শাসন : শাসনের ভুল পন্থা
শাসনের প্রয়োজন আছে তবে তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন শাসনের নিয়ম ও মাত্রা রক্ষা করা।
নীতিহীন ও মাত্রাহীন শাসনে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। কখনো কখনো দুর্ঘটনাও ঘটে। একটি দুর্ঘটনার মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার বেপজা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ৯ আগস্ট ২০১৭-এর দৈনিক নয়া দিগন্তের শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বেদনাদায়ক ঘটনাটির শিরোনাম ছিল- ‘চট্টগ্রামে শিক্ষকের বেত্রাঘাতে চোখ হারাল শিক্ষার্থী মাশরাফুল।’ ঘটনার সারসংক্ষেপ-
‘২৯ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অষ্টম শ্রেণীর বিশেষ কোচিং ক্লাস চলাকালে অংক করতে গিয়ে ভুল করে মাশরাফুল আলকাবীর। এতে শিক্ষক আরিফ বিল্লাহ উত্তেজিত হয়ে চিকন কাঁটাতার পেঁচানো বেত দিয়ে তাকে মারতে থাকেন। একপর্যায়ে তারযুক্ত বেতের আঘাত তার বাম চোখে লাগে। সাথে সাথে তা লালবর্ণ ধারণ করে এবং গুরুতর জখম হয়।’
ছেলেটির বাবা চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে দেখানোর পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। শেভরন আই এবং ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ছেলেটির বাঁ চোখের কর্ণিয়া গুরুতর জখম হয়েছে, যার ফলে সে বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অপারেশন করা হলে সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারে, না-ও পারে।
আমরা আন্তরিকভাবে দুআ করছি, ছেলেটি যেন সুস্থ হয় এবং দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।
এখানে কিছু বিষয় চিন্তা করার আছে। নিশ্চয়ই ঐ শিক্ষকও চাননি এই রকমের একটি দুর্ঘটনা ঘটুক। ন্যূনতম বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষই তা চাইতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, না চাইলেও বিষয়টি ঘটেছে। কারণ, শাসনের যে পদ্ধতি ঐ শিক্ষক অবলম্বন করেছেন তাতে এটা ঘটার সম্ভাবনা ছিল। শিক্ষক শুধু বেতই ব্যবহার করেননি, বেতটি-কাঁটাতার দিয়ে মুড়েও নিয়েছিলেন! এই বর্বর পন্থা কেন তিনি অবলম্বন করলেন?
এখন তো একথা বলে কোনো লাভ নেই যে, ওর চোখ নষ্ট হয়ে যাক তা আমি চাইনি। আপনি চাননি ভালো কথা, কিন্তু প্রহারের যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তাতে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলেই ছেলেটি এই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
একইসাথে বোঝাই যাচ্ছে, তিনি উত্তেজিত ছিলেন এবং এলোপাতাড়ি বেত্রাঘাত করছিলেন। শাসনের এই ধরনটা কোনোভাবেই অনুমোদনযোগ্য নয়। এটা জুলুমের মধ্যে পড়ে যায়, ইসলামের বিধানানুসারে যা বড় অপরাধ ও গোনাহ।
এখানে প্রথমেই যে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া উচিত তা হচ্ছে, শাসনের ক্ষেত্রে উস্তায-শিক্ষক, বাবা-মা সম্পূর্ণ স্বাধীন নন। যে কোনো উপায়ে এবং যে কোনো মাত্রায় শাসন করার অধিকার শরীয়ত তাদের দেয়নি। এক্ষেত্রেও তারা নীতি ও মাত্রা রক্ষা করতে আদিষ্ট। অন্যথায় তারাও ‘জালিম’ হিসেবেই গণ্য হবেন। বলাবাহুল্য, উত্তেজিত অবস্থায় সাধারণত এই নীতি ও মাত্রা রক্ষিত হয় না। তাই ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত অবস্থায় প্রহার থেকে বিরত থাকা উচিত। রাগ প্রশমিত হওয়ার পর অপরাধের ধরন ও মাত্রা এবং শাস্তির উপযোগিতা চিন্তাভাবনা করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এটা শিক্ষক ও মুরব্বির করণীয়। এ না হলে শাসন বাস্তবে শাসন থাকে না, সেটা পরিণত হয় ব্যক্তিগত ক্রোধ চরিতার্থ করার দৃষ্টান্তে।
শিক্ষক ও গুরুজনের সম্মান ও মর্যাদার সাথে একজন ক্রুদ্ধ ব্যক্তির ক্রোধ চরিতার্থ করার বৃত্তিটা কোনোভাবেই মেলে না।
দ্বিতীয়ত শাসনের এমন কোনো পন্থাই অবলম্বন করা উচিত নয়, যার দ্বারা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেমনটা উপরের দৃষ্টান্তে দেখা গেল। হাদীস শরীফে মুখম-লে চড় মারতে বা অন্য কোনোভাবে আঘাত করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। সহীহ বুখারীতে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে-
نَهَى النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ تُضْرَبَ الصّورَةُ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখম-লে প্রহার করতে নিষেধ করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৪১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৭৭৯
সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার আল্লামা নববী রাহ. এই নববী-আদেশের তাৎপর্য বয়ান করে বলেছেন, ‘মানুষের মুখম-ল হচ্ছে সৌন্দর্য ও সংবেদনের স্থান। এতে রয়েছে মূল্যবান অঙ্গ ও ইন্দ্রিয়। (শ্রবণ, দর্শন, ঘ্রাণ ও আস্বাদের ইন্দ্রিয়গুলো মানুষের মুখম-লেই স্থাপিত) কাজেই মুখম-লে আঘাত করা হলে এসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ও ইন্দ্রিয়ের কোনোটি নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চেহারায় দাগ পড়ে যেতে পারে এবং চেহারার সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
কাজেই শাসনের এমন কোনো পন্থা অবশ্যই বর্জনীয়, যাতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।
তৃতীয়ত, এ বিষয়টাও বোঝা দরকার যে, শাসন মানেই প্রহার নয়। ইসলামে শাসনের যে পর্যায়ক্রম রয়েছে তাতে প্রহারের পর্যায়টি হচ্ছে সর্বশেষ। অথচ একেই সবার আগে প্রয়োগ করে ফেলা হয়। কোনো কোনো উস্তায-শিক্ষকের অবস্থা থেকে মনে হয়, প্রহার ছাড়া শাসনের আর কোনো পন্থাই তার জানা নেই। এটা সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি এবং শাসন সংক্রান্ত ইসলামী বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞানহীনতার প্রমাণ।
যিনি শাসন করবেন তাঁকে অবশ্যই শাসনের নিয়ম-নীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। অন্যথায় এক্ষেত্রে তিনি অজ্ঞ বলে বিবেচিত হবেন।
আমাদের শিক্ষক ও মুরব্বিগণ জ্ঞান-প্রজ্ঞা, স্থিরতা-সহনশীলতা এবং ধৈর্য ও মাত্রাজ্ঞানের অধিকারী হোন- এ-ই প্রত্যাশা।