ইবাদতের তাৎপর্য : কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ভূমিকা
শুরুতে আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে শোকর আদায় করছি, যিনি আমাদের হেদায়েতের জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী ও রাসূল করে পাঠিয়েছেন। তাঁর উপর শেষ আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। তাঁকে পূর্ণাঙ্গ ও চিরন্তন একটি শরীয়ত দান করেছেন এবং তাঁর সীরাত ও সুন্নাহকে আমাদের জন্য ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ’ ও উত্তম আদর্শ সাব্যস্ত করেছেন।
শোকর আদায় করছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের, যিনি আমাদেরকে শোকর ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য সকাল-সন্ধ্যায় গভীর মর্মসমৃদ্ধ এই দুআটি পড়ার তালীম দিয়েছেন :
رَضِيتُ بِاللّهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا.
বাস্তবিকই আমরা এ কারণে সন্তুষ্ট যে আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক, আমরা সন্তুষ্ট যে ইসলামই আমাদের দ্বীন, আমরা সন্তুষ্ট যে মুহাম্মাদ আমাদের নবী। (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
আল্লাহ ছাড়া না কোনো রব আছে আর না আমরা তাঁকে ছাড়া কাউকে রব হিসেবে মানতে প্রস্তুত। ইসলাম ছাড়া না কোনো হক দ্বীন আছে আর না আমরা ইসলামের কোনো বিকল্প তালাশ করার কথা ভাবতে পারি। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নতুন কোনো নবী আসার কথা কল্পনাও করা যায় না। এখন কেবল তাঁর অনুসরণের মাধ্যমেই হেদায়েত পাওয়া সম্ভব। আমরা নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর উম্মত বানিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি কেবল তাঁর সুন্নাহ ও শরীয়ত অনুসরণের মাধ্যমেই আখেরাতে মুক্তি ও সফলতা লাভ করা সম্ভব। তিনি ছাড়া অন্য কাউকে ‘উসওয়াহ’ ও আদর্শ বানানোর জন্য আমরা প্রস্তুত নই।
رَضِيتُ بِاللّهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا.
অতপর শোকর আদায় করছি সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং প্রত্যেক যুগের আলেম-উলামা, নেককার ও বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গ ও মুসলিম মনীষীদের, যাঁরা আমাদের কাছে যথাযথভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীরাছ (ইলমে ওহী, সুন্নাহ ও শরীয়ত এবং সুন্নাহ ও শরীয়তের সঠিক মর্ম ও আমলী রূপকাঠামো) পৌঁছিয়েছেন। আমরা এই মীরাছে মুতাওয়ারাছ১ (মুতাওয়ারাছ আকীদা, মুতাওয়ারাছ শরীয়ত, মুতাওয়ারাছ ফিক্হ) নিয়েই বাঁচতে চাই, এ নিয়েই মরতে চাই। এই মীরাছের ধারক-বাহকদের সাথে নববী পতাকা তলে আমাদের হাশর হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
শোকর আদায় করছি রহমান রহীম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের, যিনি এই মীরাছে নববী হেফাযতের যিম্মাদারী নিয়েছেন এবং ওয়াদা করে আপন কালামে পাকে তা ঘোষণা করেছেন-
اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.
‘বস্তুত এ উপদেশ বাণী (কুরআন) আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষাকর্তা।’ (সূরা হিজর, আয়াত: ৯)
এই আয়াতে প্রত্যক্ষভাবে কুরআন, সুন্নাহ ও শরীয়ত এবং এগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও মর্ম (প্রত্যেক যুগের ইলমের ধারক-বাহকদের মাধ্যমে যা আমাদের কাছে অবিচ্ছিন্নসূত্রে পৌঁছেছে) সংরক্ষণের ওয়াদা করা হয়েছে। এবং পরোক্ষভাবে ওইসব বিষয় সংরক্ষণের ওয়াদা করা হয়েছে, উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোনো একটিরও সংরক্ষণ যা সংরক্ষিত থাকার উপর নির্ভরশীল। এই এলাহী হেফাযতেরই ফল হল-
ক. কুরআন নাযিলের সাড়ে চৌদ্দশ বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও আজ আমরা কুরআন মাজীদকে সেই রকমই পাচ্ছি এবং তা তিলাওয়াত করতে পারছি যেভাবে তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা এ রকমই থাকবে। যেন কুরআন প্রত্যেক যুগের মানুষের সামনেই নাযিল হয়েছে।
খ. সাড়ে চৌদ্দশ বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও আজ আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও সুন্নাহর সহীহ ও সঠিক ইলম হাসিল করতে পারছি, আমাদের কাছে তা আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত উত্তর প্রজন্ম এভাবেই তা অর্জন করতে পারবে, তাদের কাছেও তা থাকবে।
গ. ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও র্শয়ে মুনায্যালের প্রতিটি বিষয় আমাদের সামনে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ রকম স্পষ্ট আকারেই তা বিদ্যমান থাকবে।
ঘ. যেসব বিষয় সংরক্ষিত থাকার উপর কুরআন-সুন্নাহ এবং দ্বীন ও শরীয়তের পাঠ ও মর্মের সংরক্ষণ নির্ভরশীল তার সব কিছুই সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা সংরক্ষিত থাকবে। এই এলাহী সংরক্ষণের ফলশ্রুতিতেই ইসালামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস, খুলাফায়ে রাশেদীনের সীরাত ও সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম-তাবেয়ীন-তাবে তাবেয়ীনের দ্বীনী ও দুনিয়াবী ইতিহাস, হাদীসের রাবী, কুরআনের ক্বারী, দ্বীনের সঠিক বুঝ ও বোধের অধিকারী ফকীহ আলেমে দ্বীন ব্যক্তিবর্গের ইতিহাস, ইসলামের জন্য প্রাণপণ লড়াইকারী বীর মুজাহিদ ও শহীদানের ইতিহাস, সবশ্রেণীর আলেম-উলামা ও নেককার-বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গের কীর্তি-সাধনা- এ সব কিছুর জরুরি অংশ আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। আর এরই ফলশ্রুতিতে নববী মীরাছের ধারক-বাহকদের সামনে কুরআন অবতীর্ণের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতৃক হাদীস ইরশাদের সময়কালের ভাষা ও পরিভাষা এবং রীতি-নীতি ও প্রথা-প্রচলন স্বচ্ছ আয়নার ন্যায় স্পষ্ট আকারে বিদ্যমান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা এমনই থাকবে।
فالحمد لله الذي صبَّحنا على فطرة الإسلام، وكلمة الإخلاص، وعلى دين نبينا محمد صلى الله عليه وسلم، وعلى ملة أبينا إبراهيم حنيفا مسلما، وما كان من المشركين. فاللهم ما أصبح بي من نعمة أو بأحد من خلقك فمنك وحدك لا شريك لك، فلك الحمد ولك الشكر.
নিআমতের সঠিক ব্যবহারই নিআমতের যথার্থ শোকর আদায়
আল্লাহ তাআলা দ্বীনে ইসলাম, ইসলামপ্রদত্ত সর্বশেষ ও চিরন্তন শরীয়ত এবং এর উৎস ও দলীল আমাদের জন্য সংরক্ষণ করেছেন। আমাদের শত অবহেলা ও বিচ্যুতি সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা এই সব কিছু সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এই যে ইলমে ওহী ও মীরাছে নববীকে আল্লাহ তাআলা সংরক্ষণ করে রেখেছেন এর প্রকৃত শোকর তো তখনই আদায় হবে যদি আমরা এর কদর করি এবং একে যথার্থভাবে কাজে লাগাই। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক নিআমতের শোকর আদায়ের পন্থা এই যে, উক্ত নিআমতকে আল্লাহ তাআলা যে উদ্দেশ্যে প্রদান করেছেন সে উদ্দেশ্যেই তা ব্যবহার করা, কিছুতেই এর ভুল ব্যবহার না করা।
এ জন্য প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দ্বীন ও ঈমান শিক্ষা করা, কুরআন-হাদীস শেখা, সীরাত ও সুন্নাহ শেখা, ফিক্হ ও মাসায়েল শেখা। এগুলো সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের কাছে গিয়ে শেখা, শুধু কিতাব পড়া কিংবা যন্ত্র থেকে শোনা বা দেখাকে যথেষ্ট মনে না করা।
মুহাক্কিক আকাবির আলেমে দ্বীন ব্যক্তিবর্গের কর্তব্য হল,
عرض الفقه على الأدلة২ (আরযুল ফিকহ আলাল আদিল্লাহ) থেকে গাফেল না হওয়া এবং فقه الحوادث (ফিকহুল হাওয়াদিছ)-এর ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শ ও আলোচনা-পর্যালোচনা অব্যাহত রাখা।
মসজিদের ইমাম ও খতীববৃন্দ, মাদারেসের শিক্ষকবৃন্দ, মুরশিদ ও মাশায়েখে কেরাম, লেখালেখি ও রচনাকর্মের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং এ ছাড়া অন্যান্য আলেম-উলামা যারা আছেন তাদের উপর ফরয তা‘লীম-তাদরীস, দাওয়াত ও তাবলীগ, ওয়ায-নসীহত, তাযকিয়া-তারবিয়াত, বয়ান ও খুতবা, দ্বীনী কোনো প্রশ্নের উত্তর প্রদান- মোটকথা সকল দ্বীনী কাজে সর্বোচ্চ সতর্কতার পরিচয় দেওয়া, বিনা তাহকীকে কোনো কথা না বলা বা কিছু না লেখা।
শোনা, বলা, লেখা ও দেখা এবং চিন্তা করার ক্ষেত্রে সতর্কতার পরিচয় দেওয়া এবং সকল কাজ সুন্দর, সুচারু এবং নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা মুমিনের শান। এক কথায় ইবাদতে ইহসান এবং প্রত্যেক কাজে ইতকান এই হল মুমিনের শান। আর উলামায়ে কেরামের তো এগুলো ‘শিআর’ (প্রতীক) হওয়া উচিত।
আর আম মুসলিমদের কর্তব্য হল তারা উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে শিখবে এবং তাঁদের অনুসরণ করবে। দ্বীনী বিষয়ে নিজেরা তাহকীক করতে যাবে না, দ্বীনী বিষয়ে রায় ও মতামত প্রকাশ করবে না এবং উলামায়ে কেরামের ভুল ধরে বেআদবি করবে না। উলামায়ে কেরাম মা‘ছুম নন, ভুলের ঊর্ধ্বে নন কিন্তু তাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের মুরুব্বিরা ও তাঁদের সমকালীন উলামায়ে কেরাম তো আছেন।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই বান্দা এক সামান্য তালিবে ইলম। যদিও সত্যি কথা হল আমার দ্বারা তলবে ইলমের হক আদায় হয় না এবং তলবে ইলমের আদাব রক্ষা হয় না। তবুও চেষ্টা করি, আসাতেযায়ে কেরামের পথে চলার, আসাতেযায়ে কেরাম আমাদেরকে এই বিষয়টির প্রতি সতর্ক করেছেন যে, কোনো ইলমী বিষয়ে যেন আন্দায-অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কাজ না করা হয় এবং তাহকীকের ক্ষেত্রে কখনও যেন তাড়াহুড়া না করা হয়। বরং এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ও স্থৈর্যকে আবশ্যক জ্ঞান করা হয়। কোনো বিষয়ে কিছু বলতে বা লিখতে হলে এ বিষয়ে পূর্ববর্তীরা কী বলেছেন, এ বিষয়ে তাঁদের বোধ ও চেতনা কী ছিল তা দেখে নেওয়া। তাঁরা কুরআনুল কারীমের কোন্ আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করেছেন, কোন্ কোন্ হাদীস ও আছারকে আলোচ্য বিষয়ের দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সালাফ ও পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়টিকে কীভাবে বুঝেছেন এবং কীভাবে উপস্থাপন করেছেন, বর্তমান যুগের মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম এ সম্পর্কে কী বলেছেন বা কী লিখেছেন, উসূলে তাহকীক তথা তাহকীকের মূলনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ তো করতে হবে কিন্তু নিজের তাহকীকের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আস্থাশীল ও নিশ্চিত হওয়া যাবে না; বরং সমকালীন উলামায়ে কেরামের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করবে, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করবে, তাহকীকের নতীজা তাদের সামনে পেশ করবে। বিষয়টির তত্ত্ব বুঝতে গিয়ে কোনো ভুল হয়ে গেল না তো? ভাষা ও উপস্থাপনগত কোনো ভুল নেই তো? কোন বাক্যে বা শব্দে ইবহাম ও ঈহাম তথা অস্পষ্টতা ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয় এমন কিছু নেই তো?
ধরুন হজ্বের একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আমাকে লেখার হুকুম করা হল আর হজ্বের তাৎপর্য নিয়ে লেখার সিদ্ধান্ত হল তখন একজন তালিবে ইলম হিসেবে আমাকে উপরোক্ত পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হয়েছে।
আহকামের হিকাম তথা দ্বীনী ইবাদাত এবং শরয়ী বিধানের তাৎপর্য ও রহস্য বিষয়ক শাস্ত্রের নাযুকতা
প্রথমে আমাকে আরো ভাবতে হবে যে, ‘আসরারে শরীয়ত’ তথা ‘শরীয়তের বিধানাবলীর গুঢ়তত্ত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা’ সংক্রান্ত শাস্ত্র অত্যন্ত নাযুক ও স্পর্শকাতর একটি শাস্ত্র। মুমিন বান্দার জন্য আসলে যা জানা প্রয়োজন তা হল আল্লাহ তাআলার হুকুম কী? নির্ভরযোগ্য সূত্রে যদি জানা যায় যে, এটি আল্লাহ তাআলার বিধান তাহলে তা মেনে নিতে বিলম্ব নেই। সঙ্গে সঙ্গে মুমিন বলে উঠবে- سمعنا واطعنا। সে কেমন মুমিন, যে তাৎপর্য জানার উপর শরীয়তের বিধান মানাকে মওকুফ রাখে! মুমিনের তো এ বিষয়েও ঈমান রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা হাকীম ও প্রজ্ঞাময় এবং এ বিষয়েও ঈমান রয়েছে যে, তিনি আহকামুল হাকিমীন ও সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচে’ ক্ষমতাবান শাসক। তিনি যা চান তাঁর বান্দাদের হুকুম করতে পারেন, যেমন ইচ্ছা ইবাদাতের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, শরীয়তের প্রতিটি বিধানের তাৎপর্য আছে। কিন্তু সব হিকমত ও তাৎপর্যের কথা কুরআন-হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। কিছু কিছু বিষয়ে তাৎপর্যের প্রতি ইশারা করা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাৎপর্যের কোনো উল্লেখ নেই। বিভিন্ন বিধানের যে তাৎপর্যের উল্লেখ পাওয়া যায় তা কতেক বুযুর্গ নিজস্ব রুচি ও উপলব্ধি (ذوق و وجدان)-এর আলোকে বলেছেন। যেগুলো সম্পূর্ণই সম্ভাবনার পর্যায়ের। নিশ্চিতভাবে সেগুলোকে সংশ্লিষ্ট বিধানের তাৎপর্য বলার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই তাৎপর্যাবলীর উপর কোনো শরয়ী বিধানের ভিত্তি নয় কিছুতেই। যে তাৎপর্যাবলীর কথা নুসূসে শরীয়াতে তথা কুরআন-সুন্নাহর মূল পাঠে উল্লেখ আছে শরীয়তদাতা নিজেই সেগুলোকে বিধানের ভিত্তি বানাননি। বিধানের ভিত্তি হল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আদেশ-নিষেধ; বিধানের ভিত্তি হল শরয়ী দলীল। তাই হিকমত ও তাৎপর্যের ভিত্তিতে না কোনো বিধানে পরিবর্তন করা জায়েয আছে আর না এর ভিত্তিতে কোনো বিধানের দালীলিক মর্যাদা কমানো-বাড়ানো যাবে। শরয়ী দলীল দ্বারা যা প্রমাণিত হবে এবং যতটুকু প্রমাণিত হবে তা-ই অবশ্য-অনুসরণীয় হবে।
তত্ত্ব ও তাৎপর্য বিষয়ে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর কিতাব ‘আহকামে ইসলাম আকল কি নযর মে’ প্রসিদ্ধ। হযরত রাহ. নিজেও এ কিতাবের ভূমিকায় উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তাঁর ‘খুতুবাতে’ বিভিন্ন জায়গায় এ ব্যাপারে মানুষের মাঝে যে বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতা দেখা যায় সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। এ ক্ষেত্রে সঠিক ও মধ্যপথ কী হবে তাও নির্দেশ করেছেন। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘...এই তাৎপর্যের উপর শরয়ী হুকুম ও বিধানের ভিত্তি নয়। বরং এই তাৎপর্যাবলীর ভিত্তি শরয়ী বিধানের উপর এবং এগুলি শরয়ী বিধানের অনুগামী।৩ শরয়ী হুকুম নির্ধারণ করেছেন আল্লাহ তাআলা। যা তাঁর রাসূল আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন...।
‘আমাদের জন্য এই বিধানের বড় ভিত্তি এই যে, তা আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করেছেন। তবে যে বিধানের হিকমত ও তাৎপর্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই বলে দিয়েছেন তা বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে। কিন্তু যে বিধানের তাৎপর্য আল্লাহ তাআলা (কিংবা তাঁর রাসূল) বলেননি তাতে নিজের রায় খাটানো এবং নিজের পক্ষ থেকে ধারণাকৃত তাৎপর্যের উপরেই শরয়ী বিধানের ভিত্তি- এমনটি মনে করা বড় নির্বুদ্ধিতা...।
‘আমি ‘আল মাসালিহুল আকলিয়্যাহ ফিল আহকামিন নাকলিয়্যাহ’ (আহকামে ইসলাম আকল কি নজর মে) নামে একটি কিতাব লিখেছি। যাতে শরয়ী বিধি-বিধানের কিছু তাৎপর্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এ কিতাবের যে বিষয়টি বেশি পছন্দের ও কার্যকরী তা হল কিতাবের ‘খুতবাটি’। যাতে কিছু মূলনীতি ও ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে এই মূলনীতিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ তাৎপর্যাবলী শরয়ী বিধানের অনুগামী। শরয়ী বিধানের ভিত্তি এগুলোর উপর নয়। -খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত খ. ১৭, পৃ. ৩৮৯-৩৯৩
রূহুল আরওয়াহ’তে তো হযরত রাহ. এ কথাও বলেছেন-
"اور غیر منصوص حکمتیں جتنی بیان کی جاتی ہیں وہ اکثر اٹکل پچو ہوتی ہیں۔۔۔" ج ১৭/৩৮৯ ৪
মোটকথা, কোনো আমল ও বিধানের হিকমত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। ‘রূহুল আরওয়াহ’ এটি হজ্ব সম্পর্কে হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর একটি বয়ান। বাহ্যত হযরত এতে হজ্বের গূঢ়তত্ত্ব ও তাৎপর্যই বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ বয়ান ‘আসরার ও হিকাম’ তথা ‘তত্ত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা’- এ শাস্ত্রের শরয়ী অবস্থান বোঝাতে এবং এ ক্ষেত্রে যে প্রান্তিকতা ও বাড়াবাড়ি হয় তা চিহ্নিত করেই শেষ হয়ে গেছে।
কোনো আমলের প্রথম পরিচয় কীভাবে দিতে হবে?
এখানে এ প্রশ্ন তোলাও সঙ্গত হবে যে, যদি আমাকে কোনো আমলের পরিচয় দিতে হয় তা কীভাবে দিতে হবে? আমলের হিকমত বর্ণনা করে, নাকি আমলের হাকীকত ও তার শরয়ী অবস্থান ও গুরুত্ব বর্ণনা করার মাধ্যমেই তার আসল পরিচয় দিতে হবে।
তাই হজ্বের পরিচয় দিতে হলে প্রথম কথা এই বলতে হবে যে, হজ্ব গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ইবাদত, ইসলামের পঞ্চ রুকনের একটি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান সবার উপর আল্লাহ যা ফরয করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ لِلهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا وَ مَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللهَ غَنِیٌّ عَنِ الْعٰلَمِیْنَ.
‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্জ করা ফরয। কেউ এটা অস্বীকার করলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ হতে বেনিয়ায।’ -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭
এরপর হজ্বের ফযীলত ও বিধি-বিধানের আলোচনা হবে। সীরাত ও ফিকহের কিতাবাদি থেকে হজ্বের আমলী রূপকাঠামো পেশ করা হবে। এরপর আসবে ‘আসরার ও হিকাম’ তথা তত্ত্ব ও তাৎপর্যের প্রসঙ্গ।
আসরার ও হিকাম বর্ণনা করা নিষিদ্ধ নয় কিন্তু আসরার ও হিকাম বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সীমা ও নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য রাখা তো জরুরি। অনেকে বলে এ তো আহকাম নয় বরং হিকাম, তাই এখানে রুখসতের উপর আমল করা যাবে। নিঃসন্দেহে আহকামের তুলনায় হিকাম (তাৎপর্য) বর্ণনা করার ক্ষেত্রে কিছু না কিছু রুখসত (ছাড়) আছে। কিন্তু তাতেও সীমা আছে এবং নীতিমালা আছে যা লঙ্ঘন করা উচিত নয় কিছুতেই। উদাহরণত মুনকার কথা, মুনকার রেওয়ায়েত উল্লেখ করা কিংবা মুনকার উপস্থাপন, এই সব আসরার ও হিকাম বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও একেবারেই প্রযোজ্য নয়। এগুলো পরিহার করা জরুরি। আর যে হেকমত ও তাৎপর্য ‘মুহতামাল’ তথা হতে পারে আবার নাও হতে পারে এমন পর্যায়ের; সেগুলোকে প্রমাণিত ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াবলীর মত নিশ্চিতভাবে বর্ণনা করা ঠিক নয়। ‘নুসূস’ তথা কুরআন-সুন্নাহর মূল পাঠে স্পষ্টভাবে অথবা ইশারায় যে হিকমতের কথা উল্লেখিত হয়েছে সেগুলো সবার আগে উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই হিকমত ও তাৎপর্যকে ঢাল বানিয়ে কোনো বিধানে কোনোরূপ রদ-বদল করা যাবে না। তেমনি হিকমতের উপর ভিত্তি করে কোনো নতুন হুকুম আবিষ্কারও করা জায়েয হবে না।
এই মূলনীতিসমূহের আলোকে আমরা অন্তত উচ্চতর পড়াশোনায় নিরত তালিবে ইলমদের কাছে এই দরখাস্ত করতে পারি, তারা যেন এ বিষয়ে তাদের আসাতিযায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে তামরীন-অনুশীলন করেন। যেমন তিনি যদি হজ্বের হিকমত ও তাৎপর্য নিয়ে পড়তে চান তাহলে তার কর্তব্য হবে, প্রথমে হজ্বের স্থানসমূহ, আলমাশআরুল হারামসহ সকল মাশায়ের, শাআইরে ইসলাম (ইসলামের প্রতীকী বিষয়াবলী) হজ্ব, হজ্বের ফাযায়েল এবং হজ্বের বিধিবিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ প্রথমে নিজে তাদাব্বুর ও চিন্তা-ভাবনা করে অতপর কোনো সংক্ষিপ্ত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরের আলোকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করবেন। এমনিভাবে উপরোক্ত বিষয়াবলী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, সাহাবা তাবেঈন তাবে-তাবেঈনের আছার এবং আইম্মায়ে দ্বীন-এর বাণী মুতালাআ করবেন। সীরাত এবং তারীখ ও তারাজিমের কিতাবাদি থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতপর খোলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনের হজ্বের ঘটনাবলী গভীরভাবে অধ্যয়ন করবেন।
হজ্ব ও হজ্বের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিধানাবলী পালন কালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত মাসনূন দুআ ও যিকির পড়ার কথা হাদীস, আসার ও সীরাতের কিতাবাদিতে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর অর্থ-মর্ম সম্পর্কে গভীর চিন্তা করবেন। মক্কা, মিনা এবং আরাফাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল খুতবা দিয়েছেন এরপর তাঁর খোলাফায়ে রাশেদীন এবং সালেহ ও নেককার মুসলিম আমীরগণ যে খুতবা দিয়েছেন প্রভৃতি খুতবাগুলোর প্রত্যেকটি বাক্য গভীরভাবে পড়বেন। এরপর হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলো, বড় কলেবরের দলীলসমৃদ্ধ ফিকহের গ্রন্থাবলী ‘হিকাম ও আসরার’ তথা তত্ত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা বিষয়ক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী পড়ে দেখবেন এবং কোথাও খটকা হলে আসাতিযায়ে কেরাম ও সমকালীন ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা পর্যালোচনা করবেন। এভাবে মেহনত করে হজ্বের তত্ত্ব ও তাৎপর্য (হিকাম ও আসরার) সম্পর্কে তার উপলব্ধি ইনশাআল্লাহ গভীর ও প্রান্তিকতামুক্ত হবে।
এরপর এ সম্পর্কে মনে যে খোলাসা বা সারাংশ উপস্থিত হয় তা উপস্থাপনের ভঙ্গি ও শৈলী কী হবে? এটিও তামরীন ও অনুশীলন করার মতো বিষয়। কলম ও বয়ানের অধিকারী এবং ইলম ও ফিকহের পারদর্শী আহলে দিল আলেমে দ্বীনের কাছ থেকে এই বিষয়ে পরামর্শ নেয়া জরুরি।
এই পদ্ধতি সঠিক নয় যে, কোনো ওয়ায়েযের, খতীব বা বুযুর্গের বয়ানসমগ্র পাওয়া গেল আর তা থেকে হজ্ব-সম্পর্কিত বয়ান ও হজ্বের হিকাম-আসরার মুতালাআ করে কোনো প্রবন্ধ লিখে মাসিক পত্রিকায় ছাপিয়ে দেয়া হল কিংবা জুমার দিন বাংলা বয়ানে বা আরবী খুতবায় বলে দেয়া হল। অন্তত উচ্চতর পড়াশোনায় নিরত তালিবে ইলমদের জন্য, যাদের সামনে ইসলামী উলূমের সকল উৎসপঞ্জি আছে, তাদের জন্য তো এরকম করা একেবারেই মুনাসিব নয়।
আজকে উপরোক্ত মূলনীতি অনুসারে হজ্বের আসরার ও হিকাম সম্পর্কে কোনো লেখা পেশ করা উদ্দেশ্য নয়। অন্য কোনো অবসরে তা হবে ইনশাআল্লাহ। আজকে শুধু একটি ঘটনাই উল্লেখ করছি।
একদিনের কথা। আমি কোথাও যাচ্ছিলাম। দেখলাম যে, এক আল্লাহর বান্দা হজ্ব সম্পর্কে কিছু বলছে। পাঁচ-ছয় মিনিটের কথা ছিল। কথার শুরু ও শেষে একই কথা- ‘হজ্ব হল পাগলামি, আর হাজ্বী পাগল’। একেবারে এই শব্দই! তবে হাঁ, একবার এ বাক্যও বলেছেন, ‘কার পাগল? আল্লাহর পাগল’। আমার কিছুতেই বুঝে আসেনি যে, এ বাক্যের মাধ্যমে হজ্বের পরিচিতি কীভাবে হয়। এ বাক্য দিয়ে হজ্বের কোনো তাৎপর্যের বর্ণনাই বা কীভাবে হয়। আর এ বাক্য ও প্রকাশভঙ্গিই বা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হয়।৫ হজ্ব আল্লাহ তাআলার ইবাদত। যার সম্পূর্ণ আমলী রূপ ও এতদসংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিধি-বিধান আল্লাহ তাআলা শিক্ষা দিয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে তা হরফে হরফে শিক্ষা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হাজ্বীর উপর এ কর্তব্য বর্তায় যে, সে হুবহু সেই পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করবে এবং সেই বিধি-বিধানেরই পাবন্দী করবে। জযবা ও আবেগের শিকার হয়ে কোনো বিধানের বিপরীত করা এবং সীমালঙ্ঘন করার একেবারেই অনুমতি নেই। প্রত্যেক ইবাদতই ইসতিসলাম ও আত্মসমর্পণ, ইহতেসাব ও সওয়াবের নিয়ত এবং ইহসান তথা আল্লাহর সামনে উপস্থিতির মুরাকাবা করে যথাযথ ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আদায় করার চেষ্টা করা কাম্য। আর হজ্বের কার্যাবলী তো এত সূক্ষ্ম ও নাযুক যে, তা পূর্ণ সতর্কতা ও মুহাসাবার সাথে আদায় করতে হয়। সামান্য অসতর্কতা কখনও হজ্বকেই ফাসেদ করে দেয়। মোটকথা, হাজ্বী যা কিছুই করে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের হুকুমেই করে। হাজ্বী হুকুমের বান্দা ও ইশারার গোলাম; হজ্ব বড় মুজাহাদার কাজ। এমনকি হাদীসে তাকে জিহাদ বলা হয়েছে। হজ্বের কার্যাবলীতে মুহাব্বাত, আযমত উবুদিয়্যাত ও আবদিয়্যাত আছে। আছে ইসতিসলাম, ইহসান ও ইহতিসাব। হজ্ব আগাগোড়া তাওহীদ ও তামজীদ এবং তাআব্বুদ ও ইহসানের নাম। এতে আদৌ কোনো পাগলামী নেই। আর না খালেক মাখলুকের সম্পর্কের মাঝে এর কল্পনা করা যায়। শরীয়ত কর্তৃক শিক্ষা দেওয়া কোনো আমলে পাগলামি (যে অর্থেই শব্দটি বলা হয়ে থাকুক) এর লেশমাত্রও থাকা সম্ভব না।
যদি হজ্ব ও হাজ্বী সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে হজ্বের তালবিয়াই তো শুনিয়ে দেয়া যেত। কারণ তাতে হজ্বের হাকীকত তাওহীদ ও ইহসানের কথা আছে।
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيكَ لَكَ.
‘বান্দা হাযির প্রভু হে! বান্দা হাযির। বান্দা হাযির। তুমি লা শরীক। বান্দা হাযির। প্রশংসা ও করুণা তোমারই সাজে। রাজত্ব তোমারই শোভে। তুমি লা শরীক।’
এবং এ সংক্ষিপ্ত তালবিয়াও যা মূল তালবিয়ার পাশাপাশি হযরত আনাস রা. মাঝেমধ্যে পড়তেন-
لَبَّيْكَ حَجًّا حَقًّا تَعَبُّدًا وَرِقًّا
‘আল্লাহ আমি হাযির। জিয়ারতে হাযির। আমি সত্যিই হাযির। বন্দেগী এবং গোলামির সঙ্গে হাযির।’ (মুসনাদে বাযযার, খ-: ১৩, পৃষ্ঠা: ২৬৬, বর্ণনা: ৬৮০৪)
হাজ্বী সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী শুনিয়ে দেওয়াও যথেষ্ট ছিল।
الْغَازِي فِي سَبِيلِ اللّهِ، وَالْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ وَفْدُ اللَّهِ، دَعَاهُمْ، فَأَجَابُوهُ، وَسَأَلُوهُ، فَأَعْطَاهُمْ.
قال البوصيري : إسناده حسن
অর্থাৎ আল্লাহর রাহে (ইসলামের দুশমনদের সাথে) জিহাদকারী, বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে গমনকারী হাজ্বী ও উমরার উদ্দেশ্যে গমনকারী- এরা আল্লাহর ওয়াফ্দ (মেহমান)। আল্লাহ তাদের দাওয়াত দিয়েছেন আর তারা দাওয়াত কবুল করেছেন। তারা আল্লাহর কাছে চেয়েছেন আর আল্লাহ তাদের দিয়েছেন। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৬১৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮৯৩
‘ওয়াফ্দ’ বলা হয় সরকারি মেহমানকে। সরকার যত বড় হয় মেহমানের মর্যাদা তত বেশি হয়। এরপর যদি সে হয় সরকারের পক্ষ থেকে দাওয়াতপ্রাপ্ত। তাহলে তো কথাই নেই!
‘ওয়াফ্দের’ মাঝে এ বিষয়টিও থাকে যে, তারা দরবারে গিয়ে নিজ কওমের পক্ষ থেকে প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়টিই হাদীসে বলা হয়েছে।
الْحَاجُّ وَفْدُ اللَّهِ، وَالْحَاجُّ وَافِدُ أَهْلِهِ.
مرسلا عن أبي قلابة، بإسناد رجاله ثقات.
অর্থাৎ, হাজ্বী আল্লাহর মেহমান। এবং নিজের ‘আহলের’ পক্ষ থেকে প্রতিনিধি। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১২৮০২, কিতাবুল মানাসিকের প্রথম বাব।
এখন দেখার বিষয় হল, হজ্বে গমনকারী ‘মেহমান’ হওয়ার হক কতটুকু আদায় করেছি। মেহমানের আদব কতটুকু বজায় রেখেছি এবং নিজ কওমের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছি। আর হাজী সাহেবান রব্বুল আলামীনের সে পবিত্র স্থানসমূহ থেকে যে পয়গাম ও বার্তা নিয়ে এসেছেন আমরা তার কী কদর করব? যে বরকত, ইনআম ও অনুগ্রহ-পুরস্কার নিয়ে এসেছেন, তা থেকে কতটুকু আমরা নিতে পারব?
১. যুগ পরম্পরায় অবিচ্ছিন্ন সূত্রে চলে আসা মীরাছ।
২. এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অতি নাযুক ও স্পর্শকাতর একটি দায়িত্ব। এদিকে দৃষ্টি না দিলে ‘জুমুদ’ সৃষ্টি হয় আবার এ কাজে তাড়াহুড়া করলে ‘শুযুয’ (বিচ্ছিন্ন রায় ও মতামত) সৃষ্টি হয়। জুমুদ ও শুযুয উভয়টিই প্রান্তিক পথ। সঠিক ও মধ্যপথ হল উভয়ের মাঝামাঝি পথ। (আবদুল মালেক)
৩. گويا ان میں سے بعض نکتہ بعد الوقوع کے قبیل سے ہے، اور بعض فوائد مترتبہ کے قبیل سے ہے نہ کہ تشریع کے حکم ملحوظہ کی قبیل سے (عبد المالک)
৪. حضرت رح کا مقصد غالبا یہ ہے کہ اسرار و حکم کی کتابوں میں جو حکمتیں مذکور ہوتی ہیں ان کی اکثر غیر منصوص ہیں، پھر غیر منصوص ہونے کے ساتھ یہ بھی نہیں کہ وہ سب باضابطہ شرعی اجتہاد واستنباط کے اصول کے مطابق مستخرج ہیں، بلکہ عموما وہ ذوق ووجدان کی بنیاد پر ہی کہدی جاتی ہیں،ظاہر ہے کسی طرح کے ذوقیات حجت تو ہو نہیں سکتیں، البتہ اگر بات فی نفسہ درست ہو اور اسلوب منکر نہ ہو تو اسے ایک محتمل حکمت کی طرح پیش کی جا سکتی ہے، یہ ہے محققین کا طرز عمل، لیکن غلو کر نے والے منصوص و غیر منصوص اجتہادی وذوقی، اور منکر اور غیر منکر ہر چیز کو ایک ہی پلڑے کا سمجھتے ہیں۔ (عبد المالک)
৫ شايد اس اللہ کے بندے نے كسى بزرگ صاحب قلم كى بات برہى ہے ، كہ حج جذبہ عشق كى تسكين كے لئے ہے، ليكن اس بزرگ نے تو اور دس باتون كے ساتھ يہ ايك بات بهى لكهى ہے ، یہی نہیں صرف اسى بات سے حج كا تعارف كرايا، تا ہم يہ سوال ہے كہ ان كى اس بات كا مأخذ اور باين عبارت كيا ہے، كيا كسى نص كى اشارے سے يا خير القرون كى كسى امام كى عبارت ميں يہ بات پائى جاتى ہے؟ كسى كو اس كا كوئى مستند مأخذ ملے تو مطلع فرمانے كى درخواست ہے، ان شاء اللہ شكر و اعتراف كى ساتھ قبول كيا جائيگا، پهر كہاں ان كى مہذب عبارت اور كہاں يہ كہ حج كو پاگلامى كہا جائے اور حاجى كو پاگل؟! انا للہ وانا اليہ راجعون. (عبد المالک)