নবীজীর দস্তরখানে
৩০. ঘর থেকে ও দস্তরখান থেকে শয়তান তাড়াও
তুমি কি চাও তোমার ঘরে শয়তান রাত্রিযাপন করুক? অথবা তোমার দস্তরখানে শয়তান তার চেলা-চামু-া নিয়ে বসে পড়–ক? না, তা হতে পারে না। শয়তানকে ঘরেই ঢুকতে দিব না; দস্তরখানে বসা তো ‘দূর কি বাত’। কী করলে শয়তানের জন্য তোমার ঘরের দরজা বন্ধ হবে এবং শয়তানটা তোমার দস্তরখানের ধারে-কাছেও আসতে পারবে না- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শিখিয়েছেন।
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-
إِذَا دَخَلَ الرّجُلُ بَيْتَهُ، فَذَكَرَ اللهَ عِنْدَ دُخُولِه وَعِنْدَ طَعَامِه، قَالَ الشّيْطَانُ: لَا مَبِيتَ لَكُمْ، وَلَا عَشَاءَ، وَإِذَا دَخَلَ، فَلَمْ يَذْكُرِ اللهَ عِنْدَ دُخُولِهِ، قَالَ الشّيْطَانُ: أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ، وَإِذَا لَمْ يَذْكُرِ اللهَ عِنْدَ طَعَامِه، قَالَ: أَدْرَكْتُمُ الْمَبِيتَ وَالْعَشَاءَ.
কেউ যখন ঘরে প্রবেশ করে এবং প্রবেশের সময় ও খাবারের সময় আল্লাহ্র নাম নেয় তখন শয়তান (তার চেলা-চামুণ্ডাদের) বলে, (তোরা অন্যখানে দেখ) এখানে তোদের রাত্রিযাপনের সুযোগ নেই, খাবারেরও ব্যবস্থা নেই। আর ব্যক্তি যদি ঘরে প্রবেশের সময় আল্লাহ্র নাম না নেয় তখন শয়তান (তার চেলা-চামুণ্ডাদের) বলে, এখানে তোমাদের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর খাবারের সময়ও যদি আল্লাহ্র নাম না নেয় তখন বলে, (এসো! তোমরা সবাই এখানে এসো!!) এখানে তোমাদের রাত্রিযাপন ও খাবার উভয় ব্যবস্থাই হয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০১৮
ঘরে ঢোকার সময় কোন্ দুআর মাধ্যমে আল্লাহর নাম নিতে হবে- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের তা শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যখন কেউ ঘরে প্রবেশ করে সে যেন এই দুআ পড়ে-
اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَ الْمَوْلِجِ، وَخَيْرَ الْمَخْرَجِ، بِسْمِ اللهِ وَلَجْنَا، وَبِسْمِ اللهِ خَرَجْنَا، وَعَلَى اللهِ رَبِّنَا تَوَكّلْنَا.
আল্লাহ! আমি তোমার কাছে চাই- কল্যাণপূর্ণ প্রবেশ, কল্যাণপূর্ণ প্রস্থান, আল্লাহ্র নামে প্রবেশ করলাম, আল্লাহ্র নামেই বের হলাম এবং আল্লাহ্র উপরই ভরসা করলাম। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৯৬
এ তো গেল ঘরে প্রবেশের সময় আল্লাহ্র নাম নেয়া। আর খাবারের শুরুতে আল্লাহ্র নাম নেওয়ার জন্য বিসমিল্লাহ বললেই হয়ে গেল। সাথে সাথে এক্ষেত্রে নবীজী আমাদের আরেকটি দুআও শিখিয়েছেন, যাতে আল্লাহর নামের সাথে সাথে বরকতের দুআও রয়েছে। সামনের শিরোনামে আমরা সে দুআটি শিখব।
৩১. খাওয়া শুরু করার একটি দুআ
এখন আমরা যে দুআটি শিখব তা খাওয়ার শুরুতে পড়তে হয়। শয়তান খাবারের বরকত নষ্ট করে দেয়। এই দুআ পড়লে শয়তানও ভিড়তে পারবে না তোমার দস্তরখানের কাছে, সাথে তোমার খাবারেও বরকত হবে। এ খাবারের মাধ্যমে দেহ যেমন শক্তি সঞ্চয় করবে তেমনি আত্মাও পাবে নূর। আল্লাহ্র নাম নিয়ে খাওয়া খাবারের দ্বারা শরীর যেমন শক্তিশালী হয়, কলবও হয় নূরানী-আলোকিত।
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর রা. ও ওমর রা. আবু আইয়ূব আনসারী রা.-এর বাড়িতে এলেন। তাঁদের সামনে কয়েক প্রকার সুস্বাদু খাবার পেশ করা হল। তাঁরা তৃপ্তিভরে খেলেন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
...إِذَا أَصَبْتُمْ مِثْلَ هَذَا فَضَرَبْتُمْ بِأَيْدِيكُمْ فَكُلُوا بِسْمِ اللهِ وَبَرَكَةِ اللهِ.
...যখন তোমাদের সামনে এমন সুস্বাদু খাবার পেশ করা হয় এবং তোমরা খাবার শুরু কর তখন বল-
بِسْمِ اللهِ وَبَرَكَةِ اللهِ
আল্লাহ্র নামে এবং তাঁর বরকত নিয়ে শুরু করছি। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭০৮৪; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪২৮৪; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ২২৪৭; আলমুজামুস সগীর, হাদীস ১৮৫
৩২. কাঁচা পেয়াজ-রশুন খেলে...
আজকে বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। দুপুরের দস্তরখানে খুব মজা হবে। বিরিয়ানির সাথে সালাদ তো থাকবেই, কিন্তু কাঁচা পেঁয়াজ না হলে কি চলে। লোকমায় লোকমায় কাঁচা পেঁয়াজ- খাওয়ার রুচি বাড়িয়ে দেয়। খুব খেলাম পেঁয়াজ দিয়ে বিরিয়ানি। কিন্তু পেঁয়াজের গন্ধ আমি যতটুকু টের পাচ্ছি না পাচ্ছি- যেই মানুষটার সাথে আমি কথা বলছি, তিনি ঠিকই টের পাচ্ছেন এবং কষ্ট পাচ্ছেন। একটি হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ أَكَلَ ثُومًا أَوْ بَصَلًا فَلْيَعْتَزِلْنَا، أَوْ لِيَعْتَزِلْ مَسْجِدَنَا.
যে পেঁয়াজ-রশুন খেয়েছে (এর দুর্গন্ধ দূর করা ছাড়া) সে যেন আমাদের (মজলিস) থেকে অথবা বলেছেন আমাদের মসজিদ থেকে দূরে থাকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪৫২
তাই বলে কি কাঁচা পেয়াজ-রশুন খাওয়া নিষেধ? না, তা নয়। মদীনায় হিজরত করে নবীজী যখন আবু আইয়ূব আনসারী রা.-এর বাসায় অবস্থান করছিলেন তখন একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দস্তরখানে একটি খাবার দেওয়া হল। নবীজী তা খেলেন না। আবু আইয়ূব রা. চিন্তায় পড়ে গেলেন- নবীজী খেলেন না কেন? কারণটা তার মুখ থেকেই শুনি-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا أُتِيَ بِطَعَامٍ أَكَلَ مِنْهُ، وَبَعَثَ بِفَضْلِه إِلَيّ، وَإِنهُ بَعَثَ إِلَيّ يَوْمًا بِفَضْلَةٍ لَمْ يَأْكُلْ مِنْهَا، لِأَنّ فِيهَا ثُومًا، فَسَأَلْتُهُ: أَحَرَامٌ هُوَ؟ قَالَ: لَا، وَلَكِنّي أَكْرَهُه مِنْ أَجْلِ رِيحِه.
(তিনি বলেন,) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে খাবার পেশ করলে তিনি খেতেন এবং বেঁচে যাওয়া অংশ পাঠিয়ে দিতেন। একদিন তিনি খাওয়া ছাড়াই একটি খাবার পাঠিয়ে দিলেন। (আমি বুঝতে পারলাম) তাতে রশুন থাকার কারণে তিনি তা খাননি। তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম- রশুন (খাওয়া) কি হারাম? তিনি বললেন, না, তবে এর দুর্গন্ধের কারণে আমি তা পছন্দ করি না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৫৩
তাহলে কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়া যাবে। প্রয়োজন শুধু খাওয়ার পর ভালো করে মুখের দুর্গন্ধটা দূর করা। ‘দুর্গন্ধ’ তো দূর করারই বিষয়; তা আমার মুখে থাকবে কেন? সুতরাং কাঁচা পেঁয়াজ খেলে ভালো করে মুখ পরিষ্কার করব, দুর্গন্ধ দূর করব; যাতে অন্যের কষ্ট না হয়।
৩৩. আওয়াজ করে ঢেকুর তুলব না
কোথাও মেহমান হিসেবে খেলাম বা নিজের বাসায়। খাবারটা বেশ মজাদার হয়েছে। খাবার শেষে তৃপ্তির ঢেকুর এল। বেশ আওয়াজ করে মস্ত বড় একটা ঢেকুর তুললাম। আশপাশের মানুষগুলো একটু বিরক্ত হল। আমি সেদিকে ভ্রƒক্ষেপই করলাম না।
এটি ঠিক নয়; ভদ্রতার খেলাফ। খাবার শেষে যদি ঢেকুর আসে তাহলে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে তা প্রতিহত করার। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত আওয়াজ যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তেমনি মুখে হাত দিয়ে বা রুমাল দিয়ে অসুন্দর দৃশ্যটি অন্যদের থেকে আড়াল করারও চেষ্টা করতে হবে।।
একবার নবীজীর সামনে এক ব্যক্তি (আওয়াজ করে) ঢেকুর তুলল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন-
كُفّ عَنّا جُشَاءَكَ.
তুমি (যথাসাধ্য) তোমার ঢেকুর প্রতিহত কর (প্রতিহত করার চেষ্টা কর)। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৭৮