকর বিষয় থেকে আমরা তোমার দরবারে নিজেদের নিঃসম্পর্ক ঘোষণা করছি। আপনাদের অভিভাবক এবং আপনাদের শিক্ষক সবারই এই কাজ করা উচিত। বরং স্কুল-কলেজের ছাত্র, তাদের অভিভাবক এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলগণের কর্তব্য হল, হিম্মত করে সরকারের কাছ থেকে এই দাবি আদায় করে নেওয়া যে, তারা যেন পাঠ্যপুস্তকগুলো মুহাক্কিক ও আহলে হক উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পাদনা করিয়ে নেন এবং ফরযে আইন ইলমকে পাঠ্যক্রমের বাধ্যতামূলক অংশ সাব্যস্ত করেন।
আমাদের জানা উচিত যে, ঈমান সবার আগে, সবকিছুর আগে। সেটাই তো মুমিনের জীবন, সেটাই নূর এবং হেদায়েত। এইজন্য আমাদের জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখা এমনভাবে যেন না হয় যে, আমাদের ঈমানের দৌলত আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, আমাদের ¯্রষ্টা থেকে আমাদের সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। যদি আমরা এমন করি তাহলে এর চেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ততা আর কিছু হতে পারে না।
আমি এখন হাদীসটা বলি, এরপর কথা শেষ করে দিব।
কী বলেছিলাম, হাদীসের প্রথম শব্দটা কী?
‘আরবাউন’ তাই না? হাদীসটি-
أَرْبَعٌ إِذَا كُن فِيكَ فَلَا عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنَ الدنْيَا: حِفْظُ أَمَانَةٍ، وَصِدْقُ حَدِيثٍ، وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ، وَعِفةٌ فِي طُعْمَةٍ.
আপনি বাংলায় লিখে ফেলতে পারেন এই হাদীস। আরবীর উচ্চারণ বাংলায় হয় না; এজন্য কেউ কুরআনকে কখনো বাংলা উচ্চারণে লিখবেন না। বাংলা উচ্চারণ বা ইংরেজী উচ্চারণে লিখবেন না এবং বাংলা উচ্চারণ বা ইংরেজী উচ্চারণে পড়বেনও না কখনো। শিখবেন। ا ب ت ث থেকে শেখেন। কারণ, অনেক অক্ষর আছে, বাংলায় তার কোনো প্রতিউচ্চারণ নেই। আছে? ع বাংলায় নাই। ق বাংলায় নাই। ض বাংলায় নাই। অনেক অক্ষর বাংলায় বিলকুল নাই। কিছু অক্ষর আছে এমন বাংলায় যার কাছাকাছি অক্ষর আছে। আর কিছু আছে হুবহু। যাইহোক, বলছিলাম, কুরআন অন্য ভাষায় লিখবেনও না। পড়বেনও না। কিন্তু অন্যান্য বিষয় ছোটখাটো জিনিস বাংলা উচ্চারণে লিখে রাখলে আশা করি গুনাহ হবে না।
আরবাউন ইযা কুন্না ফী-কা...
أَرْبَعٌ إِذَا كُنّ فِيكَ فَلَا عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنَ الدُّنْيَا: حِفْظُ أَمَانَةٍ، وَصِدْقُ حَدِيثٍ، وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ، وَعِفّةٌ فِي طُعْمَةٍ.
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, চারটা সিফাত, চারটা গুণ যদি তোমার মধ্যে থাকে, তাহলে কী আছে, কী নেই এটা নিয়ে আর পেরেশান হওয়ার দরকার নেই।
দুনিয়ার কী পেলে আর কী পেলে না- পেরেশান হওয়ার দরকার নেই। চার গুণ পেয়ে গেছ; দুনিয়ার আর কিছু না পেলেও সবই আছে তোমার। চারটা জিনিস-
১. ছিদ্কু হাদীসিন- সত্য বলা; সত্য কথা বলব, মিথ্যা বলব না।
২. হিফ্যু আমানাতিন- আমানত রক্ষা করা। খিয়ানত না করা। কোনো ধরনের ভেজাল, কোনো ধরনের দুর্নীতিতে না জড়ানো। অন্যের হক নষ্ট না করা। নিজের দায়িত্বে, নিজের ডিউটিতে কোনো ফাঁকি না দেওয়া। বিষয়টা কিন্তু অনেক ব্যাপক। আজকে এতটুকুই বললাম। হিফ্যু আমানাতিন-আমানত রক্ষা করা। কোনো প্রকার খিয়ানত না করা।
৩. হুস্নু খালীকাতিন- আখলাক-চরিত্র সুন্দর এবং ব্যবহার সুন্দর হওয়া। চরিত্র পবিত্র হওয়া, ভালো হওয়া। মানুষের সাথে ব্যবহার সুন্দর হওয়া। এটাকে বলে হুস্নু খালীকাতিন। এটা তৃতীয় বিষয়।
৪. ইফ্ফাতুন ফী তু‘মাতিন- খাবার হালাল হওয়া। রিযিকটা হালাল হতে হবে।
চারটা বিষয় হল : সত্য বলা, আমানত রক্ষা করা, স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার ভালো হওয়া, আর রিযিক হালাল হওয়া।
এই চার গুণ থাকলেই চলবে। এটা কি শুধু মাদরাসার ছাত্রদের জন্য? না। সবার জন্য এই চার গুণ। একজন মুমিন বান্দার মধ্যে এই চার গুণ থাকতেই হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সিফাতগুলো হাসিল করার তাওফীক নসিব করেন- আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين
[বয়ানটি মুসাজ্জিলা থেকে পত্রস্থ করেছেন অলী আমীন মুহাম্মাদ খায়রুল বাশার, সম্পাদনার সময় হুজুর এতে কিছু জরুরি বিষয় সংযোজনও করে দিয়েছেন। -বিভাগীয় সম্পাদক]