অবক্ষয় : সুন্দরের অসুন্দর দিক
হারিছ তাবীল
কয়েকদিন ধরে পত্রপত্রিকায় সংবাদটি ঘুরে ফিরে আসছে। পিলে চমকে যাওয়ার মত শিরোনামে। কোন্ যুগে বাস করছি এমন প্রশ্নও চলে আসছে মাথায়। লাক্স-চ্যানেল আইয়ের উদ্যোগে শুরু হচ্ছে কথিত সুন্দরী প্রতিযোগিতা। তারা পত্রপত্রিকায় যে শিরোনামে এর বিজ্ঞাপন প্রচার করছে তাকে ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়।
‘দেখিয়ে দাও অদেখা তোমায়’ এমন শিরোনাম দেখলে ভদ্র ঘরের যে কোনো শালীন মানুষ আঁতকে উঠতে বাধ্য। এই শিরোনাম মোতাবেক একজন নারীর অদেখা কিছু থাকতে পারবে না, যা কিছু অজানা এবং যা কিছু অদেখা তা অবলীলায় প্রকাশ করতে না পারলে নারী-স্বাধীনতার সুফল থাকল কোথায়? তাই অজানা-অদেখা জিনিস প্রদর্শনের জন্য ২০০৭ থেকে শুরু হয়েছে তাদের এই আয়োজন।
চলতি বছর এই প্রতিযোগিতার ঘোষণা আসার পরে এখন পর্যন্ত তাদের প্রকাশিত তথ্য, তাদের ফেসবুক পেইজ এবং অন্যান্য সংবাদ মারফত জানা গেছে বিপুল পরিমাণ উঠতি তরুণী এতে নাম লেখাচ্ছে। এরা নিজেদের শারীরিক প্রদর্শনীতে প্রবল আগ্রহী। বোঝা যাচ্ছে, এইসব কোম্পানী চোখ বন্ধ করে এই কাজে নামেনি। তারা বা তাদের গডফাদাররা নাটক-সিনেমা, নাচ-গান ইত্যাদির মাধ্যমে আগে এমন একটা জাতিগোষ্ঠী তৈরি করেছে, যাদের কাছে নিজের শারীরিক প্রদর্শনী অতি স্বাভাবিক, এমনকি অতি কাক্সিক্ষত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সারাদিন টিভি-সিনেমা দেখতে দেখতে তাদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, তাদের ওই সুন্দর শরীরটার সার্থকতাই হচ্ছে জগতকে তা প্রদর্শন করার মাঝে; যেমনটা টিভি-সিনেমার লোকেরা করে থাকে।
আয়োজকদের ঘোষণা মোতাবেক যারা এতে শীর্ষস্থান লাভ করবে তাদেরকে নানা পুরস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন নাটক ও সিনেমায় সুযোগ করে দেয়া হবে। অবশ্য এর জন্য নাকি শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গসমূহের মাপজোখ পুরুষ বিচারকদের সামনে পেশ করতে হবে। এমনকি দিতে হবে কুমারিত্বের পরীক্ষা। তবুও এগুলোকে অংশগ্রহণকারীদের কাছে অশ্লীলতা মনে হয় না; কারণ টিভি-সিনেমায় তারা হরদম এসব দেখে অভ্যস্ত। এই ধরনের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে, প্রয়োজনে আরো অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও এই মেয়েরা শীর্ষস্থান অর্জন করতে চায়। বড় বড় বিজ্ঞাপনে কাজ করে অথবা এসব প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান লাভ করে কেউ যখন একটু ওপরে উঠে আসে তখনই তারা বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, আমলা ও হোমড়াচোমড়াদের ফোন পায়। আসতে থাকে নৈতিক-অনৈতিক বিভিন্ন প্রস্তাব। বিনিময়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ। গাড়ি-বাড়ি আর কথিত অভিজাত জীবনের মোহে পড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মেয়ে কোনো না কোনোভাবে এসবে জড়িয়ে যায়। আর এই অন্ধকার জগতটাই এমন, একবার ঢুকলে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
২০০৭ সালে লাক্সের এই প্রতিযোগিতায় যিনি প্রথম হয়েছিলেন সম্প্রতি তার একটি বক্তব্যে মিডিয়াপাড়ায় তোলপাড় চলছে। যেখানে তিনি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে এইসব প্রতিযোগিতার অনেক কদাকার দিক ফাঁস করে দিয়েছেন। শালীনতার স্বার্থে আমরা সেই প্রসঙ্গের অবতারণা থেকে বিরত থাকছি।
নারীবাদীদের দ্বিমুখী আচরণে আমাদের বিস্ময় জাগে। এইসব নোংরা প্রতিযোগিতায় মেয়েদের অপব্যবহারকে তাদের কাছে নারীর স্বাধীনতা ও স্বার্থবিরোধী মনে হয় না। তাদের হম্বিতম্বি ও বহুমুখী শ্লোগানকে আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়। তারা নারী স্বাধীনতার মূলা দেখিয়ে মেয়েদেরকে বাইরে নিয়ে আসলেন। এরপর সরাসরি ভোগ্যপণ্য বানিয়ে দিলেন। পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য নারীকেও তারা বিজ্ঞাপনের পণ্য বানিয়ে ছাড়লেন। সমাজে আজকে নারীর ব্যবহার যে পদ্ধতিতে হচ্ছে তাকে ভোগ ছাড়া অন্য কোনো শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না। যে পশ্চিমাদের প্ররোচনায় আমাদের নারীবাদীরা হৈ চৈ করেন তাদের নিজেদের দেশেই আজকে মায়ের জাতি নারী সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার। নারীকে তারা ভোগ করে অতপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মজার ব্যাপার হল ভোগ্যপণ্য হওয়ার মধ্যে নারীর স্বাধীনতা কীভাবে লুকায়িত আছে সেই ব্যাখ্যা তাদের কখনো করতে শোনা যায় না।
নারীর নিরাপত্তা যে বাইরে নয়, বরং নিজের ঘরে স্বামী-সন্তানের মাঝে- এ কথা আমাদের আধুনিকমনা মেয়েরা বোঝে না বা বুঝতে চেষ্টা করে না। তাদের মাথায় ভূত সওয়ার হয়ে গেছে, তাকে মিডিয়ায় ক্যারিয়ার গড়তে হবে, তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। মিডিয়াও তাকে পিঠ চাপড়ে দেয়। যে মেয়ে যত খোলামেলা হবে, মিডিয়া ততই তাকে সাহসী মেয়ে, সাহসী অভিনয় বলে তারিফ করবে। নিজের সমাজ ও পরিবারকে লাথি মেরে, নিজের ইজ্জত আব্রু বিসর্জন দিয়ে যে মেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, সাহসী খেতাব পেতে চায়, সেই মেয়েটি- জীবন, প্রতিষ্ঠা ও সাহসের অর্থ বোঝে কি না সন্দেহ।
একটা সময় ছিল যখন আমরা গর্ব করে বলতাম, ওড়না-ঘোমটা আমাদের সংস্কৃতি, পর্দা ঝুলানো পালকি আমাদের ঐতিহ্য। ছোটবেলায় দেখতাম শাড়ি বা চাদর দিয়ে রিকশার চারদিক পেঁচিয়ে নববধূরা বাপের বাড়ি যেত। সেই যুগ এখন যাদুঘরে চলে গেছে। তথাকথিত আধুনিকতা আর পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির সয়লাবে ভেসে যাচ্ছে আমাদের গৌরবান্বিত সংস্কৃতি। আজ মা-দাদীর বয়সী নারীদেরও আটোসাঁটো, বিশ্রী, অরুচিকর পোশাক দেখে রক্তক্ষরণ হয় হৃদয়ে। নিষেধও করা যায় না, তাতে নাকি ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়। আহ! আফসোস!!
বর্তমানে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা অন্যায় ও অশ্লীলতার ওপর নিজেদের ভিত্তি তৈরি করে নিয়েছে। পুরো সমাজব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া এর প্রতিকার মুশকিল। তবে বিপ্লব তো সময়সাপেক্ষ বিষয়। তার আগ পর্যন্ত কিছু করার নাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। বরং এই যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পঁচে যাচ্ছে তার একটা দায় আমাদের ওপরও বর্তায়।
প্রত্যেক এলাকায় গুণীজন-মুরুব্বীরা আছেন। সমাজের বখে যাওয়া যুবকদের প্রতি নজর রাখা এবং মেয়েদের বেপরোয়া চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে তারা নিজেদের দায়িত্ব মনে করেন না। শুধুমাত্র ক্ষমতা অর্জন এবং...। সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধতা আমাদের অভিভাবকদের। একটা সময় পর্যন্ত সন্তান তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, এরপর তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। জন্মের পর থেকে দীর্ঘ যে সময়টা সন্তান তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকে তখনই যদি সমকালীন সমস্যাগুলোর কথা মাথায় রেখে তাদের মনমানসিকতা সেভাবে গড়ে তোলা হয়, নৈতিক-অনৈতিক এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য ধরিয়ে দেয়া হয় তাহলে বড় হওয়ার পরে সন্তানের সে পথে অগ্রসর হওয়ার আশংকা কম। এই আশংকা সবচেয়ে কমে যাবে যদি সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই দ্বীন শিক্ষা দেয়া হয়। দ্বীনী ইলমের নূর তাকে ভবিষ্যৎ জীবনে লাইনচ্যুত হওয়া বা বিগড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের অভিভাবকেরা বিষয়টা নিয়ে কি এভাবে ভাবেন? দিনরাত পার্থিব ব্যস্ততার মধ্যে এসব নিয়ে ভাববার ফুরসত কি তাঁদের হবে?