আমাদের রাজ্য শাসন-১৮
মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী
মুসলমানদের মাঝে বিশৃঙ্খলা ও হযরত উসমান রা.-এর শাহাদত-৩
উসমান রা. প্রতিটি আপত্তির এত স্পষ্ট জবাব দিলেন যে, সত্যি সত্যি কোনো অভিযোগ থাকলে তার নিরসন হয়ে যেত। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যই তো ছিল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। ফলে তারা ফিরে গিয়ে আবারো নানা দিকে চিঠিপত্র লিখতে শুরু করল এবং মিথ্যা অপপ্রচার চালাতে লাগল। পরবর্তী বছর হজ্বের নামে কূফা, বসরা ও মিসর থেকে এরা সংঘবদ্ধ হয়ে রওনা হয়ে গেল।
অন্যদের যাতে সন্দেহ না হয় এজন্য তারা পৃথক চারটি দলে বিভক্ত হয়ে আগে পরে আসতে থাকে এবং মদীনার তিন মনযিল আগে যাত্রা বিরতি করে। মদীনার অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রথমে দুজন মদীনায় প্রবেশ করে। এরপর সময়-সুযোগ বুঝে আরো কিছু লোক মদীনায় আসে। তারা মদীনায় হযরত আলী রা., হযরত তালহা রা. ও হযরত যোবায়ের রা.-এর সাথে সাক্ষাত করে। তাদের কাছে উসমান রা.-এর অনেক দোষ-ত্রুটি তুলে ধরে এবং বলে, আমরা চাই তার পরিবর্তে আপনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করুন। কিন্তু এ সকল বুযুর্গ ব্যক্তি স্পষ্ট ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করে দেন। তখন তারা সদলবলে ফিরে যায়। পরবর্তীতে তারা পুনরায় সমবেত হয়ে একসাথে মদীনায় আক্রমণ করে বসে এবং উসমান রা.-এর বাড়ির চারদিক ঘিরে ফেলে। এরপর শহরজুড়ে ঘোষণা করে দেয় যে, কেউ নিজের কল্যাণ চাইলে সে যেন অস্ত্র সমর্পণ করে।
আলী রা. জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা তো চুপচাপ চলে গিয়েছিলে তাহলে এখন আবার কেন ফিরে এসেছ? মিসরের লোকেরা বলল, আমরা তো চলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা একটি পত্র উদ্ধার করেছি। যাতে লেখা আছে, আমরা মিসরে পৌঁছলে আমাদেরকে যেন হত্যা করে দেওয়া হয়। এরপর আলী রা. কূফা ও বসরার লোকদেরকেও একই প্রশ্ন করলেন। তারাও অনুরূপ উত্তর দিল। এতে তাদের মিথ্যাবাদী হওয়া স্পষ্ট হয়ে গেল।
আলী রা. বললেন, তোমরা তো ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। তোমাদের পথও ভিন্ন। তাহলে তিন মনযিল চলে যাওয়ার পর কীভাবে জানলে যে, মিসরীয়দের সম্পর্কে হত্যার নির্দেশ যাচ্ছে। আর তারা তা পথিমধ্যেই আটক করেছে? যার কারণে তোমরা উত্তেজিত হয়ে তাদের সাহায্য করতে চলে এসেছ? আল্লাহর শপথ! তোমরা সবাই মিথ্যাবাদী। এটা তোমাদের পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্ত।
তারা এর কী উত্তর দিবে? আলী রা.-এর কথায় তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। অবশেষে যখন কোনো উত্তরই খুঁজে পেল না তখন বলে উঠল, আপনার যা ইচ্ছা বলুন। আমরা এই খলীফাকে হত্যা করেই ছাড়ব। এ কাজে আপনিও আমাদের সাথে আসুন। হযরত আলী রা. তাদেরকে লা‘নত করলেন এবং বললেন, আমি কখনোই তোমাদের সাথে নেই। হযরত তালহা রা. ও হযরত যোবায়ের রা.-এর কাছে তারা একই প্রস্তাব দিলে তারাও তাদের লা‘নত করেন।
কিন্তু এতে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটল না। তারা সোজা হযরত উসমান রা.-এর কাছে গেল এবং ঐ বানোয়াট চিঠি দেখাল। উসমান রা. তা দেখামাত্রই বলে উঠলেন, এটা তো আমার পাঠানো চিঠি নয়। আর আমি এ চিঠির ব্যাপারে কিছু জানিও না। বাস্তবে এমন কিছু ঘটলেই তো তারা বুঝবে। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল ভিন্ন কিছু। এজন্য তারা গোঁ ধরে বলতে লাগল, এটা আপনারই চিঠি।
বাড়ি তো আগে থেকেই অবরোধ করে রেখেছিল। একপর্যায়ে বাইরে যাওয়া, চলাফেরা, খাবার-দাবার সবকিছু বন্ধ করে দিল। খুবই সংকটময় অবস্থা চলছিল তখন। বড় বড় সাহাবীও নিজ নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ ছিলেন। বাইরে বের হওয়ার মতো সাহস কারো ছিল না। সারা শহরজুড়েই উগ্রবাদীরা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। হযরত আলী রা. যখন দেখলেন তিনি হযরত উসমান রা.কে উদ্ধার করতে পারবেন না আর বিদ্রোহীরা তাকেও জড়াতে চাচ্ছে তখন দুই পুত্র হাসান ও হুসাইনকে উসমান রা.কে উদ্ধারের জন্য পাঠিয়ে তিনি মদীনা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন।
মোটকথা, মদীনা প্রায় শূন্য হয়ে গেল। উগ্রবাদীরা বাইশ দিন অবরুদ্ধ করে রাখার পর মূল ফটকে আগুন ধরিয়ে তা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে। আর কিছু লোক পার্শ্ববর্তী বাড়ি টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। উসমান রা. তখন কুরআন মজীদ পড়ছিলেন। উগ্রবাদীদের তলোয়ারের আঘাতে উসমান রা. লুটিয়ে পড়লেন। কুরআন মজীদের فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ আয়াতের উপর গিয়ে রক্তের ফোটা পড়ল। উসমান রা.-এর স্ত্রী নাইলা রা. বাঁচাতে গেলে তাঁর আঙ্গুল ও কব্জি কাটা গেল।
উসমান রা.কে হত্যা করার পর উগ্রবাদীরা তাঁর মস্তক কেটে নেয় এবং ঘরের সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।
ঘটনাটি ঘটে ১৮ যিলহজ¦, ৩৫ হিজরীতে। মূলত এই দিন থেকেই মুসলমানরা এতই বিভক্ত হয়ে পড়ে যে, আজ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এই দিনের আগ পর্যন্ত মুসলমানরা নিজেদের শাসক বা নেতার বিরোধিতা করাকে কুফরতুল্য মনে করত। কিন্তু আজকের পর থেকে এই ধারণা মন থেকে মুছে গেল। এক মুসলিমের তরবারির আঘাতে অন্য মুসলিম নিহত হতে লাগল। যে মুসলিম জাতি ছিল শৌর্য-বীর্যে পাহাড় সমান তারা আজ শতধা বিভক্ত হয়ে পড়ল।
উসমান রা. তাঁর শাসনকালের প্রথম দিকে হযরত ওমর রা.-এর শাসনব্যবস্থাই হুবহু বহাল রেখেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তাতে রদবদল দেখা দেয়। তাঁর যুগেই মুসলমানদের নৌবহর প্রস্তুত হয়। আমীরে মুআবিয়া রা. এ ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু হযরত ওমর রা. এর অনুমতি দেননি। হযরত উসমান রা.ও প্রথমদিকে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। কিন্তু অবশেষে যখন তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন যে, এটি ক্ষতিকর নয়; বরং উপকারীই হবে তখন তিনি এর অনুমতি দেন। আমীরে মুআবিয়া রা. অল্প দিনেই এক শক্তিশালী নৌবহর নির্মাণ করে ফেলেন এবং রোম সম্রাট কায়সারের নৌবহরকে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
(অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ)