জুমাদাল উলা ১৪৩৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আমেরিকার সমাজে মুসলমান

মুহাম্মাদ আদম আলী

জীবনের সব প্রথমই মানুষ মনে রাখে। স্বাদ-বিস্বাদ যা-ই হোক। প্রথম বিস্বাদ যত তীব্র হয়, স্বাদ তত মজার হয় না। এজন্য বার বার ফিরে পেতে চায়। পায়ও। সারাজীবনেও আর সেই প্রথমকে ভুলতে পারে না। পঞ্চমবার আমেরিকায় এসে প্রথমবারের কথাই বেশি মনে পড়ছে। সেইবার ডালাসে যে ধর্মীয় পরিবেশ ছিল, এটা এবার তেমন নেই। ডালাসের রিচারডসনে উঠেছি আমি। অনেক বাঙালী পরিবার বসত গেড়েছে এখানে। অনেকে দেশে সব বিক্রি করে দিয়ে আমেরিকান হয়ে গেছে। কেউ কেউ বাড়ি-গাড়ি করেছে। আবার কারো ভাড়া বাড়িতেই কাটছে জীবন। বাস-ট্রেনে যাতায়াত। বুয়েটের অনেক ইঞ্জিনিয়ার আছেন। তাদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। চাকরি না থাকলে তাদের অবস্থাও কাহিল হয়ে যায়। বউ ছাড়া থাকতে পারলেও এদেশে চাকরি ছাড়া থাকা যায় না। আবার চাকরি খুব ভালো হলে বউ হারানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সম্পদ বেড়ে গেলে ডিভোর্স হয়ে গেলে স্ত্রী অর্ধেক পায়। এই লোভে অনেকে ডিভোর্স নেয়। সেলিব্রেটিদের মধ্যে এটা বেশি হলেও এখন আমজনতাও এর স্বাদ নিতে শুরু করেছে। মুসলমানরাও বাদ পড়ছে না। আমাদের কাছে সবই সমস্যা লাগে। তাদের কাছে সব এক। বেঁচে থাকলেও যা, মরে গেলেও একইরকম। মুসলমানরা কালচারে এক হতে হতে এখন সমবিশ্বাসেও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথম জেনারেশন সারেন্ডার না করলেও থার্ড জেনারেশন নাগালে পাওয়া মুশকিল। তবে ব্যতিক্রমও আছে। বিভিন্ন দেশের মানুষ আসে আমেরিকায়। মুসলমানরাও আসে। অনেকে পরিবার নিয়ে আসে। অন্যরা যা ইচ্ছা করে। মুসলমানরা তা করতে পারে না। কিন্তু শুরুটা প্রায় সবার একইরকম। প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ধাক্কা সামলাতে হয়। আর এজন্য প্রয়োজনে সব কিছুই জায়েয মনে হয়। এ তালিকা অনেক বড়। তবে মুসলমানদের ভয়ানক কিছু করতে হয়। তাদের দ্বীনদারীতে কম্প্রোমাইজের চাপ বাড়ে। অনেকে দেশে থাকতে হয়ত নামায পড়তেন না। এখানে এসে আরো উদাসীন হন। আর যারা নামায পড়তেন, তাদের অনেকেই ছাড় দেন। এই কদিন পরেই সাচ্চা নামাযী হয়ে যাব! তাদের ‘ক’দিন’ আর শেষ হয় না। একসময় হয়ত নামায পড়েন, তখন বেলা পড়ে যায়। অবেলার দ্বীনদারিতে পরবর্তী জেনারেশন টেকানো যায় না। সব স্যাটেল হয়ে গেলেও ইসলামের মূল্যবোধ ঠিক থাকে না। মুখ থুবড়ে পড়ে। ।

২। আমেরিকায় অনেকগুলো স্টেট; পঞ্চাশটি। এর মধ্যে নিউইয়র্ক ব্যতিক্রম। মুসলমানদের সংখ্যা, মসজিদ-মাদরাসা বেশি। উলামায়ে কেরামও অনেক। অন্য শহরগুলোতে এরকম নেই। এদেশ অনেক বড় দেশ। শুধু নিউইয়র্ক শহর দেখলে দেশ বোঝা যায় না। শহর থেকে বের হয়ে কোনো হাইওয়েতে উঠলেই চোখে পড়ে। কত যে প্রান্তর খালি পড়ে আছে, হিসেব নেই। অন্যান্য স্টেটে আরো বেশি। প্রকৃতির বিশালতায় মানুষের মনও বিশাল হওয়ার কথা। মন তো এক অনন্য সৃষ্টি। এটা বিশাল হওয়ার জন্য জায়গা লাগে না। দ্বীনের সঠিক বুঝ লাগে। এখানে কেন যেন সেটা উবে যায়! মুসলমানরা অনেকেই হালাল-হারাম বেছে চলে। অনেকে পারে না। আমার এলাকার পরিচিত একজন মদ খান না। কিন্তু মদের ভালো ককটেল বানাতে পারেন। তিনি যে হোটেলে কাজ করেন, এজন্য তার অনেক সুনাম। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ছেলেদের এদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা পড়ালেখা করে বড় চাকরি করছে। বাবা খুব খুশি। তারপর? হঠাৎ এক ছেলে খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল। আরো দুই ছেলের অবস্থাও বলার মতো না। অনেক মুসলমান ঘরেই এই এক নতুন সমস্যা। ছেলে তো ইসলামেই থাকছে না! খুব বেশি তাবলীগে সময় দেন যারা, অথবা সন্তানদের মাদরাসায় পড়ান, তারা ছাড়া বাকিদের অবস্থা একইরকম। কী রকম? তারা ছেলেদের একটু কুরআন পড়িয়ে দিতে পারলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন। আর মাঝে মাঝে যদি মসজিদে নিতে পারেন, তাহলে তো ছেলের মুসলমানিত্ব নিশ্চিত। এভাবে হয় না কিছুই। বেশিরভাগই বাবা-মাকে খুশি করার জন্য এসব করে। বয়স আঠারো হয়ে গেলেই ছেলে আসল আমেরিকান হয়ে ওঠে। তখন বাবা-মা’দের আর কিছু করার থাকে না। ছেলের বিয়ের বয়স হয়ে গেলেও জোর করতে পারে না। ছেলের ইচ্ছের কাছে নত হয়ে থাকতে হয়। সমাজ তো এখানে সামাজিক না। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কেউ কিছু মনে করে না। যারা দ্বীনদারি রক্ষা করে চলার খুব চেষ্টা করেন, তারা নিজেরা নামায-কালাম পড়েন। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কিছু কসরত করেন। কিন্তু তালীম দেন না। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আর কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া ইসলামের আর কিছু শেখে না। রাসূলের নাম বলতে পারলেও সাহাবী কী জিনিস- জানে না। ইসলামের নিজস্ব কালচার আছে, এ বোধ উন্মেষের কোনো সুযোগই পায় না। তারা আমেরিকান কালচার নিয়ে পড়ে থাকে। ঘরে-বাইরে। খুব সহজেই দ্বীনদারী বিদায় নেয়। এটা হলো সেকেন্ড জেনারেশন। এরা নিজেরা যা শিখেছে, তা প্রাক্টিস করে না। থার্ড জেনারেশন আসতে আসতে সব ভুলে বসে। একদিন মুসলমান ছিল, এ বোধও আর কাজ করে না। আর খ্রিস্টান বিয়ে করলে তো আমেরিকা জিন্দাবাদ! ।

৩। বাইরে আজ আইস কুল ঠাণ্ডা। হাত-পা জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবু মানুষগুলো জমে যায় না। মুখে ঘন হাওয়া ছাড়তে ছাড়তে দিব্বি বেঁচে থাকে। কাজে যায়। ফিরে আসে। ঘরেই কাটে বেশিরভাগ সময়। ঘরে হট এয়ার সিস্টেম আছে। অনবরত হিটার চলছে। হিটারে শরীর গরম হয়। আত্মার শান্তি মেলে না। শান্তি দেওয়ার মানুষটা নেই। শূন্য ঘর। সেলফোন আর টিভি ছাড়া সঙ্গী কেউ নেই। অনেকের কুকুর থাকে। একটা, দুইটা। বিড়ালও থাকে। সবার থাকে না। বড় নিঃসঙ্গ জীবন। এদেশে এরকম জীবন যে কত, পরিসংখ্যান জানা নেই। মুসলমানও দিন দিন এ সংখ্যা বাড়াচ্ছে। ফজরের পরে স্টারবাকসের কফি খাচ্ছি। ভোর পাঁচটায় এ দোকানটা খোলে। সূর্য ওঠে আরো পরে- সকাল সোয়া সাতটায়। মানুষ এখানে রোবটের মতো কাজে লেগে যায়। এই একটা জায়গায় কোনো তাড়া দিতে হয় না। ডলার তাকে মেশিন বানিয়ে ফেলে। উপায়ও নেই। কফি খেতে খেতে আমার ভাই গল্প করছেন। এদেশের মানুষের গল্প। কঠিন সব গল্প। শুনলে গা শিউরে ওঠে। এক ভদ্রলোক দেশ থেকে কেবল বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছেন। নিজে অড জব করে বউকে ডাক্তার বানালেন। পাশ করেই বউ তাকে ফেলে চলে গেল। কোথায় বউয়ের কামাইতে আলীশান জীবন কাটাবে, এখন বউই নাই। অবশ্য বউয়ের কামাইয়ের দিকে এদেশে চেয়ে থাকার সুযোগ নেই। শেয়ারে হয়ত একটু ভালো বাসায় থাকা যেত, এই যা। এখানে বউ-ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে মানুষের আশাও কমে যায়। ভালো বাসায় থাকতে পারলেও ভালোবাসা হয় না। মহব্বতকে ওরা বলে ফিলিংস। এই ফিলিংস বুঝতে আমার সময় লেগেছে। ঐর উধফ! বলা তাদের ফিলিংসের প্রকাশ। তা-ও বছরে একবার! আরেকদিন এক বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। সঙ্গে আমার ভাই। ভদ্রলোক এসে আমাদের খুব আন্তরিকভাবে এক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেন। তার স্ত্রী নার্সিং কোর্সে কোয়ালিফাই করেছে। এজন্য গ্রাজুয়েশন পার্টি হবে। সেখানে যেতে বললেন। লোকটার খুশি দেখে আমি অবাক। শেষ পর্যন্ত স্ত্রী থাকবে তো! সেকেন্ড জেনারেশনেও বউ থাকছে না। বাবা-মা সত্তর থেকে আশি হাজার ডলার খরচ করে ওয়েডিং পার্টি করছে। এক বছরের মাথায় বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। হু কেয়ারস! দুজনই উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকুরী করে। সামান্য ইস্যুতেই ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে। তখন এসব ভাঙা মন কী করে? সে বিষয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ভুক্তভোগীরা জানে। অন্যের জানার সুযোগ হয় না। এদেশে একার কামাইতে সংসার চলে না। স্ত্রীকেও কাজ করতে হয়। সেটা আরেক জীবন। অফিস ডিউটি খুব কম পরিবারই করে। বেশিরভাগ অড জব। তাতে টাইমিং ঠিক থাকে না। একজন যদি বিকেলে ঘরে ঢোকে, আরেকজন রাত বারোটায়। ভালোবাসা তখন টায়ার্ড হয়ে যায়। ডলার গুনেই পার করতে হয় পারিবারিক জীবন। মরে গেলেও এদেশে শান্তি নেই। কাফন-দাফনে প্রায় দশ হাজার ডলার লাগে। আসল ভালোবাসা তখনো ডলারের চিন্তা থেকে মুক্তি পায় না। আমেরিকার ঘোর কাটলেও ফেরার উপায় নেই। ।

৪। খুব ভালো থাকতে মন চায়। খুব ভালো হতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছেটাই পাল্টে গেছে। মরা গাছে ফুল ফোটে না। এমনিতে ফুল ভালো লাগে। গাছের পরিচর্যা করতে ইচ্ছে করে না। এখানে গাছ কি ছিল নাকি! একদিন হয়ত ছিল। সে গাছ মরে গেছে। এখন ঝরা পাতায় উঠোন ভর্তি। সেখানে ফুলের টবে প্লাস্টিকের ফুল ফোঁটে। শিশিরে সিক্ত হয়। আহ! কী সুন্দর! এ সৌন্দর্যে মুসলমানরা দিশেহারা। একবার দিশা হারালে হুঁশ ফেরানোর কেউ নেই। বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কেউ সহজে প্রবেশ করে না। বসবাসের জন্য একটা বাড়ি এদেশে খুব জরুরি। আর চলাফেরার জন্য একটা গাড়ি। হোটেল বয় হিসেবে কাজ করলেও এগুলো পেতে অসুবিধা হয় না। বাড়ি-গাড়ি রেডিই আছে। একটু কষ্ট করে কেবল সাহস করতে হয়। মনে সাহস না থাকলেও পরিবেশ সাহসী করে তোলে। গাড়ির দোকানে পয়সা ছাড়া গেলেও একটা কিনে ফেরা যায়। বাড়ির জন্য একটু ঝামেলা সইতে হয়। ইনকামের উপর বাড়ির কোয়ালিটি ডিপেন্ড করে। সবই মেলে মরগেজের উপর। বিশ্বাসে কমতি নেই এদের। সোস্যাল কার্ড থাকলেই আর কিছু চাইবে না। হাউজ লোন দিয়ে দেবে। মরে গেলেও অনেকের এ লোন শোধ হবে না। অসুবিধা নেই। মরে যান। ব্যাংক তার হিস্যা বুঝে নিবে ঠিকই। আমেরিকার ইকোনমি সিস্টেম খুব কঠিন। সমাজের কণায় কণায় সুদের চাকা ঘুরছে। দ্বীনদাররা বেঁচে থাকতে চায় না যে এমন না। পারে না। ঘণ্টায় দশ ডলারে কাজ করে সুদের চাকায় তেল না দিয়ে উপায় থাকে না। খুব ভালো বেতনে যারা প্রফেশনাল জব করেন, তারা চাইলে কিছু পারেন। নগদ টাকায় বাড়ি-গাড়ি করেন। এ দলে লাখে এক মিললেও বেশি। শীতের কষ্টে হাত পকেটে পুরে রাখতে হয়। আর সুদের ঘোরে চোখ-কান খোলা রাখা যায় না। জিবটাকে সচল রাখলেই চলে। বাড়ি-গাড়ি করে অনেকে বিয়ে করে। এদেশে মানুষ অন্যের খবর রাখে না। তবে বিয়ে-শাদীর খবর ঠিকই রাখে। দাওয়াত দিলে ছুটে আসে। নিজেকে চেনানোর এই সুযোগ হাতছাড়া করে না কেউ। বিশাল করে ওয়েডিং পার্টির আয়োজন করে। হাজার হাজার ডলার লোন করে। ক্রেডিট কার্ডে সুদের ধাক্কা লাগে। অন্তরে লাগে না। মেহমানদের হাসি-তামাশায় অন্তর ফুলে ওঠে। আগুনের পর আগুন জ্বলে। আগুন ছাড়ে না কাউকেই। দেখা যায়, লোন শোধ না হতেই বিয়ে ভেঙে যায়। বউ নাই। বিয়ের লোন টানতে হচ্ছে। তারা অবশ্য আবার বিয়ে করে। তবে প্রথমবারের মতো তামাশা আর করতে পারে না। সুদের আগুন দেখা যায় না। পুড়ে সব ছাড়খাড় করলেও দেখা যায় না। এজন্য শিক্ষাও নেয় না কেউ। ।

৫। সিস্টেম ওয়ার্কস। এটা দেখার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো ভালো জায়গা। আমেরিকাও এর মধ্যে অন্যতম। মানুষ এই একটি কারণে এখান থেকে যেতে চায় না। সুবিধা অসুবিধা বোঝে না। জাগতিক সুবিধা জীবনের জন্য জরুরি। জীবন যদি এখানেই শেষ হয়ে যেত, তাহলে বেশ মজা হত। এই মজায় যারা মজে যায়, তাদের জন্য নগদ সুবিধাই আসল। মরার পর যে জীবন আছে, সে জীবনের সুবিধা-অসুবিধা তাদের ভাবায় না। এদেশে লাল বাতি জ্বললে গাড়ি থামে। পুলিশ না থাকলেও থামে। আবার কোথাও বাতি নেই। কেবল লেখা আছে, স্টপ। সেখানেও গাড়ি থামে। আশেপাশে তাকায়। শূন্য প্রান্তর হলেও গাড়ি চালিয়ে দেয় না। হয়ত কোনো মানুষ রাস্তা পার হবে। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করে। এমন দৃশ্য অবাক না করে পারে না। বাস-ট্রেনে লাইন ভাংগে না কেউ। ধাক্কা-ধাক্কি নেই। এটুকু শান্তি মানুষ চায়। এ শান্তির এখানে কোনো অভাব নেই। এরকম কিছু আমাদের দেশে ভাবা যায় না। এ মুহূর্তে কল্পনাও করা যাচ্ছে না। রাস্তায় চলার এই এক সুবিধা জীবনের দর্শনকেই পাল্টে দেয়। সে আর দেশে ফিরে যেতে চায় না। সরকারী কোনো সুবিধা নিতে এদেশে কোনো ঘুষ দিতে হয় না। সিস্টেম ওয়ার্কস। লাইন লম্বা হলেও ভাগেরটা ঠিকই মেলে। ব্যাংক? গাড়ি থেকেও নামতে হয় না। সীটে বসেই সেরে নেয়া যায় টাকা জমা ও তোলার কাজ। এখানকার দোকানপাট আরেক জগৎ। জিনিস কিনে বাড়ি গেলেন। দ্রব্যটা পছন্দ হচ্ছে না। ফিরিয়ে দিন। চাইলে টাকাও ফেরত পাবেন। আপনাকে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। এমন দেশ কে ছাড়তে চাইবে? মুসলমানদের অনেক আখলাক তারা নিয়েছে। আমল করছে। ফল পাচ্ছে। আমরা তাদের বাহবা দেই। মনে করতে শুরু করি- তাদের কাছ থেকেই মানবিকতা শিখতে হবে। সবচেয়ে বড় অমানবিকতা- ¯স্রষ্টাকে না মানা। আবার এটা যারা মানে, তারা এদেশে থেকে মুত্তাকী হতে পারতেন। সেখানেও সিস্টেম কাজ করে। তাকে আমেরিকান বানায়, মুত্তাকী হতে দেয় না। ।

৬। ঘরের মানুষ ঘরে থাকতে চায় না। সবাই বাইরে বেরোতে চায়। বাইরের জগৎ দেখতে চায়। দু পা ফেলে গাছের পাতায় শিশির দেখার আশা লুকাতে পারে না। শীতের সকালে দেখে। গ্রীষ্মেও। বেলায়-অবেলায় সবসময় কি পাতায় শিশির থাকে? মানতে চায় না। ওখানে এখন শিশির নেই। যেয়ো না। ঠেকানো যায় না। সে নিজে পরখ করতে চায়। না থাকলেও সে যাবেই। আকাশে মেঘ গর্জন করছে। গর্জন কানে লাগে না। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে বাড়ি ফেরে। ফিরতেই হয়। না ফেরার দেশে পাড়ি দেওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে যাওয়া-আসার মধ্যেই সে থাকে। নারী-পুরুষ সবাই। ছেলে-মেয়েরাও। আঠারোর পরে আর কাউকেই এখন ঘরে রাখা যায় না। সবাই সব অধিকার ভোগ করে মজা নিতে চায়। সরকারও সেগুলো দিয়েছে। আইন করে নিশ্চিত করেছে। আখেরাতের কথা মনে থাকে না! আমেরিকায় এসে প্রায় সব পুরুষই নারীবাদী হয়ে ওঠে। নারীদের অধিকার দিতে উঠেপড়ে লাগে। আর তাদের প্রথম অধিকার হল কামাই করার সুযোগ দেওয়া। মাইগ্রেন্ট করা মুসলমানদের অনেক পরিবারে শিক্ষিত নারী থাকে। আবার অনেকের এদেশে এসে আর পড়ালেখা করার সুযোগ থাকে না। বয়স হয়ে গেছে। অথবা ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। কিন্তু চাকরি করানোর সুযোগ তারা খুব কমই মিস করে। ব্যস, তারপর তাদের আর নারীবাদী তত্ত্ব নিয়ে সংশয় থাকে না। নারীবাদী কথাটা নারীদের আবিষ্কার নয়। পুরুষদের। চার্লস ফোরিয়ার (Charles Fourier) এই শব্দটির জনক। ফ্রান্সে ১৮৩৭ সাল থেকে শুরু হয়ে এখন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়েছে। নারীরা যদি ঘরেই থাকে, তাহলে তাদের ভোগ করার সুযোগ মিলবে না। সুতরাং একটা ধুয়া তুলে তাদের রাস্তায় বের করতে হবে; অফিস-আদালতে- হাতের নাগালে। সম অধিকারের কথা বলতে হবে। উন্নতির কথা বলতে হবে। আধুনিকতার কথা বলে গণহারে তাদের চাকরি দিতে হবে। হলোও তা-ই। নারীরা বের হল। আগে কোনো ধর্মের নারীরা এত খোলামেলা ছিল না। এখন যখন ধর্ম ফেলে উন্নতির জোয়ার লাগল, তখন আর বাধ মানল না। বের হয়ে একেবারে নিজেদের উজাড় করে দিল। প্রযুক্তি তাদের ভোগ্যপণ্য বানিয়ে ফেলল। যদিও বলা হয়, এটা আধুনিক সংস্কৃতি। মূলত এর মাধ্যমেই তাদের বেহায়াপনার শুরু। এখান থেকেই বাকি অবরুদ্ধ জায়গাগুলোতে পৌঁছে। মুসলমান নারীরাও আর ঘরে থাকতে পারল না। এদেশে নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করে। আমাদের দেশেও করে। এখন গ্লোবাল কালচারে এটা আলোচ্য বিষয় নয়। মূল সমস্যা পর্দার কনসেপ্ট পাল্টে গেছে। জিন্স আর টি শার্টের সংগে মাথায় হিজাব দিলেই পর্দা হয়ে গেল। ধুমধাম পার্টি আর পুরুষদের সংগে অবাধ মেলেমেশায় অসুবিধা দেখে না কেউ। কিছু বললেই তেড়ে আসে। এসব মাসআলা এদেশে বেকার। নাচতে নেমে কেউ ঘোমটা দেয় না। ঘোমটা দেয়ার কথা বলাটাই অন্যায়। নাচ থামাবেন, না ঘোমটা দেওয়ার কথা বলবেন? আসলে ঈমানই...। ঈমানের প্রসঙ্গ তুললেও বিপদ। তারা নামায পড়ে। রোযা রাখে। ইফতার পার্টিও দেয়। এই এক মেলানো-মেশানো কালচার। বেঁচে থাকতে হলে অনেক কিছুই করতে হয়। আস্তে আস্তে পরিবর্তন হবে। সেটা এতই আস্তে যে, মরে গেলেও আর হয় না। কামিজ ছেড়ে যে নারী জিন্স পরে, তার কাছে ঈমানের সংজ্ঞা ডিফরেন্ট। তাকে ঘরে ফেরানো মুশকিল। এভাবে ঘরছাড়া নারীরা বাইরের রোদ্দুরে গা পুড়িয়ে ঘরে ফেরে। একদিন বুড়ো হয়। তখন না ভোগ করতে পারে, না ভোগের পাত্র থাকে! ফেলে আসা শৈশব মনে পড়ে। দেশী হুজুরদের কথা মনে উঁকি দেয়। মা-বাবার স্মৃতিও ভেসে ওঠে। কী লাভ হল এতসব করে? গাড়ি-বাড়ি আর বিলাসিতা সব পড়ে থাকে এক কোণে। এখন ফেরার সময়। যিনি এ জীবন দিয়েছিলেন, তার কাছে ফিরে যেতে হবে। একা একা সেসব স্মৃতি মাড়িয়ে যেই একটু ভালো হতে চায়, শরীরের হাড়-গোড় মুচড়ে ওঠে। মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সুযোগও মেলে না। ।

৭। মানুষ আশা করে। স্বপ্ন দেখে। একটু ভালো থাকতে চায়। কাজ আর আনন্দ নিয়ে থাকতে চায়। নিরিবিলি কাটাতে চায় আলস্যের সময়। ঝামেলায় জড়াতে চায় না। পাশ্চাত্যে এগুলো পেতে স্বপ্ন দেখতে হয় না। এমনিতেই মেলে। কেউ কারো পেছনে লেগে নেই। যে যার কাজ করছে। সামাজিক নিয়ম-কানুন ছকে বাঁধা। সব ঘড়ির কাটায় চলে। মানুষও। ঝামেলা যে হয় না, তা না। চুরি, ডাকাতি, খুন-খারাবি সবই হয়। এর মূলে কাজ করে এদেশের এডুকেশন সিস্টেম। ভারী বোঝা এরা এত হালকা করে বহন করতে জানে, সিস্টেমে না ঢুকলে বোঝা যায় না। আমাদের দেশে শিশুদের উপর প্রথমে ভারী বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তারা যখন বড় হয়, তখন সেগুলো মাথা থেকেই ফেলে দেয়। সমাজ অন্ধকারে যেতে থাকে। আলোর মুখ দেখে না। সেক্যুলার হয়েও পাশ্চাত্যের ভালো কিছু নিতে পারে না। কিন্তু খারাপ নিতে ভুল করে না। আমেরিকান এডুকেশন সিস্টেমের মন্দ দিকটা সবাই জানে। ভুক্তভোগী অনেক মুসলমানও সেসব নিয়ে কথা বলতে চান না। পড়ালেখা করতেই হবে। বড় হতে হলে এর বিকল্প নেই। কত বড় হবে তুমি? এটা কারো জানা থাকে না। টার্গেট থাকে। মজার ব্যাপার হল এদেশে ছেলেরা ফায়ারম্যান হতে চায়, গারবেজম্যান হতে চায়, সুপারম্যানও হতে চায়। চাইতেই পারে। মিডিয়াতে যা দেখে, তা-ই হতে চায়। এডুকেশন সিস্টেম এমন, এলিভেন ক্লাস না পেরুনো পর্যন্ত তার চাওয়া থামে না। তারপর যারা টিকে যায়, তারা সোসাইটিতে আগে বাড়তে পারে। উচ্চ শিক্ষা নিতে পারে। এ পথ পরিক্রমা খুব সহজ না। মাল্টিকালচারে পড়ালেখা তার মেধা-মননে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। বড় কিছু হতে শেখায়। তবে রিলিজিয়ন পড়ে থাকে। এদেশে রাস্তা-ঘাট যেমন সুন্দর তেমন স্কুল-কলেজও। খুবই প্রশস্ত জায়গা নিয়ে বানানো। খেলার মাঠ ছাড়া কোনো স্কুল নযরে পড়েনি। শারীরিক ফিটনেস পড়ালেখার অংশ। খেলাচ্ছলেই ছেলে-মেয়েদের পড়ানো হয়। খুবই ইফেক্টিভ। তুলনামূলক পাবলিক স্কুলে পড়া সহজ। খরচ কম। মাইগ্রেট করা অনেক মুসলমান ছেলে-মেয়েদের এখানেই হাতে-খড়ি হয়। তারা যা দেখে, তাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। কালচার ভেবে লুফে নেয়। তাকেও জাতে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। তখন তারা পাত ভুলে যায়। খুব আস্তে আস্তে সে আমেরিকান হয়ে ওঠে। বাবা-মা টের পায় না। টেন-ক্লাসেই অনেক মেয়ে... হয়ে যায়। বয়ফ্রেন্ড অথবা গার্লফ্রেন্ড বাড়তে থাকে। সমাজে এটা নিয়ে হৈচৈ হয় না। অগোচরে সম্পর্ক গড়ায় অনেক দূর। নারী-পুরুষের অন্যায় সম্পর্কের বিষয়টা তাই পুরোনো আদলেই থাকে। আর রিলিজিয়ন বাসা-বাড়িতে আগে বাড়লেও স্কুল-কলেজে বাড়ে না। পেছনে পড়ে থাকে। আমেরিকান বানাতে চাইলে এটা ধরে রাখতেই হবে। সরকার এই একটা জায়গায় যা খেলার খেলে। মুখে কিছু বলে না। এজন্য বাবা-মা ধার্মিক হোক, তাতে অসুবিধা নেই। সরকার তাদের নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। তাদের সন্তানই টার্গেট। জেনারেশন কিল (Kill) করতে এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই। এদেশে ইসলামী এডুকেশন সিস্টেমও আছে। মসজিদকেন্দ্রিক স্কুল। সব শহরে এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেক শহরেই আছে। মুসলমানদের জন্য একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার সুযোগ করে দিয়েছে এ স্কুলগুলো। উচ্চশিক্ষার দ্বার খোলা রেখেই এর কারিকুলাম বানানো হয়েছে। এর সঙ্গে ইসলামী কৃষ্টি-কালচারের চর্চা হয়। অনেকে হাফেজও হয়। তবে ধরে রাখাটা সহজ হয় না। ইউনিভার্সিটিতে গেলে তারা তখন মূল ধারায় ফিরে আসে। যাদের ভাগ্য ভালো, তারা নিজেদের বাঁচিয়ে চলে। আর নতুবা গা ভাসিয়ে দিয়ে সত্যিকার আমেরিকান হয়ে ওঠে। মুসলমান পরিবার কখনো পরবর্তী জেনারেশন হারাতে চায় না। পরিবেশের জন্য ঠিক রাখতেও পারে না। বেঠিক চলতে চলতে আশার আলো দেখে সবাই। একদিন হয়ত জাগরণ হবে। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। সেদিন কবে আসবে?

 

 

advertisement