আমার মুহসিন কিতাব-৫
মাওলানা সাঈদ আহমাদ আকবরাবাদী রাহ.
[কয়েক সংখ্যা ধরে শিক্ষার্থীর পাতায় বড়দের মুহসিন কিতাব বিষয়ে লেখা ছাপা হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় গত (রবিউস সানি ১৪৩৯ হি.) সংখ্যায় ছাপা হয়েছে হযরত মাওলানা ই‘যায আলী রাহ.-এর লেখা। কিন্তু ভুলবশত সেখানে নাম এসেছে সায়্যিদ তালহা হাসানী রাহ.-এর। মুহতারাম পাঠকবৃন্দের কাছে নিজ নিজ নুসখা সংশোধন করে নেয়ার অনুরোধ রইল। মূলত সায়্যিদ তালহা হাসানী রাহ.-এর লেখা ছাপা হয়েছে তার আগের (রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ হি.) সংখ্যায়। এই সংখ্যায় ছাপছে হযরত মাওলানা সাঈদ আহমাদ আকবরাবাদী রাহ.-এর লেখা।
একটি কথা, যা আমি আগেও বলেছি- মালুমাত হাসিল করার জন্য এইসব লেখা তো ঠিক আছে। কিন্তু আমল ও অনুসরণের জন্য কেবল কোথাও কারো কোনো লেখা পড়ে নেওয়াই যথেষ্ট নয়। সেজন্য জরুরি হল, নিজ উস্তাযের মশওয়ারা নেওয়া। তাছাড়া সব মুহসিন কিতাব সবার জন্য মুহসিন সাব্যস্ত হয় না। এমনিভাবে কোনো কিতাব এক বয়সে মুহসিন সাব্যস্ত হবে না বলে এটা জরুরি নয় যে, সেটি কখনোই তার জন্য মুহসিন হবে না। অতএব এটি পুরোই মশওয়ারা-নির্ভর একটি বিষয়।
আরেকটি বিষয় হল, আমাদের তালিবুল ইলম ভাইদের ইযাফী বা বাড়তি মুতালাআ সবসময়ই নিজেদের মাদরাসার উসূল-নেযাম অনুযায়ী হওয়া আবশ্যক। উসূল-নেযামের খেলাফ করা কখনোই উচিত নয়। প্রিয় তালিবুল ইলম ভাইদেরকে বিষয়দুটির প্রতি খুব যত্নের সাথে খেয়াল রাখতে হবে।
হযরত মাওলানা আকবরাবাদী রাহ.-এর এই লেখায় দেওয়ানে হাফিয থেকে ‘ফাল’ বের করার কথা এসেছে। এটি কেবল একটি ঘটনার বর্ণনা। অনুসরণযোগ্য কোনো বিষয় নয়। আসলে কোনো কিতাব থেকেই ‘ফাল’ বের করা ঠিক নয়। শরীয়তেও এটি গ্রহণযোগ্য কোনো বিষয় নয়। كان يعجبه الفأل الحسن এই কথার সঙ্গে এসব ‘ফাল’-এর কোনো সম্পর্ক নেই।
এই লেখায় কবি হাফিয সীরাজী রাহ.-এর ব্যাপারে লেখা হয়েছে, ‘একবার তো তিনি একেবারে পীর-মুর্শিদের মতো কাজ করেছেন।’ এটি একটি মাজায বা রূপক ব্যবহার, যা বর্জনীয়। বাস্তব কথা শুধু এতটুকুই ছিল যে, আল্লাহ তাআলা আকবরাবাদী ছাহেবকে দেওয়ানে হাফিযের ঐ কবিতাগুলো মনে করিয়ে দিয়েছেন এবং তার মাধ্যমে রাহনুমায়ী করেছেন। যদি তিনি হাফিযকে স্বপ্নে দেখে থাকেন কিংবা গায়ব থেকে কোনো আওয়ায শুনে থাকেন তাহলে সেটিও আল্লাহ তাআলার রহমত ও কুদরতেই হয়েছে। তাতে কবি হাফিযের কোনো দখল নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রতিটি বিষয় সঠিকভাবে বোঝার তাওফীক দান করুন। সবধরনের ভুল ভাবনা ও ভুল বুঝ থেকে হেফাযত করুন- আমীন। -মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]
[সংক্ষিপ্ত জীবনী
মাওলানা সাঈদ আহমাদ আকবরাবাদী রাহ.-এর পৈর্তৃক ভূমি মুরাদাবাদ জেলার ‘বিছরায়ূ’ অঞ্চলে। বাবা সরকারি চাকুরির সূত্রে আগ্রার আকবরাবাদে থাকতেন। ১৩২৬ হিজরী মোতাবেক ১৯০৮ ঈসাব্দে সেখানেই তাঁর জন্ম। সেজন্য তাঁকে আকবরাবাদী বলা হয়।
প্রাথমিক পড়াশোনা তিনি নিজ বাড়িতেই, গৃহশিক্ষকের কাছে সম্পন্ন করেন। এরপর ভর্তি হন দারুল উলূম দেওবন্দে। সেখান থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। এরপর বিভিন্ন কলেজ ও ইউনিভার্সিটি থেকে জেনারেল শিক্ষায় এমএ পাশ করেন।
পড়াশোনা সমাপ্ত করে প্রথমে ‘ডাভেল’-এ তিন বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে আরবীর শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে কলকাতা আলিয়ার অধ্যক্ষ হন। ১৯৫৯ সালে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির দ্বীনিয়াত শাখার প্রধান নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৩৮ সালে তিনি তাঁর মামাত ভাই মাওলানা হিফযুর রহমান সিওহারভী রাহ. ও মুফতী আতীকুর রহমান উসমানী রাহ.-এর সাথে দিল্লিতে ‘নদওয়াতুল মুসান্নিফীনে’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর তাঁরই তত্ত্বাবধানে সুবিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘বুরহান’ প্রকাশিত হয়। মৃত্যু পর্যন্ত মোট সাতচল্লিশ বছর তিনি এই পত্রিকার দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে ওহীয়ে ইলাহী, সিদ্দীকে আকবার, হযরত উসমান যিন্নুরাইন, ফাহমে কুরআন, গোলামানে ইসলাম, ইসলাম মেঁ গোলামী কি হাকীকত, মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী আওর উনকে নাকেদ ইত্যাদি।
১৪০৫ হিজরীর ৩০ রমযান/১৯৮৫ ঈসাব্দের ২৪ মে করাচিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।
করাচির দারুল উলূম কোরেঙ্গী কবরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। -ফয়সাল আহমাদ ভাটকালী]
আমার উর্দূ ও ফার্সী শিক্ষা এবং প্রাথমিক আরবী ও ইংরেজি শিক্ষা হয়েছে আগ্রাতেই। আমাদের বাড়িতে। আমার আব্বা আগ্রার স্বনামধন্য সরকারি ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন খুবই দ্বীনদার, বুযুর্গ। তিনি তালীমের চেয়ে তারবিয়াতকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন।
শুরুতে তিনি আমাকে আরবী পড়ানোর উদ্দেশ্যে দেওবন্দ থেকে যথাযোগ্য সম্মানী নির্ধারণ করে একজন মাওলানা সাহেবকে এনেছিলেন। যিনি সারাক্ষণ আমাকে তাঁর সঙ্গে রাখতেন। পড়ালেখা ছাড়াও তিনি বুযুর্গানে দ্বীনের ঘটনাবলী এবং ইসলামী ইতিহাসের মর্মস্পর্শী গল্পগুলো শোনাতেন। সন্ধ্যাবেলা একজন শিক্ষক আসতেন ইংরেজি-অংক শেখাতে। এই ধারা অব্যাহত ছিল তিন বছর। এরমধ্যে অনেক বিষয়ে অগ্রগতি হলেও বিশেষভাবে কোনো ইলমী বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়নি।
১৯২২ সালে আমার বয়স যখন পনের তখন বিভিন্নজনের উপর্যুপরি অনুরোধে আব্বাজান আমাকে দেওবন্দে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানে দরসী কিতাবাদি তো পড়তামই, এর পাশাপাশি কীভাবে যেন আরবী সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হতে লাগল। ফলে অতিরিক্ত সময়ে মিসরের বিভিন্ন পত্রিকা, পুস্তিকা এবং আরবী সাহিত্যের নতুন পুরনো কিতাবাদি খুব বেশি পড়তাম। আব্বা আমার মাসিক হাত খরচের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ পাঠাতেন। সেজন্য আমার এইসব বই-পুস্তক সংগ্রহ করতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি। সে সময়ই মুবাররাদের ‘কামেল’, ‘আগানী’, ‘নিহায়াতুল আরাব’, ‘সুবহুল আ‘শা’ ইত্যাদি কিতাবগুলো মুতালাআ করেছি।
জাহেযের ‘আলবায়ান ওয়াত তাবয়ীন’ কিতাবটি আমাকে এমনভাবে যাদুগ্রস্ত করেছে যে, তার একেকটি অনুচ্ছেদ বারবার পড়েছি। প্রতিবারই নতুন অনুভব অনুভূতি লাভ করেছি। ‘দেওয়ানুল হামাসা’র প্রতিও আমার তীব্র আকর্ষণ ছিল। তার অসংখ্য কবিতা আমার মুখস্থ-ঠোঁটস্থ ছিল।
দরসী কিতাবের মধ্যে মানতেক, ফালসাফা, ফিকহ, তাফসীর, হাইআত, তারীখ, মাআনী-বায়ান-আরূয ইত্যাদি সব শাস্ত্রের কিতাবাদিই পড়েছি। তবে সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে মাআনী ও বায়ান শাস্ত্রে সময় ব্যয় হত অনেক বেশি, যা অন্য কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে হত না।
মানতেক ও ফালসাফার দরসে অনেক কষ্টে মনোযোগ ধরে রাখতাম। কিন্তু যখন ইমাম গাযালী রাহ.-এর ‘মাকাসিদুল ফালাসিফা’ এবং ‘তাহাফুতুল ফালাসিফা’ মুতালাআ করলাম তখন ফালসাফাতেও মজা পেয়ে গেলাম। এমনকি একসময় এই শাস্ত্রের প্রতি এত আগ্রহ হল যে, ইবনে সীনার ‘ইশারাত’ কিতাবটি ইমাম রাযী রাহ. ও নাসীরুদ্দীন তূসীর ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোর সহায়তা নিয়ে বুঝতে শুরু করলাম। এভাবে কিতাবটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই পড়লাম।
আরবী কবিতায় দরসী কিতাবাদির বাইরে আবুল আলা মাআররীর ‘সাকতুয যানদ’ এবং ‘লুযূমু মা লা ইয়ালযাম’ এবং ‘দেওয়ানে হাসসান বিন সাবিত’-এর খুব আশেক ছিলাম। অধিকাংশ সময় কিতাবগুলো আমার সঙ্গে থাকত। কিন্তু আমার এই ইশক ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।
তখন উর্দূ সাহিত্যেরও বিভিন্ন পুস্তিকা ও উপন্যাস পড়তাম। মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ‘আলহেলাল’ও কয়েক খ- পড়েছি। তাঁর রচিত ‘তাযকেরা’ ও ‘মাসআলায়ে খেলাফত’ও পড়েছি। এগুলোর অনেক লেখা বারবার পড়েছি। এই ধারাও বেশিদিন চলেনি। দুয়েক বছরের মধ্যে কেটে গেছে।
পরে একসময় কিছুটা ইলমী মেযাজ তৈরি হল। সেক্ষেত্রে মাওলানা শিবলী নোমানী ও সায়্যিদ সুলাইমান নদভীর অবদানই বেশি। মাওলানা শিবলী নোমানীর রচনাবলির মধ্যে সম্ভবত প্রথম পড়েছি ‘আলমামুন’ ও ‘আলগাযালী’। তাঁর রচনাশৈলী, উপস্থাপন কৌশল ও বিশ্লেষণধারা একেবারে হৃদয়ের গভীরে রেখাপাত করত। ফলে তাঁর লেখার এমনই ভক্ত হয়ে গেলাম যে, তাঁর সকল কিতাব সংগ্রহ করে করে পড়ে ফেললাম। ‘আলফারূক’ ও ‘সীরাতুন্নবী’ কয়েকবার পড়লাম। এই দুই কিতাবের ভূমিকা কতবার পড়েছি হিসেব নেই।
সেসময় সায়্যিদ সুলাইমান নদভীর ‘আরদুল কুরআন’-এর উভয় খ-, ‘সীরাতে আয়েশা’, ‘ইমাম মালেক’ ইত্যাদি মুতালাআ করলাম। এতে লেখকের অধ্যাবসায় ও মেহনত, সংকলন ও বিন্যাস এবং এসব ক্ষেত্রে তাঁর সুনিপুণ দক্ষতা ও মুগ্ধকর উপস্থাপনা হৃদয়ের গভীরে রেখাপাত করল। সেজন্য তাঁর সম্পাদিত মাসিক ‘মাআরিফ’-এর গ্রাহক হয়ে গেলাম। তখন থেকে কেবল সাহিত্যের বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিনের পরিবর্তে ইলমী ও গবেষণাধর্মী পুস্তক পত্রিকা পড়তে শুরু করলাম। ‘মাআরিফ’ নিজেই সংগ্রহ করতাম। এছাড়াও ‘জামিয়া’, ‘উর্দূ’, ‘যামানা’ ইত্যাদি ম্যাগাজিন অন্যদের থেকে নিয়ে পড়তাম। তখন কেবল সাহিত্য, শব্দ, বাক্য, বাকপটুতা ইত্যাদির পরিবর্তে গবেষণাধর্মী ইলমী বিষয় খুঁজে খুঁজে পড়তাম। অবশ্য মাআরিফ-এর সব লেখা তখন বুঝতাম না। তবে বিশ্বাস করতাম, লেখাটি যেহেতু মাআরিফে ছাপা হয়েছে নিঃসন্দেহে এটি উন্নত ও মানসম্মত। ভাবতাম, লেখক অনেক কষ্ট মেহনত করে এই লেখা তৈরি করেছেন। এজন্য না বুঝলেও আমার কাছে তার মূল্য ছিল অনেক। মাআরিফের প্রতিটি সংখ্যা হেফাযত করে রাখতাম। বছর শেষে বাঁধাই করে নিতাম।
১৯২৬ সালে দাওরায়ে হাদীসের বছর হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.-এর কাছে সহীহ বুখারী ও সুনানে তিরমিযী পড়ার সৌভাগ্য হল। শাহ ছাহেবের দরস যে কেমন ছিল! উলূম ও ফুনূনের যেন উচ্ছ্বসিত ঝর্ণা। দরসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ অবস্থা। প্রতিদিন দরসে বহু কিতাবের পরিচিতি, মুসান্নিফ ও ইমামদের জীবনী, তাঁদের ইলমী আমলী অবস্থা, তাঁদের ইজতিহাদ ও ইজতিহাদের কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করতেন। বিশেষ করে আল্লামা ইবনুল জাওযী, হাফেয ইবনে তাইমিয়া, হাফেয ইবনুল কায়্যিম, হাফেয ইবনে হাজার -রাহিমাহুমুল্লাহ- প্রমুখদের আলোচনা হত খুব বেশি। শাহ ছাহেবের সেসব তাকরীরের মাধ্যমেই হাফেয ইবনে তাইমিয়া ও হাফেয ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর কিতাবাদির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তখন এই দুইজনের অনেক কিতাব মুতালাআ করি। অবশ্য তাদের সব কথা বুঝতে পারিনি। কিছু বুঝে কিছু না বুঝে, এভাবেই পড়েছি।
মাওলানা শিবলী নোমানী রাহ.-এর রচনাবলী আমার মাঝে যে ইলমী মেযাজ তৈরি করেছে শাহ ছাহেব রাহ.-এর দরস তাকে আরো পোক্ত করেছে। দরসের বাইরেও আমি শাহ ছাহেবের বিভিন্ন মজলিশে বসতাম। তাঁর সাধারণ ইলমী আলোচনাও দরসের চেয়ে কোনোদিক থেকে কম হত না। আল্লাহর মেহেরবানীতে তা থেকে অনেক উপকৃত হয়েছি।
শুরুতেই বলেছি, আব্বাজান আমার জন্য আরবী ইংরেজি দু’ধারার পড়াশোনাই একসাথে পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু দেওবন্দে গিয়ে ইংরেজি পড়া বন্ধ হয়ে গেল। তাই ফারেগ হওয়ার পর মনে হল, ইংরেজি পড়াও একটা পর্যায় পর্যন্ত সমাপ্ত করি। কিছু পরীক্ষা দিলাম প্রাইভেটভাবে, কিছু কলেজ থেকে। সবগুলোতেই দ্বিতীয় স্তরে পাশ করলাম। কেবল শেষমেশ এমএ তে প্রথম স্তর লাভ করলাম। বিএ ক্লাশে আমাদের শিক্ষক ছিলেন আগ্রা ইউনিভার্সিটির একজন বাঙালী প্রফেসর। তিনি ইংরেজি ভাষার বড় সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি আমার মাঝে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে দিলেন। তখন এবিষয়েও অনেকগুলো বই পড়ি। ব্রক-এর ফ্রান্স বিপ্লব, ম্যাকেল-এর বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং হিন্দুস্তানের ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই পড়ি। সেইসঙ্গে আমীর আলীর ‘দ্যা স্প্রিট অফ ইসলাম’ কয়েকবার মুতালাআ করি। আজ পর্যন্ত মনে হয় হৃদয়ের আয়নায় সেই দৃশ্যগুলো ভাসছে।
আমার ফারসি মুতালাআ কয়েকটি দেওয়ান (কবিতার বই) আর কয়েকটি ইতিহাসের বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেওয়ানগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরাকী, খসরূ, নেযামী, জামী, নযীরী, উরফী, খাকানী প্রমুখদের দেওয়ান। এদের সবার দেওয়ান পড়েছি। কিন্তু দেওয়ানে হাফিয ও দেওয়ানে গালিব আমাকে সবচে বেশি মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে দেওয়ানে হাফিয তো আমার একাকিত্বের সঙ্গী, দুঃখ-পেরেশানীর সান্ত¡না। আমি অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছি, যখন কোনো কারণে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি তখন দেওয়ানে হাফিয থেকে দুয়েকটি গযল পড়তেই মন হালকা হয়ে যায়। মনে হয় যেন কোনো দুঃখই ছিল না।
একবার তো তিনি একেবারে পীর-মুর্শিদের মতো কাজ করেছেন। আল্লাহ তাআলা যেহেতু বান্দার দোষ লুকিয়ে রাখেন, তাই সবকিছু বিস্তারিত বলা ঠিক হবে না। মূল বিষয় হল, একবার আমি এক কঠিন ফেতনার মধ্যে পড়ে গেলাম। তখন তিনি তাঁর এক কবিতার মাধ্যমে যেন আমাকে দিক নির্দেশ করলেন। অন্যথা আমি হয়ত গোনাহেই লিপ্ত হয়ে যেতাম। সেইসঙ্গে জান মালেরও বিরাট ক্ষতি হত। তাঁর এই ইহসান আমার কাছে এত বড় মনে হয়েছে যে, কখনো তাঁর এই ঋণ থেকে বোধহয় মুক্ত হতে পারব না। এজন্যই তাঁর দেওয়ানকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। কয়েকবার তো এই দেওয়ান থেকে ‘ফাল’ নির্ধারণ করেছি এবং সেগুলো বাস্তবসম্মতও হয়েছে।
জীবনে যা কিছু লিখেছি, পড়েছি এবং এখনো যা কিছু লিখছি পড়ছি- আমার কাছে মনে হয় তার সবই আব্বাজান রাহ.-এর নেক আমল ও নেক নিয়তের বরকত, আম্মাজানের দুআর ফসল। আব্বাজান তো এমন পরিবেশে থাকতেন, যাদের সবাই আরবী পড়াকে ঘৃণা করে। এরপরও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমাকে আরবী পড়িয়েছেন। এক্ষেত্রে খরচও এত পরিমাণ করেছেন, যেমন কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি তার সন্তানের পেছনে ইংরেজি পড়ার জন্য খরচ করে।
আর আম্মা আমার ইলম ও আমলের তারাক্কির জন্য তাহাজ্জুদের সময় কেঁদে কেঁদে কত দুআ করেছেন। কখনো তিনি চাননি আমার দুনিয়াবী মান-সম্মান ও উঁচু পদমর্যাদা হোক।
আল্লাহ তাআলা তাঁদের দুজনকেই দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন এবং আমাকে তাঁদের তামান্না মুতাবেক উত্তম থেকে উত্তম আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
ভাষান্তর : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব