খোদার সাথে স্টিফেন হকিং-এর সাক্ষাৎ
স্টিফেন হকিং জন্মগ্রহণ করেন ৮ জানুয়ারি। এটা গ্যালিলিওর মৃত্যুর তারিখ। তিনি মারা গেলেন ১৪ মার্চ। এটা আইনস্টাইনের জন্মদিন। আর মাঝের এই গোটা সময়টা তার বেঁচে থাকা কোনো অংশেই কম অলৌকিক নয়। যদিও অলৌকিক কোনো ব্যাপারে এবং ঈশ্বরে তার বিশ্বাস ছিল না।
তিনি ঐসকল প্রশ্নই করেছেন, বিজ্ঞান ও দর্শনের জগৎ যার উত্তর খুঁজছে কয়েক শতাব্দী ধরে। এই জগৎ কীভাবে এল? এই জগতে আমরাই আছি, না আরো কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে? জীবনের সবকিছুই কি নির্ধারিত? মানুষ কতদূর অক্ষম, কতটুকু সক্ষম? সময়ের শুরু কীভাবে? অনাদি কী? অনন্ত কী? জীবনের সূচনা কখন? অন্য কোনো গ্রহে কি আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী আছে? আমাদের পৃথিবীতে সবকিছুই কি বিজ্ঞানের নিয়মাধীন না বাইরের কোনো শক্তির এখানে কোনো প্রভাব আছে? এই জগৎ যদি নিরন্তর প্রসারমান হয় তাহলে কি কোটি কোটি বছর আগে এর কোনো অস্তিত্ব ছিল? এই জগৎ কি একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে ইত্যাদি।
ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছে। ‘গুবারে খাতির’ পুস্তিকায় আবুল কালাম আযাদ লেখেন, ‘কয়েকবার আমার মনে হয়েছে, খোদার অস্তিত্ব আমাদেরকে এজন্যও স্বীকার করে নিতে হবে যে, তা না হলে এই বিশ্ব জগতের ধাঁধাঁর কোনো সমাধান থাকে না। অথচ সমাধানের এক তৃষ্ণা আমাদের অস্থির করে রেখেছে। ...এই জগতের প্রত্যেক অংশ, প্রতিটি বস্তু একেকটি জ¦লন্ত প্রশ্ন। আমরা বুদ্ধির সহায়তা নেই এবং যাকে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান বলি তার আলোতে যতদূর দেখা যায়, চলতে থাকি, কিন্তু এমন কোনো সমাধান পাই না, যা এই গভীর তৃষ্ণা মেটাতে পারে। ...কিন্তু যেইমাত্র আমরা পুরানো সমাধানের দিকে ফিরি এবং আহরিত জ্ঞানের সাথে এইটুকু যোগ করি যে, পর্দার আড়ালে একজন জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী সত্তা রয়েছেন তখনই অকস্মাৎ দৃশ্যপট বদলে যায়। মনে হয় যেন অন্ধকার গহ্বর থেকে হঠাৎ আমরা আলোর রাজপথে উঠে এসেছি। এখন যেদিকে তাকান শুধু আলো আর আলো... (অসীম) জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী একজন যদি পর্দার পেছনে থাকেন তাহলে এখানের সবকিছু এক সুবিজ্ঞ ইচ্ছার ফল এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আবর্তিত। এই সামাধানের আলোকে যখন আমরা মহাবিশ্বের জটিলতা নিয়ে চিন্তা করি তখন সকল জটিলতা কর্পূর হয়ে যায় এবং সবকিছুই স্ব স্ব স্থানে স্থিতি লাভ করে।
গোটা ‘গুবারে খাতির’ বইটিই স্বর্ণের বাটখারায় ওজন করার মতো। কিন্তু এই চিঠিটি, যাতে মাওলানা ধর্ম ও খোদার অস্তিত্বের ধারণা পেশ করেছেন এমন একটি ‘মাস্টার পিস’, যা মস্তিষ্কের জানালাসমূহ খুলে দেয়। দশ-বারো পৃষ্ঠার মধ্যেই মাওলানা গোটা সমস্যাটি যেন জলবৎ তরলং করে দিয়েছেন।
স্টিফেন হকিং বিজ্ঞানী ছিলেন। সবকিছুকে বিজ্ঞানের মানদণ্ডে বিচার করতেন। তার মতে, ধর্ম ও দর্শন বিশ্ব জগৎ সংক্রান্ত প্রশ্নসমূহের প্রশান্তিদায়ক উত্তর দিতে পারেনি। এ যাবৎ বিশ্বজগতের সকল রহস্য বিজ্ঞানের বদৌলতে উন্মোচিত হয়েছে। তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমাদের পৃথিবীতে বস্তুসমূহের চরিত্র এতই জটিল এবং এত বেশি বিষয়ের প্রভাবাধীন যে, প্রাচীন সভ্যতাসমূহের পক্ষে এই জ্ঞানের ব্যাখ্যায় পরিষ্কার কোনো রূপরেখা বা তত্ত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আওতার বাইরে নতুন নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার হয়েছে এবং এ সবই বৈজ্ঞানিক নিমিত্ত্ববাদ (scientific determinism) ধারণার উদ্ভব ঘটায়, যার ফলশ্রুতিতে ধরে নেয়া হয়েছে যে, অবশ্যই একগুচ্ছ পূর্ণাঙ্গ সূত্র আছে, মহাবিশে^র একটি নির্দিষ্ট সময়কালকে হিসেবে নিয়ে যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের মহাবিশ্ব সম্পর্কে আগাম কথা বলা যায়।
‘এই সূত্রগুলো সর্বদা ও সর্বত্র একই রকমের হতে হবে। এটা না হলে এগুলোকে সূত্র বলা যাবে না। দৈব বা কোনো কিছুর কারণে এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটতে পারবে না। এই মহাবিশ্বের চলমানতায় ইশ্বর বা অপদেবতার পক্ষে এর ভেতর কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে না...।’
এটা জিজ্ঞাসা করা যৌক্তিক যে, কে এবং কী কী দিয়ে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর উত্তর যদি ইশ্বর হন তাহলে এর পরবর্তী প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ইশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন। এই ধারা মতে এটা গ্রহণযোগ্য যে, এমন একটি অস্তিত্ব বিদ্যমান, যার জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই। আর তাকেই ইশ্বর বলা যেতে পারে। একে ইল্লাতুল ইলাল (first cause) বলে। আমাদের মতে বিজ্ঞানের মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব এবং তাতে কোনো রকম স্বর্গীয় ইশ্বরকে আহ্বান করার প্রয়োজন নেই। (ঞযব এৎধহফ উবংরমহ ১৭১-১৭২)[1] ১
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই স্টিফেন হকিং সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে গেলেন।
আমাদের জনা নেই, বিখ্যাত গ-তত্ত্ব- স্টিফেনের মতে যার মধ্যে বিশ্বজগতের সকল প্রশ্নের জবাব রয়েছে, কখনো আবিষ্কৃত হবে কি না। তবে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দর্শন ও বিজ্ঞান-সংক্রান্ত (প্রায়) সকল গবেষণা এখন হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়াতেই। ওখানকার ভার্সিটিগুলোতে মুসলিম চিন্তা নায়কদের বইপত্রের উপর আলোচনা হয়। ইবনে রুশদের চিন্তুা-ভাবনা তারা আকণ্ঠ পান করেছে। মুসলিম বিজ্ঞানীদের গবেষণা, জ্ঞান ভাণ্ডার ও আবিষ্কারসমূহ সংরক্ষণ করে রেখেছে। ওদের লাইব্রেরি, ওয়েব সাইট ও ইনসাইক্লোপিডিয়া আমাদের জানায় যে, একসময় বাগদাদ ছিল জ্ঞান-গবেষণার কেন্দ্র। সাইন্সের কথা যদি বলেন, তাহলে ঈ ঊ জ ঘ তারাই বানিয়েছেন, যেখানে তারা বিশ্বজগতের বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিরহস্য জানার চেষ্টায় ব্যাপৃত। ওদের ওখানে বিগত চার শ বছরে যত দার্শনিক জন্মলাভ করেছে তার দশভাগের এক ভাগও মুসলিম বিশ্বে পয়দা হয়নি। চিন্তার উপর ওদের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। প্রশ্ন করার অবাধ স্বাধীনতা। প্রশ্ন এলে তার উত্তর খোঁজা হয়। আমরা তো প্রশ্নের উপরই বিধি-নিষেধ আরোপ করি। আমাদের ভার্সিটিগুলোর অবস্থা হচ্ছে, পিএইচডি ধারী ব্যক্তিদের মধ্যেও প্রশ্ন ও পর্যালোচনা নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। গবেষণাপত্রে তস্করবৃত্তিতে তারাও লিপ্ত, যাদের উপর গবেষণাসমূহের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব অর্পিত। এমনকি ভার্সিটির ভিসি মহোদয়গণ পর্যন্ত ‘তারকা-রাজ্যে অভিযান পরিচালনায়’ পারঙ্গম।
স্টিফেন হকিং ভাগ্যের শাসনে বিশ্বাসীদের বিদ্রুপ করেছেন। তার মতে, যারা বিশ্বাস করেন যে, যা হওয়ার তা হবেই তারাও সড়ক পাড়ি দেয়ার সময় প্রথমে ডানে বামে দেখে নেন।
স্টিফেন হকিংয়ের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। দু’জনের ব্যস্ততাই এর কারণ। কখনো সাক্ষাৎ হলে যে প্রশ্নটি তাকে করতাম তা হচ্ছে, চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত অনুসারে তো আপনার মাত্র কয়েক বছর বেঁচে থাকার কথা।[2]২ কিন্তু এই নিয়মের ব্যত্যয় কে ঘটিয়ে দিলেন, যার ফলে আপনি বেঁচে রইলেন ৭৬ বছর।
স্টিফেন হকিং সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন।
(Jang. com. pk থেকে গৃহীত
অনুবাদে : ইবনে নসীব)
১ উর্দু নিবন্ধে উল্লেখিত উদ্ধৃতিটুকুর তরজমা নেয়া হয়েছে সদেশ থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ বইটির বাংলা অনুবাদ থেকে। পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪০।
২ মাত্র বাইশ বছর বয়সে বিরল রোগ মোটর নিউরনে আক্রান্ত হন। তিনি বড় জোর কয়েক বছর বাচবেন বলে সে সময় চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন।