আরবজাতি কীভাবে ফিরে পাবে তার মর্যাদা
বিশ্বের চোখে আরববিশ্বের গুরুত্ব
বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে আরবভূখণ্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। শুরু থেকেই তা ঐসব জাতি ও জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল, যারা মানবজাতির ইতিহাসে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া তার বুকে রয়েছে সম্পদ ও শক্তির সুবিশাল ভাণ্ডর-জ্বালানী তেল, লোভাতুর পশ্চিমা বিশ্ব যার নাম দিয়েছে ‘তরল স্বর্ণ’। শিল্প ও যুদ্ধকে যদি একটি শরীর কল্পনা করি তাহলে তেল হচ্ছে সেই শরীরের জন্য প্রবহমান রক্ত, (যার জন্য বিভিন্ন নামে পশ্চিমাদের হাতে লাগাতার ঝরছে আরবদের এত রক্ত)। তদুপরি আমাদের আরবভূখ- হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা ও দূরপ্রাচ্যের মাঝে সংযোগস্থল। সর্বোপরি আরব হচ্ছে ইসলামী বিশ্বের স্পন্দিত হৃদ্পি-। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কারণে পুরো মুসলিমবিশ্বের অভিমুখ আরবের দিকে। প্রতিটি মুসলিম হৃদয় আরবের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততার বন্ধনে আবদ্ধ।
সম্প্রতি বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে আরবভূখণ্ডের গুরুত্ব আরো বেড়ে যাচ্ছে একারণে যে, আল্লাহ না করুন হয়ত এটাই হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র। তাই পশ্চিমা সমরবিশেষজ্ঞরা নতুন করে আরববিশ্বের মানচিত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। সেখানে রয়েছে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা ও প্রতিভা; রয়েছে চিন্তার উপযোগী সক্রিয় বুদ্ধি এবং যুদ্ধের উপযোগী মযবূত শরীর; রয়েছে দক্ষ জনবল ও কর্মীর হাত; রয়েছে বড় বড় বাজার ও বাণিজ্যকেন্দ্র এবং রয়েছে কৃষি-উপযোগী প্রচুর ভূমি।
সেখানে রয়েছে ‘সৌভাগ্যের প্রতীক’ নীলনদ এবং নীলনদের দেশ মিশর, যা উর্বরতায়, সম্পদে, শস্যপ্রাচুর্যে, সর্বোপরি বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি ও নাগরিক সভ্যতার সমৃদ্ধিতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী।
আরো রয়েছে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও প্রতিবেশী বিস্তীর্ণাঞ্চল, যার আবহাওয়া ও জলবায়ু অতি মনোরম ও স্বাস্থ্যপ্রদ। প্রকৃতি সেখানেই তার অপার সৌন্দর্য যেন অকৃপণভাবে ঢেলে দিয়েছে। সর্বোপরি এ অঞ্চল আলাদা সামরিক কৌশলগত গুরুত্বেরও অধিকারী।
সেখানে রয়েছে সভ্যতার লালনভূমি ইরাক, দজলা-ফোরাতের সুবাদে আদিকাল থেকেই যাকে বলা হয় দুই নদীর দেশ, بلاد الرافدين যা শৌর্য-সাহস, অদম্য মনোবল ও কষ্টসহিষ্ণুতার কারণে, সেই সঙ্গে বর্তমানে বস্তুসভ্যতার প্রাণ তেল-সম্পদের কারণে প্রসিদ্ধ।
সর্বোপরি আরবভূখণ্ডেই রয়েছে মক্কা, মদীনা, হিজায ও জাযীরাতুল আরব; মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসাবে যা অপরিসীম দ্বীনী মর্যাদা ও ধর্মীয় প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী। সেখানে পবিত্র ভূমিতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ইসলামের অন্যতম প্রধান ইবাদত হজ্জ। তাতে ঘটে সারা পৃথিবী থেকে আগত লাখ লাখ মানুষের ভাবগম্ভীর আধ্যাত্মিক সমাবেশ, সারা বিশ্বে যার কোন তুলনা নেই। তেল, সম্পদের বিপুল মজুদের কথা এখানে না হয় না-ই বলা হলো।
এসকল বহুমুখী গুণ, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বের কারণে বহুকাল ধরে আরববিশ্ব হয়ে আছে পশ্চিমাদের আগ্রহ ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু, লোভ-লালসার ক্ষেত্র এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বসঙ্ঘাতের উত্তপ্ত ভূমি। এর প্রতিক্রিয়ারূপে আরবজাতির মধ্যে যেখানে জেগে ওঠার কথা ছিলো ঈমানী গায়রত ও ইসলামী চেতনার জোয়ার; আফসোস, তার পরিবর্তে আজ সমগ্র আরবিশ্বে জেগে উঠেছে আরবজাতীয়তাবাদ ও স্বদেশপূজার সুতীব্র অনুভূতি ও আন্দোলন।
আল্লাহর রাসূল মুহম্মদ আরবজাতির প্রাণ
কিন্তু একজন মুসলিম আরববিশ্ব ও আরবজাতির প্রতি সেই দৃষ্টিতে তাকায় না, যে দৃষ্টিতে তাকায় ইউরোপ, আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের জাতিবর্গ। এমনকি আরবের প্রতি কোন জাতীয়তাবাদী আরবের যে দৃষ্টি, একজন মুসলিমের দৃষ্টি তা থেকেও সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন মুসলিমের দৃষ্টিতে আরবের পবিত্র ভূমি হচ্ছে ইসলামের দোলনা ও প্রতিপালনভূমি, ইসলামের নূর-মিনার এবং মানবতার রক্ষাদুর্গ। জাযীরাতুল আরব হচ্ছে বিশ্বনেতৃত্বের কেন্দ্রভূমি। মুসলিম বিশ্বাস করে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হচ্ছেন আরবজাতির প্রাণ, অস্তিত্বের ভিত্তি এবং তার গৌরব ও মর্যাদার শিরোনাম। আরববিশ্ব আজ যত সম্পদ, তেলক্ষেত্র, সোনার খনি এবং যত গুণ-বৈশিষ্ট্য ও কল্যাণের অধিকারী, তার সঙ্গে যদি আরো কয়েকগুণ যুক্ত হয়, আর আল্লাহ না করুন সাইয়েদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে তার পরিচয়সূত্র ছিন্ন হয়ে যায়, তাঁর দ্বীন ও শরীআত, তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ থেকে যদি তারা বিচ্যুত হয়ে পড়ে তাহলে আরবজাতি হবে প্রাণহীন এক দেহ এবং মরুভূমির বালুতে আঁকা অস্পষ্ট রেখা। এককথায় বিশ্বের মানব-মঞ্চ থেকে আরবজাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে তখন খুব বেশী সময় লাগবে না।
আল্লাহর নবী এই মুহম্মদে আরাবীই তো তাদের জাতীয় সত্তার অস্তিত্ব দান করেছেন। তাঁর পূর্বে তো এই ভূখণ্ড ছিলো শতখণ্ডে খণ্ডিত অখ্যাত, অজ্ঞাত, উপেক্ষিত ও অবহেলিত দেশ। সেখানে ছিলো পরস্পর দ্বন্দ্ব-বিবাদ; খুনাখুনি ও রক্তপাতে লিপ্ত বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্র। মেধা, যোগ্যতা ও প্রতিভা যা কিছু ছিলো, অপচয় হচ্ছিলো, কিংবা অক্ষেত্রে ব্যয় হচ্ছিলো। অজ্ঞতা, মূর্খতা, ভ্রষ্টতা ও গোমরাহির অন্ধকারে সারা দেশ ডুবে ছিলো।
অহমিকা, আত্মম্ভরিতা ও জাত্যাভিমান ছিলো তাদের প্রচণ্ড, কিন্তু রোম ও পারস্যের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার কথা স্বপ্নেও তারা ভাবতে পারতো না। এমন কথা কেউ যদি তাদের কানে দিতো তাহলেও কোন অবস্থাতেই তারা তা বিশ্বাস করতে পারতো না। আরববিশ্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ শাম ও সিরিয়া ছিলো রোম সাম্রাজ্যের ‘উপনিবেশ’, যা রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিলো। ন্যায়, সাম্য, সুবিচার ও স্বাধীনতার কোন অর্থই তাদের জানা ছিলো না।
অন্যদিকে ইরাক ছিলো কায়ানি শাসনের ভোগ-চাহিদা ও লোভলালসার শিকারভূমি। বিভিন্ন নামে আরোপিত নিত্যনতুন শুল্ক ও করের বোঝায় তারা ছিলো বিপর্যস্ত। মিশর ছিলো রোমান সাম্রাজ্যের বাহন-উট ও দুধের উটনী। পিঠে চড়তো, দুধ খেতো, কিন্তু পর্যাপ্ত ঘাস দিতো না। তদুপরি ছিলো রাজনৈতিক যুলুম-অবিচার এবং ধর্মীয় নিপীড়ন-নির্যাতন।
ছিন্নভিন্ন, বিপর্যস্ত ও বিভিন্ন নিপীড়ন-নির্যাতনের এই ভূখণ্ডে হঠাৎ ইসলামের সুশীতল বায়ু প্রবাহিত হলো। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতে পেলেন, গোটা আরব বিনাশ ও ধ্বংস এবং হালাকত ও বরবাদির দোরগোড়ায় চলে গিয়েছে। তিনি হাত ধরে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের নতুন জীবন দান করলেন। নূর দান করলেন, যার উজ্জ্বলতায় তারা মানবসমাজে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে। তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিলেন এবং তাযকিয়া ও আত্মসংশোধনের দীক্ষা দিলেন। এভাবে মুহম্মদী নবুয়তের পর আরবজাতির প্রকৃতি বদলে গেলো। এখন তারা বিশ্বের জন্য ইসলামের সফীর ও প্রতিনিধি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার বার্তাবাহী। তাহযীব ও তামাদ্দুন এবং নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির পতাকাবাহী। সারা বিশ্বের জন্য এখন তারা সাম্য, শান্তি, কল্যাণ ও করুণার অগ্রদূত। এভাবে শাম, ইরাক ও মিশর নতুন পরিচয় লাভ করলো এবং আরবজাতি নতুন জাতীয় সত্তায় আত্মপ্রকাশ করলো।
আল্লাহর রাসূল যদি না হতেন, তাঁর দাওয়াত, রিসালাত ও মিল্লাত যদি না হতো, কোথায় থাকতো আজ শাম, ইরাক ও মিশর? কোথায় থাকতো আজকের এ অনন্য মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী আরব জাহান ও আরবজাতি? কোন কিছুর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেতো না। শুধু তাই নয়, পৃথিবীও কখনো সভ্যতা, সংস্কৃতি, জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম ও নৈতিকতা এবং উন্নতি ও অগ্রগতির বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছতে পারতো না।
উপরে যা বলা হলো, কসম করে বলো হে আরব, তা কি সত্য নয়? যদি সত্য হয় তাহলে বলবো, আরবের কোন সরকার বা জনগোষ্ঠী যদি দ্বীনুল ইসলামকে পরিত্যাগ করে পাশ্চাত্যের সঙ্গে, কিংবা ইসলামপূর্ব আরব জাহেলিয়াতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, যদি তারা জীবন ও জীবনব্যবস্থা থেকে শরীয়তে মুহম্মদীর আহকাম ও বিধান সরিয়ে পাশ্চাত্যের জীবনব্যবস্থা ও জীবনদর্শন গ্রহণ করতে চায়, কিংবা আরবজাতীয়তাবাদের বুনিয়াদের উপর নিজেদের ভবিষ্যত তৈরি করতে চায়, যদি কেউ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইমাম ও উসওয়াতুন হাসানাহ এবং নেতা ও আদর্শরূপে গ্রহণ করতে না চায় তাহলে এই মুহূর্তে তারা মুহম্মদ বিন আব্দুল্লাহর সমস্ত দান, অবদান, দয়া ও অনুগহ যেন ফিরিয়ে দেয় এবং প্রাচীন জাহেলিয়াতের অবস্থায় ফিরে যায়, যেখানে আছে শুধু গোত্রীয় যুদ্ধ ও গৃহবিবাদ, রোম ও পারস্যের যুলুম-অবিচার, দাসত্ব-লাঞ্ছনা এবং ক্ষুধা-অনাহারের অভিশাপ; যেখানে আছে শুধু পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, শিক্ষা ও সভ্যতার ছায়া থেকে বঞ্চিত অখ্যাত, অজ্ঞাত ও অন্ধকার এক জীবন।
এই যে তোমাদের গৌরবময় ইতিহাস, আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা, এই সুসমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য, এই আরব সালতানাত, এত রাজ্য ও রাজত্ব, এসব তো মুহম্মদী নবুয়তেরই দয়া ও দান, ফয়য ও ফয়যান, এ তো তাঁরই শুভাগমনের কল্যাণ-অবদান!
