আমাদের কাছাকাছি আসতে হবে কর্মে, বিশ্বাসে, মানসিকতায়
[বিগত ১৯ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৯/৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর হযরতপুর প্রাঙ্গণে নবনির্মিত দাওয়াহ ভবনে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্নকারীদের নিয়ে দিনব্যাপী একটি দ্বীনশিক্ষা মজলিস। ঐ মজলিসে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি আলোচনার পাশাপাশি ছিল কুরআনে কারীমের মশ্ক ও নামাযের মশ্ক। এই মজলিসে বাদ মাগরিব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর সম্মানিত মুদীর হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। তিনি উপস্থিত ছাত্রদের অনেক প্রশ্নেরও জবাব দেন। তাঁর মূল্যবান বয়ান ও প্রশ্নোত্তর এখানে আলকাউসারের পাঠকবৃন্দের জন্য উপস্থাপিত হল। একই ধরনের আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় মারকাযের মিরপুর প্রাঙ্গণেও ১৫ জুমাদাল আখিরাহ মোতাবেক ৪ মার্চ ২০১৮। ঐ মজলিসেও তিনি উপস্থিত ছাত্র ও সুধীবৃন্দের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তারও কিছু অংশ এখানে সংযোজিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের যথাযথভাবে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন।]
হামদ ও ছানার পর
আজকের এ আয়োজনটা মূলত ছাত্রদেরকে লক্ষ করে। এ ছাত্ররা জীবনের একটা স্তর ইতিমধ্যে অতিক্রম করেছে। আমাদের দেশের হিসেবে মাধ্যমিক। পরিক্ষাটার নামও এসএসসি- সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট। অনেক দেশে অবশ্য হায়ার সেকেন্ডারিসহ সেকেন্ডারি ধরা হয়। আমরা যেটাকে বলি, ইন্টারমিডিয়েট বা উচ্চমাধ্যমিক। দুটো স্তরই থাকে। সেকেন্ডারি স্তরের পরে ইউনিভার্সিটি স্তরটা শুরু হয়। এমনিভাবে মানুষের বয়সের একটা স্তর থাকে, শিশু বয়স; একেবারে কোলে কোলে বড় হয়। এরপরে কৈশর; দৌড়ঝাঁপ দিয়ে, লাফ-ফাল দিয়ে বড় হয়। আরেকটা বয়স থাকে তখন চলার বয়স শুরু হয়। ওই স্তরটার সমাপ্তি ঘটে মাধ্যমিক স্তরে এসে।
কাজেই আমরা শুধু একটা পরীক্ষাই দেইনি বরং আমরা জীবনের একটা দিকের পরিপূর্ণতায় পৌঁছেছি। গাছে যেমন ফল ধরলে কিছু ঝরে ঝরে পড়ে যায়। এই যে এখন আমের মুকুল এসেছে। কিছু ঝরে নষ্ট হয়ে যায়। কিছু টিকে থাকে। এরপরে যখন একটু বড় হয়ে ওঠে, তুফান আসলে কিছু পড়ে যায়। মানুষের জীবনটাও এরকম। শিশুরাও এরকম ঝরে যায়। একটা স্তরে গিয়ে আমটা বড় হয়। তখন চাইলে কেউ কাঁচাও খেতে পারে। কিন্তু পাকার পরেই সাধারণত খায়। ওই পাকাটাই ইউনিভার্সিটি লেভেল। আর কাঁচা থাকা একটু বড় হওয়া সেটা হল এই বর্তমান লেভেলটা। এ স্তরেও ফলটা উপকারী হয়, যদি ফলটা খুব বেশি টক না হয়। মানুষ ওটা কাঁচাও খেতে পারে। আর যদি ফলটা ঠিকমত পাকতে পারে, তাহলে সে সবাইকে খুশি করে। মানুষের জীবনটাও এরকম। এভাবেই একটা স্তর থেকে আরেকটা স্তর তাকে অতিক্রম করতে হয়। আমাদের শরীয়তেও ঠিক একই অবস্থা। আমরা যে আল্লাহর বান্দা, আমরা যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত, সেখানেও মানুষকে এভাবেই একটার পর একটা স্তরে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমি আপনি যখন ছোট ছিলাম, তখন ছিলাম দায়-দায়িত্বমুক্ত। অন্যের কাঁধে আমাদের সব দায়-দায়িত্ব। তখন নির্দেশ- মা-বাবাসহ অন্যান্য যারা আছে তারা খাইয়ে দিতে হবে, অন্যান্য সবকিছু সাফ করতে হবে। বদলিয়ে দিতে হবে। গোসল করিয়ে দিতে হবে। সব অন্যের কাজ।
আরেকটু বড় যখন হয়, যখন অবুঝ থাকে, কিন্তু দৌড়ঝাঁপ দেয়, পাঁচ-সাত-নয় বছর তখনও অন্যদের দায়িত্ব। কিন্তু যখন বুঝ হয়ে ওঠে, দশ -বার বছর হয়ে গেছে তখন একটা নির্দেশ শরীয়তের পক্ষ হতে আসে। হাঁ, নামায পড়া শুরু করো। আল্লাহকে চেনা এবং বুঝা শুরু করো। আর যখন শাবাবের বয়স আসে তখন সে একটা স্পেশাল স্তরে পদার্পণ করে। শাবাব মানে যৌবনের বয়স। পনের-ষোল-সতের থেকে যৌবনের বয়স। কিছু নতুন নতুন শব্দ আছে। তরুণ, তারুণ্য একটা শব্দ আছে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশেও তারুণ্য থাকে অনেকের। বলে আমি তরুণ। হাঁ, তারুণ্য মরণ পর্যন্ত থাকা ভালো। কাজের দিক থেকে। কিন্তু তরুণ অর্থ যদি হয় তুমি যাচ্ছেতাই করবে, সে সুযোগ শরীয়ত রেখেছে বুঝ-বুদ্ধি হওয়ার আগ পর্যন্ত। যখন বুঝ হয়ে যাবে তখন যৌবনের বয়স শুরু হল। ইসলামের ভাষায় এটাকে ‘শাবাব’ বলা হয়। শাবাব মানে যৌবন। এ যুবক বয়সে যখন মানুষ উপনীত হয়, তখন যেভাবে তার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, দাড়ি-মোচ গজায়, আরো অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আসে, নতুন নতুন চিন্তা আসে, সেভাবে তার দায়-দায়িত্বের মধ্যেও নতুনত্ব আসে।
পড়াশোনার চর্চাও অনেকটা এরকম। পড়াশোনার স্তর ঠিক এখন মাধ্যমিক স্তর অতিক্রমের পরে উচ্চস্তর। দু’বছর পর উচ্চমাধ্যমিকে গেলেই জীবনের একটা বিষয়কে বাছাই করে নেওয়া লাগে। আমাদের এভাবে একত্রিত হওয়া এভাবে বসার উদ্দেশ্যটা হল সবাই সবাইকে বুঝা। সবাই সবার কাছে আসা। কাছাকাছি হয়ে যাওয়া। মুসলমান বলতেই একগোষ্ঠী। এক গোষ্ঠী না? সবার বাবার নাম কী? আদম। আদম আলাইহিস সালাম থেকেই তো আমার আপনার সবার গোষ্ঠী এসেছে। সবার মা? হাওয়া আলাইহাস সালাম। এটা একটা মিল। দ্বিতীয় মিল হল, আমাদের সকলের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তাহলে আমি মাদরাসায় পড়ি আর কলেজে পড়ি বা লেখাপড়া নাই করি, শিল্প কারখানায় চাকরি করি, কৃষি কাজ করি, যেটাই করি- আমি মুসলিম। এখানে আমরা ঐক্যবদ্ধ; এটি সবার একটা যোগসূত্র। সবাই এক হয়ে যাওয়ার একটা জায়গা। এক হয়ে যাওয়া মানে শুধু শব্দে এক হওয়া নয়; বরং যে যোগসূত্র দিয়ে আমি আপনি মিলে আছি সেগুলোর দিক থেকে এক হওয়া। সে যোগসূত্রগুলোর চাহিদা কী? যেমন আমরা সবাই একটা কালিমা পড়ি, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। আমার আপনার কালিমার মাঝে কি কোনো বেশকম আছে? না। সবার কালিমা এক, অভিন্ন। টাকা পয়সা যখন হয়, তো হজে¦ যায়। হজে¦ যেতে জেনারেল শিক্ষিত, স্কুলপড়ুয়া, জমিদার লোক আর মাদরাসার লোকের কি ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম আছে, না এক নিয়ম? এক নিয়মে জুমার দিন আমরা মসজিদে যাই নামায পড়তে, নামাযের মধ্যে কোনো ভিন্ন নিয়ম আছে? নেই। আচ্ছা, অফিসে তো বস এক চেয়ারে বসে, আর তার কর্মচারী একটা সাধারণ চেয়ারে বসে। কিন্তু নামাযে? বস আর কর্মচারীর কি ভিন্ন ভিন্ন জায়গা আছে? নেই। আল্লার দরবারে সবাই সমান।
ইসলাম মানুষকে এগুলোই শেখায়। সাম্য, সৌন্দর্য এবং শান্তিপূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থান। তুমি জীবনের যে স্তরেই থাক, যে পেশাই তুমি অবলম্বন কর, সবাই সবাইকে সম্মান করবে। সকলেই সকলের ইজ্জত বুঝবে, মূল্যায়ন করবে এবং সবাই কাছাকাছি থাকবে। অবস্থানগত দিক থেকে নিকটে না থাকলেও মনের দিক থেকে কাছাকাছি থাকবে। সবাই যখন মনের দিক থেকে কাছাকাছি থাকবে তো একে অপরের থেকে উপকার নেওয়ার সুযোগ হবে।
আপনি এখন মেট্রিক পড়েছেন, সামনে আরো পড়বেন। আল্লাহ তাআলা নিলে আরো বেশি পড়বেন। আপনি একসময় হয়ত ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবেন, মাদরাসার লোক আপনার কাছে যাবে। আমি একটি বিল্ডিং বানাব, মসজিদ বানাব, আপনি মসজিদটার একটু ডিজাইন করে দিন, এটা দ্বীনের কাজ। মাদরাসা-মসজিদের উপকারে আসলেন কি আসলেন না? আসলেন।
এই যে, মসজিদ বানাতে যিনি টাকা দিলেন, মসজিদে যিনি ইমামতি করবেন, মসজিদে যিনি আযান দিবেন, তারা যেমন সওয়াব পাবেন যিনি এই মসজিদের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করবেন তিনি সওয়াব পাবেন না? নিশ্চয়ই পাবেন। শুধু উদ্দেশ্যটা ভালো হতে হবে। উদ্দেশ্যটা ভালো হতে হবে যে, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, মানুষের সেবা করার জন্য। মানুষ যেন ভুল বিল্ডিং বানিয়ে অর্থ নষ্ট না করে, ভেংগে না পড়ে। মানুষের যেন টাকা নষ্ট না হয়, ক্ষতি না হয়- এ মানসিকতা থাকতে হবে।
আমি চিকিৎসা বিষয়ে পড়তে চাচ্ছি, এখন তো এসব বিষয়ে পড়ার কথা বেশি বলে না। আগে ছেলেরা বলত, আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, আমি ডাক্তার হব, এখন আর এগুলো বলে না। এখন বলে, আমি এমবিএ করব। বিবিএ করব। তাহলে একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে যাবে। হোক! এমবিএ, বিবিএ করলেও সমস্যা না। এমবিএ করল, কোনো প্রতিষ্ঠানের এইচআর সেকশনে সে যোগ দিল, ওই প্রতিষ্ঠান হয়ত কোনো সেবা দেবে, না হয় কোনো প্রোডাক্ট তৈরি করবে, সে পণ্য দিয়ে মানুষ উপকার পাবে। সে সেবা দিয়ে মানুষ উপকার পাবে। যদি ওটা নাজায়েয কিছু না হয়, তার উদ্দেশ্য যদি ভালো থাকে তো সওয়াব পাবে।
এখন আমি যদি আলেমদের কাছাকাছি না যাই তাহলে তো আমি এ বিষয়টা জানতে পারব না। সারা জীবন কাজ করে গেলাম শুধু দুনিয়ার ক’টা পয়সা পেলাম। শুধু বেতন পেলাম, কিন্তু এটা যে আখেরাতেও কাজ দিতে পারে তা জানলাম না। সৎ উদ্দেশ্য কীভাবে হবে তাও হাসিল করতে পারলাম না।
আর যদি আমরা পরস্পর কাছাকাছি থাকি, তাহলে আপনার ভালোটা আমি বুঝব, আমার ভালোটা আপনি বুঝবেন। এজন্য মুসলমান হিসেবে সবাই কাছাকাছি আসা- এটা আমাদের দাওয়াত। আমরা এটা বলতে চাই সবাইকে।
এ কাছাকাছি আসার যে দাওয়াতটা দিচ্ছি, আমি গতবারও মেট্রিকের ছেলেদের বলেছিলাম, এটা বলতে হচ্ছে সময়ের প্রয়োজনে। আসলে যদি যথাযথ পদ্ধতি থাকত তাহলে এটা বলার দরকার ছিল না। আমাদের এখানে শিক্ষাপদ্ধতির যে বৈষম্য; শিক্ষাপদ্ধতিতে যে সিলেবাস রাখা হয়েছে তা কোনোক্রমেই যুক্তিসংগত সিলেবাস না। বিশেষত একটা সময় ছিল -আপনারা ইতিহাসে পড়েছেন- এখানে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ছিল। বৃটিশদের শাসন ছিল দু’শ বছরেরও বেশি। তখন তারা তাদের নিয়মের শিক্ষাপদ্ধতি চালু করেছে। এরপরে দেশ দু’ দু’ বার স্বাধীন হয়েছে। একবার পাকিস্তান হয়েছে, আবার পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার যে পদ্ধতি রাখা হয়েছে, তাতে আমাদের একটা ছেলে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ে ফেলে, কিন্তু এমন ব্যবস্থা রাখা হয়নি যে, সে অন্তত আল্লাহ্ নাম শুদ্ধভাবে ভালো করে পড়তে পারে। ধর্মীয় শিক্ষার নামে দু’-একটা বই আছে। কোনো রকম পরীক্ষা দেওয়া হয়ে যায়। এমন কোনো পদ্ধতি রাখা হয়নি, যে পদ্ধতি থেকে সে জানতে পারে যে, একজন মুসলমান হিসেবে তার দিনটা কীভাবে শুরু হবে। এমন পদ্ধতি নেই, যেখান থেকে সে জানবে যে, বেচা-কেনা করতে গেলে সেখানে কোন্টা শুদ্ধ কোন্টা অশুদ্ধ?
সে যখন বাবার সাথে কৃষিকাজে সহায়তা করতে যাবে, সেখানে কোন্টা শুদ্ধ, কোন্টা অশুদ্ধ? সে যখন খাবার কিনবে ওই খাবারের মধ্যে কোন্টা শুদ্ধ, কোনটা অশুদ্ধ; কোনটা হালাল, কোনটা হারাম? সবচেয়ে বড় যে বিষয়, সে যখন তার পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন; বন্ধু-বান্ধবের সাথে তার জীবন যাপন করবে, তখন সেখানে তার কোন্টা করা উচিত, কোন্টা উচিত নয়- এটি সে জানতে পারছে না।
আপনি বলতে পারেন যে, ছেলে তো শিক্ষিতই হচ্ছে, এগুলো না জানলে কী হবে? শিক্ষা-দীক্ষা তো সে হাসিল করছে। বরং মডার্ন শিক্ষা-দীক্ষা হাসিল করছে। যে শিক্ষা দিয়ে আজকের পৃথিবী উন্নতি করে যাচ্ছে, সে শিক্ষাই তো সে হাসিল করছে। অবশ্যই হাঁ, সে শিক্ষিত হচ্ছে। তার বুদ্ধি হচ্ছে। জ্ঞান হচ্ছে। এ শিক্ষা জীবনে কাজ দিবে। সবকিছুই ঠিক; কিন্তু এ শিক্ষাটা যথাযথ উপকারে আসার জন্য এবং শিক্ষাটাকে ভালোভাবে দ্বিগুণ, বহুগুণে কাজে লাগাবার জন্য এ জিনিসগুলো যদি সাথে যোগ হত তাহলে শিক্ষা আরো অনেক বেশি ফলপ্রসূ হত। শিক্ষা বেশি কাজ না করার কারণ এটাই।
আমরা দুআ করি, সামনে আপনাদের লেখাপড়ার সময় পার হবে, আরো বড় হবেন, আরো ভালো পড়বেন এবং ভবিষ্যতে ভালো অফিসার হবেন, সৎ অফিসার হবেন, ভালো ব্যবসায়ী হবেন, সৎ ব্যবসায়ী হবেন, দেশ-বিদেশে যেখানেই চাকরি করবেন, নিজেদের নাম, মা-বাবার নাম, দেশের নাম উজ্জ্বল হবে এবং আখেরাতেও এটার দ্বারা যেন ফায়দা হয় এটাই আমাদের কামনা।
আমরা তা-ই চাই। আপনাদের ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের ভালো আশা। শিক্ষা দিয়ে মানুষ ভালো হতে পারে, ভালো হয়, কিন্তু তারপরও শিক্ষিত লোকদের কারণে বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে কেন? দেশের মধ্যে একটা সংস্থা আছে। যদিও তার নামে অনেক বদনামও আছে। তারপরও দেখুন এ দুদক- দুর্নীতি দমন কমিশন এ পর্যন্ত যাদেরকে ধরেছে, কোনো অশিক্ষিত লোক ধরেছে? না। কোনো কৃষক, শ্রমিক ধরেছে? না! সবাই উচ্চশিক্ষিত। ভালো ভালো শিক্ষিত! তাহলে আপনি কি বলবেন, শিক্ষার দোষ? না। শিক্ষার দোষ নয়। শিক্ষার কমতি। শিক্ষা ছিল কিন্তু সেই শিক্ষার সাথে আরো কিছু জিনিস থাকা দরকার ছিল। ওই যে রেসিপিতে সমস্যা; রেসিপিতে যা যা উপাদান দেওয়ার দরকার ছিল, উপাদান সবগুলো দেওয়া হয়নি। উপাদান কিছু কম থাকার কারণে গোস্ত রান্না করেছে বটে, কিন্তু লবণ কম দেয়ায় ওটা পানসে পানসে থেকে গেছে। নাইলে লবণ বেশি হয়ে গেছে। দামী জিনিস কিন্তু খাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষা হাসিল করেছে ঠিক কিন্তু সেই শিক্ষার সাথে তার আরো কিছু শিক্ষার দরকার ছিল। এ শিক্ষাটা কার্যকর হওয়ার জন্যে, এ শিক্ষাটা তাকে বেশির চে’ বেশি উপকার দেয়ার জন্যে তার আরো কিছুর দরকার ছিল। কিন্তু সেটা সে পায়নি। সিস্টেমের কারণে পায়নি।
আমাদের সমস্যাটা হল, -আপনারা বড় হলে আরো জানবেন, যখন নিজেরাই অনার্স, মাস্টার্স করবেন তখন নিজেরাও ভালো বুঝবেন- শিক্ষার জন্য যে সিলেবাস তৈরি হয়, তার জন্য অনেক খাটুনি হয়। দেশের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিদেশে গিয়ে -অনেক দেশেই যায়- ধারণা এনে তারপরে এখানে শিক্ষানীতি তৈরি হয়। সিলেবাস তৈরি হয়। কিন্তু আসলে শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য তো শুধু বিদেশ দেখলে হবে না। প্রত্যেক জাতি এবং প্রত্যেক দেশের নিজস্ব কৃষ্টিকালচার আছে। যেমন, এখানে আপনারা এসেছেন অনেকের বাপ-চাচা সাথে আছে। আপনার বয়সের কেউ ধরুন ২০-২১ বছর হয়ে গেলে যে সব রাষ্ট্রকে আমরা উন্নত রাষ্ট্র বলি, সেখানে বাবা মা’র সাথে সন্তানদের দেখা হয় না। তারাও উচ্চশিক্ষিত। তারপর? গত বছর পড়েছিলাম বিদেশী একটি পত্রিকায়। এখন আমেরিকাতে মেডিকেলে লাশ দিয়ে দেওয়ার পরিমাণ অনেক হারে বেড়েছে। জীবনের শেষের কথা বলছি। মানুষ তো ছোট বড় সব বয়সেই মরে। বেশিরভাগই বয়স হলে মরে। সেখানে মেডিকেলে লাশ দিয়ে দেওয়া অনেক হারে বেড়েছে। কেউ যদি এ সংবাদের শুধু শিরোনাম পড়ে এবং যদি সে মডার্ন ব্যক্তি হয়, বলবে যে, এ তো ভালো। তারা রিসার্চের জন্য অবদান রাখছে। কিন্তু আপনি যদি খবরের ভেতরের অংশ পড়েন, তো আপনার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। ভেতরে লেখা আছে, কারণ হল, ওখানে সৎকার করতে যত টাকা খরচ হয়, ছেলেমেয়েরা মা-বাবার জন্য অত টাকা খরচ করতে চায় না। পাঁচ হাজার ডলার, দশ হাজার ডলার খরচ হয়ে যাবে তা তারা মেনে নিতে পারে না। এখানে যে রকম দাফন করতে অল্প টাকা খরচ হয়, এত অল্প টাকায় ওখানে পারে না। কয়েক হাজার ডলার খচর হয় সৎকারের জন্যে। আমাদের ভাষায় দাফন করার জন্যে। ছেলে-মেয়ে তো মৃত্যুর আগে এমনিতেই বয়স্ক মা বাবার কাছে ধারে থাকে না। কোথায় থাকে? মা-বাবারা তো যখন চাকরির বয়স শেষ হয়ে যায় বেশিরভাগ সময়ই নার্সিং হোমে বা ওল্ড কেয়ার হোমে থাকে। বয়স্কদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে থাকে। আর ছেলেমেয়ে বিভিন্ন জাগায় যে যার মত থাকে, চাকরি-বাকরি করে। দু’-এক সময় হসপিটালে এসে দেখে যায়। তারপর যখন মৃত্যু হয়, তাকে হয়ত জানানো হয় ফোনের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে, তোমার বাবা মারা গেছেন। ওরা বলে যে, মেডিকেলে দিয়ে দাও! কেউ কেউ আসে। এসে লাশ নিয়ে সৎকার করে। আবার কেউ কেউ বলে যে, আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি ব্যাংকে, তোমরা সৎকার করিয়ে দাও!
এরা কিন্তু শিক্ষিত জাতি! এবং উন্নত জাতি!! আপনি হয়ত বলবেন, আমাদের জওয়ানদের তো অসুবিধা নেই। বুড়োদের সাথেই না এ আচরণ করা হয়। তাহলে কি এ জওয়ানগুলো বুড়ো হবে না? একসময় তাদের ছেলেমেয়ে হবে না? তারা বুড়ো হবে না? এখন তারা তাদের মা-বাবার সাথে যে আচরণ করছে, তাদের সাথে তখন সে আচরণ হবে না?
