যিলক্বদ ১৪৩৮   ||   আগস্ট ২০১৭

ঈসালে সওয়াব : কিছু রসম-রেওয়াজ ও মনগড়া পদ্ধতি

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান

মুমিনের প্রতিটি কাজ হওয়া চাই সুন্নাহসম্মত পন্থায়। নবীজীর পবিত্র সীরাত হওয়া উচিত তার কাজের আদর্শ। যে কাজে থাকে আদ্যোপান্ত নববী সুন্নাহ ও আদর্শের উপস্থিতি তা রূপে-রসে হয়ে ওঠে অপূর্ব। তার নূর ও খায়ের-বরকত হয় অনন্য। আর যে কাজ করা হয় মনগড়া ও নবউদ্ভাবিত পন্থায় এবং যার অনুপ্রেরণা হয় প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ সেটা হয় নিষ্প্রাণ। তাতে কোনো খায়ের ও বরকত থাকে না। তদুপরি তা বহু রকমের উদ্বেগ, জটিলতা ও সংকীর্ণতার কারণ হয়। এজন্য হাদীস শরীফে সুন্নাহ্র অনুসরণ আর নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة، وإن كل بدعة ضلالة. তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহকে মজবুতভাবে ধরে রেখো। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থেকো। কারণ সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বিদআত আর সকল বিদআত গোমরাহী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১৪৫ কিন্তু অনেক বিষয়ের মত ঈসালে সওয়াবের ক্ষেত্রেও সমাজে সুন্নাহ্র যথেষ্ট অভাব রয়েছে এবং এর জায়গায় নানা রকমের বিদআত, রসম-রেওয়াজ ও মনগড়া বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যার ফলে অনেক সময়ই ঈসালে সওয়াবের রূহ ও হাকীকত বাকি থাকছে না এবং এই সহজ বিষয়টি কঠিন কাজে পরিণত হচ্ছে। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ. (১৩৬২হি.) এক প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘রসম-রেওয়াজ অন্তরে এমনভাবে ছেয়ে গেছে যে, কাজের হাকীকতের প্রতি মানুষের বিলকুল দৃষ্টি নেই। বরং মনে করে যে, অন্যরা করে, চল আমরাও করি। আল্লাহ বুদ্ধি ও দ্বীন এজন্যই দিয়েছেন, যাতে মানুষ প্রতিটি আমলের হাকীকত নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানুষ চিন্তাভাবনা করা-ই ছেড়ে দিয়েছে। এটাই সকল খারাপির মূল। হাকীকত উপলব্ধি করে কাজ করলে অনেক খারাবি থেকে নিরাপদ থাকা যায়।’ -মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত ১৬/১২১ বিদআত ও রসম-রেওয়াজের ব্যাপারে বিচক্ষণ আলেমগণ সবসময় সতর্ক ছিলেন। তবে এক্ষেত্রে হযরত থানবী রাহ. ছিলেন আরো প্রোজ্জ্বল। তিনি যবান ও কলম উভয়ের মাধ্যমে মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন এবং ‘ইসলাহুর রুসূম’ নামে স্বতন্ত্র কিতাবও লিখেছেন। ওই কিতাবের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের মনগড়া রীতি-রেওয়াজের ব্যাপারে এত পাবন্দ যে, ফরয-ওয়াজিব কাযা হয়ে গেলে কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু এসব রসমের মধ্যে বিন্দুমাত্রও ত্রুটি হতে পারবে না। ফলে তারা নানা রকমের পেরেশানি, সংকীর্ণতা ও বিপদের শিকার হচ্ছে এবং দ্বীন ও দুনিয়া উভয়েরই ক্ষতি করছে। আর বেশি ব্যাপক হওয়ায় এসকল রসমের ক্ষতির কথা নামমাত্র চিন্তায় আসে; বরং কিছু কিছু বিষয় তো তাদের কাছে ভালো বরং সওয়াবের কাজ। এজন্য প্রতিবাদকারীদের সাথে তারা তর্কে লিপ্ত হয় এবং অহেতুক সন্দেহ ও ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে একে সঠিক মনে করার চেষ্টা করে। আর কিছু রসমকে বিশ্বাসগতভাবে গোনাহ মনে করলেও আমলগতভাবে হালকা মনে করে; বরং কতককে একেবারে মুবাহ ও বৈধ মনে করে বসেছে। আরো পরিতাপের বিষয় হল, কতককে একেবারে ইবাদত বানিয়ে ফেলেছে...। তাই এ ব্যাপারে তাদের অবগত করা ঈমানী দাবি ছিল’। -ইসলাহুর রুসূম পৃ. ৩ এখানে ঈসালে সওয়াবের ব্যাপারে সমাজে প্রচলিত কিছু রসম-রেওয়াজ ও মনগড়া বিষয়ের উপর পর্যালোচনা করা হল। এক. নির্দিষ্ট দিন-তারিখকে জরুরি মনে করা সমাজে নির্দিষ্ট কিছু দিনে ঈসালে সওয়াব করাকে এত জরুরি মনে করা হয় যেন তা শরীয়তের পক্ষ থেকে সুনির্দেশিত। যেমন মৃত্যুর তিনদিন পর বা দশদিন পর কিংবা চল্লিশদিন পর দাওয়াত-অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এগুলো মানুষের মাঝে এত প্রচলিত যে, স্বতন্ত্র নামে পরিচিতি পেয়েছে। অথচ শরীয়তে ঈসালে সওয়াবের জন্য দিন-তারিখ নির্দিষ্ট নেই যে, অমুক দিন বা অমুক তারিখ কিংবা অমুক সময় তা করতে হবে; বরং মানুষের শক্তি-সামর্থ্যরে উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকে নিজ শক্তি ও সামর্থ্য অনুসারে যে কোনো দিন যে কোনো সময় তা করতে পারবে। এ কারণে বিশেষ কোনো দিন বা তারিখকে শরীয়ত কর্তৃক নির্দিষ্ট মনে করলে অথবা অনুরূপ আচরণ করলে তা বিদআত হবে। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. যে আমাদের দ্বীনে এমন কোনো নবউদ্ভাবিত বিষয়ের প্রবর্তন করে, যার শরীয়তে কোনো ভিত্তি নেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭১৮ মুফতী কিফায়াতুল্লাহ দেহলভী রাহ. (১৩৭২হি.) বলেন, اب اس کے لئے کوئی خاص تاریخ یا دن معین کرنا اور اس تعیین کو وصول ثواب کی شرط یا زیادت ثواب کے لئے بغیر شرعی دلیل کے مفیدسمجھنا یا خاص چیزیں مقرر کرناৃ یہ سب خلاف شریعت اور بدعت ہے. ঈসালে সওয়াবের জন্য বিশেষ কোনো দিন বা তারিখ নির্দিষ্ট করা এবং এটাকে সওয়াব পৌঁছার শর্ত মনে করা কিংবা শরয়ী দলীল ছাড়া অধিক সওয়াবের পক্ষে সহায়ক মনে করা অথবা বিশেষ নিয়মকানুন নির্দিষ্ট করা এ সবই শরীয়ত পরিপন্থী ও বিদআত। -কিফায়াতুল মুফতী ৪/১১২ দুই. সম্মিলিতভাবে করার প্রবণতা অনেক জায়গায় সম্মিলিতভাবে ঈসালে সওয়াব করার খুব রেওয়াজ। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী বহু মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়। কখনো বা মসজিদে ঘোষণা করা হয়। কেউ না এলে বা উঠে চলে গেলে দোষারোপ করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন এটাই ঈসালে সওয়াবের একমাত্র পন্থা! এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ঈসালে সওয়াবের কিছু কাজ এমন আছে, যা সম্মিলিতভাবে যেমন করা যায় তেমনি একা একা করতেও অসুবিধা নেই। শরীয়ত বিশেষ কোনো পন্থা নির্দিষ্ট করে দেয়নি। এজন্য বিশেষ কোনো পন্থাকে শরীয়তের পক্ষ থেকে জরুরি মনে করা বিদআত। থানবী রাহ. বলেন, اگر وہ کام کرناہی ہے تو یہ کرو کہ اس کی صورت بدل دو، تاکہ عوام پر برا اثر نہ پڑے اور کام بھی ہو جائے ، میری ہمشیرہ کا جب انتقال ہوا تو طالب علموں نے کہا کہ اگر اجازت ہو تو ہم جمع ہو کر قرآن شریف پڑھ دیں، میں نے کہا کہ پڑہو، لیکن جمع ہوکر نہ پڑہو، بلکہ ہرشخص اپنے حجرے میں بیٹھ کر جتنا جی چاہے پڑھ دے، اور اس میں راز یہ ہے کہ جو کام خدا کے لئے نہیں ہوتا وہ مقبول نہیں ہوتا، اور ثواب بخشنے کی حقیقت یہ ہے کہ اپنا ثواب دوسرے کو دیاجائے ،تو جب اپنے ہی کوثواب نہ ملا تو دوسرے کو کیا چیز دی جائےگی، اور جب جمع ہوکر پڑہاجائے گا تو چار آدمی تو اللہ کے واسطے پڑہیں گے اور دس آدمی محض شکایت سے بچنے کے لئے، ان کی نیت ہوگی کہ اگر ہم نہ پڑہیں گے تو یہ دل میںمجھیں گے کہ دیکھوں ان کو ہم سے تعلق کم ہے، تو ایسے لوگوں کو خود ہی ثواب نہ ملیگا پھر وہ اس مرحومہ کو کیا بخشیں گے؟ اس لئے اگر تم پڑھنا چاہو تو حجرے میں بیٹھ کر پڑھو اور پھر پڑھنے کےبعد بھی مجھے خبر نہ کرو کہ کس نے پڑہا اور کتنا پڑہا، کیونکہ خبر کرنے سے پھر میری خوشی کا خیال ہوگا، اس کے جواب میں لوگ کہتے ہیں کہ یوں تو کوئی بھی نہ پڑہے گا ، میں کہتاہوں کہ رسم کے طور پر ہونا بھی تو نہ ہونے کے برابر ہے، پھر اگر مان لو کہ کسی نے بھی نہ پڑھا تو کیا نقصان ہوگیا ، اب بھی نہ ہوگا اس وقت بھی نہ ہوا. যদি এটা করতেই হয় তাহলে রূপ বদলে দাও, যাতে সর্বসাধারণের উপর কুপ্রভাব না পড়ে এবং কাজও হয়ে যায়। আমার বোনের ইন্তেকাল হলে তালেবে ইলমরা বলল, অনুমিত হলে আমরা সমবেত হয়ে কুরআন শরীফ পড়ব। আমি তাদের বললাম, পড়, কিন্তু সমবেত হয়ে না। বরং প্রত্যেকে নিজ নিজ কামরায় বসে যত ইচ্ছে পড়। এর রহস্য হল, যে কাজ আল্লাহর জন্য করা হয় না এ তাঁর কাছে কবুল হয় না। আর ঈসালে সওয়াবের হাকীকত হচ্ছে নিজের সওয়াব অন্যকে দান করা। তো যদি নিজেই সওয়াব না পায় তাহলে অন্যকে কী দান করবে? আর সমবেত হয়ে পড়লে (উদাহরণস্বরূপ) চারজন তো আল্লাহর জন্যই পড়বে কিন্তু দশজন শুধু অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য পড়বে। তাদের নিয়ত এই হবে যে, আমরা না পড়লে তিনি মনে মনে বলবেন যে, দেখ আমার সাথে এদের সম্পর্ক কম। এধরনের মানুষ তো নিজেই সওয়াব পাবে না তাহলে এই মরহুমাকে কী পৌঁছাবে? এজন্য তোমরা পড়তে চাইলে কামরায় বসে পড় এবং পড়ার পর আমাকে জানানোরও দরকার নেই যে, কে কে পড়েছে এবং কতটুকু পড়েছে। জানানোর প্রসঙ্গ এলে আমাকে খুশী করার নিয়ত থাকতে পারে। কারো প্রশ্ন হতে পারে যে, তাহলে তো কেউই পড়বে না। আমি বলি, রসম রক্ষার জন্য পড়া আর না পড়া সমান। আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, কেউই পড়েনি তাহলে ক্ষতি কী? সওয়াব এখনও হবে না, আগেও হয়নি। -তাসহীলুল মাওয়ায়েয ২/৪২৯ লক্ষণীয়, হযরত রাহ.-এর কাছে যারা ঈসালে সওয়াবের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তারা স্বপ্রণোদিত হয়েই করেছিল। তাদেরকে দাওয়াত বা ঘোষণা কিংবা বোঝানো-সমঝানো কিছুই করা হয়নি। উপরন্তু তারা ছিল তালেবে ইলম। তা সত্ত্বেও তিনি সমবেতরূপে করার অনুমতি দেননি। বরং করতে চাইলে নিজ নিজ কামরায় একা একা করতে বলেছেন এবং কেন দেননি সেটাও স্পষ্ট বলে দিয়েছেন। এ কারণটা আমাদের উপলব্ধি করা ও স্মরণ রাখা চাই। আরো দ্রষ্টব্য : আহসানুল ফাতাওয়া ১/৩৬২ তিন. নামদাম বা সামাজিকতা অনেককে দেখা যায় সামাজিকতা রক্ষার জন্য ঈসালে সওয়াব করে। অর্থাৎ ঈসালে সওয়াব না করলে সমাজের লোকেরা কী বলবে! পিতা এত টাকাপয়সা বাড়িঘর জমিজমা রেখে গেছে অথচ ছেলেরা দুজন মিসকীনকে পর্যন্ত এক বেলা খাওয়ালো না! কারো কারো মনোভাব থাকে এরকম যে, এটা আগে থেকে চলে আসছে এবং সবাই করে, চল আমরাও করি। কেউ কেউ আবার তা করে সুনাম-সুখ্যাতি লাভের জন্য। মানুষ বলবে অমুকের ছেলেরা বিরাট ঈসালে সওয়াবের আয়োজন করেছে! অথচ মাইয়িতের কাছে কোনো আমলের সওয়াব শুধু তখনই পৌঁছতে পারে যদি তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়। আর আল্লাহর কাছে আমল গৃহীত হওয়ার অন্যতম শর্ত হল নিয়ত সহীহ হওয়া। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করা। সামাজিকতা বা সুনাম-সুখ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে করা আমল তাঁর কাছে কিছুতেই কবুল হয় না। তো যদি খোদ আমলকারীই সওয়াব না পায় তাহলে মাইয়িতকে তিনি কী পৌঁছাবেন? তাই আগে ঈসালে সওয়াবের স্বরূপ ও প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করুন। তারপর করার দিকে মন এগুলে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে করুন। থানবী রাহ. লেখেন, اکثر جگہ دستور ہے کہ کچھ معین تاریخوں میں یا ان کے قریب قریب آگے پیچھے کھانا پکاکر برادری میں تقسیم ہوتا ہے اور کچھ مساکن کو کھلاتے ہیں اور اس کا ثواب مردے کو بخشتے ہیں ، اس میں بھی وہی قصہ ریاء وتفاخر کا ہے ، اور اتباع رسم کی وجہ سے اس کی ایسی پابندی ہے کہ بعض اوقات قرض لے کر کرتے ہیں، اور اگر کو‎ئی ان سے کہے کہ جتنے دام اس میں صرف کرتے ہیں وہ دام خفیہ طور پر دے دو تو یہ ہرگز گوارا نہ ہو اور یہی خیال کریں کہ وہ اس قدر خرچ بھی کیا اور کسی کو اطلاع بھی نہ ہو‎ئی. অধিকাংশ জায়গায় এ রেওয়াজ আছে যে, নির্দিষ্ট কিছু তারিখে বা কিছু আগে-পিছে খাবার পাকিয়ে সমাজের লোকদের মাঝে বিতরণ করা হয়, কিছু গরীব-মিসকীনকে খাওয়ানো হয় এবং মাইয়িতের জন্য সওয়াব পৌঁছানো হয়। কিন্তু এখানেও রিয়া ও গর্ব উদ্দেশ্য থাকে এবং রসমের কারণে এর এত পাবন্দি যে, কখনো কখনো ঋণ পর্যন্ত নেওয়া হয়। কেউ যদি তাকে বলে যে, এখানে যা খরচ করবেন তা গোপনে দান করে দিন, তাহলে তিনি কিছুতেই রাজি হবেন না। মনে করবেন যে, এত কিছু খরচ করলাম অথচ কেউই জানল না! -ইসলাহুর রুসূম পৃ. ১৪২-১৪৩ চার. প্রকাশ্যের প্রবণতা কারো কারো মধ্যে ঈসালে সওয়াব প্রকাশ্যে করার প্রবণতা বেশি। এর উদাহরণ আমরা একটু আগে থানবী রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে দেখেছি। অথচ ঈসালে সওয়াব একটি নফল আমল। আর নফল আমলের ক্ষেত্রে শরীয়তে গোপনীয়তার প্রতি বেশি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এটা ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়তের পক্ষে সহায়তা করে। পক্ষান্তরে প্রকাশ্যে করলে তাতে ত্রুটি সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে। এজন্য হাদীসে নফল আমল বিশেষত দান-খায়রাত গোপনে করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই হাদীস তো সকলেরই জানা থাকার কথা যে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণির মানুষকে তাঁর আরশের ছায়াতলে জায়গা দিবেন। তার মধ্যে এক শ্রেণি হল, وَرَجُلٌ تَصَدّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ. যে এমন গোপনে দান করেছে যে, ডান হাতে কী দান করেছে সেটা বাম হাত পর্যন্ত জানে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪২৩ থানবী রাহ. বলেন, اور وہ ثواب بخشنے کی ترکیب یہ ہے کہ داہنے ہاتھ دو اور بائیں کو خبر نہ ہوৃلوگ چاہتاہے نام بھی ہو اور ثواب بھی ہاتھ سے نہ جائے، سو دکھلادے میں ثواب کہاں اور الٹا عذاب ہے. সওয়াব পৌঁছানোর নিয়ম হল, ডান হাতে এমনভাবে দান করবে যে, বাম হাতেরও খবর হবে না। ...মানুষ চায় নামও হোক আবার সওয়াবও হাত থেকে ছুটে না যাক। কিন্তু দেখানোর উদ্দেশ্যে করলে কী সওয়াব হবে? উল্টো গোনাহ হবে। -তাসহীলুল মাওয়ায়েয ২/১৪৫ পাঁচ. যিয়াফত সমাজে যিয়াফত তথা মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর প্রচলন এত বেশি যেন এটা ছাড়া ঈসালে সওয়াব হয় না; বরং কতক মানুষ ঈসালে সওয়াব বলতে শুধু যিয়াফতকেই বুঝে। কেউ কেউ সন্তানদেরকে এর অসিয়ত করে যায়। কেউ কেউ আবার নিজের জীবদ্দশায়ই তা সেরে ফেলে। যিয়াফত না করলে দোষারোপ করা হয়। এটা সম্পূর্ণ ভুল। যে কোনো নেক কাজ করে ঈসালে সওয়াব করা জায়েয। এ ক্ষেত্রে শরীয়তে বিশেষ কোনো কাজ নির্দিষ্ট নয় যে, তা-ই করতে হবে। এ কারণে নির্দিষ্ট কোনো কাজকে শরীয়তের পক্ষ থেকে জরুরি মনে করলে তা বিদআত হবে। দ্বিতীয়ত, এধরনের যিয়াফতে ধনী-গরীব উভয়কে দাওয়াত দেওয়া হলেও গরীবরা থাকে নামমাত্র। অথচ তারাই এর প্রকৃত হকদার। তৃতীয়ত, অনেক সময় এ যিয়াফতের আয়োজন করা হয় যৌথ সম্পদ থেকে। এক্ষেত্রে সকল ওয়ারিশের স্বতঃর্স্ফূর্ত সম্মতি আছে কি না তা যথাযথ খেয়াল করা হয় না। ওয়ারিশদের মধ্যে কেউ এমনও থাকতে পারেন যিনি অন্য কোনোভাবে ঈসালে সওয়াব করতে চান। যেমন দুআ, নামায, কুরআন তিলাওয়াত...। তার কাছ থেকে জোরপূর্বক যিয়াফতের খরচ নেওয়া কিছুতেই জায়েয হবে না। মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রাহ. লিখেছেন, رسم ورواج کے ما تحت مخصوص تاریخوں میں کھانا پکانا اور اسے ضروری سمجھنا اور نہ کرنے والے کو ملامت طعن وتشنیع کرنا ،برادری کو کھلانا یہ تمام باتیں بے اصل اور بدعت ہے، اور ترکہ مشترکہ میں سے یہ مصارف کرنا اور نابالغ یا غائب وارثوں کے حصوں میں سے جبرا یہ رقوم وضع کرنا حرام ہے، سودی قرض لے کر یہ رسوم ادا کرنا خسر الدنيا والآخرة کا مصداق بننا ہے ، ان رسوم کا صحابۂ کرام تابعین عظام اور مجتہدین امت کے زمانوں میں نہ تعامل تھا ، نہ ان سے ان کا جواز منقول ہے، اس لئے یہ باتیں واجب الترک ہے. রসম ও রেওয়াজের জন্য নির্দিষ্ট তারিখে খাবার পাকানো, এটাকে জরুরি মনে করা, যারা তা করে না তাদের নিন্দা করা, সমাজের লোকদের খাওয়ানো এসবই ভিত্তিহীন ও বিদআত। যৌথ সম্পদ থেকে এর ব্যয় নির্বাহ করা, নাবালেগ বা অনুুপস্থিত ওয়ারিশের হিস্যা থেকে তা জোরপূর্বক কর্তন করা হারাম। সুদী ঋণ নিয়ে এই রসম পালন করা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় বরবাদ করার শামিল। এসকল রসম সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও মুজতাহিদ ইমামদের যামানায় না অনুসৃত ছিল, না তাঁদের থেকে এর বৈধতা প্রমাণিত আছে। এজন্য তা পরিহার করা জরুরি। -কিফায়াতুল মুফতী ৪/১১৮-১১৯ অন্যত্র বলেন, یہ کھانا اکثر ی طور پر رسم کے بموجب کیا جاتاہے اور اگر اس سے مقصد میت کو ثواب پہنچانا ہوتاہے تو اس کھانے کےمستحق نادار اور غریب لوگ ہیں، خویش اقرباء اور مالدار آدمی اس کے مستحق نہیں ہیں، اس میں غیرمستحقین کو شریک ہونا مکروہ ہے. সাধারণত এই খাবারের আয়োজন করা হয় রসমের জন্য। আর যদি মাইয়িতকে সওয়াব পৌঁছানো উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এর হকদার হচ্ছে গরীব-অসহায় মানুষ। আত্মীয়স্বজন ও ধনী লোকেরা এর হকদার নয়। তাদের এতে শরীক হওয়া মাকরূহ। -প্রাগুক্ত ৪/১১৬ আরো দেখুন : তাসহীলুল মাওয়ায়েয ২/১৪৫ আরেকটি বিষয় হচ্ছে গরীব-মিসকীনকে খাওয়ানো মূলত সদকার অন্তর্ভুক্ত। আর সদকার ব্যাপারে শরীয়ত কয়েকটি বিষয় লক্ষ রাখতে উৎসাহিত করে- (ক) গরীবদের প্রয়োজন একেকজনের একেকরকম। কারো খাবারের ব্যবস্থা আছে কিন্তু কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা নেই। কারো উল্টো। কারো আবার উভয়েরই ব্যবস্থা আছে কিন্তু অন্য কোনো প্রয়োজন মেটানোর জন্য নগদ অর্থের দরকার। তো যার যে জিনিসের প্রয়োজন তাকে সেটা দান করা উত্তম। অনেক সময় খাবার বা কাপড়ের চেয়ে নগদ অর্থ দান করা বেশি উপকারী হবে। নগদ অর্থ হলে সে নিজ প্রয়োজন অনুসারে খরচ করতে পারবে। -দ্রষ্টব্য : আহসানুল ফাতাওয়া ১/৩৫৬ (খ) সদকা দুই প্রকার। ১. সদকায়ে জারিয়া তথা যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাকি থাকে। ২. সদকায়ে গাইরে জারিয়া তথা যা অল্প দিনেই শেষ হয়ে যায়। সাধারণত সদকায়ে জারিয়ার মর্যাদা বেশি। এতে গরীবের দীর্ঘ মেয়াদী প্রয়োজন পূরণ হবে এবং তা যতদিন বাকি থাকবে ততদিন দানকারীর সওয়াবের সঞ্চয় সমৃদ্ধ হতে থাকবে। সদকায়ে জারিয়ার কিছু নমুনা এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রাসঙ্গিকতার কারণে তা এখানেও উল্লেখ করা হল। ১. মসজিদ নির্মাণ। ২. মকতব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা। ৩. পাঠাগার ও দ্বীনী কিতাবের ব্যবস্থা করা। ৪. ঈদগাহ বানানো। ৫. কবরস্থান করা। ৬. যে কোনো দ্বীনী কাজের জন্য জমি ওয়াফক করা। ৭. এতীম ও অসহায় লোকদের বাসস্থান ও উপার্জনের ব্যবস্থা করা। ৮. রাস্তা ও পুল নির্মাণ করা। ৯. পানির ব্যবস্থা করা। ১০. ফলদার বৃক্ষ রোপণ করা। ১১. সরাইখানা তৈরি করা। ১২. সীমান্ত পাহারা দেওয়া ইত্যাদি। ছয়. বিনিময় দিয়ে কুরআন পড়ানো ঈসালে সওয়াবের একটি মুবাহ পদ্ধতি হল কুরআন তিলাওয়াত। এ ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে নিজে তিলাওয়াত করা। নিজের তিলাওয়াতের মধ্যে মাইয়িতের প্রতি যে মহব্বত ও আন্তরিকতা থাকে অন্যের তিলাওয়াতে তা সবসময় থাকা জরুরি নয় এবং নিজের তিলাওয়াতের পর দুআ করলে যে ব্যথা ও জ্বলন অনুভব হয় অন্যের তিলাওয়াতের পর তা সর্বদা থাকা অনিবার্য নয়। কিন্তু সমাজে অন্যকে দিয়ে কুরআন পড়ানোর রেওয়াজই বেশি। তা-ও আবার বিনিময় দিয়ে। অথচ কুরআন তিলাওয়াত নামায-রোযার মত ‘ইবাদতে মাকসূদা’র অন্তর্ভুক্ত। আর এধরনের ইবাদতের বিনিময় দেওয়া-নেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয। হাদীসে এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। দু-একটি হাদীস লক্ষ করুন- আবদুর রহমান ইবনে শিবল রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পড় তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না। এর প্রতি বিরূপ হয়ো না। এর বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৫২৯ ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পড় এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর। তোমাদের পরে এমন এক জাতি আসবে যারা কুরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৯১৭ থানবী রাহ. লেখেন, دستور ہے کہ قبر پریا گھر پر حفاظ کو بٹھلا کر کہیں دس روز کہیں چالیس روز یا کم وبیش قرآن مجید ختم کراتے ہیں، پھر ان کو کچھ اسباب کچھ نقد وغیرہ دیتے ہیں، گو لوگ اس کو کوشش کرکے درست بنانا چاہتے ہیں، مگر بات کھلی ہوئی ہے کہ جب مقصود جانبین کا اجرت دینا لینا ہے اور طاعت پر اجرت لینا جائز نہیں، اس لئے یہ فعل ہر گز درست نہیں، نہ ایسے قرآن پڑھنے کا ثواب ملے ، جب پڑھنے والےکو نہ ملا تو مردہ کو کیا پہنچے گا. প্রচলন আছে যে, কবরের কাছে বা ঘরে হাফেযদের দিয়ে কোথাও দশদিন পর কোথাও চল্লিশদিন বা তার চেয়ে কিছু কমবেশি পর কুরআন মাজীদ খতম করানো হয়। তারপর তাদেরকে কিছু সামগ্রী, কিছু নগদ অর্থ ইত্যাদি প্রদান করা হয়। মানুষ এটাকে বৈধ বানানোর চেষ্টা করলেও বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিষ্কার। কেননা উভয় পক্ষের উদ্দেশ্য বিনিময় দেওয়া-নেওয়া। অথচ নেক কাজের বিনিময় নেওয়া নাজায়েয। তাই এ কাজটা কিছুতেই জায়েয নয়। এরূপ কুরআন পড়ার কোনো সওয়াব হবে না। তো যদি খোদ তিলাওয়াতকারীই সওয়াব না পায় তাহলে মাইয়িত কী পাবে? -ইসলাহুর রুসূম পৃ. ১৪৬ অন্যত্র বলেন, بعض لوگ کہتے ہیں کہ پھر ایصال ثواب کس طرح کریں؟ جواب یہ ہے جس طرح سلف صالحین کرتے تھے، بلا تقیید وتخصیص اپنی ہمت کے موافق حلال مال سے مساکین کی خفیہ مدد کریں، اور جو کچھ توفیق ہو بطور خودقرآن وغیرہ ختم کرکے اس کو پہنچادیں. কতক মানুষ বলে, তাহলে আমরা ঈসালে সওয়াব কীভাবে করব? জবাব হল, যেভাবে সালাফে সালেহীন করতেন। বিশেষ দিনক্ষণ বা বিশেষ নিয়ম-নীতি নির্দিষ্ট না করে নিজ সামর্থ্য অনুসারে হালাল সম্পদ থেকে গোপনে গরীব-মিসকীনদের সাহায্য করুন এবং যতটুকু তাওফীক হয় কুরআন শরীফ ইত্যাদি খতম করে এর সওয়াব পৌঁছে দিন। -প্রাগুক্ত পৃ. ১৪৬ আরো দেখুন : শিফাউল আলীল ওয়া বাল্লুল গালীল ফী হুকমিল ওয়াসিয়্যাতি বিল খাতামাতি ওয়াত্তাহলীল (রাসায়েলে ইবনে আবেদীন) ১/১৫৩-১৯২; রাফিউল ইশকালাত আলা হুরমাতিল ইস্তিজার আলাত্তাআত, মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. (মাজমূআয়ে রাসায়েলে ফয়যিয়্যা ৪র্থ খণ্ডের সাথে প্রকাশিত) সাত. নির্দিষ্ট দিনে কবর যিয়ারতকে জরুরি মনে করা মাইয়িতের উপকার করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল দুআ। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে তার মাগফিরাতের জন্য দুআ করা। আর তা যে কোনো দিন যে কোনো সময় এবং যে কোনো জায়গা থেকে করা যায়। কবরের কাছে গিয়ে করতেও অসুবিধা নেই। কবরের পাশে দুআর অতিরিক্ত ফায়েদা হচ্ছে, এতে আখেরাতের কথা স্মরণ হয়, মনদিল নরম হয় এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রেরণা জাগে। তাই ইসলামে শুরুর দিকে মূর্তিপূজা ও কবরপূজার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য কবর যিয়ারত থেকে নিষেধ করা হলেও পরবর্তীতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে মূল দুআর মত এর জন্যও দিনক্ষণ নির্দিষ্ট নেই। বরং যখন ইচ্ছে করা যাবে। কিন্তু কেউ কেউ নির্দিষ্ট কিছু দিনে কবর যিয়ারত করাকে এত জরুরি মনে করে যেন তা ওই দিনের বিশেষ আমল। তা-ও আবার জামাতবদ্ধ হয়ে এবং কেউ শরীক না হলে তাকে দোষারোপ করা হয়। যেমন ঈদুল ফিতরের দিন, ঈদুল আযহার দিন ইত্যাদি। এটা ভুল। ইউসুফ লুধিয়ানবী রাহ. (১৪২১হি.) লিখেছেন, دوم: شریعت نے جو چیز مطلق رکھی ہے اس میں اپنے سے قیود لگا لینا بدعت ہے ،مثلا شریعت نے زیارت قبور کے لئے کوئی وقت مقرر نہیں کیا، اب کسی بزرگ کی قبر پر جانے کے لئے وقت مقرر کر لینا اور اسی کو ضروری سمجھنا بدعت ہوگا. দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে শরীয়ত যে বিষয়কে উন্মুক্ত রেখেছে তাতে নিজের পক্ষ থেকে বিশেষ কিছু যোগ করা বিদআত। যেমন কবর যিয়ারতের জন্য শরীয়ত কোনো সময় নির্দিষ্ট করে দেয়নি। এখন কোনো বুযুর্গের কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়কে জরুরি মনে করলে তা বিদআত হবে। -ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুসতাকীম পৃ. ১১৩ আরো দ্রষ্টব্য : আহকামুত তাযিয়া ফিল ফিকহিল ইসলামী, ইনতিসার সায়ীদ আহমাদ নাসির পৃ. ১৩৮ আট. ওরস উদ্যাপন কিছু কিছু কবর বা মাযারে ওরস পালন করা হয়। কোথাও মাযারওয়ালার জন্মদিবসে কোথাও মৃত্যুদিবসে কোথাও বা অন্য কোনো দিনে। কিছুসংখ্যক লোক এটাকে ঈসালে সওয়াবের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যদি তাদের কথা সঠিক ধরেও নেওয়া হয় তবু এই প্রশ্ন বাকি থেকে যায় যে, ঈসালে সওয়াবের জন্য দিন-তারিখ নির্ধারিত করা এবং সেটাকে জরুরি মনে করা কি সুন্নাহসম্মত? অথচ ওরসের দিনকে এত জরুরি মনে করা হয় যে, কখনোই এর ব্যতিক্রম হয় না। ওরস উদ্যাপন বিদআত হওয়ার জন্য শুধু এটুকুই যথেষ্ট ছিল। অথচ এর সাথে আরো বহু নাজায়েয কর্মকা- যুক্ত আছে। যথা- (ক) কোথাও কোথাও ওরসে নাচগান ও মদ্যপানের আসর হয়। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও পর্দাহীনতা হয়। আর এগুলো প্রত্যেকটাই হারাম। (খ) জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস পালনের কোনো বিধান ইসলামে নেই। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন ও উম্মাহর মনীষী আলেমগণ তা কখনোই পালন করেননি। এটা মূলত বিজাতীয় অপসংস্কৃতি, যা থেকে হাদীসে কঠোরভাবে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ومن تشبه بقوم فهو منهم. যে কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫১১৫ আর ওরস জন্মদিবস বা মৃত্যুদিবসে পালিত হওয়ায় বিজাতির সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। (গ) মানত একটি ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহর জন্য করা যায়। অন্য কারো জন্য করলে তা শিরিক হবে। কিন্তু বহু মানুষ ওরসের দিনে মাযারওয়ালার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে। (ঘ) কারো কারো বিশ্বাস, ওরস না করলে জানমালের ক্ষতি হবে কিংবা কামাই-রোজগারে বে-বরকতি হবে। বলাবাহুল্য, এধরনের বিশ্বাস একেবারে ভিত্তিহীন। (ঙ) ইসলামের শিক্ষা হল আখেরাতের স্মরণ ও ঈমান-আমল সংশোধনের প্রেরণা জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে কবর যিয়ারত করা। আর সম্ভব হলে মাইয়িতের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা, তিনি যেন তাদের সুখেশান্তিতে রাখেন, গোনাহসমূহ মাফ করে দেন। কিন্তু কিছুসংখ্যক মানুষ তা না করে খোদ মাইয়িতের কাছেই সাধারণ উপায়-উপকরণ-ঊর্ধ্ব প্রয়োজনসমূহ পেশ করতে থাকে। যেমন রিযিক, সন্তান, সুখশান্তি, বিপদমুক্তি প্রভৃতি। যেন কবরওয়ালাই রিযিকদাতা, বিপদ থেকে মুক্তি দানকারী, সন্তান দানকারী এবং সুস্থতা-অসুস্থতা, জীবন-মরণ, লাভক্ষতি সবই তার হাতে। অথচ এসব বিষয়ে একচ্ছত্র অধিপতি হলেন একমাত্র আল্লাহ। অন্য কারো জন্য তা বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ তাওহীদ পরিপন্থী ও শিরিক। তাহের পাটনী রাহ. (৯৮৬হি.) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ- ولا تجعلوا قبري عيدا -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, أي لا تجتمعوا لزيارته اجتماعكم للعيد، فإنه يوم لهو وسرور، وحال الزيارة بخلافه، وكان دأب أهل الكتاب فأورثهم القسوة. অর্থাৎ তোমরা তা যিয়ারতের জন্য ঈদের মত সমবেত হয়ো না। কেননা ঈদ হচ্ছে আনন্দ-ফুর্তির দিন আর যিয়ারতের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পূর্বযুগের কিতাবীরা কবরের কাছে ঈদের মত সমবেত হত। ফলে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গিয়েছিল। -মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার ৩/৭১৭ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. (১১৭৬হি.) উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, هذا إشارة إلى سد مدخل التحريف كما فعل اليهود والنصارى بقبور أنبيائهم، وجعلوها عيدا وموسما بمنزلة الحج. এখানে দ্বীন বিকৃতির পথ বন্ধ করার দিকে ইঙ্গিত আছে যেটি ইহুদী ও খ্রিস্টানরা করেছিল। তারা তাদের নবীদের কবরকে ঈদ ও হজ্বের মৌসুমের মত বানিয়ে নিয়েছিল। -হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ২/১২০ কাজী সানাউল্লাহ পানীপতী রাহ. (১২২৫হি.) বলেন, لا يجوز ما يفعله الجهال بقبور الأولياء والشهداء، من السجود والطواف حولها، واتخاذ السرج والمساجد عليها، ومن الاجتماع بعد الحول كالأعياد ويسمونه عرسا. জাহেল লোকেরা ওলী ও শহীদদের কবরের সাথে যেসব আচরণ করে, যেমন একে সেজদা করা, প্রদক্ষিণ করা, আলোকসজ্জা করা, সেজদার স্থান বানানো, বছরান্তে সেখানে ঈদের মত সমবেত হওয়া, যাকে তারা ওরস বলে থাকে তা সম্পূর্ণ নাজায়েয। -তাফসীরে মাজহারী ২/৬৫ আরো দ্রষ্টব্য : ইসলাহুর রুসূম পৃ. ১২১-১২৮ নয়. ফাতেহা ইয়াযদাহম রবীউস সানির ১১ তারিখে আবদুল কাদির জিলানী রাহ. (৫৬১হি.)-এর নামে যে খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয় তা ফাতেহা ইয়াযদাহম বা গিয়ারভী নামে পরিচিত। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়- (ক) যেমনটি একাধিকবার বলা হয়েছে যে, ঈসালে সওয়াবের জন্য দিন-তারিখ নির্দিষ্ট নেই। অথচ ১১ তারিখকে এত জরুরি মনে করা হয় যেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত বিধান। এই দিন ছাড়া অন্য দিনে করতে বললে তারা কিছুতেই রাজি হবে না। এ থেকে বোঝা যায় যে, ফাতেহা ইয়াযদাহম দ্বারা শুধু ঈসালে সওয়াব উদ্দেশ্য নয়; বরং এটা তাদের কাছে এই দিনের একটি বিশেষ ইবাদত। (খ) কারো কারো বিশ্বাস, ফাতেহা ইয়াযদাহম না করলে জানমালের ক্ষতি হবে বা বরকতহানি ঘটবে। অথচ নামায-রোযার মত ফরয ও অকাট্য বিধানে অবহেলা করলে কিছুই যায় আসে না কিন্তু ফাতেহা ইয়াযদাহমে কিঞ্চিৎ ত্রুটি হলেও তারা জানমালের শংকায় পড়ে যায়। তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন তাবে-তাবেয়ীন, মুজতাহিদ ইমামগণসহ বড় বড় মনীষীদের ঈসালে সওয়াব না করলে এ আশংকা নেই যে, জানমালের ক্ষতি হয়ে যাবে; কিন্তু ফাতেহা ইয়াযদাহম না করলে বিরাট আশংকা তাদের! সন্দেহ নেই যে, এধরনের বিশ্বাস সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী এবং চরম বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন। (গ) আগে এটাও উল্লেখিত হয়েছে যে, ঈসালে সওয়াবের জন্য বিশেষ কোনো কাজ নির্দিষ্ট নয়। বরং যে কোনো নেক কাজের সওয়াবরেসানি করা জায়েয। অথচ এই দিনে খাবার-দাবার ও মিষ্টি-তাবারকের আয়োজনকে জরুরি মনে করা হয়। (ঘ) কিছুসংখ্যক লোকের নিয়ত তো আরো ভয়াবহ। তাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন নয়; বরং খোদ আবদুল কাদির জিলানী রাহ.-এর নৈকট্য লাভ করা। এক্ষেত্রে থানবী রাহ.-এর বয়ান থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কানপুরে এক মসজিদে দুজন তালেবে ইলমের মাঝে তর্ক হচ্ছিল। একজন বলছিল, যারা নিয়ায চড়ায় তাদের আকীদা সঠিক নয়। কেননা নিয়ায একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত। অথচ লোকেরা বুযুর্গদের জন্য নিয়ায চড়ায়। অপরজন বলল, তাদের আকীদা সঠিকই। নিয়ায আল্লাহর জন্যই চড়ানো হয়। আর বুযুর্গদের শুধু ঈসালে সওয়াব করা হয়। ইতিমধ্যে এক বৃদ্ধা একটি পাত্রে মিষ্টি নিয়ে এসে তা বড়পীরের নামে নিয়ায দেওয়ার জন্য বলল। যে তালেবে ইলম এটাকে নাজায়েয বলছিল সে বৃদ্ধাকে বলল, আপনি নিয়ায আল্লাহকে দিন আর বড়পীরকে এর সওয়াব দান করুন। মহিলাটি বলে উঠল, আল্লাহর নিয়ায তো আমি আগেই দিয়েছি, এটা বড়পীরের নিয়ায। -তাসহীলুল মাওয়ায়েয ২/৪২৭-৪২৮ এ থেকে কি এটা বোঝা যায় না যে, ফাতেহা ইয়াযদাহমের উদ্দেশ্য শুধু বড়পীরের ঈসালে সওয়াব নয়, বরং দান-খায়রাত ইত্যাদির মাধ্যমে যেমন আল্লাহর নৈকট্য অর্জন উদ্দেশ্য হয়, তেমনি ফাতেহা ইয়াযদাহমের মাধ্যমেও বড়পীরের নৈকট্য অর্জন ও তাঁকে খুশী করা তাদের উদ্দেশ্য? এজন্যই তা না করলে জানমালের ক্ষতি বা বরকতহানির শংকায় পড়ে যায়। থানবী রাহ. বলেন, دن مقرر کر نے یا گیارہویں نام رکھنے سےعوام کو اس لئے روکا جاتاہے کہ ان کے عقائد فاسد ہوتے ہیں، اور خواص کو اس لئے روکا جاتاہے کہ ان کی وجہ سے عوام کے عقائد فاسد ہوجاتے ہیں، ورنہ مباحات اصلیہ کو غیر مباح کون کہہ سکتاہے، پس ایصال ثواب اگر اس طور سے کرے جس میں فساد عقیدہ کا احتمال نہ ہو تو مضائقہ نہیں، اس کا طریقہ یہ ہے کہ نہ دن اور تاریخ کی تخصیص کرے، نہ کسی خاص چیز کی، اور اغنیاء اور گھر والوں نہ دے، اور اعلان کرکے نہ دے، اور کھانا وغیرہ سامنے رکھکر کچھ نہ پڑھے، اور یہ عقیدہ نہ کرے کہ حضرت ہماری مدد فرماویں گے، اور یہ نیت نہ رکھے کہ اس عمل کی برکت سے ہمارے مال اور اولاد میں برکت وترقی ہوگی، محض یوں سمجھے کہ انہوں نے ہم پر احسان کیا ہے کہ سیدھا راستہ کتابوں میں بتلاگئے، ہم ان کو نفع پہونچاتے ہیں کہ ثواب سے ان کے درجات بلند ہوں گے، بس اس طرح کرنے میں کوئی حرج نہیں. দিন নির্দিষ্ট করতে বা গিয়ারভী নাম রাখতে এজন্য নিষেধ করা হয় যে, এতে সর্বসাধারণের আকীদা নষ্ট হয়। নতুবা মৌলিকভাবে মুবাহ কোনো বিষয়কে কে অস্বীকার করবে? তো ঈসালে সওয়াব যদি এমনভাবে করা হয় যে, এতে কারো আকীদা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। আর এর নিয়ম হল দিন-তারিখ নির্দিষ্ট না করা। বিশেষ জিনিস নির্দিষ্ট না করা। ধনী ও আত্মীয়দের না দেওয়া। ঘোষণা করে না দেওয়া। খাবার ইত্যাদি সামনে রেখে কিছু না পড়া। এই আকীদা না রাখা যে, বড়পীর আমাদের সাহায্য করবেন এবং এই নিয়তও না করা যে, এতে আমাদের সম্পদ ও সন্তানের মধ্যে বরকত ও উন্নতি হবে। বরং শুধু এই নিয়ত থাকবে যে, আমাদের উপর তাঁদের এহসান ও অনুগ্রহ রয়েছে। তাঁরা দ্বীনি কিতাব লিখে আমাদের হেদায়েতের পথ দেখিয়ে গেছেন। আমরা তাঁদের কিছু সওয়াব পৌঁছাতে চাই। এতে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এভাবে করতে কোনো অসুবিধা নেই। -ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/৩০৭ আরো দ্রষ্টব্য : ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুসতাকীম পৃ. ১৯৮-২০২ দশ. ফাতেহা পাঠ কোথাও কোথাও ঈসালে সওয়াবের জন্য প্রস্তুতকৃত খাবারে কোনো মাওলানা বা পীর সাহেবকে দিয়ে সূরা-কালাম পড়িয়ে ফুঁক দেওয়ানো হয়। তারপর তা বিতরণ করা হয়। এটা ফাতেহা পাঠ (কোথাও কোথাও কুলখানি) নামে প্রসিদ্ধ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটা সুন্দর বলে মনে হলেও এতে বেশ কিছু আপত্তিকর বিষয় রয়েছে। যথা- (ক) সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের যুগে ঈসালে সওয়াবের এই প্রথা ছিল না। (খ) অনেকের ধারণা, খাবারে এভাবে ফাতেহা পাঠ না করা হলে তা কবুল হয় না এবং মাইয়িতের কাছে এর সওয়াব পৌঁছে না। বলাই বাহুল্য যে, এটা সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন কথা। (গ) গরীব-মিসকীনকে খাওয়ানো ঈসালে সওয়াবের একটি পদ্ধতি। এর আরো বহু পদ্ধতি আছে যেমন তাদের নগদ অর্থ দান করা, কাপড়-চোপড় দান করা প্রভৃতি। অথচ এসকল ক্ষেত্রে কখনোই ফাতেহা পাঠ করা হয় না। সুতরাং বিশেষ খাবারের ক্ষেত্রে তা করা অযৌক্তিকও বটে। মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রাহ. বলেন, مگر دونوں کا ثواب کے پہونچنے کی یہ شرط نہیں ہے کہ کھانا سامنے رکھ کر ہی پڑھا جائے، یہ اشتراط نہ شریعت سے ثابت ہے اور نہ معقول، کیوں کہ کھانے پر فاتحہ دینے والے بھی کپڑے یا پیسے کا ثواب پہونچانا چاہتے ہیں تو اس پر وہ بھی فاتحہ نہیں پڑھتے. আর্থিক ইবাদত হোক বা দৈহিক ইবাদত কোনোটি পৌঁছার জন্য এরূপ কোনো শর্ত নেই যে, খাবার সামনে রেখেই (কিছু) পড়তে হবে। এরূপ শর্তারোপ না শরীয়তের পক্ষ থেকে প্রমাণিত, না যুক্তিসঙ্গত। কারণ খোদ খাবারের মধ্যে ফাতেহা পাঠকারীই যখন কাপড়-চোপড় বা টাকা-পয়সার মাধ্যমে ঈসালে সওয়াব করে তখন ফাতেহা পাঠ করে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৪/১১২ আরো দ্রষ্টব্য : ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুসতাকীম পৃ. ২০২-২০৫

 

 

advertisement