যিলহজ্ব ১৪৩৮   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৭

আমার ছাত্রজীবন

মাওলানা মুহাম্মাদ মানযূর নোমানী রাহ.

[হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ মানযূর নোমানী রাহ. ১৩৯০ হিজরীর জুমাদাল উখরার শেষ সপ্তাহে দারুল উলূম দেওবন্দের মসজিদে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এই বক্তব্য পেশ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের হুকুমে বক্তৃতাটি   ছাপা হয়।]

الحمد لله الذي هدانا لهذا وما كنا لنهتدي لولا أن هدانا الله، لقد جاءت رسل ربنا بالحق، صلوات الله تعالى عليهم وعلى كل من تبعهم بإحسان.

আমার প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! এখন আমি আপনাদেরকে আমার ছাত্রজীবনের কিছু ঘটনা ও অভিজ্ঞতা শোনাতে চাচ্ছি। আশা করি, সেগুলো আপনাদের জন্য উপকারী হবে ইনশাআল্লাহ। আমার ছাত্রজীবনের বৃত্তান্ত বিভিন্ন দিক থেকে শিক্ষণীয়।

আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত জেনে থাকবেন, আমার আসল বাসস্থান ইউপি প্রদেশের মুরাদাবাদ জেলার প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন উপশহর সাম্ভলে। আমার আব্বাজানকে আল্লাহ দুনিয়াবী ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দান করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি নিজস্ব বিশেষ ধারায় পাকা দ্বীনদার বরং জাকের ও ইবাদতগুযার ছিলেন। একসময় তিনি কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনাও করেন। এজন্য তিনি সূফীজী নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। অনেকে আব্বাজানের মূল নাম জানতেনই না।

তিনি আলেম ছিলেন না। হক্কানী ওলামায়ে কেরামের সঙ্গেও তাঁর তেমন সম্পর্ক ছিল না। উল্টো এমন কতেক ভ্রান্ত সূফীর সাহচর্যে প্রভাবিত ছিলেন, যারা সাধারণত মুখলিস ও নেকনিয়ত হলেও তাদের কিছু কিছু আকীদা-বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত গোমরাহী ও ভ্রষ্টতাপূর্ণ। সে সময়টাতে আব্বাজানেরও একই অবস্থা ছিল। যেমনটা বলেছি, ব্যক্তিগতভাবে আব্বাজান পাক্কা দ্বীনদার ও বেশ আমলওয়ালা ছিলেন। শরীয়তের খুবই অনুগত ছিলেন। যিকির-আযকার ও রাত্রি জাগরণও ছিল যথেষ্ট। দুনিয়াবী কাজকর্মও ছিল সুন্দর ও নিখুঁত। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সফলকাম।

তবে আব্বাজানের দ্বীন ও আখেরাতের চিন্তা দুনিয়ার চিন্তার উপরে বিজয়ী ছিল। এ জন্য তিনি সন্তানদেরকে শুধুই দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চাইতেন। পরিপূর্ণ সামর্থ্য ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কোনো সন্তানকে দুনিয়াবী শিক্ষায় অর্থাৎ স্কুল-কলেজের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না।

 

ছাত্রজীবনের সূচনা

এ ধারাবাহিকতায় আমাকেও কুরআন শরীফ নাজেরা ও কিছু উর্দূ কিতাবাদি পড়ার পর ফারসী ও আরবী পড়ায় লাগিয়ে দেন। কিন্তু আমি -হয়ত বয়স কম হওয়ার কারণে অথবা ছরফ ও নাহু বুঝার উপযুক্ত না হয়ে উঠায় (বিশেষভাবে মিজান-মুনশাইব, পাঞ্জেগাঞ্জ ও নাহবেমীরের মত কিতাবগুলোর মাধ্যমে ছরফ ও নাহু পড়া ও বুঝার উপযুক্ত ছিলাম না।)- অত্যন্ত অনাগ্রহ ও অমনোযোগিতার সঙ্গে পড়ালেখা করছিলাম। এরচে’ বড় কারণ ছিল, দ্বীনী শিক্ষার প্রতি আমার কোনো ধরনের আগ্রহ ও চাহিদা ছিল না। আমি অত্যন্ত অনিচ্ছা ও অনাগ্রহের সঙ্গে পড়ছিলাম। বরং অবস্থা তো এই ছিল যে, শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য যা পড়া দেয়া হত মুখস্থ করে শুনিয়ে দিতাম- কিছুই বুঝতাম না। পড়াশোনার প্রতি বিন্দুমাত্রও মনোযোগ ছিল না আমার।

 

একই জামাতে কয়েক বছর পড়া

আমার মনে আছে, কয়েক বছর আমার এ অবস্থাই ছিল। ফলে প্রতি বছর আমার মিজান প্রথম থেকে পড়তে হত। আমাদের সাম্ভলে সে সময় তিনটি আরবী মাদরাসা ছিল। এমন হত, এক বছর এক মাদরাসায় পড়তাম। বছর শেষে কখনো কখনো মিজান-মুনশাইব শেষ হয়ে পাঞ্জেগাঞ্জ ও নাহবেমীর শুরু হয়ে যেত। আব্বাজান ও পরিবারের লোকেরা বুঝতেন পড়া বলতে কিছুই হয়নি আমার। তাই পরের বছর অন্য মাদরাসায় একই জামাতে ভর্তি করিয়ে দিতেন। ঐ মাদরাসার উস্তায যখন আমার এ অবস্থা দেখতেন- মিযান কিছুই পড়া হয়নি তখন তিনিও আবার মিজান পড়ানো শুরু করতেন। আবার পুরো বছরে মিজান মুনশাইব শেষ করে পাঞ্জেগাঞ্জ ও নাহবেমীর  এমনকি এরচে’ বেশিও পড়ে ফেলতাম। কিন্তু পড়া বলতে কিছুই হত না আমার। এ জন্য পরের বছরও অন্য মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দিতেন। সেখানকার উস্তাযগণও আমার কল্যাণার্থে আবার মিজান থেকে পড়ানো শুরু করতেন। আমার মনে আছে, কয়েক বছর আমার অবস্থা এভাবেই চলছিল- প্রতি বছর আমার পড়াশুনা  بداں أسعدك الله في الدارين থেকে শুরু হত।

 

স্কুলে পড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখান

এভাবে যখন আমার -খুব সম্ভব- দুই-তিন বছর নষ্ট হল, আর আমার বয়স তখন ১২ বছর, এক ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের মুরাদাবাদ জেলার তখনকার ইংরেজ কালেক্টর -আব্বাজানকে যিনি খুব সম্মান করতেন- এক সাক্ষাতে আব্বাজানের নিকট সন্তানদের খবরাখবর জিজ্ঞেস করলেন। আব্বাজান বললেন, আল্লাহর দয়ায় আমার পাঁচ ছেলে। তিনি তাদের লেখাপড়ার বিষয়েও জিজ্ঞাসা করলেন। এ কথা শুনে তিনি খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন যে, তাদের কেউ স্কুলে পড়েনি; এখনো পড়ছে না। তখন আমার বয়স ও পড়ার স্তরটাই এমন ছিল যে, আমার ব্যাপারে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। কালেক্টর সাহেব জোর দিয়ে বললেন, কালই একে এলাকার হাই স্কুলে পাঠিয়ে দিবেন। আমি হেড মাস্টারকে বলে দেব যেন পাঁচ বছরে তাকে এন্টার্ন্স করিয়ে দেয়। পরে আমি তাকে সহকারী তহসিলদার বানিয়ে দেব।

ঐ সময় সহকারী তহসিলদারী অনেক বড় ব্যাপার ছিল। প্রথম পদোন্নতিতেই তহসিলদার হয়ে যেত। এরপর ডেপুটি কালেক্টর। এটা ছিল হিন্দুস্তানীদের আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। এর উপরের পোস্ট- কালেক্টর ও কমিশনার শুধু ইংরেজরাই হত। কালেক্টর সাহেব অত্যন্ত জোরের সাথেই আব্বাজানকে এ মাশওয়ারা দিলেন।

আব্বাজান ঘরে এসে এ ঘটনা শুনালেন। সঙ্গে এটাও বলে দিলেন, তিনি

কালেক্টর সাহেবের কথা মানতে পারবেন না। কিন্তু আব্বাজানের অনেক বন্ধুর এবং পরিবারের অনেকের মতামত এটাই ছিল যে, এত বড় সুযোগ যেন হাতছাড়া করা না হয়। আমাকে যেন অবশ্যই স্কুলে পাঠানো হয়। এমনকি কয়েকজন আব্বাজানকে রাজি করানোর চেষ্টাও করেছিলেন। তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। আব্বাজানের শেষ কথা ছিল, আল্লাহর উপর আমার পূর্ণ ভরসা আছে; আমার জীবনে সন্তানদের থেকে কিছু গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়বে না। ইনশাআল্লাহ সবসময় তাদেরকে দিতেই থাকব। হাঁ, মৃত্যুর পর কবরে কিছুর প্রয়োজন পড়বে। আর এ জন্য আমি তাদের দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করছি, যাতে কবরে ও হাশরে কিছু পেতে পারি। মোটকথা,  আব্বাজান কারো কোনো কথাই শুনলেন না।

 

অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়াশোনা

আমার এখনো স্মরণ আছে, আব্বাজানের তখনকার সেই সিদ্ধান্তে আমি বড়ই কষ্ট পেয়েছিলাম। যার একটা কারণ ছিল, আমি ভাবতাম- যদি আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়, কিছুদিন পরেই আমি সহকারী তহসিলদার, এরপর তহসিলদার হয়ে যাব। তারপর ডেপুটি কালেক্টর। এরচে’ বড় কারণ ছিল, আমার ক্রিকেট খেলার নেশা। এর জন্য প্রতিদিন মার খেতে হত। তবুও খেলা বন্ধ হত না আমার।  আশা ছিল, স্কুলে ভর্তি হলে খেলার পূর্ণ সুযোগও পেয়ে যাব। কিন্তু আব্বাজানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত- আমাকে স্কুলে ভর্র্তি করবেন না। এ ঘটনার পরেও প্রায় কয়েক বছর আমার অবস্থা ছিল, অনিচ্ছা ও অনাগ্রহে পড়তাম। মাদরাসায় আসা যাওয়া আর প্রতি বছর মাদরাসা পরিবর্তন। আবার প্রথম থেকে মিজান মুনশাইব পড়া।

 

জীবনে পরিবর্তনের সূচনা

১৩৩৮ হিজরী। আজ থেকে ৫২ বছর পূবের্র কথা। তখন আমার বয়স পনের বছর। আব্বাজান জানতে পারলেন সাম্ভলের এক মাদরাসায় একজন নতুন পাঞ্জাবী উস্তায এসেছেন। তিনি খুব যত্ন সহকারে ছাত্রদের পড়ান। আব্বাজান আমাকে তাঁর নিকট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আমাকে একজন হেকিমের একটি চিঠি দিয়ে সে উস্তাযের নিকট পাঠালেন। তিনি ছিলেন মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ নাঈম লুধিয়ানভী। (যিনি এখন পশ্চিম পাকিস্তানে আছেন। তিনি আমার বিশেষ মুহসিন উস্তাযগণের একজন।) তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কখন কোথায় পড়ালেখা করেছি? আমি বললাম, এতদিন এভাবে পড়ালেখা করেছি। এখন আমি কিছুটা বুঝমান হয়েছি। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিলেন, আমি নির্বোধ ও মেধাহীন নই। এও বুঝলেন, আমার এ সময়গুলো নষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে শুধু পড়ার প্রতি আমার অনিচ্ছা ও অনাগ্রহের কারণে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করায় আমি উত্তরে বললাম, ঘটনা বাস্তবেই এমন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করুন।

 

নিজ আগ্রহে পড়াশোনা শুরু

তিনি অত্যন্ত মুহাব্বতের সঙ্গে কোনো প্রকার রাখঢাক ছাড়াই বললেন, তুমি নিজেই নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নাও! যদি এখনো তোমার পড়ার আগ্রহ না জন্মে থাকে তাহলে আমাকে পরিষ্কার বল। আমি নিজে তোমার আব্বাজানের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাকে বুঝিয়ে বলব- তিনি যেন তোমার সময়গুলো নষ্ট না করেন। অন্য কোনো লাইনে তোমাকে লাগিয়ে দেন। আর যদি তোমার পড়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে আমি তোমাকে পড়াব এবং ইনশাআল্লাহ, তুমি অতি অল্প সময়ে পড়ে শেষ করতে পারবে। তখন আমার অন্তরে আল্লাহ তাআলা দান করলেন আমি বললাম, ইনশাআল্লাহ এখন থেকে আমি পড়ব। নিজ আগ্রহে পড়ব। তিনি আমাকে পড়ানো শুরু করলেন। মিজানের কিছু পৃষ্ঠা নির্দিষ্ট করে বললেন, এ পৃষ্ঠাগুলো মনোযোগের সঙ্গে দেখো। এর বিষয়বস্তু মুখস্থ করে নাও। যেখানে বুঝবে না আমাকে  জিজ্ঞাসা করে নিবে। অন্যান্য সবক শেষ করে আমি তোমার পরীক্ষা নেব।

এভাবে তিনি আট-দশ দিনের মধ্যে মিজান-মুনশাইব শেষ করে দিলেন। আমি এখন বুঝি মিজান মুনশাইবে কী আছে। একইভাবে মাস দু-একের মধ্যে পাঞ্জেগাঞ্জ ও নাহবেমীর পড়িয়ে শেষ করলেন। তাঁর কাছে গিয়েছিলাম বছরের মাঝে । শাবান পর্যন্ত তিনি ইলমুসসীগা ও হেদায়াতুন্নাহু পড়িয়ে দিলেন। তখন থেকে আমি নিজ আগ্রহে মনোযোগসহ পড়তে লাগলাম।

পরের বছর মুফতী নাঈম ছাহেব সাম্ভলে আর আসেননি। আমাকে পড়ার জন্য সাম্ভলের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হল। চার বছরে আমি মুতাওয়াসসিতার সকল কিতাব শেষ করলাম। সে সময় আমাদের মাদরাসাগুলোতে মানতিক ও ফালসাফার অনেক প্রচলন ছিল। এজন্য আমি মানতিক ফালসাফার অনেক কিতাব পড়েছিলাম। এখন প্রকাশ করতে দোষের কিছু নেই, আল্লাহর দয়ায় আমি সাথীদের মধ্যে মুমতায ছিলাম।

 দেওবন্দে পড়ার আগ্রহ ও আব্বাজানের অনুমতি প্রদান

আমি যাঁদের নিকট পড়ালেখা করেছি তাঁরা সকলেই দারুল উলূমের শিক্ষা-দীক্ষাপ্রাপ্ত রূহানী সন্তান। এ জন্য আমার মানসিকতা দেওবন্দীই ছিল। তাই সামনের পড়াশুনা দারুল উলূমেই করার ইচ্ছা হল। আমি আব্বাজানের ব্যাপারে পূর্বেও বলেছি, তাঁর আকীদা-বিশ্বাস কিছুটা অন্য ধরনের ছিল। আকাবিরে দেওবন্দের ব্যাপারেও তাঁর একরকম দূরত্ব ছিল। কিন্তু জানা নেই, আল্লাহ কীভাবে তাঁর অন্তরে এ কথা গেঁথে দিয়েছিলেন- দেওবন্দের ওলামায়ে কেরামই ভালভাবে হাদীস পড়ান। এজন্য যেই আমি হাদীস পড়ার জন্য দারুল উলূম দেওবন্দে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম, তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। এ কথা যখন জানাজানি হল যে, আমি হাদীস পড়ার জন্য দেওবন্দ যাচ্ছি তখন আব্বাজানের এগার শরীফ, বার শরীফ এবং উরসের পীর ভাইয়েরা তাঁকে বললেন, সূফীজী, কি জুলুমের কথা! শুনলাম আপনার ছেলে দেওবন্দ পড়তে যাচ্ছে। আব্বাজান তখন শুধু এটুকুই বলেছিলেন- আমার বিশ্বাস সে আমার পথেই থাকবে। তিনি তাঁর মত পাল্টালেন না। আমি ১৩৪৩ হিজরির শাওয়াল মাসে দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হলাম। প্রথম বছর মেশকাত, হেদায়া আখেরাইনসহ অন্যান্য কিতাবাদি পড়লাম। আর দ্বিতীয় বছর দাওরায়ে হাদীস।

 

আব্বাজানের দেওবন্দ আগমন

দারুল উলূমে অবস্থানের সময়কার একটি ঘটনা আপনাদের বলি। যে জায়গায় শাইখুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ. অবস্থান করতেন, এখন হযরতের পরিবারের লোকেরা থাকেন, আমাদের ছাত্রজীবনে সে জায়গায় কাসেমী মাতবা ও কাসেমী কুতুবখানা ছিল। যে ছাত্রদের মাদরাসায় জায়গার ব্যবস্থা হত না তাদেরকে সেখানের একটা কামরায় থাকার অনুমতি দেয়া হত। আমিও সে ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। দু’বছর আমার অবস্থান সেখানেই ছিল।

প্রথম বছরের কথা। ভালভাবে স্মরণ আছে, দিনটি ছিল রবিউল আউয়াল মাসের চৌদ্দ তারিখ শুক্রবার। এশার নামাযের সময় হয়েছে। আমি কাসেমী মাতবাআতে অযু করছি। হঠাৎ আব্বাজান জিজ্ঞাসা করতে করতে কাসেমী মাতবাআতে এসে উপস্থিত। পূর্ব থেকে কোনো অবগতি ছিল না। ধারণা বা সম্ভাবনা কোনোটাই না। কিন্তু আমার মনে

পড়ল, রবিউল আউয়াল মাস, এ সময়েই পীরানে কালিয়ারের উরস হয়ে থাকে। হয়ত আব্বাজান সেখানেই গিয়ে থাকবেন। পীরানে কালিয়ারের উরস তাঁর কখনো ছুটে না। জিজ্ঞাসা করার পর তিনি এটাই

বললেন, আমি কালিয়ার শরীফের উরসে

এসেছি। মনে হল, দেওবন্দ তো নিকটেই। তাই উরস শেষ করে এসে পড়লাম।

আমি বললাম, এশার জামাতের সময় হয়ে গেছে। আব্বাজানের অযু ছিল। তিনি আমাদের সঙ্গে মসজিদে চলে এলেন। তখনকার সময় হাউজ ঐ জায়গায় ছিল বর্তমানে যে স্থানে মসজিদের শেষ অংশ। যেহেতু মসজিদে লোক সংকুলান হত না তাই কাঠ দিয়ে হাউজকে ঢেকে দিয়ে সেখানেও কাতারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা মসজিদে প্রবেশ করলাম। এ দিকে নামাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। শেষ কাতারে হাউজের উপরে জায়গা পেলাম।

 

আব্বাজানের পরিবর্তন

চৌদ্দ তারিখের চন্দ্রালোকিত রজনী, তাছাড়া জুমার দিবাগত রাত হওয়ায় ছাত্ররা সকলেই সুন্দর পোশাক পরিহিত ছিল। আমরা যারা হাউজের উপরে একটু উঁচুতে দাঁড়িয়েছিলাম, রুকু ও সেজদার সময় সামনের লোকদেরকে মনে  হচ্ছিল আসমান থেকে নেমে আসা ফেরেশতার কাতার। আমার ভালভাবেই স্মরণ আছে, বড়ই নূরানী ছিল সে দৃশ্য। আমি আব্বাজানের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি অনুভব করলাম, আব্বাজান এ দৃশ্যের দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছেন। নামায শেষে কাসেমী মাতবাআয়ে আসলাম। আব্বাজানের কথায় বুঝলাম, আমার অনুভূতি সত্য। আব্বাজান দারুল উলূমের নামাযের দৃশ্যে অত্যন্ত প্রভাবান্বিত হয়েছেন।

 

ইদরিস কান্ধলভী রাহ.-এর কুরআনের দরস

ফজরের পর মসজিদে হযরত মাওলানা ইদরিস কান্ধলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কুরআনের দরস হত। যদিও তিনি তখন দারুল উলূমের উঁচু পর্যায়ের উস্তায ছিলেন না, বয়সও ছিল কম, কিন্তু নিজের যোগ্যতার কারণে বেশ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। ছাত্রদের কাছেও ছিলেন প্রিয়পাত্র। সে সময় দারুল উলূমের পাঠ্যসূচিতে তরজমায়ে কুরআন ছিল না। তঁাঁর এ দরস ছিল অতিরিক্ত ও তাঁর স্বভাবজাত রুচির পরিচায়ক। চিন্তার প্রশস্ততা ছিল, বলতেনও খুব, দরসে কুরআনের হক আদায় করতেন তিনি। বেশ উপকৃত হতাম আমরা।

সময় বুঝে ঐ দিন হুযুরের কানে দিয়ে দিলাম যে, আমার আব্বাজান এসেছেন। তিনি উরস ও কাওয়ালীভক্ত। তঁাঁর আকীদা-বিশ্বাস এই এই ধরনের। আমাদের বুযুর্গানে দ্বীনের ব্যাপারে তাঁর কুধারণা রয়েছে। না জানার কারণে তিনি মনে করেন, দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম তাসাউফ ও বুযুর্গানে দ্বীনের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখেন না। আমার উদ্দেশ্য ছিল, আজকের দরসে যেন এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়।

ঘটনাচক্রে সেদিন সূরা ইউসুফের ঐ অংশের আলোচনা ছিল, যেখানে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম খাদ্য আনার জন্য তাঁর সন্তানদেরকে মিসর পাঠাচ্ছিলেন। আর ছোট ছেলে বিনইয়ামিন- ইউসুফ আলাইহিস সালামের সহোদর ভাই- কেও তাদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সে সময় তাদেরকে এক দরজা দিয়ে সকলকে প্রবেশ না করার উপদেশ দিয়েছিলেন।

يَا بَنِيَّ لَا تَدْخُلُوا مِنْ بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوا مِنْ أَبْوَابٍ مُتَفَرِّقَةٍ .

অধিকাংশ মুফাসসিরীন এর উদ্দেশ্য বলেছেন- যেন দর্শকের নযর লেগে না যায়। তাই উপদেশ শেষে আবার এও বলেছিলেন,

وَمَا أُغْنِي عَنْكُمْ مِنَ اللهِ مِنْ شَيْءٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ  .

 

তাসাউফ ও মারেফতের চমৎকার আলোচনা

মাওলানা কান্ধলভী ছাহেব এ আয়াতের উপর আলোচনা করতে গিয়ে তাওয়াক্কুলের হাকীকত এবং তাওয়াক্কুল ও উপকরণের সম্পর্কের বিষয়ে সুন্দর আলোকপাত করেন। সেদিন আরেফে রূমী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কিছু কবিতাও শুনালেন। এছাড়া তাসাউফ ও মারেফতের আরো কিছু বিষয়ে এত চমৎকার আলোচনা করেন, যা আব্বাজানের জন্য খুবই উপযুক্ত ছিল। এ দরসের দ্বারাও আব্বাজান প্রভাবিত হন। নামাযের দৃশ্য, নূরানিয়্যাতের উপলব্ধি, আবার সকালের দরস। সবকিছু আব্বাজানের মানসিকতা এবং আকাবিরগণের ব্যাপারে ধারণা অনেকটাই বদলে দিল।

দরস শেষে আব্বাজান বললেন, এখানকার বুযুর্গগণের মাযারে যেতে চাই। আমি আব্বাজানকে তাঁদের কবরে নিয়ে গেলাম। প্রথমে শাইখুল হিন্দ রহমাতুল্লাহি আলাইহির কবরের পাশে ধ্যানে বসলেন। দীর্ঘক্ষণ বসে রইলেন। এরপর হযরত নানুতবী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কবরের পাশেও মোরাকাবায় বসলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে রইলেন। তাঁর চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম, আব্বাজানের মাঝে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ফিরে এসে বললেন, তাদের স্তর তো অনেক উঁচু।

পরে আমাকে বললেন, এখানের উস্তাযগণের মধ্যে যিনি বেশি আল্লাহওয়ালা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাও। আমি প্রথমে মাওলানা সায়্যিদ আসগর হুসাইন ছাহেবের নিকট নিয়ে গেলাম। তাঁর যিয়ারত ও সাক্ষাতেও আব্বাজান খুবই প্রভাবিত হলেন। এরপর শাহ ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও মুফতী আযিযুর রহমান রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সাক্ষাতে নিয়ে গেলাম। এতেও অনেক প্রভাবিত হলেন। তাঁদের ব্যাপারে বললেন, তাঁরা তো সর্বদা যিকিরেই মশগুল থাকেন এবং ছাহেবে নিসবত।

মোটকথা, আমাদের আকাবির এবং দেওবন্দের ব্যাপারে আব্বাজানের যে খারাপ ধারণা ছিল অনেকটাই সেদিন দূর হয়ে গেল। এরপর তো আব্বাজানের উপর আল্লাহর অনেক বড় দয়া হয়েছে। আমার উদ্দেশ্য ছিল, ছাত্রজীবনের কিছু ঘটনা শুনানো।  আব্বাজানের জীবন চরিত বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। যেহেতু তাঁর আলোচনা এসেই পড়েছে; তাঁর আরেকটি ঘটনা শুনানো ভাল মনে করছি। ইনশাআল্লাহ এর দ্বারাও আপনাদের ফায়দা হবে।

 

আমার জন্য আব্বাজানের বিশেষ দোয়া

সম্ভবত ১৩৫৪ হিজরি। এখন থেকে তেইশ-চব্বিশ বছর পূর্বের কথা। আব্বাজানের হজ্বের সৌভাগ্য হয়। ফিরে এসে আমাকে একাকী  ডেকে বললেন, আমি তোমার জন্য কোনো কিছুই আনিনি। শুধু  তোমার জন্য একটা দুআ করেছি- ‘যেন তোমার নিকট সম্পদ জমা না হয় আর যেন তুমি কখনো অস্বচ্ছলতা ও কষ্টে না পড়’। আমার আশা, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ  তাআলা দুআ কবুল করেছেন।

এ কথার পর আজ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর চলছে। আপনাদের সামনে এই বাস্তবতা প্রকাশ করে দেওয়া সমীচীন মনে হচ্ছে যে, আজ পর্যন্ত আল্লাহ আমার সঙ্গে এ আচরণই করছেন। আমার নিকট সম্পদ আসেনি। তবে আলহামদুলিল্লাহ জীবনে কখনো আর্থিক সংকটেও পড়িনি। আল্লাহর দয়ায় জীবন বেশ সহজেই কেটেছে। আমার বিশ্বাস, যদি আমি ডেপুটি কালেক্টরও হতাম এবং আমার হাজার টাকার বেশি বেতন হত জীবনের এ শান্তি ও প্রশান্তি পেতাম না; আল্লাহর দয়ায় এখন আমার ভাগ্যে যা জুটেছে।

দারুল উলূম দেওবন্দের বরকত

আমার প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! আল্লাহ সাক্ষী, আমার কোনো যোগ্যতা ও পারদর্শিতা নেই। যা কিছু দেখছেন, দারুল উলূম ও তার আসাতিযায়ে কেরাম থেকে অর্জন করেছি। পূর্বেই বলেছি, যখন আমি

আরবী পড়া শুরু করি আমার মধ্যে পড়ার

কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ কিছুই ছিল না। পরে যখন নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা ও মনোযোগসহ পড়া শুরু করলাম তখনও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন বা আখেরাতের সফলতা অর্জনের কোনো স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি আমার ছিল না। কিন্তু আল্লাহর শোকর! দারুল উলূমে প্রবেশের মাধ্যমে এ নিআমতের একটা অংশ আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। তবে আমি যা পূর্বে বলেছি, আব্বাজান আমাকে কেবলমাত্র মাদরাসায় ভর্তি করেছেন- কবরে ও আখেরাতে এর প্রতিদান লাভ করার জন্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহ অবশ্যই আব্বাজানের এ আমলকে কবুল করেছেন। এ ছিল তাঁর মহা কুরবানী। যেন তিনি আমাকে আল্লাহর রাহে মান্নত করেছিলেন। দ্বীনের জন্য  উৎসর্গ করেছিলেন।

 

ইলম দুনিয়ার সবচে’ বড় নিআমত

আমার স্মরণ আছে, আব্বাজান সেদিন কালেক্টরের জোর আবেদন সত্ত্বেও আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে অস্বীকার করলেন। তখন অজ্ঞতার কারণে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। আমি মনে করেছিলাম, আমার ভবিষ্যত বুঝি অন্ধকার হয়ে গেল। এখন আমি বুঝি, সে দিনটি ছিল আমার সবচে’ মোবারক দিন; যে দিন আব্বাজান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি তার আখেরাতের জন্য আমাকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন।  আমার যখনই কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ হয়, হাদীসের কিতাব মুতালাআ করি এবং বুঝতে পারি- আল্লাহ কী ইরশাদ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসে কী হেদায়েত প্রদান করছেন তখন আমি অনুভব করতে পারি এটাই এ দুনিয়ার সবচে’ বড় নিআমত। যমীন ও আসমানের কোনো কিছুই এর মত মূল্যবান নয়।

আমার উপর আব্বাজানের সবচে’ বড় ইহসান

আর এটা আব্বাজানের সেই সিদ্ধান্তের বদৌলতেই হয়েছে। তখন অনুভব করি, এটাই আমার উপর আব্বাজানের সবচে’ বড় এহসান। আব্বাজান আমার জন্য ঘর বাড়িও রেখে গেছেন যার বর্তমান মূল্য অনেক। এছাড়া অনেক জমা-জমি রেখে গেছেন। যার মধ্যে অনেকগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। কিছু এখনো আছে। কিন্তু এসব কিছুর চেয়ে’ বড় এহসান- আমাকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসল মীরাছ। আল্লাহ আব্বাজানের এ আমলের প্রতিদান কবর ও আখেরাতে তাঁর শান অনুযায়ী দান করুন।

 

আত্মপরিচয় জেনে নিন!

আমার প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! আপনাদের অনেকেই এমন, যাদের পিতামাতা আব্বাজানের মত জেনেশুনে নিজের আখেরাতের জন্য সন্তানদেরকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সন্তানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অস্পষ্ট। যেমন একটা সময় আমারও এ অবস্থা ছিল। আর আপনাদের কিছুসংখ্যক এমন, যারা বংশীয় প্রথা বা পারিপার্শিক অবস্থার কারণে অথবা স্কুল কলেজের শিক্ষা অর্জন করতে না পেরে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করছেন। কিন্তু আমি আপনাদের আপন লোক। আপনাদের বলছি, আপনারা দ্বীনী ইলমের মর্যাদা ও সম্মান এবং নিজের আত্মপরিচয় জেনে নিন। এর মূল্যায়ন করুন। আপনারা যে মহা সম্পদ অর্জন করতে এখানে এসেছেন তা সকল নবীর মীরাছ এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘ওরাসাত’ বা রেখে যাওয়া মহাধন।

যদি আল্লাহ ইখলাছ দান করেন, নিয়ত এবং আমল সঠিক হয়ে যায় তাহলে আমাদের ও আপনাদের চেয়ে বড় সম্পদশালী আর সৌভাগ্যবান কেউ নেই। আপনারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিশনের দায়িত্বশীল-সেনাপতি ও সৈনিক। যদি আপনারা এর মর্ম বুঝতে পারেন এবং আত্মপরিচয় লাভ করতে পারেন তাহলে দুনিয়াবী কোনো পদ বা আসনের কামনা আপনাদের অন্তরে জাগ্রত হবে না। দুনিয়াদারদের জাকজমকপূর্ণ বাংলো আর দামী গাড়ি দেখে আপনাদের এগুলো না থাকার আফসোস ও হতাশা আসবে না; বরং আপনাদের অনুভূতি ও বিশ্বাস এটাই হবে যে, কুরআনের একটি সূরা এমনকি একটি আয়াত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস, যার জ্ঞান আপনার আছে, তা তাদের বাংলো আর গাড়ির তুলনায় হাজার গুণ মূল্যবান।

 

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন!

আমাদের তো উচিত, নিজেদের ভুল-ত্রুটি, অলসতা ও গুনাহের কারণে নিজেদেরকে ছোট মনে করা। কিন্তু ইলমে নববী ও নববী উত্তরাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদেরকেই উত্তম ও উঁচু মর্যাদার মনে করা। আর এ নিআমতের জন্য আল্লাহর অগণিত শুকরিয়া আদায় করা।  আল্লাহর কসম, আমি কিছুই না। গুনাহগার বান্দা। কিন্তু যতটুকু ইলম দারুল উলূমের বদৌলতে এবং আসাতেযায়ে কেরামের বরকতে অর্জিত হয়েছে, তা শুধু আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানীতেই হয়েছে। এটাকেই এ দুনিয়ার মহা সম্পদ মনে করি।

 

ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনটি পরামর্শ

আমার ভাইয়েরা! এটাই আমাদের বুযুর্গানে দ্বীনের রেখে যাওয়া সম্পদ। আল্লাহ আপনাদেরকেও দান করুন। এজন্যে আপনাদের তিনটি নছিহত করছি।

প্রথমত, নিজের মর্যাদা ও উদ্দেশ্যকে ভালোভাবে জানুন। এখনও যদি নিয়ত ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে আপনার চিন্তা সুস্পষ্ট না হয় তাহলে এখনই তা শুদ্ধ করে নিন। একাকী বসে ভাবুন, আপনি এখানে কেন এসেছেন? আপনি কে? আপনি যে ইলম শিখছেন এর মর্যাদা কী? এটাই আপনাদের সর্বোত্তম মোরাকাবা।

স্বাগ্রহে এবং মনোযোগের সঙ্গে পড়–ন। এটাই ইলমে দীনের কদর ও আযমতের হক। এছাড়া না কেউ কিছু অর্জন করেছে, না করতে পারবে। না কিছু লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, না হবে।

সর্বশেষ কথা হল, যে ইলম আপনি অর্জন করছেন  সে অনুযায়ী আমল করুন। জীবনকে সে মতে পরিচালনা করুন। তাকওয়া অর্জন করুন। তাকওয়ার সঙ্গে ইলম হল নূর ও আলো। যেমনটা আমি বলেছি, ইলম হল নববী মিরাস। আর তাকওয়া ছাড়া ইলম হল অন্ধকার-মহাবিপদ।

 

আল্লাহর দরবার এখনও সকলের জন্য উন্মুক্ত

আমার প্রিয় ভাইয়েরা! আল্লাহ ইলমের যেই মহা সম্পদ আমাদের আকাবির হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শাইখুল হিন্দ রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত গাংগুহী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত মাওলানা সায়্যিদ হোসাইন আহমাদ মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ মহামনীষীদের দান করেছেন তা এখনো তাঁর ভাণ্ডারে আছে। এ দারুল উলূম সেই ভাণ্ডারের দরজা। আল্লাহ আপনাদেরকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। যদি আপনারা সঠিক নিয়ত, মেহনত-মুজাহাদা ও তাকওয়ার

সঙ্গে এ ইলম অর্জনের চেষ্টা করেন তাহলে আমি আল্লাহর দয়ায় বিশ্বাসী হয়ে কসম খেয়ে বলতে পারি, আপনাদেরকে আপনাদের যোগ্যতা হিসাবে অবশ্যই দান করা হবে। কবর ও আখেরাতের পূর্বে এ দুনিয়াতেও এর স্বাদ আস্বাদন করতে

পারবেন। 

 

অনুবাদ : মুনশী মহিউদ্দিন আহমদ

 

 

 

advertisement