শিক্ষা আছে, তবে শিক্ষার মধ্যে কমতি আছে। শিক্ষাতে কিছু কিছু জিনিস যদি যোগ করা হয়, তাহলে এ শিক্ষা বহুগুণ কাজ দেবে।
আমরা চাই মুসলমানের সন্তানেরা শিক্ষিত হোক। শিক্ষিত সমাজ হোক। এটা একটা লম্বা বিষয়। আমি শুধু সংক্ষেপে বলছি যে, কাছাকাছি চলে আসা। শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়া হল, কিছু জিনিস বাকি রয়ে গেল, সেগুলো যেহেতু আমাদের স্কুলে পড়া হয়নি, সামনেও হয়ত আর পড়া হবে না। সেগুলো আমাদের শিখতে হবে তাই শিখব। আলেমদের কাছাকাছি যাব। আল্লাহর কুরআন শিখতে চেষ্টা করব। আমাদের সামাজিক জীবনটা কেমন হওয়া চাই তা শিখতে চেষ্টা করব। আমাদের জীবনটা যেন অর্থবহ হয়। যেন আমরা পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে সুন্দর হয়ে থাকতে পারি। কেউ যেন এরকম না হয় যে, আমাকে আমার পাওয়ারের কারণে ভয় করছে। ক্ষমতাবান লোকেরা কেউ গ্রামে থাকে, কেউ শহরে থাকে। যেখানের ক্ষমতাই বলেন, এদের মধ্যে দু’ধরনের লোক দেখবেন, সবাইকে মানুষ ভয় করে। কিন্তু কাউকে ভয় করে ইজ্জত সম্মান করে আর কাউকে ভয় করে মানে হল তাকে বাঘের মত ভয় করে। দেখলে পালায়। এ আমাকে মারবে- এ কারণে ভয় করে। আরেকজনকে তাঁর মর্যাদার কারণে ভয় করে। আমরা এমনভাবে জীবনটাকে গড়ব, যেন আমার শিক্ষা, আমার ক্ষমতা, আমার পাওয়ার, আমার চলা-ফেরা সব দেখে সমাজের সবাই জানে, এ ছেলেটা সৎ ও ভালো। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, এ কারো সাথে ঝগড়া করে না। এ মানুষকে দেখলে সালাম দেয়। এ মুরুব্বীদেরকে ইজ্জত করে চলে। এ মারামারি করে না। একে কোনো সময়ই কারো জিনিসে বিনা অনুমতিতে হাত দিতে দেখা যায়নি। এ ছেলেটাকে কিন্তু কোনো সময়ই দেখিনি সিগারেট টানতে। এটা যেন মানুষের মুখে মুখে থাকে। যেগুলো স্বীকৃত ভালো কাজ সেগুলো যেন আমরা করি। যেগুলো স্বীকৃত মন্দ সেগুলো থেকে দূরে থাকি। আজকাল তো আরো খারাপ জিনিসের সয়লাব হয়ে গেছে- মাদক। বলা লাগবে না, আপনারা নিজেরাই বোঝেন। গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সেগুলোর তো নামও ধরা যাবে না। ধূমপানের অভ্যাসও যদি কারো থেকে থাকে, আস্তে আস্তে তা থেকে দূরে সরে যাওয়া। নিজের মধ্যে গুনাহের চাপ সৃষ্টি না করা। এভাবে আমরা ভালো কাজগুলো করব। মন্দ কাজগুলো থেকে বাঁচবো এবং কাছাকাছি থাকব।
আপনারা জানেন, এখানে প্রতি মাসের প্রথম সোমবার মাহফিল হয়। আপনাদের জন্য হয়, সেখানে আসার চেষ্টা করব। ওটা ছাড়াও আমাদের যে মাওলানা সাহেবরা এখানে আছেন- ছাত্ররা, তারা আপনাদের বড় ভায়ের মত। এরা গ্রাজুয়েট লেভেল শেষ করে এখানে পড়তে এসেছে। এখন হাদীসের উপর, ফিক্হের উপর, দাওয়াহ্র উপরে হায়ার স্টাডি করছে। উপরের পড়া এরা পড়ছে। তো এরা এখন আপনাদের খেদমতে আছে। এরা সারা বছর আপনাদের খেদমত করতে প্রস্তুত থাকবে। আপনারা আসলে দ্বীনী কথা শিখিয়ে দেওয়া, কুরআন শিখিয়ে দেওয়া, হাদীস শিখিয়ে দেওয়া এবং আপনাদের প্রয়োজনীয় মাশওয়ারা দেওয়া, পরামর্শ দেওয়া- এগুলো আপনারা ইনশাআল্লাহ নিতে পারবেন এখান থেকে। আমি লম্বা করতে চাই না। রাত হয়ে গেছে। এখন আপনাদের প্রশ্নগুলোর জবাব দিচ্ছি।
প্রশ্নোত্তর পর্ব
প্রশ্ন : ভিডিও ওয়াজ ও গজল শোনা অথবা দেখা কি জায়েয আছে? যদি জায়েয থাকে তাহলে মসজিদের ভেতরে কি দেখা জায়েয আছে?
উত্তর : মসজিদের ভেতরে এগুলো না চালানো উচিত। আপনি আপনার ঘরে যদি দেখেন এবং সেখানে যদি ছবিগুলো পুরুষের হয় তা হতে পারে। তবে বাছাই করে শুনতে হবে। ওয়াজ অনেকেই করে। ডাক্তার যে রকম বাছাই করে নিতে হয়, ইঞ্জিনিয়ার যে রকম বাছাই করে নিতে হয় ওয়াজও এরকম বাছাই করে শুনতে হবে। নির্ভরযোগ্য আলেমদের সাথে মাশওয়ারা করে নেব; কার ওয়াজ শুনব, কার ওয়াজ শুনব না।
প্রশ্ন : হুজুর! আমার ছোট বেলায় শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল। তখন আমার আব্বা নিয়ত করেছেন, যদি আমার ছেলে সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে মাদরাসায় পড়াবেন। আমি বড় হয়ে যাই। কিন্তু আমার আব্বা আর আমাকে মাদরাসায় পড়াননি। এখন চিন্তা করছি কী করা উচিত?
উত্তর : হাঁ, মাদরাসায় কীভাবে পড়বেন, তা জেনে নিবেন। মাদরাসায় ভর্তি না হলেও হবে। মাদরাসায় যা পড়ানো হয় ওগুলোর কিছু অংশ পড়লে হবে। আবার বলছি, মাদরাসায় যেমন কুরআন শেখানো হয়, হাদীস শেখানো হয়, ওগুলোর এক পার্সেন্ট শিখুন। আধা পার্সেন্ট শিখুন। ইচ্ছা রাখুন, আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে থাকুন। কিছু কিছু করে শিখবেন ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন : আমরা যারা স্কুলে পড়ি, আমাদেরকে বাধ্য হয়ে মেয়েদের সঙ্গে একসাথে ক্লাশ করতে হয়। আমরা কীভাবে চোখের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকব?
উত্তর : এটাও একটা বড় বিপদ। যেটা একটু আগে বললাম যে, শিক্ষা আলো ছাড়ায়। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত পথ দেখায়। কিন্তু সে শিক্ষার মধ্যে যদি পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকে? সে শিক্ষার মধ্যে যদি কমতি থাকে? যথাযথ আলো আর ছড়াতে পারে না। অনেক সময় উল্টো বিপদের কারণ হয়। রাষ্ট্রের কত মাথাব্যাথা! ইভটিজিং-এর জন্য আইন করে। আইন করতে করতে শেষ। পেপার পত্রিকায় এ রিপোর্ট, সে রিপোর্ট ক’দিন হৈচৈ হয়। শেষ হয়ে যায়। মেয়েরা তো পড়বে সেটা তাদের অধিকার। কিন্তু তার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা কেন করা হয় না? সবাই একসাথে পড়ে। একসাথে পড়া হয়। ঝামেলা হয়। এগুলোর জন্য ডান-বামের তরিকা খোঁজ করা হয়। আসলটা খোঁজ করা হয় না। আসল পদ্ধতি হচ্ছে, ছেলে-মেয়েদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়াও। উঠতি বয়স। ছেলের বয়সও উঠতি। মেয়ের বয়সও উঠতি। সেখানে ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। ভুল-ভ্রান্তি থেকে বাঁচার ব্যবস্থা নিতে হবে। ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার পরে গণ্ডগোল করা কেমন? আর এ ছাড়া মেয়েদেরকে অন্যায়ভাবে ডিস্টার্ব করা, সেগুলোও আছে। এখন শুধু শুধু বলা হচ্ছে যে, অধিকার! আজকেও তো আছে- আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমি ঢাকা থেকে আসার সময় ছেলে গাড়িতে রেডিওর খবর ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে কয়েকজন নারী শোনাল যে, কীভাবে নারীর উন্নতি করে ফেলেছে!! নারীর উন্নতি করার প্রসঙ্গে ফুটবল খেলোয়াড়ের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সে বলছে, আমার মা-বাবা বাধা দিয়েছিলো। আমি কিন্তু অগ্রসর হয়ে গেছি। পেরে গেছি। করে ফেলেছি। দেশ নাকি উন্নত হয়ে গেছে। ফুটবল খেলোয়াড় যদি ফুটবল খেলে থাকে এতে নারী জাতির কীভাবে উন্নতি হল? নারী জাতি কীভাবে এর দ্বারা লাভবান হল? যদি বলেন যে, সে টাকা-পয়সা পেয়েছে। লাভবান হয়েছে।
আদৌ লাভবান হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। ফুটবল সে খেলছে। কয়দিন খেলবে? কয়দিন খেলা যায় ফুটবল? চল্লিশ বছর পর্যন্ত তো খেলা যায় না। এক আধ খেলোয়াড় হয়তো চল্লিশ বছর পর্যন্ত খেলে, পুরুষ হলে। মেয়ে খেলোয়াড় হয়তো সে ত্রিশ বছর পর্যন্ত খেলবে। এরপরে তার ক্যারিয়ার কোথায় যাবে? শরীরের গতি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে? সে যদি ভবিষ্যতে মা হয়, যদি আরেকজনের স্ত্রী হয়, কোথায় যাবে তার অবস্থা? সে তো জীবনের উন্নতি ভেবে ফেলেছে যে, এখন আমি খেলছি, আমি তারকা হয়ে গেছি। কিন্তু তারকা হয়ে যখন সে জীবনের আরেকটা ধাপে পৌঁছবে তখন সে বুঝবে। চোখে শুধু অন্ধকারই দেখবে। কেন মা-বাবার কথা শুনিনি! কেন আমি গেলাম ফুটবল খেলতে! কিন্তু বলা হচ্ছে যে, নারীরা উন্নতি করে ফেলছে!! আসলে কীভাবে নারীর উন্নতি হয় সেটাই আমরা ভুলে চলছি। ও পথটাই আমরা দেখাতে চাই। নারীদের শিক্ষা দেব। তাদের মর্যাদা রক্ষা করে শিক্ষা দেব। তাদের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করব। কিন্তু স্বার্থপর মহল ওটা করতে দেয় না। মনে করে যে, মিলে ঝুলে থাকলেই তো সুবিধা। অনেক জায়গায় অনেক শিক্ষকের ব্যাপারেও বহু হাবি-জাবি কথা শোনা যায়। ছাত্রীদের অপমান করার কথা শোনা যায়। এগুলো শুধুই শিক্ষার পদ্ধতিগত দোষের কারণে। শিক্ষা-পদ্ধতিটা যথাযথ না হওয়ার কারণে এগুলো হচ্ছে।
যাই হোক, এখন যেহেতু এই পরিস্থিতিতে আমরা থাকছি। পড়ছি একই প্রতিষ্ঠানে সুতরাং যদ্দূর সম্ভব দৃষ্টির হেফাজত করতে হবে। আমরা নিজেরা নিজেদের পড়া পড়ব। স্কুলে যাব, কলেজে যাব, নিজের পড়া পড়ব। যতটুকু সম্ভব কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা থেকে বিরত থাকব। এভাবেই নিজের দৃষ্টির হেফাজত করার চেষ্টা করতে হবে। দৃষ্টি অবনত রাখা। বইয়ের দিকে রাখা। এভাবে চেষ্টা করতে হবে।
প্রশ্ন : আমার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে অনেকে আছে যারা হিন্দু। কিছু বন্ধু অনেক ঘনিষ্ঠ। তারা অনেক সময় তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে বলে এবং খেতে দেয়। অনেক সময় মাংসও দেয়। না খেলে বা না গেলে তারা অনেক রাগ করে। কষ্ট পায়। জানার বিষয় হল, এ ধরনের আমন্ত্রণে যাওয়া যাবে কি না?
উত্তর : সহপাঠীর সাথে খাতির থাকা তো স্বাভাবিক। কোনো সময় সে হয়ত আপনার বাড়িতে এসে যাবে, কোনো সময় আপনি যাবেন। হতে পারে। কিন্তু খাবার-দাবারের ব্যাপারে একটু বাছ-বিচার করতে হবে। সে বাছ-বিচারটা হল, যদি গোশতজাতীয় খাবার দেয়, মুরগি দিল, খাঁসির গোশত দিল তাহলে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে। কিরে, এটা কোত্থেকে আনলি? মুরগিটা কোত্থেকে আনলি? বাজার থেকে এনেছি। তো বাজার থেকে যে এনেছে কেটেকুটে এনেছে, না এখানে কেটেছে! তো সবজি-টবজি আছে? মুরগি খেতে ভালো লাগছে না রে! তখন কৌশলে সবজি খেতে হবে। মাছ খেতে হবে। আর যদি বলে, না বাজার থেকে অমুকের দোকান থেকে এনেছি, তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে কে জবাই করেছে। কার দোকান। তখন খেতে পারবে। কিন্তু তাদের ঘরে যদি জবাই হয়, তাহলে খাওয়া যাবে না। কুরআনে কারীমে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলমানদের যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো আছে তার মধ্যে অন্যতম হল, মুসলমানরা কোনো প্রাণী খেলে নিজেরা বিসমিল্লাহ বলে জবাই করে খেতে হবে। মাছ ছাড়া, পানির প্রাণী ছাড়া। এটা অন্যরা করে না। ইয়াহুদীদের মধ্যে কিছু আছে, তারা করে। অন্য ধর্মের মধ্যে এটা নেই।
আরেকটা কথা সাথে যোগ করি সেটা হলো, বন্ধুত্ব। এখানে লিখেছে হিন্দু বন্ধু থাকে। আগেই বলেছি নিজের ক্লাসমেট হিসেবে সম্পর্ক দূষণীয় নয়। ন্যূনতম খাতির থাকতে পারে। একজন মুসলমান হিসেবে আমি সবার সাথে সদাচরণ করব। তার বিপদে এগিয়ে আসব। সে অসুস্থ হলে সেবা শুশ্রূষা দেওয়া দরকার, ডাক্তার দেখানো দরকার। এগুলো আমি করব। সব ঠিক, কিন্তু একেবারে অন্তরঙ্গতা, অন্তরের ঘনিষ্ঠতা; একজন আরেকজনের পেটের খবর জানা- এটা চলবে না। কুরআনের নির্দেশ হল, মুসলমান কেবল মুসলমানের সাথে এমন সম্পর্ক করবে। মুসলমান কোনো অমুসলমানের সাথে এটা করবে না। বর্তমানে পৃথিবীতে খালি মুসলিমদের সমস্যা নিয়ে সবার মাথাব্যথা। রাষ্ট্রপর্যায় থেকে আরম্ভ করে আমাদের ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত অমুক জায়গায় মুসলমান মারা যাচ্ছে, অমুক জায়গায় এ হয়ে যাচ্ছে, অমুক জায়গায় সে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব জায়গার গোড়ার সমস্যাটা হল ওটা। সেটা আমাদের বন্ধু-বান্ধব বরং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, অন্তরের সম্পর্কওয়ালা বন্ধু-বান্ধব, রাষ্ট্রীয় পর্যায়সহ অন্যান্য পর্যায়ে অমুসলিমরা। এটা একটা বড় বিপদ। এজন্য বলছি, স্বাভাবিক সম্পর্ক। কিন্তু একেবারে পেটের খবরের বন্ধুত্ব, সেটা আমরা শুধু মুসলমানদের সাথেই রাখব। অন্যদের সাথে নয়।
প্রশ্ন : আমার এক সহপাঠী ইসলামের কিছু বিধানের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে থাকে। আমার প্রশ্ন হল, তাকে আমি কীভাবে দাওয়াত দিব? কোন্ বইগুলো পড়তে বলব? মাঝেমধ্যে খুব হতাশা প্রকাশ করে। সে জানতে ও বুঝতে আগ্রহী।
উত্তর : এটার জন্য আমাদের এখানে যোগাযোগ করবেন। এটা যে কারো জন্যেই, যে প্রশ্ন করেছে তার জন্য এবং আমাদের নিজেদেরও কখনো ইসলামের কোনো বিষয়ে কোনো ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। ইসলামের ব্যাপারে, দ্বীনের ব্যাপারে কোনো সময় মাথায় উল্টো বুঝ এসে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজই হল দ্রুত আলেমদের কাছে আসা, বুঝতে চেষ্টা করা। তাদেরকে সমস্যাটা খোলামেলা বলব। ইনশাআল্লাহ সমাধান হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : ব্যাংকে চাকরি করা হারাম না হালাল?
