শিক্ষা-দীক্ষা : মিছে ডক্টর!
গোলাম এলাহী
মিথ্যাবাদিতা এক চারিত্রিক বিকার। ভয়াবহ পাপ। শুধু পাপই নয়, একে বলা যায় অসংখ্য পাপের জনক। এক মিথ্যাবাদিতা থেকেই জন্ম নেয় নানা অনাচার। অতপর এর বিস্তার যখন ঘটে শিক্ষার অঙ্গনে ও শিক্ষক-সমাজে তখন তা শুধু ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, আরো অনেককে সংক্রমিত করে। যে শিক্ষক মিথ্যা ও দুর্নীতির আশ্রয় নেন জাতি তার কাছে কী আশা করতে পারে?
গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭-এর দৈনিক প্রথম আলোতে এই রকম একটি দুঃখজনক ঘটনার নজির দেখা গেল। সংবাদের হুবহু বক্তব্য এরকম-
‘তিনি এখনো পিএইচডির ছাত্র। পড়ছেন যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে শিক্ষার ঝুলিতে ডক্টরেট ডিগ্রিটা এখনো জমা না হলেও দিব্যি তিনি ‘ডক্টর’ উপাধি ব্যবহার করছেন। এই উপাধি নিয়ে তিনি একবার পদোন্নতি পেয়েছেন, আরেকবার নিয়োগে প্রধান্য পেয়েছেন। পিএইচডি শেষ না করেও এই অসদুপায় অবলম্বন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম্স বিভাগের শিক্ষক অনুপ কুমার সাহা।...
‘অনুপ কুমার সাহা অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ জমা দিয়েই পদোন্নতি ও নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।’
এরপর আছে প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানের বিবরণ। তাতে বলা হয়েছে, অনুপ কুমার ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান। ওয়েব সাইটে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজনেস স্কুলের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের পিএইচডি শিক্ষার্থীদের তালিকায় ১৫ নম্বরে তার নাম। ওয়েব সাইটের ‘দি অ্যাওয়ার্ড অব ডিগ্রি’ অংশটিতে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় উন্নীত হওয়ার পর একজন পিএইচডির ছাত্রকে তাঁর অভিসন্দর্ভের একটি ই-কপি ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। এরপর তিনি কনগ্রিগেশনে (সনদ প্রদানের অনুষ্ঠান) অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন। সেখানে আরো বলা হয়েছে, পিএইচডির সমস্ত পড়াশোনা এবং গবেষণা জমা দেওয়া হয়ে গেলেও কনগ্রিগেশন ছাড়া কোনো ছাত্র পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করতে পারবে না। এই কনগ্রিগেশন অনুষ্ঠান হয় বছরে দু’বার- ৮ জুন এবং ১৫ ডিসেম্বর।
জানতে চাইলে অনুপ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, গত জুন মাসে তিনি কনগ্রিগেশনে অংশ নিয়েছেন। সেখানে তাকে ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ দেওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটে তাকে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে দেখানো হচ্ছে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি দেখেছি, ওদের আপডেট দেওয়ার বিষয়ে মেইল দেব।’
তবে অনুপ কুমার সাহার এই দাবি সত্য নয়। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের ওয়েব সাইটের নিচে লেখা রয়েছে ওয়েবসাইটটি সর্বশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর তারা হালনাগাদ করেছে। (অথচ অনুপের দাবি ছিল, গত জুন মাসে তিনি কনগ্রিগেশনে অংশ নিয়েছেন।) তাছাড়া ওয়েবসাইটটি ঘেঁটে আরো দেখা যায়, অনুপ কুমার সাহা গত ৬ অক্টোবর ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তাঁর অভিসন্দর্ভের সারসংক্ষেপ আপলোড করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর কনগ্রিগেশনে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়া এখনো চলছে। অথচ অনুপ গত এপ্রিলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছেন ওই মাসেরই ২৩ তারিখ।...
রিপোর্টটিতে আরো বলা হয়েছে যে, (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের) প্রশাসনিক ভবনে অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষকদের ফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, অনুপ কুমার সাহা পিএইচডি ডিগ্রির কোনো সনদ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেননি। তিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোযুক্ত একটি ফটোকপি জমা দিয়েছেন, যেখানে লেখা রয়েছে, ‘এই প্রার্থী পরীক্ষকদের সন্তুষ্ট করেছেন। কনগ্রিগেশন নিশ্চিত করা হবে।’ এই কাগজের নিচে ৬ অক্টোবর তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে।
(দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শেষ পৃষ্ঠায়)
পত্রিকাটির বিবরণ যথার্থ হলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্তির বিষয়ে অনুপ কুমার সাহা প্রথম আলোকে যা বলেছেন তা অসত্য। অসত্যকথনকে শিক্ষার সাথে জড়িত ব্যক্তিরাও কোনো দোষ মনে করছেন না। মেধা-মননে অগ্রসর হয়েও নৈতিকতায় কেন এই দেশ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে তার কারণ এখান থেকে অনুমান করে নেয়া যায়। এখানে স্বভাবতই এই প্রশ্ন আসে যে, কোনটা কাম্য- নৈতিকতাহীন বিদ্যা, না নৈতিকতার আলোয় আলোকিত শিক্ষা। শিক্ষা-দীক্ষার বিপুল বিস্তৃত কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে যদি নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা না দেয়া যায় তাহলে এই কর্মযজ্ঞই যে সমাজের উঁচু স্তরে দুর্নীতির বিস্তার ঘটাবে- উপরের ঘটনাটি তার অসংখ্য দৃষ্টান্তের একটি।
এক্ষেত্রে আমাদের ফিরে যেতে হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা-দর্শনের দিকে। ইসলাম ঐ জ্ঞানকেই জ্ঞান বলে, যা মানুষকে সত্যনিষ্ঠ করে- বিশ্বাসে, কর্মে ও কথায়। সত্যনিষ্ঠাই হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য।
চিন্তা ও বিশ্বাসে কুসংস্কার পোষণ করে, কর্মে ও আচরণে অন্যায়-অনাচার ধারণ করে আর কথায় মিথ্যাচারী হয়ে কোনো ব্যক্তি কীভাবে জ্ঞানী ও শিক্ষিত হতে পারে? আসলে আল্লাহর ভয় ও তাঁর পরিচয় ছাড়া প্রকৃত জ্ঞানী ও শিক্ষিত হওয়া যায় না। আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আল্লাহভীতিই হচ্ছে ঐ জ্ঞানের উৎস, যা থেকে উৎসারিত হয় জ্ঞানের আলোকধারা, যে ধারায় ¯œাত হয় ব্যক্তির মন-মানস, স্বভাব-চরিত্র, আচরণ-উচ্চারণসহ সবকিছু। তখন শিক্ষা ও কর্মের যে অঙ্গনেই এই ব্যক্তি বিচরণ করুক নৈতিকতা ও সত্যনিষ্ঠার এক আলোকবলয় তাকে বেষ্টন করে রাখে।
কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ كُوْنُوْا مَعَ الصّٰدِقِیْنَ .
হে ঈমানদারেরা! আল্লাহকে ভয় কর আর সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গে থাক। -সূরা তাওবা (৯) : ১১৯
এই আয়াত আমাদের সত্যনিষ্ঠ হওয়ার এবং সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গে থাকার আদেশ করেছে। যা অর্জিত হতে পারে ঈমান ও তাকওয়ার দ্বারা।
কাজেই মিথ্যাচার ও দুর্নীতিবিরোধী সোচ্চার ভূমিকায় যদি আমরা সত্যনিষ্ঠ হই, তাহলে আমাদের কর্তব্য, ঈমান ও তাকওয়ার পথ অবলম্বন করা এবং তাকওয়া ও ঈমানের ধারাকে বেগবান করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করা। এর বিপরীত অবস্থান আমাদের শুধু সত্যের আলোক থেকেই দূরে সরিয়ে দিবে না, আমাদের সোচ্চার কণ্ঠকেও মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করবে।