আরবজাতির শক্তির উৎস ঈমান
ইসলামই হচ্ছে আরব জাহানের পরিচয় ও জাতীয়তা, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন আরবজাতির ইমাম, নবী ও পথপ্রদর্শক। আর ঈমানই হচ্ছে আরবজাতির শক্তির উৎস। এ শক্তিবলেই জাগতিক শক্তিতে দুর্বল হয়েও তারা সমগ্র বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে। অতীতে যেমন ছিলো, আজো তেমনি ঈমানই আরবজাতির অস্ত্র ও শক্তি। এ শক্তিবলেই সে পারে শত্রুকে পরাস্ত করতে এবং নিজের অস্তিত্বকে সুরক্ষা দিতে এবং পারে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব; রিসালাতের দাওয়াত ও পয়গাম নিয়ে বিশ্বের সামনে দাঁড়াতে। আরবজাতি ইহুদীবাদ বা অন্য শক্তির বিরুদ্ধে, ইউরোপ-আমেরিকা ও রাশিয়ার দেয়া অস্ত্র দিয়ে- যার মাধ্যমে তারা আরবদের অর্থ শোষণ ও তেল লুণ্ঠন করছে- এসব অস্ত্র দিয়ে তারা কারো বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারবে না; যুদ্ধ জয় করা তো দূরের কথা। তারা জয়ী হতে পারবে শুধু ঈমান ও আত্মিক শক্তি দ্বারা এবং প্রাণপ্রেরণা ও উদ্যম-উদ্দীপনা দ্বারা, যার বলে বলীয়ান হয়ে একদিন তারা রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিলো এবং জয়ী হয়েছিলো।
আজ আমরা আরবজাতির অবস্থা কী দেখতে পাই! জীবনের আকাক্সক্ষা ও মৃত্যুর ভয়, ভোগ ও আরাম-আয়েশের লোভ, অবিশ্বাস ও দ্বিধা-সংশয় এবং চিন্তার দ্বন্দ্ব; এ অবস্থায় আর যাই হোক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় না। সুতরাং আরববিশ্বের সরকার ও নেতৃবৃন্দ এবং আরবলীগের নীতিনির্ধারকদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো শ্রেণী ও স্তরনির্বিশেষে গোটা জাতির অন্তরে এবং আরব ফৌজের, সিপাহী ও সিপাহসালার সবার দিলে ঈমানের বীজ বপন করা, জিহাদের প্রেরণা, শাহাদাত ও জান্নাতের আকাক্সক্ষা জাগ্রত করা।
আরবজাতির বিশিষ্ট-সাধারণ সর্বস্তরের মানুষকে আজ এমন শিক্ষা ও দীক্ষা দান করতে হবে, যেন দুনিয়ার অন্তসারশূন্য চাকচিক্য ও জাঁকজমকের প্রতি তুচ্ছতা ও নির্মোহতা সৃষ্টি হয়; নাফসের খাহেশাত ও প্রবৃত্তির চাহিদা-লালসা এবং জীবনের মোহ-মায়ার উপর সংযম ও নিয়ন্ত্রণ অর্জন করা সম্ভব হয়। শুধু কথা ও বাগ্মিতা দ্বারা নয়, বরং কর্ম ও আচরণ দ্বারা তাদের দেখাতে হবে, কীভাবে আল্লাহর রাস্তায় বিপদ-কষ্ট বরণ করতে হয় এবং কীভাবে আলো ও পতঙ্গের মত মৃত্যুতে ঝাঁপ দিতে হয় এবং মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে হয়। তাদের দেহ-শিরায় যদি আল্লাহর তলোয়ার খালিদ বিন ওয়ালীদের রক্ত থাকে তাহলে তাঁর মত তাদেরও আজ বলতে হবে শত্রুর উদ্দেশ্যে, ‘আগামীকাল এমন কাউমের সঙ্গে হবে তোমাদের মোকাবেলা, মৃত্যু যাদের কাছে তেমনই প্রিয় যেমন প্রিয় তোমাদের কাছে মদের পেয়ালা।’
আরবযুবশক্তির আত্মত্যাগ ও মানবতার মুক্তি
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয় ঠিক ঐ সময় যখন মানবতার দুর্গতি ও দুর্ভাগ্য এমন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলো, যারপর আর কোন সীমা নেই। সেখান থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করা এবং মুক্তি ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করা তাদের সাধ ও সাধ্যের বাইরে ছিলো, যারা প্রাচুর্যের কোলে প্রতিপালিত হয়েছে এবং যাদের জীবন ও যৌবন ছিলো খাহেশাত ও ভোগ-বিলাসে নিমজ্জিত, যাদের বর্তমান ছিলো আনন্দ-বিনোদনের আয়োজনে ভরপুর এবং ভবিষ্যত ছিলো নিশ্চিন্ত নিরাপদ। ছায়াঘেরা জীবন থেকে বের হয়ে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়া এবং জানমালের কোরবানি দেয়ার যোগ্যতা তাদের ছিলো না। এজন্য প্রয়োজন ছিলো এমন জাতি ও জনগোষ্ঠীর, মুমূর্ষু মানবতার মুক্তির মহান দায়িত্ব পালনের জন্য যারা জীবন, যৌবন ও ভবিষ্যত বিসর্জন দিতে পারে; পারে যে কোন বিপদ-দুর্যোগের মধ্যে হাসিমুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে। না জানমালের পরোয়া আছে, না পেশা, ব্যবসা ও জীবিকার দুয়ার বন্ধ হওয়ার দুশ্চিন্তা আছে, না মা-বাবা পরিবার ও বন্ধু-স্বজনের আশাহত হওয়ার অনুতাপ আছে। যেমন কাউমে ছালেহ বলেছিলো-
یٰصٰلِحُ قَدْ كُنْتَ فِیْنَا مَرْجُوًّا قَبْلَ هٰذَاۤ .
হে ছালেহ, এর আগে তো আমাদের মধ্যে তুমি সম্ভাবনাময় ছিলে (কোত্থেকে কী হলো, এমন উন্মাদনা পেয়ে বসলো যে, আমাদের সব আশা, সব সম্ভাবনা মাটি হয়ে গেলো।) -সূরা হূদ (১১) : ৬২
কিন্তু যারা আগে বাড়ে, তাদের অন্তরে এসব চিন্তা ও দুশ্চিন্তা কিছুই থাকে না। থাকে শুধু মানবতার প্রতি দরদ-ব্যথা এবং মানবতার মুক্তির ব্যাকুলতা।
‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য’করা এমন মুজাহিদীনের জামাত ছাড়া মানবতার উদ্ধার ও অস্তিত্ব রক্ষার আশা কিছুতেই করা যায় না এবং কোন মহান দাওয়াত ও আন্দোলনের সফলতার কথা চিন্তাও করা যায় না। হাতে গোনা এমন কিছু মানুষের- সময় ও সমাজের চোখে যারা বোকা ও দুর্ভাগা- হ্যাঁ, তাদেরই ‘দুর্গতি ও দুর্ভাগ্যের’ মূল্যেই মানবতা লাভ করে নবজীবন, মানবজাতির ঘটে নব-উত্থান; জীবন ও সভ্যতার গতি পরিবর্তিত হয় অন্ধকার থেকে আলো এবং অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে।
যদি কিছু মানুষের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ, বঞ্চনা ও দুর্ভোগ এবং বৈষয়িক ও ব্যবসায়িক ক্ষতি পুরো উম্মাহর জন্য সফলতা ও সৌভাগ্য বয়ে আনে এবং লাখো মানুষ, যাদের সংখ্যা-শুমার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না, যদি তারা আল্লাহর আযাব ও জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পেয়ে যায় তাহলে বলতেই হবে, ঐ ‘বঞ্চিত ও দুর্ভাগারাই’ সার্থক, তাদেরই জীবন ধন্য। পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো একজন মাত্র মানুষের হিদায়াত সম্পর্কে বলেছেন-
لأن يهدي الله بك رجلا خير من حمر النعم
আল্লাহ তোমার মাধ্যমে একজন মানুষকে হিদায়াত দান করবেন, এটা (আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ) লাল বর্ণের উটদলের চেয়ে উত্তম।
আর এখানে তো প্রশ্ন হলো মানুষ, মানবতা ও গোটা মানবজাতির!
নবুয়তে মুহম্মদীর ‘তাশরীফায়নে’র সময় আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই জানতেন, রোম ও পারস্য এবং পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য জাতি, যাদের হাতে তখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ছিলো, ভোগসর্বস্ব জীবন ও বস্তুবাদী স্বভাবের কারণে দাওয়াত ও জিহাদ এবং বিপন্ন মানবতার উদ্ধার-প্রচেষ্টায় কঠিন প্রতিকূলতা ও বিপদ-দুর্যোগের ঝুঁকি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারবে না। এমনকি জীবনের সামান্য আরাম-আয়েশ, সাধারণ সাজসজ্জা ও সাধ-আহ্লাদও কিছুমাত্র ত্যাগ করার যোগ্যতা তাদের নেই। সেখানে অল্পসংখ্যায়ও এমন মানুষ ছিলো না, যারা খাহেশাত ও লোভ-লালসা দমন করতে এবং নাগরিক জীবনের অপ্রয়োজনীয় ‘কেতাদুরস্তি’ ছেড়ে ‘কাফাফ’-এর জীবনে খুশী হতে পারে।
তাই ইসলামের পায়গাম ও নবীর ছোহবতের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এমন জাতিকেই মনোনীত করেছেন, যারা দাওয়াত ও জিহাদের গুরুভার বহন করতে পারে এবং ত্যাগ ও কোরবানির পথে চলতে পারে। তারা ছিলো আরবজাতি, সুস্থ-সবল, শক্ত-সুঠাম, সভ্যতার যাবতীয় দোষ-উপসর্গ থেকে মুক্ত। কারণ সে যুগের ‘পচনধরা’ নগরসভ্যতার ছোঁয়া-ছায়া থেকে তারা ছিলো নিরাপদ দূরত্বে। তাদের মধ্য হতেও আল্লাহ তা‘আলার নির্বাচিত ব্যক্তিগণ হলেন নবীর ছাহাবা, হৃদয়ের পুণ্যতায়, জ্ঞানের গভীরতায় এবং জীবনের অনাড়ম্বরতায় মানুষের সমাজে তাঁরা ছিলেন সবার উপরে।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত নিয়ে সেই যে ছাফা পাহাড়ে দাঁড়ালেন এবং নেমে এলেন, তারপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেন। এসময় তিনি চেষ্টা-সাধনা ও মেহনত-মুজাহাদার পুরা হক আদায় করেছেন। দাওয়াতের কাজকে তিনি এমন সব কিছুর উপর প্রাধান্য দিয়েছেন, যা দাওয়াতের পথে বাধা হতে পারে। দুনিয়ার যাবতীয় লোভ ও চাহিদা থেকে তিনি সম্পূর্ণ বেঁচে ছিলেন এবং এ বিষয়ে সমগ্র বিশ্বের জন্য ইমাম ও উসওয়া এবং আদর্শ মানদ- ছিলেন।
সীরাতের প্রসিদ্ধ ঘটনা, দাওয়াত থেকে বিরত থাকার প্ররোচনারূপে কোরায়শ একবার এমন কিছু প্রস্তাব দিলো, যার হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া খাহেশাতের আভাসমাত্র রয়েছে এমন কারো পক্ষেই সম্ভব হতো না; তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। আর প্রিয় চাচা যখন আগের মত ‘ছায়া’ দিতে একটু দ্বিধা প্রকাশ করলেন তখন তিনি যা বললেন, তা ছিলো দাওয়াতের প্রতি আত্মনিবেদনের ইতিহাসে তুলনাহীন। তিনি বললেন-
يا عم! والله لو وضعوا الشمس في يميني، والقمر في يساري، على أن أترك هذا الأمر، حتى يظهره الله، أو أهلِكَ فيه، ما تركته.
হে চাচা! আল্লাহর কসম, এরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে রাখে তবু একাজ থেকে আমি পিছু হটবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ এটাকে বিজয়ী করেন, কিংবা এ পথে আমি শেষ হয়ে যাই।
দাওয়াতের জন্য ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং সর্বস্ব বিসর্জনের এ ঘটনা শুধু ঘটনা ছিলো না, বরং নবী-যুগ ও পরবর্তী যুগের সমস্ত ‘আহলে দাওয়াত’-এর জন্য ছিলো চিরস্থায়ী আদর্শ। এক্ষেত্রে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের জন্য তিনি আরাম-আয়েশের সমস্ত পথ বন্ধ করে রেখেছিলেন। শুধু নিজের জন্য কেন? পরিবার পরিজন ও সমস্ত নিকটজনকেও তিনি ‘দুনিয়া’ থেকে দূরে রেখেছেন। তাই আত্মীয়তায় যিনি যত নিকটের ছিলেন, জীবনের সুবিধাভোগের ক্ষেত্রে তিনি তত পিছনে ছিলেন, কিন্তু ত্যাগ ও কোরবানির ক্ষেত্রে ছিলেন তত অগ্রভাগে। যখন কোন কিছু হারাম ও নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিতেন, আল্লাহর রাসূল আপন গোত্র, পরিবার ও ঘর থেকে তা শুরু করতেন, আর যখন কোন হক ও সুবিধা ঘোষণা করতেন তখন অন্যদের এগিয়ে রাখতেন; এমনকি কখনো নিকটতম আত্মীয়দের উপর তা হারামও করে দিতেন।
যখন ‘সুদ’ হারাম করার ইচ্ছা করলেন তখন চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবকে দিয়ে শুরু করলেন এবং সর্বপ্রথম তার পাওনা সুদ রহিত করলেন। যখন জাহেলিয়াতের ‘প্রতিশোধপ্রথা’ বাতিল করার ইচ্ছা করলেন তখন রাবী‘আ ইবনুল হারিছ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের ‘রক্ত’ দিয়ে শুরু করলেন এবং সর্বপ্রথম তার রক্তের প্রতিশোধ-অধিকার বাতিল ঘোষণা করলেন।
পক্ষান্তরে যখন যাকাতের বিধান প্রবর্তন করলেন, যা ছিলো ‘চিরঅব্যাহত’ একটি বিরাট অর্থনৈতিক সুবিধা, তিনি তা চিরকালের জন্য তার নিকটতম স্বজন বনুহাশিমের উপর হারাম করে দিলেন। তাদের ধনীরা যাকাত দেবে, কিন্তু তাদের গরীবরা যাকাত পাবে না।
মক্কাবিজয়ের দিন আলী বিন আবু তালিব রা. আবদার জানালেন, যেন বনু-হাশিমের অনুকূলে ‘সিকায়া’ এবং ‘হিজাবাহ’-এর দায়িত্বও যুক্ত করা হয়, কিন্তু তিনি তা না-মঞ্জুর করে (তখন পর্যন্ত অমুসলিম) উছমান বিন তালহাকে ডাকালেন এবং কা‘বার চাবি তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন-
هاك مفتاحك يا عثمان! اليوم يوم بر ووفاء وقال : خذوها خالدة تالدة فيكم لا ينزعها منكم إلا ظالم.
হে উছমান, তোমার চাবি নাও। আজ অনুগ্রহের ও বিশ্বস্ততা রক্ষার দিন। নাও, চিরকাল, লাগাতার এটা তোমাদের মধ্যে থাকবে, যালিম ছাড়া কেউ তোমাদের থেকে তা ছিনিয়ে নেবে না।
স্ত্রীগণকে তিনি যুহদ ও নির্মোহতা, কানা‘আত ও অল্পেতুষ্টি এবং ‘শুকনো রুক্ষ’ জীবন যাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন, যদি তোমরা অভাব অনটনের জীবনে সন্তুষ্ট থাকো তাহলে আমার সঙ্গে থাকো; আর যদি আরাম আয়েশের জীবন পছন্দ করো তাহলে ভিন্ন পথ গ্রহণ করো। তিনি তাঁদেরকে আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালা শুনিয়ে দিলেন-
یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ اِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا وَ زِیْنَتَهَا فَتَعَالَیْنَ اُمَتِّعْكُنَّ وَ اُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِیْلًا وَ اِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ فَاِنَّ اللهَ اَعَدَّ لِلْمُحْسِنٰتِ مِنْكُنَّ اَجْرًا عَظِیْمًا.
হে নবী, বলুন আপনার স্ত্রীগণকে, যদি তোমরা চাও দুনিয়ার জীবন এবং তার সৌন্দর্যশোভা, তাহলে এসো, তোমাদের আমি ভোগ করাবো এবং সুন্দরভাবে বন্ধনমুক্ত করে দেবো। আর যদি চাও তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে এবং আখেরাতের বাসস্থানকে, তাহলে আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন তোমাদের মধ্য হতে যারা পুণ্যবতী তাদের জন্য বিরাট প্রতিদান। -সূরা আহযাব (৩৩) : ২৮-২৯
তবে তাঁর ‘পুণ্যবতী’ স্ত্রীগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকেই গ্রহণ করেছিলেন।
নবীকন্যা হযরত ফাতেমা রা. অবগত হলেন, তাঁর কাছে কিছু গোলাম ও খাদেম এসেছে। এদিকে আটা পেষার যাঁতাকল চালাতে চালাতে তাঁর হাতে ‘যখম’ পড়ে গিয়েছিলো। তিনি প্রিয় পিতার নিকট গেলেন এবং একজন খাদেমের আবদার জানালেন, কিন্তু তিনি বললেন, তুমি যা চেয়েছো আমি কি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম জিনিস বাতাবো না? শয্যাগ্রহণের সময় চৌত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলো, তেত্রিশবার ‘আলহামদুল্লিাহ’ বলো এবং তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলো। এটা তোমাদের জন্য তোমাদের চাওয়া জিনিস থেকে উত্তম।
মোটকথা, এটাই ছিলো আহলে বাইত ও নিকটজনদের ক্ষেত্রে তাঁর আচরণ ও অনুসৃত নীতি। যিনি যত নিকটজন তার সুবিধা তত সঙ্কুচিত, আর দায়দায়িত্ব সম্প্রসারিত। পৃথিবীর কোন সভ্যজাতির কোন কর্ণধার এর ন্যূনতম নমুনাও যদি দেখাতে পারতো!
হ্যাঁ, পেরেছিলেন তাঁর প্রিয়তম পাত্র, উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি খলিফা হযরত আবু বকর রা.; পেরেছিলেন তাঁকে অনুসরণ করতে। তাঁর স্ত্রী যখন কিছু দিনের খরচ বাঁচিয়ে একটু মিষ্টান্ন তৈরি করলেন, তখন ছিদ্দীকে আকবর বাইতুল মালের যিম্মাদারকে জানালেন, এখন থেকে আবু বকরের ভাতা যেন এই পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়। কারণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আবু বকরের পরিবার আরো কম খরচে চলতে পারে!
পেরেছিলেন হযরত ওমর, উছমান, আলী, হাসান, হোসায়ন এবং ছাহাবায়ে কেরাম, রিযওয়ানুল্লাহি তা‘আলা আলাইহিম আজমা‘ঈন।
মক্কার কিছু মানুষ যখন ঈমান আনলেন তখন তাদের অর্থনৈতিক জীবন তছনছ হয়ে গেলো। বাজারের অসহযোগিতার কারণে এবং দাওয়াতি কাজের ব্যস্ততার কারণে তাঁদের ব্যবসা বসে গেলো। কারো কারো সারা জীবনের সঞ্চিত পুঁজি হাতছাড়া হয়ে গেলো। তাঁদের মধ্যে এমনো ছিলেন, যাদের বিলাস-ব্যসন, পোশাক-জৌলুস ও প্রাচুর্যপূর্ণ জীবন ছিলো প্রবাদতুল্য, কিন্তু সবকিছু এমনভাবে শেষ হলো যে, তাঁদের জীর্ণ-মলিন বাস দেখে সকলে হয়রান। অনেকে শুধু ঈমান আনার অপরাধে পৈতৃক সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত হলেন। (কিন্তু পরবর্তীতে এজন্য তারা বিশেষ কোন সুবিধা লাভ করেননি।)
তারপর আল্লাহর রাসূল যখন মদীনায় হিজরত করলেন এবং আনছার তাঁর সঙ্গ গ্রহণ করলেন, তখন (ঈমানী, আমলী, দাওয়াতি ও জিহাদি ব্যস্ততার কারণে) তাদের কৃষিকাজ ও বাগান পরিচর্যা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং তাঁদের আর্থিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব পড়লো। শেষে তাঁরা খামার ও বাগান পরিচর্যার জন্য কিছু সময় প্রার্থনা করলেন, কিন্তু তা নাকচ করে দিলেন, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের সতর্ক করে আয়াত নাযিল করলেন-
وَ اَنْفِقُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللهِ وَ لَا تُلْقُوْا بِاَیْدِیْكُمْ اِلَی التَّهْلُكَةِ وَ اَحْسِنُوْا اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ .
আর তোমরা খরচ করো আল্লাহর রাস্তায়, আর নিজেকে নিক্ষেপ করো না বরবাদির দিকে। আর সদাচার করো, নিশ্চয় আল্লাহ সদাচারকারীদের ভালোবাসেন। -সূরা বাকারাহ (২) : ১৯৫
একই রকম ছিলো (সাধারণ) আরবদের অবস্থা, যারা দাওয়াত গ্রহণ করেছেন এবং দাওয়াতি আমলে ও জিহাদ-মুজাহাদায় শামিল হয়েছেন। বস্তুত জানমালের কোরবানিতে এবং বিপদ-কষ্টের জীবনে পৃথিবীর অন্য যে কোন জাতির চেয়ে তারা অনেক বেশি অগ্রসর ছিলেন। আর তাদেরই সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
قُلْ اِنْ كَانَ اٰبَآؤُكُمْ وَ اَبْنَآؤُكُمْ وَ اِخْوَانُكُمْ وَ اَزْوَاجُكُمْ وَ عَشِیْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَ تِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَ مَسٰكِنُ تَرْضَوْنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیْكُمْ مِّنَ اللهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ جِهَادٍ فِیْ سَبِیْلِهٖ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللهُ بِاَمْرِه وَ اللهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ.
আপনি বলে দিন, যদি তোমাদের পিতা এবং তোমাদের পুত্র এবং তোমাদের ভাই এবং তোমাদের স্ত্রী এবং তোমাদের পরিবার-স্বজন এবং সম্পদ, যা তোমরা সঞ্চয় করেছো এবং ব্যবসা, যা মন্দাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করো এবং আবাসস্থল, যেগুলো তোমাদের খুব পছন্দের, যদি এগুলো তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা থেকে তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহ তাঁর (আযাবের) ফায়সালা পাঠানো পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক কাউমকে পথ দেখান না। -সূরা তাওবা (৯) : ২৪
আরো ইরশাদ হয়েছে-
مَا كَانَ لِاَهْلِ الْمَدِیْنَةِ وَ مَنْ حَوْلَهُمْ مِّنَ الْاَعْرَابِ اَنْ یَّتَخَلَّفُوْا عَنْ رَّسُوْلِ اللهِ وَ لَا یَرْغَبُوْا بِاَنْفُسِهِمْ عَنْ نَّفْسِهٖ .
মদীনার বাসিন্দাদের এবং তাদের প্রতিবেশে বাসকারী বেদুঈনদের জন্য শোভন ছিলো না আল্লাহর রাসূলের সঙ্গ থেকে পিছিয়ে থাকা এবং তাঁর প্রাণের কথা ভুলে নিজেদের প্রাণ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়া। -সূরা তাওবা (৯) : ১২০
কারণ এই যে, মানবজাতির সৌভাগ্যের ইমারত তাঁদেরই কোরবানির বুনিয়াদের উপর কায়েম হওয়ার কথা ছিলো এবং অবস্থার পরিবর্তন ও নতুন বিপ্লবের আত্মপ্রকাশ শুধু এ অপেক্ষায় ছিল যে, ‘মুহাজির-আনসার’-এর এই জামাত যেন ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং মানবতার স্বার্থে যে কোনো বিপদ-দুর্যোগ বরণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাই তাঁদের উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ لَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَیْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَ الْجُوْعِ وَ نَقْصٍ مِّنَ الْاَمْوَالِ وَ الْاَنْفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیْنَ.
আর অতিঅবশ্যই পরীক্ষা করবো আমি তোমাদেরকে কিছুটা ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং মালের, জানের ও ফলের ক্ষতি দ্বারা। আর সবরকারীদের আপনি সুসংবাদ দান করুন। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৫
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে প্রশ্নের শৈলীতে বক্তব্যকে আরো জোরালো, আরো আবেদনপূর্ণ করে-
اَحَسِبَ النَّاسُ اَنْ یُّتْرَكُوْۤا اَنْ یَّقُوْلُوْۤا اٰمَنَّا وَ هُمْ لَا یُفْتَنُوْنَ وَ لَقَدْ فَتَنَّا الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَیَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِیْنَ صَدَقُوْا وَ لَیَعْلَمَنَّ الْكٰذِبِیْنَ.
মানুষ কি ধরে নিয়েছে যে, তারা ‘ঈমান এনেছি’ বলবে, আর তাদের ছেড়ে দেয়া হবে; তাদের কোনো পরীক্ষা নেয়া হবে না!? অথচ অবশ্যই আমি পরীক্ষা করেছি তাদের, যারা এদের পূর্বে বিগত হয়েছে। অবশ্যই আল্লাহ জেনে নেবেন ঐ লোকদের, যারা সত্য বলেছে, আর অবশ্যই জেনে নেবেন ঐ লোকদের, যারা মিথ্যা বলেছে। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ২-৩
আরবজাতি যদি ত্যাগ ও আত্মত্যাগের এ সৌভাগ্য গ্রহণ করতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতো বা পিছপা হতো, মানবতার দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্য আরো দীর্ঘায়িত হতো এবং জাহেলিয়াতের অন্ধকার পৃথিবীর উপর আরো বহুকাল ছেয়ে থাকতো। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
اِلَّا تَفْعَلُوْهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِی الْاَرْضِ وَ فَسَادٌ كَبِیْرٌ.
