যিলক্বদ ১৪৩৮   ||   আগস্ট ২০১৭

তুরস্ক : নেতৃত্বের গুণ

মুযাককির

গত বছরের ১৫ জুলাই তুরস্কের ভয়াবহ অভ্যুত্থানটি স্বতঃস্ফূর্ত জনগণ কর্তৃক ঠেকিয়ে দেয়া ছিল সাম্প্রতিক সময়ের এক বহুলআলোচিত ঘটনা। তুরস্ক দিনটিকে ‘গণতন্ত্র ও ঐক্য’ দিবস অভিহিত করে এ দিন রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করেছে। যে বসফরাস সেতুর উপর সেনাবাহিনীর ঐ অংশটির সাথে তুর্কী জনতার মোকাবিলা হয়েছিল ঐ সেতুটি অভিহিত হয়েছে ‘জুলাই ফিফটিন মার্টায়ারস ব্রিজ’ নামে। এই ঘটনার বছর পূর্তি উপলক্ষে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায় আয়োজিত হয়েছিল বিশাল সমাবেশ। সমাবেশে বক্তৃতা করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান। অভ্যুত্থানের সেই রাতকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘সেই রাতে মানুষের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, তাদের হাতে ছিল একটি পতাকা আর সবচেয়ে বড় কথা, তাদের ছিল বিশ্বাস।’ সাম্প্রতিক সময়ে নেতৃত্বের প্রতি গণমানুষের আস্থা ও ভালবাসার এটি একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। এই ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, যেই নেতৃত্ব গণমানুষের আবেগ ও বিশ্বাসের সাথে একাত্ম হয় এবং তাদের দুঃখ-বেদনা লাঘবে আন্তরিক ও কর্মতৎপর হয় জনগণ তাকে যথাসময়ে প্রতিদান দিতে ভুল করে না। মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য ঘটনাটি একটি দৃষ্টান্তমূলক ও শিক্ষণীয় ঘটনা হতে পারে। আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি যে, এরদোয়ানের সকল কর্ম ও সিদ্ধান্তের সাথে আমরা একমত এমন নয়, কিংবা তুরস্কে তিনি ইসলামী খিলাফত কায়েম করে ফেলেছেন তা-ও নয় তবে আতাতুর্ক-পরবর্তী তুরস্কেই শুধু নয়, বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা কিছুটা হলেও বোঝার এবং কিছু ক্ষেত্রে কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার মতো মুসলিম নেতা কি খুব বেশি আছে? সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে দুই ভাতৃপ্রতিম দেশ কাতার ও সৌদী আরবের দ্বন্দ নিরসনে তাকে তৎপর দেখা যাচ্ছে। ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও তাকে সরব দেখা যাচ্ছে। অথচ ওআইসির মতো সংগঠনও নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। যাই হোক, মুসলিম নেতৃবৃন্দের কর্তব্য স্বজাতির ধর্মভীরুতা এবং ইসলামের সাথে তাদের হৃদয়ের বন্ধনকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারা। আর এ শুধু ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক স্বার্থেই নয়, নিজের ঈমানী চেতনার কারণেই হওয়া উচিত। এতে শুধু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরই নয়, রয়েছে গোটা দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে এটা হতে পারে অনেক বড় সহায়ক। এক্ষেত্রে ধর্ম হিসেবে ইসলামের রয়েছে আলাদা মাত্রা ও বিশেষত্ব। ইসলাম আল্লাহপ্রদত্ত সত্য দ্বীন হওয়ার কারণে এর চর্চা ও সঠিক বাস্তবায়ন শুধু মুসলিমেরই নয় সমাজের সকল শ্রেণির ও সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য কল্যাণ ও সুবিচার নিশ্চিত করে। কাজেই মুসলিম নেতৃবৃন্দের বড় সুবিধা হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চেতনা ও বিশ্বাসের মূল্যায়নের জন্য কোনো প্রকারের সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণতা এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতি কোনো প্রকারের অন্যায়-অবিচারে লিপ্ত হতে হয় না। কাজেই সকল গোষ্ঠীর জন্য ন্যায় ও সুবিচার নিশ্চিত করেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষাকে মূল্যায়ন করার সুযোগ মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের রয়েছে। তদ্রূপ জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জনে জনসেবা ও জনগণের প্রয়োজন পূরণে সদিচ্ছারও কোনো বিকল্প নেই। রজব তাইয়েব এরদোয়ানের আজকের এই অবস্থার পেছনে রয়েছে তার দীর্ঘ কর্মময় অতীত, যে অতীতে তুর্কী জনগণের বিপুল সেবা করার সৌভাগ্য তার হয়েছে। এরই সাথে তাঁর হৃদ্যতা, বিনয় ও সৌজন্যবোধ তাকে জনগণের আরো কাছাকাছি করেছে। আরবীতে একটি কথা আছে- سيد القوم خادمهم ‘কওমের নেতা কওমের সেবক’। প্রকৃত নেতৃত্ব-গুণের অধিকারী তিনিই, যিনি নিজ কওমের সেবা করতে পারেন এবং নিজেকে কওমের সেবক জ্ঞান করতে পারেন। যে নেতৃত্বের আচরণে-উচ্চারণে গণমানুষের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের প্রকাশ ঘটে, তিনি আর যাই হন ‘নেতা’ হবার উপযুক্ত নন। একটি সুন্দর দৃষ্টান্তকে কেন্দ্র করে যে লেখাটি আরম্ভ করেছি কোনো অসুন্দর উদাহরণের অবতারণা করে তাকে তিক্ত করতে চাই না। এটুকুই শুধু প্রত্যাশা- আমাদের নেতাগণ ‘আমাদের নেতা’ হোন।

 

 

advertisement