উত্তর : আপনারা তো জানেনই ব্যাংকে সুদি কারবার হয়। অনেকেই প্রথম ক্যারিয়ারের জন্য সহজটা খোঁজ করে। ব্যাংকে যোগ দেয়। যখন গ্রাজুয়েট হবে, মাস্টার্স করবে এ চাকরির অফার আসবে, ওই চাকরির অফার আসবে। চাকরি আমরা ভালোটা খোঁজ করব। কিন্তু ব্যাংকের চাকরি খোঁজ করব না। ব্যাংকে সুদের কারবার হয়। তাই এখন থেকেই সংকল্প করা, নিয়ত করা। নিয়ত করলেই আল্লাহ তাআলা রাস্তা বের করে দেন। রাস্তা বের হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
এখন থেকেই এ নিয়ত করার দরকার নেই যে, আমি একজন ব্যাংকের অফিসার হয়ে যাব। ব্যাংকের অফিসার দেশের কত পার্সেন্ট লোক? ব্যাংকের অফিসার ছাড়া বাকিরা ভাত খায় না? তাহলে কেন আমি ব্যাংকে যাব? ব্যাংকের যে মালিক, যে শেয়ার হোল্ডাররা, ব্যাংকের যে বোর্ড অব ডিরেক্টরস তারা সুদের কারবার করে লাভবান হবে, আমি তাদের চাকরি করে যাব? অন্যে খাবে সুদ আর আমি...?
ব্যাংকের কাজটাও কঠিন। আপনাদের জানা থাকবে, ওখানে অফিস টাইম বলতে কথা নেই। যায় একটা টাইমে। কিন্তু আসবে যখন ব্যাংকের কাজ শেষ হবে। সন্ধ্যার পরে আসে। রাত আটটায় আসে। তো এতক্ষণ পর্যন্ত কাজ করলাম। আমি তো পরিশ্রম করে পয়সা নিলাম, কিন্তু ব্যবসা করল অন্যরা। আর গুনাহের ভাগী আমিও হলাম। আমি কেন শ্রম দিয়ে গুনাহের ভাগী হতে যাব? আমি অন্য কাজ করতে পারি না?
প্রশ্ন : হুজুর! যদি ইসলামী ব্যাংক হয়?
উত্তর : হাঁ, ইসলামী ব্যাংক যদি শুদ্ধভাবে চলে তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের কেউ কেউ আছে, শুধু ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নাম নেয়, শুদ্ধভাবে চলে না। তাহলে আবার সমস্যা। আর যদি শুদ্ধ ইসলামী ব্যাংক হয় তাহলে ঠিক আছে। এটা আমাদের কাছে আসলে বুঝিয়ে বলব ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন : আত্মীয়দের কার কার সাথে পর্দা করতে হয়? ভাইয়ের স্ত্রী, খালাতো বোন, চাচাতো বোন এবং চাচি, মামির সাথেও কি পর্দা করতে হয়?
উত্তর : কুরআন শরীফে চৌদ্দ শ্রেণির নাম আছে। চতুর্থ নাম্বার পারার শেষ, পঞ্চম পারার শুরু- এ অংশের মধ্যে। এখানে যে চৌদ্দ প্রকারের উল্লেখ আছে এরা ছাড়া সবার সাথে পর্দা করতে হবে। যেমন মা, দাদি, নানি, বোন, ফুফি, খালা, এবং এ জাতীয় আরো কিছু আছেন। তো তারা ছাড়া বাকি যারা দূরবর্তী আত্মীয় এবং অনাত্মীয় সকলের সাথেই পর্দা করতে হবে। আপনারা কুরআন শরীফের তরজমা পড়ে নিলেই পেয়ে যাবেন।
চাচি, মামি, খালাতো বোন, মামাতো বোনদের সাথে পর্দা করতে হবে। এদের কথা ওই ১৪ প্রকারের মধ্যে নেই। এরা যদিও আপনজন কিন্তু আপনজনকে শরীয়ত দু’ভাগে ভাগ করেছে। কিছু আত্মীয়ের সাথে পর্দা করতে হবে। কিছু আত্মীয়ের সাথে পর্দা করতে হবে না। দেখেন না মীরাস? মুরুব্বী মারা গেলে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে কেউ সম্পদ পায়, কেউ পায় না। খুব নিকটেরা পায়, অন্যরা পায় না।
তো চাচি মামী ভাবী আরো এ জাতীয় যারা আছে তাদেরকে আমরা পাশের কামরা থেকে সালাম দেব। আসসালামুআলাইকুম চাচি কেমন আছেন? স্কুল থেকে গেলাম কলেজ থেকে গেলাম তো এভাবে বলব। মামার বাড়িতে গেলাম, তো মামিকে সালাম দেব। কুশল বিনিময় করব। কথাবার্তা জিজ্ঞেস করব। কিন্তু সামনাসামনি হব না। এরপরও ঘটে, যে ঘরে পর্দা নেই, তারা হয়ত সামনে চলে এসেছে- কিরে বাবা! তুই আমার কাছে আসছস না কেন? তোরে কোলে নিয়ে বড় করলাম। এখন দেখো! পোলায় দেখাই দেয় না? এ রকম হয় না? হয়। বহুত হয়। হলে তখন নিচের দিকে তাকিয়ে আসসালামুআলাইকুম ভালো আছেন? আধা শব্দে বলে চলে আসবে। দু’-এক মিনিট দাঁড়ানোর পর বলবে যে, আমি ঐ ঘরে বসি। পাশের ঘরে বসি। বুদ্ধি করে চলতে হবে।
প্রশ্ন : আমরা জানি, নামায রোযা না করলে গুনাহ হয়। তারপরও আমরা করি না, কিন্তু কেন? আমাদের মাঝে কি ঈমানের কোনো অভাব রয়েছে?
উত্তর : হাঁ, ঈমানটা জাগ্রত হয়ে ওঠেনি। প্রশ্নকারী বলছে যে, ঈমানের কি অভাব আছে? কেন করি না? ঈমানটা চাপা পড়ে যায়। এই যে উপরে লাইটটা জ¦লছে। এ লাইটের উপরে যদি একটা কালো পর্দা দিয়ে দেওয়া হয়, বা কালো একটা কাগজ দিয়ে দেওয়া হয়, তো কী হবে? লাইটের আলোটা কী দেখা যাবে? খুব কম দেখা যাবে। আলো চলে যাবে না। মনে হবে, বাহির থেকে একজন দেখতে পাবে যে, এখানে একটা কিছু আছেরে!! কালো জিনিসটার ভেতরে একটু ফর্সা ফর্সা লাগছে!! কিন্তু আলোটা বাহিরে ছড়াবে না। হাদীসের ভাষাটা এ রকমই। হাদীসে বলা হয়েছে যে, মুমিন বান্দা যখন গুনাহ করে, অন্তরের মধ্যে কালো দাগ পড়ে। যখন সে তাওবা করে , তো কালো দাগ মুছে যায়। আর যদি তাওবা না করে, আল্লাহর দিকে ফিরে না আসে এ কালো দাগ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকলে এ আবরণ তৈরি হয়। ঈমানটা হল এ রকম নূর। আলো। যখন গুনাহ হয়, তো সেই আলোর উপর আবরণ তৈরি হয়। আবরণ তৈরি হলে আমরা আমাদের করণীয় কাজ ভুলে যাই। কিন্তু যখনই আমার বুঝ এসে যাবে তখনই আমি ফিরে আসব। তো দেখা যাবে ওই কালো দাগগুলো আস্তে আস্তে দূর হয়ে যাবে। তখন আবার ঈমানের আলো ফুটে ওঠবে। ঈমান যায়নি। ঈমানের ওপর গুনাহের আবরণ পড়েছে। সে আবরণ দূর করলেই আবার ঈমান আলো দেওয়া শুরু করবে।
প্রশ্ন : শুনেছি মোবাইলে এমনি ছবি তুললে সমস্যা নেই, যে ছবিটা ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখা হয় সেটা নিষিদ্ধ।
উত্তর : বিনা কারণে ছবি তোলা ঠিক নয়। তবে আপনার যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ জায়েয, মা, সন্তান এদের ছবি যদি ওঠানো হয় এবং ওয়াল পেপারে না রাখা হয় বরং ভেতরে রাখা হয় তো কেউ কেউ বলেছেন একটা সুযোগ আছে। যাদের যাথে পর্দা করতে হয় তাদের ছবি রাখা যাবে না। ওয়াল পেপারেও ছবি রাখা যাবে না।
প্রশ্ন : পোশাকের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি কী? অনেকে মাদানী কাটিং অর্থাৎ নিচের দিকে ছোট করে সেলাইবিহীনকে সুন্নাত মনে করে, এটা কি ঠিক?
উত্তর : সেটা পরতে পারেন, এটাতে দোষ নেই। ওটাও সুন্নত। এরা যে পড়েছে এটাও সুন্নাত। এখানে যেভাবে আপনারা পাঞ্জাবী পরেন, সেটাও সুন্নাত। কোনো অসুবিধা নেই। পোশাকের মূল বিষয়টা হল, পোশাক হবে ঢিলাঢালা। যেমন, একজন জিজ্ঞেস করল যে, এমন পোশাক পরলাম যে প্রস্রাবই দাঁড়িয়ে করতে হয়।
কেন যে আমরা অন্যদের এটাও অনুসরণ শুরু করলাম। অনুসরণ করতে করতে এত নিচে নামলাম যে, প্রসাব দাঁড়িয়ে করতে হয়!! বিব্রতকর পরিস্থিতি। জানি না, কোন দিন ওটাও শুরু করে দয়। সেটা হল, উন্নত রাষ্ট্রগুলোর টয়লেটে পুশশাওয়ার থাকে না। ইস্তেঞ্জাখানাতে বড় ইস্তেঞ্জার পরে আমরা বদনা দিয়ে পানি ব্যবহার করি, সাবান ব্যবহার করি, পানি খরচ করে পরিচ্ছন্ন হই। ওসব দেশে সেটা থাকে না। আমাদের এখানে আমেরিকা প্রবাসী ছাত্র আছে, ওদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ওইসব দেশে শুধু টিস্যু ব্যবহার করে। পানির ব্যবহার নেই। আপনাদের এ এলাকার অনেক ছেলে সিঙ্গাপুর থাকে ওদের জিজ্ঞেস করলেও জানবেন। এখন আমরা কি ওটা শুরু করব? আমাদের টয়লেটগুলোতে পুশশাওয়ার দেব না?! পানি খরচের ব্যবস্থা দেব না!! ওরা দাঁড়িয়ে প্রস্রাবের ব্যবস্থা চালু করেছে বিধায় আমরাও সে সিস্টেম চালু করে দিয়েছি।
অনুসরণ করব, আরেকজনেরটা নিব। বিদেশীদেরটা নেব, একটু বুঝে শুনে তো নিতে হবে। রুচিতে লাগারও তো একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে। কিন্তু আমরা যখন নেওয়া শুরু করি তো রুচি-টুচি আর চিন্তা করি না। নির্বিচারে অন্যদেরটা গ্রহণ করা শুরু করি।
আমি এ ছেলেদেরকে, যারা ভবিষ্যতে শিক্ষিত হবে, বড় শিক্ষিত হবে ইনশাআল্লাহ, জাতি, সমাজ এবং রাষ্ট্রে কাজ করবে, তাদেরকে এটাই বলি, তোমরা বুঝে শুনে নেবে। পৃথিবীর যে কোনো জায়গার ভালো কিছু নিতে কোনো দোষ নেই। নেব আমরা, কিন্তু বুঝে শুনে নেব। ইসলাম ভালো কিছু নিতে কোনো বাধা দেয় না।
الحكمة ضالة المؤمن
এটা ইসলামের শিক্ষা। আল হিকমাহ মানে বিদ্যা, বুদ্ধি, আবিষ্কার এসব ‘দল্লাতুল মুমিন’- মুমিনের হারানো সম্পদ। মুসলিম যেখানে যা ভালো পাবে নেবে। কিন্তু অবশ্যই তার ঈমানের আলো দিয়ে বাছাই করে নেবে। দেখে নেবে।
আমি আলোচনায় একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম, ভুলে গেছি। এখন আকাশ সংস্কৃতি গ্রামে-গঞ্জেও এসে গেছে। আগে ছিল না। এখন গ্রামে-গঞ্জেও অনেকের ঘরেই থাকে। কেউ বাধ্য হয়ে রাখে। কেউ সংবাদ শোনার নামে রাখে। দেখার নামে রাখে। কেউ আরো বিভিন্ন কারণে রাখে। টেলিভিশন ঘরে ঘরে থাকে। রিমোটের মধ্যে একশ দু’শ চ্যানেলের পরেও শেষ হয় না। টিপছে আর আসছে। আমি বলি না যে আপনি প্রথম দিনেই ঘর থেকে ছুড়ে ফেলে দিন। কারণ, আপনি ঝামেলায় পড়ে যাবেন। আপনার মধ্যে যখন ঈমানের আলো জ¦লে উঠবে, আপনিই তখন সিদ্ধান্ত নিবেন। কিন্তু এখন যেটা করবেন তা হচ্ছে বাছাই করুন! চুজ করুন। আমি ভাবব যে, কোনটা আমি দেখব। কোনটা দেখব না। আমার রুচিকে জিজ্ঞেস করব। আমার সভ্যতা-সংস্কৃতিকে জিজ্ঞেস করব। আবহমান কাল থেকে এ দেশে আমার মা-বাবা, দাদারা-দাদিরা এগুলো দেখলে কী মনে করত? কী বলত? এগুলো আমরা চিন্তা করব। তারপরে ভাবব যে, এটা দেখা আমার জন্য উচিত কি উচিত না? ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা পুরো বিশ্ব এখন দেখছি। পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ দেখার আগে আমি নিজের সাথে ভেবে নেব। আমাকে ধ্বংস করার জন্য পুরো বিশ্ব থেকে বহু গোষ্ঠী, পুঁজিবাদী গোষ্ঠী বহু রকমের বহু কিছু আমার মোবাইলে দিবে। আমার কম্পিউটারের মধ্যে দিবে। কিন্তু আমাকে বাছাই করে নিতে হবে। আমি সব নেব না। যেটা যেটা মনে করব যে এটা আমার ক্ষতি করবে, আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি করবে, আমার মূল পরিচয়ের ক্ষতি করবে সেটা আমি নিব না। আমি নিব বাছাই করে করে। এটা অন্তত করতে হবে। এটা একদিকে যেমন ঈমানের দাবি, তেমনি আমাদের এ অঞ্চলের সভ্যতা-সংস্কৃতিরও দাবি।
প্রশ্ন : আমি যদি খেলার মাধ্যমে টাকা পাই এবং তা দান করে দেই তাহলে কি সওয়াব হবে? কবুল হবে?
উত্তর : খেলা আমাদের ছেলেরাও খেলে। খেলাটা হল শরীরচর্চার জন্য। হালকা মানসিক চর্চাও। খেলাকে প্রফেশন হিসেবে নেওয়া, খেলা দিয়ে টাকা কামানো; মানুষের জীবনটাকে ইসলাম আরো একটু উঁচু মনে করে। আমি শুধু খেলা দেখিয়ে টাকা কামিয়ে ফেললাম- ইসলাম এটাকে ভালোভাবে দেখে না। এজন্য খেলার মাধ্যমে আমরা টাকা কামানোর চিন্তা করব না। শরীরচর্চার জন্য যতটুকু খেলা দরকার অতটুকু খেলব।
প্রশ্ন : কোনো মুসলমান কি খ্রিস্টানদের দ্বারা পরিচালিত এনজিও অথবা তাদের অফিসে কাজ করতে পারবে?
উত্তর : এটা এক কথায় জবাব দেয়া মুশকিল। এনজিওগুলো বিভিন্ন রকমের কাজ করে। বহু ধরনের এনজিও আছে। অনেক এনজিও-এর ব্যাপারে বহু পেপার-পত্রিকায় বিভিন্ন সময় এসেছে যে, তারা ধর্মান্তরিত করার জন্যে কেউ সরাসরি কেউ কৌশলে চেষ্টা করে। ওই ধরনের জায়গায় কাজ করা যাবে না। তাহলে তো আমি ওই কাজের সহযোগিতা করলাম। আর যদি ওগুলো থেকে মুক্ত হয় তাহলে সেখানে ঠিক আছে। এ জন্য আগে যাচাই করতে হবে। খবর নিতে হবে।
প্রশ্ন : নামাযে অন্য মনস্ক হয়ে গেলে কী করণীয়?
উত্তর : মনটাকে আবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসা। আল্লাহর কথা মনে করা। আমি আল্লাহর সামনে আছি। আল্লাহ্র সাথে কথা বলছি। হাদীসে আছে-
إنما يناجي ربه
যখন তোমাদের কেউ নামায পড়ে, তখন يناجي ربه সে আল্লাহর সাথে একান্তে কথা বলে। يناجي মানে কানের সাথে মুখ লাগিয়ে কথা বলা। তো যেহেতু আল্লাহর সাথে কথা বলছি, তাই যখনই মন ছুটে যাবে, তখন ওহ! আল্লাহর সাথে না কথা বলছি- বলে মন ঘুরিয়ে নিয়ে আসব। নামায ঠিক হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : আমার আম্মু নামায পড়েন না। অনেক চেষ্টা করি, তারপরও পড়েন না। শুধু টিভিতে হিন্দি নাটক দেখে। এজন্য কী করা উচিত?
উত্তর : হাঁ, এ রকম দুঃখজনক পরিস্থিতি অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে দুআ করা। নিজেদের মা-বাবার জন্যে দুআ করা বা আপনজন কেউ এমন হলে দুআ করা এবং যদি বুঝতে চায় বুঝানো। যদি না বুঝতে চায়, তাহলে তুমি বলবে না যে, আপনি নামায পড়–ন। নামায কেন পড়েন না? এরকম বলবে না। তুমি যেটা করবে, সেটা হল, এমন মায়েরই খেদমত সেবা-যত্ন তুমি বেশি করে করবে। তুমি নিজে নামায পড়বে, মসজিদ থেকে এসে খেদমত শুরু করবে। মসজিদে যাওয়ার আগে বলবে মা একটু নামাযটা পড়ে আসি আবার মসজিদ থেকে এসে বলবে, মা তোমাকে একটু পানি দিচ্ছি। এ করছি, সে করছি।
মা দেখবেন যে, ওহ, ছেলেটা দেখি মসজিদে যাওয়ার কারণে আমার খেদমত বেশি করে। তখন দেখবে- মা উল্টো নামাযী হবেন। নিজের আচরণ দিয়ে মায়ের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করা। ওই যে সূরা লোকমান পড়া হল যে, মাগরিবের পরে ওখানে এটা আছে।
وَ اِنْ جَاهَدٰكَ عَلٰۤی اَنْ تُشْرِكَ بِیْ مَا لَیْسَ لَكَ بِهٖ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَ صَاحِبْهُمَا فِی الدُّنْیَا مَعْرُوْفًا. ؗ
যদি মা বাবা তোমাকে জোর-জবরদস্তিও করে যে, তুমি গুনাহের কাজ কর। فلا تطعهما তখন তুমি তাঁদের অনুসরণ করো না।
কিন্তু এ কারণে তাদের সাথে দূরাচরণ করো না। কারণ-
وَ صَاحِبْهُمَا فِی الدُّنْیَا مَعْرُوْفًا
দুনিয়াতে তাদের সাথে সদাচার করো।
এ যে লোকমান হেকিম বিদ্বান ব্যক্তি, কেন তাঁর ছেলেকে এ বিষয়টা শেখালেন? এজন্য শেখালেন যে, এর দ্বারা মা-বাবা ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং ছেলের ভালো ভালো গুণগুলো মা বাবার দিকে যাবে।
প্রশ্ন : আমরা যখন নামায পড়তে যাই, তখন বন্ধুরা সাথে থাকে। তাদেরকে নামাযের কথা বললে তারা বলে আমার কাপড় ঠিক নাই। এ ব্যাপারে হুকুম কী?
উত্তর : হাঁ, এটা অনেকেই বলে যে, কাপড় খারাপ। এ ওজর দেয়। বলতে হবে যে, ভাই! এতটুকু কাপড় খারাপ থাকলে শুনেছি নামায হয়ে যায়। আসো। অনেকেই মনে করে কাপড় খারাপ, কাপড় খারাপ মানে কী?
বড় মানুষের কাপড় আর কতটুকুই খারাপ হয়? এখানের মানুষ অজু-এস্তেনযার পরে পানি ব্যবহার করে। তো পানি ব্যবহার করলে কি আর অত নষ্ট হয়? যতটুকু হয় সেটা হল অনেক সময় রাস্তা-ঘাটে এখানে সেখানে প্রস্রাব করতে হয়। তো দু’-এক ফোঁটা প্রস্রাব লেগে থাকে। সেক্ষেত্রে সম্ভব হলে কাপড় বদলে পড়বে। না হয় আপাতত ওটা দিয়েই এখন নামায পড়ে ফেলবে। নামায হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। পরবর্তীতে বাসায় আসলে বদলে নেবে।
বলবে ভাই! নামায হয়ে যায়। হুজুররা বলেছেন নামায হয়ে যায়। এসো নামায পড়ি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের পুরো মজলিসটাকে কবুল করুন। ভবিষ্যতের জন্য এটা যেন আলোকবর্তিকা হয়। যেন আমাদেরকে সঠিক পথে চলার আলো দেখায়। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন।
[অনুলিখন : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম]