শিক্ষা-দীক্ষা : প্রশ্নফাঁসে হাঁস-ফাঁস
রফিক সাহেব অফিসে যাচ্ছেন। বাসে বড্ড ভিড়। এই দেশে অফিস টাইমে বাসে ভিড় হওয়া, এমনকি বাস না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাও অতি স্বাভাবিক। কিন্তু আজ রফিক সাহেব অস্বাভাবিক একটা বিষয় লক্ষ্য করলেন। বাসের সামনের দিকে স্কুলড্রেস পরা কিছু ছেলে গাদাগাদি করে বসে কয়েকটা স্মার্টফোনের ওপর ঝুঁকে আছে। রফিক সাহেব ভাবলেন হয়ত খেলা-টেলা কিছু দেখছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ল এখন তো খেলার মওসুম না, এখন মওসুম এসএসসি পরীক্ষার এবং যদ্দুর বোঝা যাচ্ছে এরা এসএসসি পরীক্ষার্থী; পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।
রফিক সাহেব কিঞ্চিত ধাঁধায় পড়ে গেলেন। কারণ পরীক্ষার আগমুহূর্তে মোবাইল টেপাটেপির চিত্রের সাথে তিনি পরিচিত নন। পরীক্ষার দিন সকাল হতে বাসায়, এরপর গাড়িতে, এরপর স্কুলের বারান্দায় বা মাঠে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নোট বা গাইড নিয়ে পড়ে থাকতেন। এরপর ঘণ্টা পড়লে আল্লাহ্র নাম নিতে নিতে হলে ঢুকতেন। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে এরা মোবাইল টিপছে কেন? সব মুখস্থ হয়ে গেছে, নাকি স্বপ্নে প্রশ্ন পেয়ে গেছে?
কৌতূহল সামলাতে না পেরে তাদের কাছে গিয়ে প্রশ্নটা তিনি করেই ফেললেন। এক কিশোর বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আরে আংকেল ডিস্টার্ব কইরেন না! যেই প্রশ্ন রাতে আউট হওয়ার কথা সেইটা আউট হইছে একটু আগে। এক হাজার টাকায় প্রশ্ন কিনছি, একটু শান্তিমত দেখতে দেন।’
রফিক সাহেব বুঝতে পারলেন, এরা প্রশ্ন পেয়েছে বটে, তবে তা স্বপ্নে নয়। পেয়েছে নেটে- হোয়াট্স অ্যাপ-ইমু-ভাইবারে। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এ কোন্ যুগে তিনি বাস করছেন? অফিসে পৌঁছে কলিগদের সাথে বিষয়টা আলোচনা করতে তারাও হতভম্ব হয়ে গেল। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় না, প্রশ্নফাঁসের মত অতি স্বাভাবিক কিন্তু আলোচিত বিষয় রফিক সাহেব জানেন না বলে।
অবশ্য রফিক সাহেব একা নন, দেশে আরো কতিপয় গুণী ব্যক্তি আছেন, যারা একই ক্যাটাগরির। পার্থক্য হচ্ছে রফিক সাহেব প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জানেন না, আর তাঁরা প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি মানেন না। এদের মধ্যে রয়েছেন মাননীয় একজন প্রতিমন্ত্রী। রাজবাড়ির এক অনুষ্ঠানে ‘দেশে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেনি’ দাবি করার পর সেখানে উপস্থিত কতিপয় শ্রোতা একে অন্যকে প্রশ্ন করেছেন- ‘কোত্থেকে এসেছে?’ মানহানি মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এ বাক্যের ব্যাখ্যা আমরা করতে পারছি না।
দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন এই দেশের ঐতিহ্যবাহী ও স্বনামধন্য একটি ছাত্রসংগঠনের প্রধান। তাদের হাঁকডাক ও উৎপাতে এই দেশে টেকা দায়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হলদখল ইত্যাদিসহ অল্পসময়ে বিপুল পয়সা হাতানোর কোনো ক্ষেত্রই তাদের নেকনজর থেকে রেহাই পায় না। এই ধরনের কোনো সুযোগ পাওয়ামাত্র দেশীয় অস্ত্র এবং বিদেশী হাতিয়ার নিয়ে তারা গর্জে ওঠেন, অতপর রিজিক অন্বেষণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের কতিপয় কর্র্র্র্র্মী যে পরিমাণ বুলেট ব্যয় করেছেন তা অনেক সৈনিক তার ৩০/৩৫ বছরের সৈনিক জীবনেও ব্যয় করেননি বা করার সুযোগ আসেনি। সেই অর্থে বলা চলে, সামরিক বাহিনীর চেয়েও অভিজ্ঞ কিছু ব্যক্তি এই সংগঠনের স্কোয়াডে আছেন, যারা যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তিকে ‘ফেলে’ দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
এমন একটি সুমহান ছাত্রসংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের কেন্দ্রীয় সভাপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে অতি আস্থার সাথে বলেছেন, ‘না তো! দেশে কোথাও প্রশ্নফাঁস হচ্ছে না।’ উপস্থাপিকা ভাবলেন, তিনি হয়ত শুনতে ভুল করেছেন। তিনি প্রশ্নটি আবার করলেন। এবার সভাপতি সাহেব আরো স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘যেখানে আমাদের জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায়, সেখানে প্রশ্নফাঁসের মত কোনো ঘটনা ঘটতেই পারে না।’ এবার উপস্থাপিকা যেন মাটি থেকে আকাশে পড়লেন। দিনের বেলা প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে কেউ যদি বলে ‘আহ! রাতের এই আকাশে কী চমৎকার জোছনা!’ তাহলে নির্বাক হওয়া ছাড়া আর কী উপায় থাকে!?
অবশ্য এমন কৌতুকপ্রিয় কিছু নেতা ও কর্মকর্তার বক্তব্য বাদ দিলে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে প্রশ্নফাঁস এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার বিষয়। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টা স্বীকার করে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল, এই অপকর্মের সাথে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার লোকজন জড়িত। শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সরকারি প্রেসের লোকজন, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রেস থেকে দুর্গম অঞ্চলের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, ইন্টারনেটে পারদর্শী নীতিভ্রষ্ট তরুণ- সবমিলিয়ে অজ¯্র শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে জড়িত। সাথে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রযুক্তি; আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। শিক্ষাসচিব নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, ‘প্রশ্নফাঁস আগেও কমবেশি হত। তবে সেটার পরিসর ছিল সীমিত। কিন্তু এখন ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, হোয়াট্সঅ্যাপ, ভাইবারের (অ)কল্যাণে তা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কোনো এক উৎস থেকে একবার ফাঁস হলেই হল, প্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তেই তা বিশ্বের এমাথা-ওমাথা হয়ে যাচ্ছে।’
প্রশ্নফাঁসের পর আসে এটা প্রতিরোধের প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদ্যোগগুলোতে একবার নজর বুলিয়ে নেয়া যাক।
-পরীক্ষা শুরুর ত্রিশ মিনিট আগে হলে প্রবেশ।
-কেন্দ্রের আশপাশে ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা।
-প্রশ্নফাঁসে জড়িত কাউকে ধরিয়ে দিলেই পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার।
-আরো কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে ব্যাপারে কমিটি গঠন।
-ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়া।
আশংকা হচ্ছে, সামনে কবে যেন বলা হয়- পরীক্ষাই বন্ধ করে দিতে হবে। সমগ্র পরীক্ষাব্যবস্থা বাতিল করে দিলে সমস্ত প্রশ্নফাঁস চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। এ যেন মাথাব্যথার জন্য মাথাকাটা থিওরি!
যাই হোক, সমাধান নিয়ে ভাবার আগে একটা বিষয় সামনে রাখা উচিত- সমস্যা আসলে প্রযুক্তিগত নয়, আসল সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। আমরা মানসিকভাবে পতিত হয়েছি, নীতিভ্রষ্ট হয়েছি। আমাদের কাছে শিক্ষা হল উদরপূর্তির হাতিয়ার। ভালো ফলাফল করা, বেশি বেতনের চাকুরি খুঁজে নেয়া আর বিলাসী জীবনযাপন করা। অতএব পড়ালেখা যাই হোক না কেন, ফলাফল ভালো করতে হবে। এ কারণেই ছাত্র ও অভিভাবক উভয়কেই নকলবাজিতে সমানতালে আগ্রহী দেখা যায়। ওপরের স্তরে তো বটেই, ৫ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাতেও দেখা যায় অভিভাবকরা জানালা দিয়ে ভেতরে নকল সাপ্লাই দিচ্ছেন। স্কুলের সুনামের আশায় শিক্ষকেরা হলের ভেতর উত্তর বলে দিচ্ছেন। এইসমস্ত কর্মকাণ্ডের একমাত্র ব্যাখ্যা দাঁড়ায়- ‘যেভাবেই হোক পাশ করো’।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে আমাদের শিক্ষক-অভিভাবকগণ নিজেদের কর্তব্যজ্ঞান ভুলে শিশুদের কী শিক্ষা দিচ্ছেন? ৫ম শ্রেণি থেকেই যদি শিশুদেরকে ‘অবৈধ পথে কার্য হাসিলের সবক রপ্ত করিয়ে দেয়া হয় তাহলে এরা বড় হয়ে জীবনের কোন্ অঙ্গন বাকি রাখবে? সুতরাং সবার আগে প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। শিক্ষার উদ্দেশ্য সুশিক্ষিত, যোগ্য, সৎ ও মেধাবী জাতি গড়া, যারা ভবিষ্যতে শক্ত হাতে দেশকে পরিচালনা করবে। অবশ্য সেজন্য যথাযথ উপাদান আমাদের সিলেবাসে থাকতে হবে।
প্রশ্নফাঁসের অন্যতম কারণ আমাদের নৈতিকতার ধ্বস। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে জাতিকে মূর্খ ও অযোগ্য করে ফেলা হচ্ছে- এমন ভয়াবহ অনৈতিক কাজে যারা জড়িত তাদের নৈতিকতায় যে ঘাটতি আছে তা বলাই বাহুল্য। চোখ বন্ধ করে বলা যায় এরা শুধু নামকাওয়াস্তে পড়ালেখাই করেছে। নীতি-নৈতিকতা শেখার ধারকাছ দিয়েও যায়নি। বর্তমানে আমাদের শিক্ষা সিলেবাসে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা শিরোনামে যতটুকু যা পড়ানো হয় তা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং এটা পড়ানোও হয় চূড়ান্ত অবহেলার সাথে। অনেক জায়গায় দেখা গেছে ইসলাম ধর্মশিক্ষার বই পড়াচ্ছেন এমন শিক্ষগণ যাদের মধ্যে ন্যূনতম ধর্মীয় জ্ঞানও নেই এমনকি কোথাও কোথাও হিন্দু শিক্ষকও! অথচ ৯০/৯৫ ভাগ ছাত্র মুসলমান! এই শিক্ষকগণ মুসলিম ছাত্রদেরকে ধর্মশিক্ষার বই কীভাবে পড়াবেন? এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের শিক্ষা-সিলেবাসে ধর্মশিক্ষা চূড়ান্ত অবহেলার শিকার, যার পরিণতি এখন আমাদের ভুগতে হচ্ছে। এরা শুধু শিক্ষাই নিচ্ছে, দীক্ষাটা পাচ্ছে না কোথাও। অতএব দেশের মূলধারার যোগ্য আলেমসমাজের তত্ত্বাবধানে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার সিলেবাস নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। অতপর স্কুলপ্রতি অন্তত একজন যোগ্য দ্বীনদার শিক্ষক রেখে তাঁদের মাধ্যমে বাচ্চাদের হৃদয়গভীরে আল্লাহর ভয় ও নৈতিকতার শিক্ষা গেঁথে দিতে হবে।
এর পাশাপাশি দেশের সৎ ও সুশিক্ষিত সমাজের পরামর্শ নিয়ে প্রশ্নফাঁস রোধে যাবতীয় অন্যান্য উদ্যোগ ও আয়োজন বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে আশা করা যায় প্রশ্নফাঁসের এই ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে আমাদের দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে। অন্যথায় একটা অশিক্ষিত, অযোগ্য, অর্থলিপ্সু ও উদরপূজারী একটা জাতির হাতে এই প্রিয় বাংলাদেশকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।