যদি তোমরা তা না করো তাহলে যমীনে বড় ফেতনা দেখা দেবে এবং বড় ফাসাদ (সৃষ্টি হবে)। -সূরা আনফাল (৮) : ৭৩
খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকে পৃথিবী এক দো-মাথায় এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন আরব-জাতির সামনে এবং তার ফলশ্রুতিতে মানবজাতির সামনে দুটো পথই খোলা ছিল। প্রথম পথ এই যে, আরবরা কোরবানির রাস্তায় এগিয়ে যাবে, জানমাল, সন্তান-সন্ততির কোরবানি এবং জীবনের প্রিয় সবকিছুর কোরবানি। দুনিয়ার তুচ্ছ লোভলালসা সংযত রাখবে এবং বৃহত্তর স্বার্থ ও কল্যাণের পথে ব্যক্তিস্বার্থ এবং ব্যক্তিগত সর্বস্ব বিসর্জন দেবে, তাহলে তা হবে মানবতার সৌভাগ্য এবং ইনসানিয়াতের খোশকিসমত। তখন দুনিয়াতেই বসবে জান্নাতের বাজার এবং যারা সৌভাগ্যবান, প্রাণের মূল্যে তারা ক্রয় করবে ঈমানের সম্ভার।
দ্বিতীয় পথ এই যে, বিশ্বের সংশোধন ও মানবজাতির কল্যাণের চিন্তা ছেড়ে তারা নিজেদের খাহেশাত ও চাহিদা, ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের চিন্তায় ডুবে থাকবে; তখন মানবজাতি পথহারা অবস্থায় দুর্ভাগ্যের চোরাবালিতেই আটকা পড়ে থাকবে এবং ধীরে ধীরে আরো তলিয়ে যেতে থাকবে। আর সেটা কতকাল, তা শুধু আল্লাহ জানেন।
কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির কল্যাণ, সৌভাগ্য ও মুক্তি চাইলেন, আর আরবজাতি, অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম পূর্ণ সাহস, উদ্দীপনা, ত্যাগ ও আত্মত্যাগের প্রেরণা এবং কোরবানির জোশ ও জযবা নিয়ে অগ্রসর হলেন। কেননা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের মধ্যে ঈমানের প্রেরণা এবং কোরবানির জোশ-উদ্দীপনা সঞ্চারিত করেছিলেন এবং দুনিয়ার ‘ফানি যিন্দেগি’র মোকাবেলায় আখেরাতের আবাদী যিন্দেগানির হাকীকত তাঁদের বুঝিয়েছিলেন এবং জান্নাত ও তার অফুরন্ত নায-নেয়ামতকে তাঁদের সামনে অনেক প্রিয় ও কাক্সিক্ষতরূপে তুলে ধরেছিলেন। তাই তাঁরা নিজেদের জানমাল ও জীবন যৌবনকে সমগ্র মানবতার জন্য মুক্তিপণরূপে পেশ করেছিলেন এবং মানবজাতির কল্যাণ ও সৌভাগ্যের জন্য দুনিয়ার লোভলালসা ও ভোগবিলাস বিসর্জন দিয়েছিলেন। এই জীবনে মানুষ যা কিছুর আকাক্সক্ষা করে, যা কিছুর স্বপ্ন দেখে এবং যা কিছু আপন করে পেতে চায়- সব তাঁরা বিসর্জন দিয়েছিলেন এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জিহাদ ও মুজাহাদা এবং মেহনত ও সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁদের জন্য কী ছিলো এর পুরস্কার? আলকোরআনের ভাষায়-
فَاٰتٰىهُمُ اللهُ ثَوَابَ الدُّنْیَا وَ حُسْنَ ثَوَابِ الْاٰخِرَةِ وَ اللهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.
আর আল্লাহ তাদের দুনিয়ার বিনিময় এবং আখেরাতের উত্তম বিনিময় দু’টোই দান করলেন। পুণ্যকর্মকারী ও নেককারদের তো আল্লাহ ভালবাসেন। -সূরা আল মাইদাহ (৩) : ১৪৮
পৃথিবী এখন পিছনে সরতে সরতে ঠিক সেই বিন্দুতে ফিরে গেছে যেখানে খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ছিলো। মানবজাতি আরেকবার সেই দো-মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে মুহম্মদী নবুয়তের আবির্ভাবের সময় দাঁড়িয়ে ছিল। আরবজাতিকেই আজ আবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কী তারা করবে এবং কোন্ পথে চলবে। হয় তারা নবীর উম্মত হিসাবে এবং নবুয়তের সঙ্গে রক্ত-বন্ধনের দাবিতে ঈমান ও আমলের ময়দানে আবার আগে বাড়বে এবং পৃথিবীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনার জন্য আবার বিপদ-দুর্যোগের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে; যিন্দেগীর আরাম-আয়েশ, জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং ভবিষ্যত উন্নতির সব সম্ভাবনা বিসর্জন দেবে, যাতে হোঁচটখাওয়া ও মুখ থুবড়ে-পড়া মানবতা আবার উঠে দাঁড়াতে পারে এবং পৃথিবীর আমূল চিত্রপরিবর্তন ঘটে।
কিংবা তারা এতদিন যেমন ছিলো, বদস্তুর তেমনই থেকে যাবে। সেই লোভ লালসা ও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ, সেই পদ ও সম্পদের প্রতিযোগিতা, উন্নতি-পদোন্নতি, আয়-আমদানি ও লাভ-মুনাফার চিন্তা; সেই ভোগবিলাস ও আনন্দ বিনোদনে ডুবে থাকা। এককথায়, মানবতার দুর্গতির কথা না ভেবে মানব-জাতির মুক্তি ও কল্যাণের চিন্তা না করে, ভোগবাদী জীবনের অভ্যস্ত পথেই চলতে থাকা। তখন মানবতা এই গান্দাগলিয নর্দমায়ই পড়ে থাকবে যেখানে পড়ে আছে বহু শতাব্দী ধরে। কারণ মানবতার কল্যাণের আশা করাই বৃথা যদি আরবের অভিজাত যুবশক্তি বড় বড় শহরে, ইউরোপ-আমেরিকার বিনোদন-কেন্দ্রে খাহেশাত ও ভোগবিলাসে মজে থাকে; যদি তাদের জীবন-যৌবন বস্তুপূজা ও উদরপূজার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে; যদি ব্যক্তিজীবনের উন্নতি ও প্রাচুর্যের চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তাই তাদের না থাকে।
আমাদের তো মনে হয়, জাহেলি যুগের কোনো কোনো যুবক আজকের আরব ও মুসলিম যুবকদের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চ মনোবলের অধিকারী ছিল; চিন্তায় চেতনায় অনেক বেশি প্রসারিত ছিল। কারণ যে বিশ্বাস ও জীবনদর্শন তারা সত্য বলে গ্রহণ করেছিল তার জন্য তারা নিজেদের ভবিষ্যত বিসর্জন দিয়েছিল। এমনকি জাহেলিয়াতের কবি ইমরুউল কায়েসও হয়ত তাদের চেয়ে অনেক অভিজাত ছিলেন, যিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন-
ولو أنما أسعى لأدنى معيشة + كفانى ولم أطلب قليلا من المال
ولكنما أسعى لمجد مؤثل + وقد يدرك المجد المؤثل أمثالي
যদি জীবনের সাধারণ জীবিকা-স্তরের জন্য সচেষ্ট হতাম, সামান্য অর্থই আমার জন্য যথেষ্ট হত, কিন্তু আমি তা চাইনি। আমি তো চাই এমন মর্যাদা, যার শিকড় অনেক গভীরে, আর আমার মত যুবকই পায় সুসংহত মর্যাদার নাগাল।
মানবতা ও মানবজাতিকে যদি শান্তি-সৌভাগ্যের সেই সবুজ দ্বীপে পৌঁছাতে হয় তাহলে নিজেদের কোরবানি ও আত্মত্যাগ দ্বারা মুসলিম যুবশক্তিকেই তৈরি করতে হবে ‘মানবতার মুক্তির সেতু’। সেই সেতু পার হয়েই নিরাপদে পৌঁছা সম্ভব কল্যাণ ও মুক্তির সবুজ দ্বীপে।
উত্তম ফসলের জন্য ভূমির প্রয়োজন উত্তম সার। মানবতার ভূমিতে ইসলামের সবুজ ফসল ফলাতে হলেও প্রয়োজন উপযুক্ত সারের, আর তা হলো মুসলিম যুবকদের ব্যক্তিগত সমস্ত ইচ্ছা-চাহিদা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, জৌলুস-প্রাচুর্য এবং ভবিষ্যতের সমস্ত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার বিসর্জন, যা তারা ইসলামের বিজয়, বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা এবং মানুষকে জাহান্নাম থেকে জান্নাতের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যুগে যুগে দিয়ে এসেছে। আরবযুবশক্তির এইটুকু ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে সত্যি যদি বিভ্রান্ত মানবতা মুক্তির পথ পেয়ে যায় এবং কল্যাণ ও শান্তির ঠিকানায় পৌঁছে যায়, বলতেই হবে, ‘বড় সস্তায় পাওয়া সওদা’।
আল্লাহ-প্রেমের পাকা সওদাগর এক কবি বড় সুন্দর বলেছেন-
আয় দিল, তামাম নফা’ হ্যয় সওদায়ে ইশক ম্যঁ
ইক জান কা যিয়াঁ, সো এয়সা যিয়াঁ ন্যহীঁ
হে দিল, সমস্ত লাভ হলো ইশকের সওদায়,
তাতে যায় শুধু জান, তা এমন কি আর যাওয়া!
এ প্রসঙ্গে কোন অন্তর্দর্শী বলেছেন-
إنه لثمن قليل جدا لسلعة غالية جدا!
বড় মূল্যবান পণ্যের জন্য বড় স্বল্প মূল্য!
ঘোড়সওয়ারি ও ফৌজি যিন্দেগী
বড় তিক্ত ও মর্মান্তিক বাস্তবতা যে, আরবজাতি আজ অতীতের সৈনিকসুলভ বহু বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে অশ্বচালনা, একসময় যা ছিল তাদের জাতীয় পরিচয়, তা এখন একদম শেষ হয়ে গেছে। আরবজীবনে এটা আসলেই বিরাট ক্ষতি ও বিপর্যয় এবং জিহাদের ময়দানে দুর্বলতা ও পরাজয়ের অন্যতম কারণ। তাদের ফৌজি জযবা ও সামরিক প্রেরণা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আয়েশি জীবনের কারণে স্বাস্থ্য ও দৈহিক শক্তিতে ভাটা পড়েছে। আরামদায়ক গাড়ি এখন আরবদের একমাত্র বাহন। ফলে বিশ্বসেরা তেজিয়ান আরবী ঘোড়া এখন আরব জাযিরাতেই বিলুপ্তপ্রায়।
সামরিক প্রশিক্ষণ, শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা, ঘোড়দৌড়, বর্শাচালনা, কুস্তিলড়াই, সাধারণ মানুষ এগুলো ভুলে এখন মজে আছে ক্ষতিকর যন্ত্রনির্ভর খেলাধুলায়। সুতরাং আরববিশ্বের নীতিনির্ধারক ও শিক্ষা-দীক্ষার নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিবর্গের অপরিহার্য কর্তব্য হল আরব যুবশক্তিকে সৈনিকসুলভ বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিপালন করা, যাতে প্রতিটি যুবক শারীরিক শক্তি, দৃঢ়চিত্ততা, কষ্টসহিষ্ণুতা ও বিপদ-দুর্যোগের মোকাবেলা করার মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে এবং সহজ সরল, অনাড়ম্বর ও শুষ্ক-রুক্ষ জীবনে অভ্যস্ত হতে পারে। মুসলিম উম্মাহর মহান মুরুব্বী ও দীক্ষাদাতা আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর অন্তর্দৃষ্টিতে এ বিষয়টির গুরুত্ব ধরা পড়েছিল। তাই তিনি আজমের বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত আরব প্রশাসকের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক দিক-নির্দেশনামূলক পত্রে লিখেছিলেন-
إياكم والتنعم وزي العجم، وعليكم بالشمس، فإنها حمام العرب، وتمعددوا، واخشوشنوا، واخشوشبوا، واخلولقوا، وأعطوا الركب أسنتها، وانزوا نزوا، وارموا الأغراض.
আরাম-আয়েশ ও আজমি পোশাক থেকে দূরেই থেকো। (শুধু ছায়ায় থেকো না) রোদের অভ্যাস বজায় রেখো, কারণ রোদই হচ্ছে আরবদের ‘স্নান’। আহার-বিহার ও পোশাক-পরিচ্ছদে রুক্ষ, কঠোর ও সহিষ্ণু হও। (ধোপদুরস্তির পরিবর্তে) মোটা খসখসে ও পুরোনো জীর্ণ কাপড়ে অভ্যস্ত হও। ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে চড়ার ও লক্ষ্যভেদের অভ্যাস করো।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
ارموا بني إسماعيل فإن أباكم كان راميا.
হে ইসমাঈলের পুত্রগণ, তীরন্দাযি করো। কারণ তোমাদের পিতা ইসমাঈল তীরন্দায ছিলেন।
অন্য এক হাদীছে সাবধান-অব্যয় ألا ব্যবহার করে বলেছেন-
ألا إن القوة الرمي ألا إن القوة الرمي.
শোনো, তীরন্দাযিই হলো শক্তি, তীরন্দাযিই হলো শিক্ত।
(আমার মনে হয়, মহাগুরুত্বপূর্ণ এ হাদীছটির চিরায়ত অনুবাদ হবে এই ‘শোনো ক্ষেপণেই শক্তি, ক্ষেপণেই শক্তি’, -অনুবাদক)
যারা আগামী প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এবং যারা কর্ণধার ও নীতিনির্ধারক তাদের অপরিহার্য কর্তব্য হলো শিক্ষাঙ্গন এবং যুবশক্তির জীবন থেকে সর্বশক্তি দিয়ে ঐ সব উপাদান-উপকরণ দূর করা, যা যুবচরিত্রে শৌর্য সাহস, ঋজুতা ও পৌরুষ-এর বিলুপ্তি ঘটিয়ে দুর্বলতা, অক্ষমতা ও ‘রমণীয়তা’ সৃষ্টি করে। তাই নগ্ন-অশ্লীল, ধর্মদ্রোহী ও চরিত্রবিধ্বংসী সাহিত্য-সাংবাদিকতার মূলোৎপাটন করতে হবে, যা তরুণ ও যুবসমাজে কপটতা, লজ্জাহীনতা, পাপাচার, যৌনতা ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার বিষ ছড়ায়। অর্থ ও বাণিজ্যের লোভে যারা মুসলিমসমাজে অশ্লীলতা ও পাপাচার ছড়াতে ভালোবাসে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাদের প্রতিহত করতে হবে। কোনভাবেই যেন তারা মহোত্তম চরিত্রের ধারক মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিবিরে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সামান্য কিছু পয়সার জন্য পাপাচার, অনাচার, নগ্নতা ও যৌনতার মোহজাল বিস্তার করে যারা মুসলিম প্রজন্মের হৃদয় ও চরিত্র ধ্বংস করছে সমাজ থেকে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোন জাতির পুরুষ পৌরুষ ও মর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলে, আর নারীসমাজ নারিত্ব ও মাতৃত্ব পরিত্যাগ করে পর্দাহীনতা ও নগ্নতার পথে চলে যায়, ঘর ছেড়ে বাইরে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চায় এবং সৌন্দর্য রক্ষার নামে বন্ধ্যাত্বমুখী হয়ে পড়ে, তখনই তাদের ভাগ্যতারকা ডুবতে শুরু করে এবং নামনিশানা মুছে গিয়ে তারা ‘ছিলো’ থেকে ‘নাই’ হয়ে যায়।
এটাই ছিলো গ্রীক, রোমান ও পারসিক জাতির পরিণতি, আজকের ইউরোপও সেই পরিণতির পথে ধাবমান। সুতরাং সাবধান, হে আমার প্রিয় আরবজাতি! এ ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে সাবধান!!
শ্রেণীবৈষম্য ও অপচয় রোধ
আরেকটি দুঃখজনক বাস্তবতা এই যে, বস্তুবাদী পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবে এবং আরো বিভিন্ন কারণে আরবজাতি আজ আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসে ভীষণভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। জীবনের অযথা প্রয়োজন, সাজসজ্জা ও প্রসাধন এবং সৌন্দর্য-বিলাসের পিছনে যেমন তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার নামে ঘটছে আল্লাহর দেয়া বিপুল সম্পদের নির্দয় অপচয়। অথচ চোখধাঁধানো এ বিত্তজৌলুসের পাশাপাশি রয়েছে এমন মুখহা-করা অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও দৈন্য যে, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে, চোখে পানি আসে, বুকে ব্যথা জাগে, লজ্জায় মাথা ঝুঁকে যায়। একদিকে রয়েছে এমন মানুষ, যার অনেক খানাপিনা, সোনাদানা; রয়েছে বিশাল গাড়ীবহর ও বহু অট্টালিকা; বিস্তর অপচয় করেও বুঝে উঠতে পারে না কোথায় কীভাবে রাখবে সম্পদ। অন্যদিকে অসহায় আরববেদুঈন জোগাড় করতে পারে না নিজের ও পরিবারের ক্ষুধার অন্ন ও লজ্জা নিবারণের বস্ত্র। একদিকে ধনকুবের আরব শায়খ ধুলি উড়িয়ে ঝকঝকে গাড়ী হাঁকিয়ে ছুটে যান, অন্যদিকে ছিন্ন জীর্ণ কাপড়ে শীর্ণ মলিন চেহারায় কোন বেদুঈন পরিবার ক্লান্তপথে হেঁটে যায় এবং অবাক চোখে সেদিকে তাকায়। মাথায় রুমাল পেঁচানো আরব শায়খ ও তার সুখী পরিবার কিছু দেখলেন কি দেখলেন না, বোঝা যায় না।
তো আরবের শহর-নগর ও জনপদে যতদিন উঁচু উঁচু প্রাসাদ ও দামী দামী গাড়ী এবং গরীবের অপ্রশস্ত, অপরিচ্ছন্ন আলোবাতাসহীন ঘরবাড়ী একসঙ্গে দেখা যাবে এবং একই জনপদে দেখা যাবে সম্পদের সর্বপ্লাবী ঢল এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের অসহনীয় ধকল, ততদিন বিভিন্ন নামে বিভিন্ন শ্লোগানে চলতেই থাকবে সর্বনাশা দাঙ্গা-ফাসাদ ও বিপ্লব-গোলযোগ। শক্তির জোরে বা প্রচারণার ছলে কৌশলে তার গতি রোধ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ সর্বসুন্দর অর্থব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থাকে যদি প্রত্যাশিত ভূমিকা ও অবদান রাখার সুযোগ না দেয়া হয় তাহলে প্রবল প্রতিক্রিয়ারূপে এবং আল্লাহর আযাব হিসাবে কোন না কোন অপশাসন ও অভিশপ্ত ব্যবস্থা দেশ ও জাতির উপর চেপে বসবে এবং যুলুম, শোষণ, অনাচার ও স্বেচ্ছাচারের নতুন ঝড় বয়ে যাবে।
বিশ্ব নেতৃত্বের শীর্ষ চূড়ায়
কী বিরাট ও কল্যাণপ্রসূ বিপ্লবই না সৃষ্টি হয়েছিলো আরবজাতির ইতিহাসে মুহম্মদী নবুয়তের আবির্ভাবের পর, যার কথা বলা হয়েছে আল কোরআনে সূরাতুল ইসরায়, অলঙ্কারসমৃদ্ধ ও সুস্পষ্ট, সমুজ্জ্বল ভাষায়! কী বিরাট নেয়ামতই না আল্লাহ দান করেছিলেন তাঁর নবীর মাধ্যমে আরবজাতিকে! একটা ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ উপদ্বীপে তারা হানাহানি ও খুনাখুনিতে লিপ্ত ছিলো। এভাবেই হয়ত শেষ হয়ে যেতো এবং মুছে যেতো ইতিহাসের পাতা থেকে। কিন্তু তিনি তাদের বের করে আনলেন বিশাল বিস্তৃত বিশ্বের বুকে, তাকে শাসন করার জন্য এবং নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। গোত্রীয় জীবনের সঙ্কীর্ণ ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে তারা আবদ্ধ ছিলো। তিনি তাদের বিশ্বমানবতার সুপ্রশস্ত প্রাঙ্গণে নিয়ে এলেন, বিভ্রান্ত মানবতাকে পথপ্রদর্শন করার জন্য।
এ বিরাট বিপ্লব ও পরিবর্তনের কল্যাণে তারা এমন মর্যাদার অবস্থানে চলে এলেন যে, সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে পারস্যসম্রাটের দরবারে সাহসী ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন-
الله ابتعثنا ليخرج بنا من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله وحده، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام.
হ্যাঁ, সত্য কথা! প্রথমে তাঁরা নিজেরা বেরিয়ে এসেছেন পৃথিবীর সঙ্কীর্ণতা থেকে পৃথিবীর প্রশস্ততার দিকে, তারপর বের করে এনেছেন মানবজাতিকে। গোত্র, সম্প্রদায় ও জাতীয়তাভিত্তিক জীবনের চেয়ে সঙ্কীর্ণ জীবন আর কী হতে পারে? এবং ন্যায়, সাম্য ও মানবতাভিত্তিক জীবনের চেয়ে প্রশস্ত ও উদার জীবন কী হতে পারে? তদ্রƒপ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী ভোগবিলাসের জন্য দৌড়ঝাঁপ ছাড়া আর কোন লক্ষ্য নেই যে জীবনের, তার চেয়ে সঙ্কীর্ণ জীবন আর কী হতে পারে? এবং ঈমান, রূহানিয়াত, আখেরাত ও জান্নাতের অনন্ত সৌভাগ্যের উপর যে জীবনের ভিত্তি তার চেয়ে প্রশস্ত জীবন আর কী হতে পারে?
মুহম্মদী নবুয়তের মহান বিপ্লবের কল্যাণে তাঁরা বের হয়ে এলেন জাযীরাতুল আরবের সঙ্কীর্ণ সীমানা থেকে, যেখানে ছিলো শুধু জীবনের দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনা, ছিলো জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সমস্যার চিন্তা, ছিলো সামান্য সম্পদ, সামান্য নেতৃত্ব ও তুচ্ছ অহমিকার জন্য হানাহানি ও রক্তপাত; সেখান থেকে তাঁরা বের হয়ে এলেন এক নতুন পৃথিবীর মুক্ত প্রাঙ্গণে, যেখানে তাঁদের প্রতীক্ষায় ছিলো নৈতিক, আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মহাগৌরব।
দানিউব, নীল, দজলা-ফুরাত ও সিন্ধুনদ তাঁদের কাছে সামান্য খাল-নালা ছাড়া আর কিছু নয়। আলেপ্পো ও পিরেনিজ পর্বতমালা, সিরিয়া ও লেবাননের পাহাড়শ্রেণী এবং হিমালয়ের সুউচ্চ চূড়া ও শিখর তাদের কাছে টিলা-টিবির চেয়ে বেশি কিছু নয়। ভারত, চীন ও তুর্কিস্তানের বিশাল বিস্তৃত দেশ তাদের কাছে ক্ষুদ্র পল্লী ও সামান্য জনপদ ছাড়া কিছু নয়। আরো সুন্দর করে বলা যায়, ‘পৃথিবীর সমগ্র ভূখ-কে যদি বিশ্বনেতৃত্বের শীর্ষস্থান থেকে অবলোকন করা হয় তাহলে টেবিলের উপর মেলে ধরা একটি রঙ্গীন সাধারণ মানচিত্রই শুধু মনে হবে। আর এই সব বিরাট জাতি ও জনগোষ্ঠীকে তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন ও বিপুল জ্ঞানসম্পদসহ মনে হবে বড় কোন ঘরানার ছোট ছোট পরিবার।
এই বিরাট ‘পৃথিবী’ অস্তিত্ব লাভ করেছিলো এক অভিন্ন ঈমান-আকীদা এবং এক সুদৃঢ় আত্মিক সম্পর্কের উপর, যা ছিলো ইতিহাসের দেখা বিস্তৃততম পৃথিবী। আর যেসব জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে এই বিরাট ‘পরিবার’ গড়ে উঠেছিলো তা ছিলো ইতিহাসের দেখা সবচে’ সংহত মানবপরিবার, যাতে বিভিন্ন প্রকৃতির সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন জাতির মেধা ও প্রতিভা দ্রবীভূত হয়ে একটি অভিন্ন সংস্কৃতির রূপ ধারণ করেছে, যার নাম ইসলামী সংস্কৃতি। এ মহান সংস্কৃতির ‘গর্ভ’ থেকে যুগে যুগে এত বিপুল পরিমাণে ইসলামী প্রতিভা জন্মগ্রহণ করেছে, যার সংখ্যা-শুমার আল্লাহ ছাড়া কেউ করতে পারে না। এবং ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক এত এত কর্ম ও কীর্তি সম্পন্ন হয়েছে, ইতিহাসের বিস্তৃত পরিসরেও যা সম্ভব হয়নি।
এ নতুন নেতৃত্ব অধিকার ও যোগ্যতাবলেই বিশ্বনেতৃত্বের সমগ্র ইতিহাসের অভিজাততম, বিরাটতম ও শক্তিশালীতম নেতৃত্ব বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই নেতৃত্ব দ্বারা আরবজাতিকে আল্লাহ মর্যাদাবান করেছেন। তারা ইসলামী দাওয়াত-এর প্রতি পূর্ণ আন্তরিক ও আত্মনিবেদিত হয়েছিলো এবং এই মহান দাওয়াত ধারণ করা, রক্ষা করা ও বহন করার জিহাদ-মুজাহাদায় নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলো। তাই বিশ্বের মানবম-লী তাদের এমন ভালোবেসেছে, যার তুলনা নেই এবং প্রতিটি বিষয়ে তাদের এমন অনুসরণ করেছে, যার কোন নযির নেই। তাদের ভাষার প্রতি বিভিন্ন ভাষা, তাদের সংস্কৃতির প্রতি বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং তাদের সভ্যতার প্রতি বিভিন্ন সভ্যতা আনুগত্য প্রকাশ করেছে। ফলে তাদের ভাষাই ছিলো সভ্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত জ্ঞানসাধনা ও গ্রন্থরচনার ভাষা। সর্বোপরি তাদের ভাষা এমন প্রিয়তা ও পবিত্রতা অর্জন করেছিলো যে, মানুষ যে ভাষায় বড় হয়েছে, প্রতিপালিত হয়েছে এবং যে ভাষায় তার মুখে কথা ফুটেছে সেই মাতৃভাষার উপরও তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং ‘ভাষাপুত্র’দের সমান, বরং আরো অধিক ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। এমন উচ্চস্তরের ভাষা-বিশারদ, সাহিত্যসাধক ও লেখক-গবেষকের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের প্রতিভা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বয়ং আরববিশ্বের সুশীল সমাজ, সাহিত্যিক ও সমালোচকমহল স্বীকার করে নিয়েছেন।
তাদের সভ্যতাই ছিলো আদর্শ সভ্যতা, যার গৌরবকীর্তন করেছে সর্বভাষার, সর্বজাতির মানুষ, এবং যা গ্রহণ ও বরণ করে তারা আভিজাত্য বোধ করেছে এবং উলামায়ে দ্বীন যাকে অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন এবং এ সভ্যতার বিপরীতে সমস্ত সভ্যতাকে জাহেলি সভ্যতা ও আজমি সভ্যতা বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং ঐ সকল সভ্যতার রীতি-নীতি, ভাব ও অভিব্যক্তি গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন।
এই সর্বব্যাপী ও সর্বাঙ্গীণ নেতৃত্ব দীর্ঘ বহু যুগ স্বমর্যাদায় ও স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত ছিলো। কোন জনোগোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার বা এর ‘কবল’ থেকে উদ্ধার লাভের কথা চিন্তাও করেনি; যেমনটি ঘটে থাকে প্রত্যেক পরাস্ত, বিজিত ও শাসিত-শোষিত জাতির পক্ষ হতে। কিন্তু আরবজাতির ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। কেননা এই মহান নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বিজেতা ও বিজিত, শাসক ও শাসিত এবং দাস ও মনিবের সম্পর্ক ছিলো না, বরং ছিলো মুমিনের সঙ্গে মুমিনের এবং ধর্মনিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে ধর্মনিষ্ঠ মানুষের। খুব বেশী হলে বলা যায়, এ সম্পর্ক ছিলো অনুগামী ও অগ্রগামীর মধ্যে অনুসরণের সম্পর্ক; যেখানে অনুগামী অগ্রগামীর এ অবদান ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে যে, হক ও সত্যকে তারাই আগে জেনেছেন; দাওয়াতকে তারাই আগে গ্রহণ করেছেন এবং হকের দাওয়াত ও সত্যের আহ্বানের পথে তারাই জানমালের কোরবানি দিয়েছেন। সুতরাং বিদ্রোহের, অসন্তোষের এবং অকৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোন অবকাশই নেই, বরং তাদের অবদান স্বীকার করা, এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই হলো ভদ্রতা ও আভিজাত্যের দাবী। কোরআনের ভাষায়-
وَ الَّذِیْنَ جَآءُوْ مِنْۢ بَعْدِهِمْ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَ لِاِخْوَانِنَا الَّذِیْنَ سَبَقُوْنَا بِالْاِیْمَانِ وَ لَا تَجْعَلْ فِیْ قُلُوْبِنَا غِلًا لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَاۤ اِنَّكَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ.
আর যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, হে আল্লাহ, ক্ষমা করুন আমাদের এবং আমাদের ভাইদের, যারা আমাদের অগ্রে ঈমান এনেছে। আর আমাদের অন্তরে, যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি বিদ্বেষ রেখেন না। হে আমাদের প্রতিপালক, নিঃসন্দেহে আপনি কোমল ও দয়ালু। -সূরা আলহাশর (৫০) : ১০
এমনই ঘটেছিলো, বিজিত জাতিবর্গ আরবজাতিকে বিজয়ী শাসক না ভেবে ভেবেছে শিরক ও জাহেলিয়াত থেকে মুক্তিদাতা, শান্তির আবাস জান্নাতের পথে আহ্বানকারী ও পরিচালনাকারী এবং নীতি, নৈতিকতা, আদব ও শিষ্টাচারের শিক্ষাদানকারী।
এটাই হচ্ছে সেই বিশ্বনেতৃত্ব, নবুয়তে মুহম্মদীর শুভাগমন যার বিনির্মাণ করেছে, এবং যার ঘোষণা এসেছে সূরাতুল ইসরায়। এই নেতৃত্বকে পরম মমতায় ও সযত্ন সতর্কতায় আঁকড়ে ধরে রাখা আরবজাতির অপরিহার্য কর্তব্য। সব মেধা, প্রতিভা এবং সাধ্য ও যোগ্যতা এর পিছনেই ব্যয় করে যাওয়া উচিত; প্রজন্ম-পরম্পরায় দাওয়াত সম্পর্কে অছিয়ত করে যাওয়া উচিত। ধর্ম, বিবেক, বুদ্ধি ও গায়রত- কোন দৃষ্টিতেই আরবদের জন্য এর বৈধতা নেই যে, কোন যুগে কোন কারণে এই নেতৃত্বের দায়ভার থেকে তারা সরে আসবে। কেননা এই নেতৃত্বের মধ্যে প্রত্যেক নেতৃত্বের পূর্ণ বিকল্প রয়েছে এবং আরো অধিক কিছু রয়েছে। কিন্তু কোন নেতৃত্বে না আছে এর বিকল্প, না আছে ন্যূনতম যথেষ্টতা এ নেতৃত্ব সর্বপ্রকার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে নিজের পরিধিতে বেষ্টন করে এবং তা দেহ ও শরীরের উপর কর্তৃত্ব অর্জন করার চেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করে হৃদয় ও আত্মার উপর কর্তৃত্ব করার বিষয়কে।
এই নেতৃত্ব লাভের পথ আরবজাতির জন্য সহজ, সরল ও পরিচিত এবং নিজেদের প্রথম যুগে একবার তারা তা পরীক্ষা করেও দেখেছে। আর তা হলো ইসলামী দাওয়াতের প্রতি ইখলাছ, ঐকান্তিকতা ও আত্মনিবেদন; মনে-প্রাণে ইসলামী দাওয়াতকে গ্রহণ ও বরণ; ইসলামী দাওয়াতের পথে আত্মত্যাগ ও সর্বস্ব বিসর্জন এবং অন্যসব জীবনব্যবস্থার উপর ইসলামী ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান, এপথেই- তবে নেতৃত্ব লাভের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য ছাড়া- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের আনুগত্য গ্রহণ করবে, তাদের অনুসরণ করবে এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করবে।
এভাবেই শুধু পৃথিবীর পূর্বে পশ্চিমে সর্বত্র তাদের জন্য খুলতে পারে বিজয়ের নতুন নতুন দুয়ার ও নতুন নতুন দিগন্ত, যা সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী পাশ্চাত্যের জন্য কখনো উন্মুক্ত হয়নি; বরং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে।
এভাবেই ইসলামের আলোকিত অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারে নতুন নতুন জাতি ও জনগোষ্ঠী, যাদের মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা ও গুণভা-ার এখনো নির্ভেজাল ও ব্যবহার-দোষ থেকে মুক্ত, সম্পূর্ণ নতুন অবস্থায় রয়েছে। ফলে তারা সহজেই ইউরোপের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির সফল মোকাবেলা করতে সক্ষম, যদি তারা পেয়ে যায় নতুন দ্বীন, নতুন ঈমান, নতুন প্রাণ, নতুন বার্তা, নতুন পায়গাম।
আর কতদিন হে আরব, ক্ষুদ্র তুচ্ছ ক্ষেত্রে তোমাদের বিপুল শক্তির অপচয় করে যাবে, যা দ্বারা প্রাচীন বিশ্বকে একবার তোমরা জয় করেছিলে? এই সর্বপ্লাবী জোয়ার আর কত দিন এই সঙ্কীর্ণ উপত্যকায় আবদ্ধ থাকবে, যা একদিন সমস্ত সভ্যতা ও স্বেচ্ছাচারী শাসকদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো?
এবার ওঠো, জাগো এবং এই বিস্তৃত মানবসমাজের প্রতি মনোযোগী হও, যাদের নেতৃত্বদানের এবং পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তোমাদের মনোনীত করেছেন। আর নবুয়তে মুহম্মদী ও দাওয়াতে মুহম্মদীই হচ্ছে তোমাদের ইতিহাসে এবং মানবজাতির ইতিহাসে এক নবযুগের শুভ উদ্বোধন এবং তোমাদের ভাগ্য ও সমগ্র বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণের সূচনা। সুতরাং এই দাওয়াত নতুনভাবে তোমরা গ্রহণ করো এবং এর জন্য জান-মাল সর্বস্ব কোরবান করো। আর আল্লাহ তা‘আলার এই আহ্বানে লাব্বাইক বলে সাড়া দাও-
وَ جَاهِدُوْا فِی اللهِ حَقَّ جِهَادِهٖ هُوَ اجْتَبٰىكُمْ وَ مَا جَعَلَ عَلَیْكُمْ فِی الدِّیْنِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ اَبِیْكُمْ اِبْرٰهِیْمَ هُوَ سَمّٰىكُمُ الْمُسْلِمِیْنَ مِنْ قَبْلُ وَ فِیْ هٰذَا لِیَكُوْنَ الرَّسُوْلُ شَهِیْدًا عَلَیْكُمْ وَ تَكُوْنُوْا شُهَدَآءَ عَلَی النَّاسِ فَاَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اعْتَصِمُوْا بِاللهِ هُوَ مَوْلٰىكُمْ فَنِعْمَ الْمَوْلٰی وَ نِعْمَ النَّصِیْر .
আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো তাঁর রাস্তায় জিহাদের হক অনুযায়ী, তিনিই তোমাদের মনোনীত করেছেন (তাঁর দ্বীনের জন্য)। আর দ্বীনের বিষয়ে তিনি তোমাদের উপর কষ্টকর কিছু আরোপ করেননি। তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত আঁকড়ে ধর। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম, পূর্বেও এবং এই কোরআনেও; যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হন, আর তোমরা সাক্ষী হও মানুষের ‘উপর’। সুতরাং তোমরা ছালাত কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো, আর আল্লাহকে আঁকড়ে ধরো। তিনিই তোমাদের অভিভাবক, সুতরাং কত না উত্তম অভিভাবক এবং কত না উত্তম সাহায্যকারী! -সূর আলহাজ্জ (২২) : ৭৮
আরববিশ্বের কাছে ইসলামী বিশ্বের প্রত্যাশা
আরববিশ্ব তার স্বকীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক (ও সামরিক) গুরুত্বের কারণে দাওয়াতে ইসলাম-এর সুমহান দায়িত্বপালনের সবচে’ বড় হকদার। এখন সে যা করতে পারে তা হলো, ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করা। তারপর পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে পূর্ণ যোগ্যতার অবস্থান থেকে ইউরোপের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলা। তখন সে তার ঈমান ও দাওয়াতের শক্তি এবং আল্লাহর গায়বী মদদ ও সাহায্য দ্বারা ইউরোপের উপর নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে পারবে, (হয় যুদ্ধ করে কিংবা বিনা যুদ্ধে)। এভাবে দুনিয়াকে সে অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে পরিচালিত করতে পারবে। ইউরোপীয় জাহেলিয়াতের আজকের তাগুত যারা, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ণ সাহসের সঙ্গে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে পারবে, যেমন মুসলিম দূত একদিন পারস্যের রাজদরবারে ঘোষণা করেছিলেন-
‘আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন তোমাদের বের করে আনতে, মানুষের দাসত্ব থেকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে এবং পৃথিবীর সঙ্কীর্ণতা থেকে পৃথিবীর প্রশস্ততার দিকে এবং নানা ধর্মের অবিচার থেকে ইসলামের সুবিচারের দিকে।’
মানবজাতি আজ নিজেদের মুক্তিদাতা ও ত্রাণকর্তারূপে মুসলিমবিশ্বের দিকে আশা ও প্রত্যাশার ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পক্ষান্তরে মুসলিমবিশ্ব আজ তাদের নেতৃত্ব ও ‘রাহবারি’ গ্রহণ করার জন্য আরববিশ্বের প্রতীক্ষায় রয়েছে। মুসলিমজাতি কি মানবজাতির আশা ও প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারবে? আর আরববিশ্ব কি মুসলিমবিশ্বের আহ্বানে, আন্দোলনে সাড়া দিতে পারবে? বহু যুগ ধরে মজলুম মানবতা এবং ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত মানবজাতি কবি ইকবালের দরদপূর্ণ কবিতার ভাষায় মুসলিমজাতির কাছে ফরিয়াদ করে আসছে, আর এখনো তারা বিশ্বাস করে যে, যে নিবেদিতপ্রাণ মানুষের হাত কা‘বা নির্মাণ করেছিল তারাই আজ পারবে পৃথিবীর ‘নব-নির্মাণে‘র মহান দায়িত্ব পালন করতে। ইকবালের কবিতা-
ناموس ازل را تو امينی تو امينی + دارئے جہاں را تو يساری تو يمينی
اے بندۂ خاکی تو زمانی تو زمينی+ صہبائے يقيں درکش واز دير گماں خيز
از خواب گراں ،خواب گراں ،خواب گراں خيز + ازخواب گراں خيز
فرياد از ا فرنگ ودل آويزئ افرنگ + فرياد زشيرينی وپرويزئ افرنگ
عالم ہمہ ويرانہ زچنگيزئ افرنگ + معمارحرم! باز بہ تعمیر جہاں خيز!
ازخواب گراں، خواب گراں ،خواب گراں خيز + ازخواب گراں خيز
হে মুসলিম, ঊর্ধ্বজগতের শাশ্বত বার্তার তুমি বিশ্বস্ত ধারক/বিশ্বজগতের মহান অধিপতির তুমি নিবেদিত সেবক/হে মাটির বান্দা, যমীন তোমার, যামানা তোমার/ঈমানের শরাব পান করো, কুফুরির বুতখানা থেকে বেরিয়ে এসো/ জেগে ওঠো, জেগে ওঠো, ঘুমের ঘোর থেকে জেগে ওঠো।
ধিক ফিরিঙ্গীকে ও তার ছল ও ছলনাকে/কখনো সাজে লাইলী, কখনো মজনু/ফিরিঙ্গীর চেঙ্গিজিতে জাহান আজ বরবাদ/হে হারামের নির্মাতা, ফিরে এসো বিশ্বের বিনির্মাণের জন্য/জেগে ওঠো, জেগে ওঠো, ঘুমের ঘোর থেকে জেগে ওঠো।
رواه البغوي عن أبي عثمان النهدي
. رواه البخاري عن سلمة بن الأكوع رضي الله عنه في كتاب الجهاد والسير، وفي كتاب أحاديث الأنبياء، وفي كتاب المناقب، وأحمد في مسنده (في مسند المدنيين)
. رواه مسلم عن عقبة بن عامر رضي الله عنه في كتاب الإمارة، وأبو داود في كتاب الجهاد، وابن ماجه في كتاب الجهاد، وأحمد في مسند (مسند الشاميين) والدارمي في كتاب الجهاد