জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৯   ||   মার্চ ২০১৮

দেশ-বিদেশের কিছু ঘটনা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের একটি স্কুলে আবারও ফায়ারিংয়ের ঘটনা ঘটল। স্কুলের সাবেক ছাত্র নিকোল্স ক্রুজ (১৯) স্কুলে এসে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে ১৭ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছে।

আমেরিকার স্কুলে ফায়ারিংয়ের এটা নতুন ঘটনা নয়। ইতিপূর্বে এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনায় শত শত ছাত্রের মৃত্যু ঘটেছে। শুধু চলতি বছরের দেড় মাসের মধ্যেই এটি ১৮তম ঘটনা। এ প্রসঙ্গে একটি বিদেশি পত্রিকা থেকে বিগত দুই দশকের কয়েকটি ঘটনার সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরছি।

১৯৯৯ সালের এপ্রিলে কলোরাডোর একটি হাইস্কুলে ১৭ ও ১৮ বছরের দুই কিশোর ফায়ারিং করে শিক্ষকসহ ১২ জন ছাত্রকে হত্যা করে। এরপর নিজেরাও আত্মহত্যা করে। সে ঘটনায় ২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছিল।

১৯৯৯-এর নভেম্বরে নিউ ম্যাক্সিকোর একটি স্কুলে ভিক্টর কর্ডোভা জুনিয়র (১২) তার সহপাঠী ছাত্রীকে গুলি করে হত্যা করে। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে দুই বছরের কারাদ- দেয়া হয়।

২০০০-এর ফেব্রুয়ারিতে মিশিগান রাজ্যের একটি স্কুলেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। ওখানে তো ৬ বছর বয়সের এক শিশু তার সহপাঠী এক ছাত্রীকে গুলি করে হত্যা করে। অল্পবয়স্ক হওয়ার কারণে তাকে কোনো শাস্তি দেয়া না হলেও সে যে নারীর সাথে থাকত তাকে দায়িত্বে অবহেলা ও অস্ত্র শিশুর হাতের নাগালে রাখার কারণে ১৫ বছর কারাদ- দেয়া হয়।

একই বছরের মে মাসে ফ্লোরিডার একটি স্কুলে ১৩ বছর বয়সের একটি ছাত্র স্কুলে তার শেষ দিনে গুলি করে তার শিক্ষককে হত্যা করে। অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পর তাকে ২৮ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়।

২০০১-এর মার্চে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তানা হাই স্কুলে ১৫ বছর বয়সের ছাত্র চার্স এন্ডি উইলিয়াম্স এলোপাতাড়ি গুলি করে ২ ছাত্রকে হত্যা করে। এ ঘটনায় ১৩ জন আহত হয়। তাকে ৫০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়।

২০০৩-এর সেপ্টেম্বরে মেনিসোটার একটি স্কুলেও সহাপাঠীর গুলিতে ২ জন নিহত হয়। একই রাজ্যে ২০০৫-এর মার্চে জেফ ওয়াইয (১৬) তার দাদা ও দাদার বন্ধুকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর রেড লেক ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশনে অবস্থিত স্কুলে গিয়ে পাঁচ ছাত্র, এক শিক্ষক ও সিকিউরিটি গার্ডকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করে। একই বছরের নভেম্বরে টেনিসি অঙ্গরাজ্যের একটি হাইস্কুলে ফায়ারিংয়ের ঘটনা ঘটে। ১৫ বছর বয়সী ঐ কিশোরের হাতে একজন নিহত ও দুইজন আহত হয়।

২০০৬-এর সেপ্টেম্বরে WISCONSIN রাজ্যে ১৫ বছর বয়সী এরিক হেন স্টক স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল জন ক্লাঙ্গ (৪৯)-কে গুলি করে হত্যা করে।

ঘটনার আগের দিন প্রিন্সিপ্যাল স্কুলে সিগারেট আনার বিষয়ে তাকে সতর্ক করেছিলেন।

২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে ILLINOIS রাজ্যের  একটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। বন্দুকবাজ হলে ঢুকে গুলি করে ৫ ছাত্রকে হত্যা করে এবং ১৮ জনকে আহত করে। এরপর সে নিজেও আত্মহত্যা করে।

২০০৮-এর অক্টোবরে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল আরকেনসাসের ৪ অস্ত্রধারীর গুলিবর্ষণে দুই ছাত্র নিহত হয়।

২০১২-এর ফেব্রুয়ারিতে স্কুল হত্যাকা- ঘটে ওহাইয়ো রাজ্যের চারভেন শহরে। এতে ৩ ছাত্র নিহত হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে অনুরূপ ঘটনা ঘটে কানেকটিকাট রাজ্যে। ২০ বছর বয়সী এডাম লযনুয প্রথমে নিজের মা নেন্সিকে ঘরে গুলি করে হত্যা করে এরপর নিউটাউন এলাকায় অবস্থিত একটি স্কুলে গিয়ে গুলিবর্ষণ করে। এতে ২৬ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ২০ জন ছিল ফার্স্টগ্রেডার। এরপর সে নিজেও আত্মহত্যা করে।

এরূপ ২০১৪-এর জুনে অরিগন রাজ্যের একটি হাইস্কুলে, ২০১৫-এর পয়লা অক্টোবর একই রাজ্যের একটি কমিউনিটি কলেজে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। প্রথম ঘটনায় একজন ছাত্র নিহত ও এক শিক্ষক আহত হয়। দ্বিতীয় ঘটনায় ৯ জন নিহত হয়। এরপর পুলিশের গুলিতে হত্যাকারী মার্সারও নিহত হয়।

২০১৭-এর ডিসেম্বর নিমেকিসকো রাজ্যের একটি স্কুলে ২১ বছর বয়সী এক বহিরাগত স্কুলছাত্রের বেশে স্কুলে প্রবেশ করে গুলি করে ২ ছাত্রকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করে।

২০১৮-এর জানুয়ারিতে কানেকটিকাট রাজ্যের মার্শাল হাইস্কুলে সহপাঠীর গুলিতে দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

এ হচ্ছে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের এক নম্বর রাষ্ট্র আমেরিকার শুধু স্কুল-হত্যাকাণ্ডের কিছু বিবরণ।

সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হত্যাকারীর পক্ষে যেন সাফাই গেয়ে বললেন, সে অসুস্থ ছিল। তার এই বক্তব্যে অনেকেই আশ্চর্য হয়েছেন। কেউ কেউ একথাও বলেছেন যে, এরকমের ঘটনা কোনো মুসলিমের মাধ্যমে সংঘটিত হলে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া ও প্রশাসনের পরিস্থিতি কী দাঁড়াত?

এই অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ এখন অনেকটাই নিয়মিত। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ১৭ ছাত্র হত্যার ঘটনার ২/৩ ঘণ্টার মধ্যেই এ নিয়ে গণমাধ্যমে আর কোনো মাতামাতি নেই। সুদূর বাংলাদেশের বাংলাভাষায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলোও যেন অদৃশ্য কোনো কারণে একেবারেই নীরব হয়ে গেল। অথচ এর চেয়ে অনেক কম মর্মান্তিক বিষয়ও আমাদের মিডিয়া দিনের পর দিন ফলাও করে প্রচার-প্রচারণা, আলোচনা-পর্যালোচনা অব্যাহত রাখে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বিরুদ্ধে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দমে যাওয়া বা অদৃশ্য শক্তির চাপে চুপসে যাওয়ার যে অভিযোগ রয়েছে এটি কি তারই আরেকটি প্রমাণ?

আমেরিকার জন-জীবনে মানসিক ও পারিবারিক অস্থিরতার পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা এর বড় কারণ। নির্বিচার গুলিবর্ষণের অসংখ্য ঘটনার পরও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো প্রয়াস বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গান-লবি এবং সে দেশের প্রেসিডেন্টের সাথে এই লবির দহরম-মহরম। পুঁজিবাদী স্বার্থ ও বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ফল যে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক হচ্ছে না- এই সকল ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তাদের শুভবুদ্ধি উদয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ সকল বাস্তবতা থেকে মুসলমানদের কর্তব্য; পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থার বিধ্বংসী রূপটি উপলব্ধি করে নেয়া। যেখানে একজন মা তার সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে পুরো সময় চিন্তিত থাকেন যে, তার ছেলে আদৌ ঘরে ফিরবে কি না, সে দেশের শান্তির মাত্রা বোঝার জন্য আর কোনো সূচকের প্রয়োজন হয় না।

 

ইরান-ভারত

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আরেকটি বিষয়ও এখন বেশ আলোচিত। তা হচ্ছে, ইরান-ভারত দহরম-মহরম। সচেতন অনেকেরই চোখে পড়ে থাকবে, ইরানের প্রেসিডেন্ট রূহানীর ভারত সফরকালে হায়দারাবাদের ঐতিহাসিক মসজিদে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাকে আমন্ত্রণ করা হয়। তিনি সেখানে ভাষণও দিয়েছেন। অথচ মসজিদটি মুসলমানদের। কোনো শিয়া ব্যক্তিত্বের এ মসজিদে প্রবেশের ঘটনা এটিই প্রথম। অথচ তাকে তো কোনো শিয়া ইমামবাড়ায় নিয়ে যাওয়া যেত। মনে পড়ছে, মসজিদে নববীর সম্মানিত খতীব শায়েখ হুযাইফীর কথা। তৎকালীন ইরানী প্রেসিডেন্ট রাফসানজানীর মসজিদে নববীতে আগমন এবং রওযা যিয়ারতের সময় আবু বকর সিদ্দীক রা. ও ওমর রা. সম্পর্কে গর্হিত ও অবমাননাকর আচরণের প্রতিবাদে তিনি কড়া ভাষণ দিয়েছেন। সেসময় আরব ক্ষমতাসীনদের বিষয়টি ভালো লাগেনি। এ প্রতিবাদী ভাষণের কারণে সে সময় শায়েখ হুযাইফীকে নানা প্রকার রাষ্ট্রীয় হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। শায়েখ হুযায়ফী কুরআন-সুন্নাহর ইলমের কারণে ঐ সময় যা উপলব্ধি করেছিলেন তা যদি আরব রাষ্ট্রনায়কেরাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হতেন তাহলে হয়তো এখন ইয়েমেন যুদ্ধ ও ইরানের সাথে এক দীর্ঘ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে যাওয়ার প্রয়োজন হত না।

ইরানের একটি বন্দর ভারত ভাড়া নিয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে মালামাল পরিবহনের জন্যে হলেও যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা- ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে শিয়া-হিন্দু সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট প্রতিষ্ঠার ছবিটাই ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এর বড় প্রমাণ, ভারতে থাকাকালীন প্রেসিডেন্ট রূহানী ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ দেয়ার দাবি তুলেছেন। অর্থাৎ ভারতে ব্যাপক মুসলিম নির্যাতন হলেও জাতিসংঘে এর বিরুদ্ধে কোনো কিছুই করা যাবে না। কোনো প্রস্তাব উঠলেই ভারত তাতে ভেটো দিতে পারবে। একইভাবে শিয়ারা যতই ষড়যন্ত্র করবে তাদের পক্ষে ভেটো ক্ষমতা নিয়ে উপস্থিত থাকবে ভারত। এইসকল দৃষ্টান্ত সামনে আসার পরও কি মুসলিমদের নিজেদের মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ ও কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত থাকা উচিত? এখনও যদি মুসলিমেরা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবিত না হয় তাহলে আর কখন উজ্জীবিত হবে?

 

প্রশ্নপত্র ফাঁস

সাম্প্রতিক উদ্বেকগজনক দেশীয় বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস। সারা দেশে ব্যাপকভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি, এমনকি প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেও কাজ হচ্ছে না। গোটা জাতি তাদের সন্তান ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন।

দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছর যাবৎ  বিসিএসসহ প্রায় সকল পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হয়ে যাচ্ছ। অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষা মানেই প্রশ্ন-ফাঁস। গোটা শিক্ষা-ব্যবস্থাটাই যেন হয়ে উঠেছে সার্টিফিকেট সর্বস্ব। শিক্ষার্থী কী শিখছে, তার চেয়ে বেশি নজর পরীক্ষায় গোল্ডেন-এ প্লাস পাচ্ছে কি না। ফলে শিক্ষা নয়, যে কোনো উপায়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করাই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

এই জাতি-বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার সাথে কারা জড়িত? শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, শিক্ষকেরা। অন্যরা বলছে, প্রশ্ন তৈরি প্রক্রিয়ায় জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মানে, জড়িতরা সকলেই ‘শিক্ষিত’। তাহলে এই জাতির ভবিষ্যত কী?

এইসব দৃষ্টান্ত বারবার আমাদের জানাচ্ছে যে, তাকওয়া, খোদাভীতি ও সুশাসন ছাড়া তথাকথিত শিক্ষা মানুষের কোনো উপকার বয়ে আনে না। এই অতি উদ্বেগজনক ব্যাপারেও কিছু খবর প্রকাশ ছাড়া কোনো বিহিত ব্যবস্থা কি নেয়া হচ্ছে? পরীক্ষা শেষ, আলোচনাও শেষ, আবার আরেকটা পরীক্ষা, আবার প্রায় সকল প্রশ্নপত্র ফাঁস। কতদিন চলবে এই তামাশা? জাতির বিবেকবান লোকদের কি জেগে ওঠা দরকার নয়?

যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে বিষয়টি এতই ভায়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, দুর্বৃত্তরা যেন গোটা জাতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। ফেসবুকে আগাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলে দিচ্ছে যে, যথাসময়ে অন্য প্রশ্নও ফাঁস করবে। এ প্রেক্ষাপটে ফেসবুক বন্ধের কথা ওঠায় বিভিন্ন মহল থেকে নানা ওজর-আপত্তি আসতে থাকে। যেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ও গোটা জাতির ভবিষ্যতের চেয়েও ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। প্রযুক্তির অন্ধ মোহ আর কাকে বলে?

এই সুযোগে আমরা কওমী মাদরাসার বিভিন্ন স্তরের বোর্ডগুলোর দায়িত্বশীলদের কাছেও সবিনয় আরজ করব, সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থার এই বিধ্বংসী ধারার সংক্রমণ থেকে আমাদের দ্বীনী শিক্ষাধারাকে রক্ষা করার জন্য এখনই পুরোপুরি সতর্ক হওয়া দরকার।

উস্তায-শাগরিদ ও সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের এই চেতনা দৃঢ়ভাবে পোষণ করতে হবে যে, সনদ ও সার্টিফিকেট মুখ্য নয়, ইলম অর্জন করাই মুখ্য। মজবুত ইসতি‘দাদ ও তাফাক্কুহ ফিদ্দ্বীন অর্জনে সক্ষম না হলে হাজারো কাগুজে সার্টিফিকেটে কোনো কাজ হবে না। মূল যোগ্যতা অর্জনে উদাসীন হয়ে সার্টিফিকেট অর্জনের রাস্তা হচ্ছে জীবন ধ্বংস করার রাস্তা। কাজেই আলিম-তালিবে ইলম সবাইকে এ বিষয়ে পূর্ণ সচেতন হতে হবে।

এক্ষেত্রে বোর্ডের দায়িত্বশীলগণকে গাইড-সাজেশন প্রভৃতি বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশ্নপত্র এমন রাখতে হবে যে, গাইড-সাজেশনে কাজ না হয়।

শোনা যায়, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় পরীক্ষার জামাতগুলোতে বছরব্যাপী পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর বিশেষভাবে মুখস্থ করানো হয়। এ প্রবণতা তালিবে ইলম্দের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করার পরিবর্তে অন্ধকারের পথে নিয়ে যেতে পারে। কারণ, বাস্তব ইস্তি‘দাদ ছাড়া ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার আশা দিবাস্বপ্ন মাত্র।

 

কোটাপদ্ধতি

আরেকটি বিষয়ে দু-একটি কথা বলে শেষ করছি। সম্প্রতি সরকারি চাকুরিতে কোটা-ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন হয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কোটাপদ্ধতি চালু হয়। জেলার জন্য কোটা রয়েছে। উপজাতি, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্যও কোটা রয়েছে। এর পরিমাণ ২৫ শতাংশ। আর মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের প্রাধিকার কোটা ৩০ শতাংশ।

সর্বমোট ৫৫ শতাংশ।  আর মেধার মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ পান মাত্র ৪৫ শতাংশ প্রার্থী। এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মেধা ও নৈতিকতাই নিয়োগের মাপকাঠি হওয়া উচিত। এখন পর্যন্ত যত মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধিত হয়েছেন তাদের পোষ্যর সংখ্যা হয়ত মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম হবে। এক্ষেত্রে তাদের জন্য ৩০ শতাংশ চাকরির প্রাধিকার কীভাবে যৌক্তিক হতে পারে?

এ ধরনের বহু সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির  ফল হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক হতে দেখা যায়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধনের অভিযোগও করে থাকে একেরা অন্যদের বিরুদ্ধে। দেশ-জাতির অনগ্রসরতার অনেক কারণের মধ্যে এজাতীয় ব্যবস্থাগুলোও অন্যতম।

ইসলাম বলে, দায়িত্ব যোগ্য লোককেই অর্পণ করতে হবে। অন্যথায় তা আমানতের খিয়ানত বলে গণ্য হবে। ইসলামে তো নিজ থেকে প্রার্থী হওয়া লোকদেরও পদ না দেয়ার নিয়ম রয়েছে।

قَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لَنْ نَسْتَعْمِلَ، أَوْ لَا نَسْتَعْمِلُ عَلَى عَمَلِنَا مَنْ أَرَادَهُ.

অর্থাৎ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো কর্মের প্রার্থী হয় আমরা তাকে ঐ পদে নিয়োজিত করব না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৫৭৯; সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৩৩

অনগ্রসরদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা এবং তাদের উপযোগী চাকরি ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অবশ্যই মেধাবী ও মুত্তাকী লোকদের নিয়োগ দিতে হবে। এটাই সকল পক্ষের জন্য কল্যাণকর।

 

advertisement