জেরুজালেম : জোর যার মুল্লুক তার
আবদুল্লাহ নাসীব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছেন। তার পূর্বসূরি মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যে কাজটি এতদিন এড়িয়ে গেছেন সেটিই তিনি সম্পাদন করলেন। নেপথ্যে কী কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে তা আমাদের মতো সাধারণ লোকের জানার কথা নয়, তবে এই কাজটি তিনি এমন এক সময়ে করলেন যখন উত্তর কোরিয়ার সাথে তার বাগযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও উত্তর কোরিয়ার পক্ষ হতে নমনীয়তার লেশমাত্রও দেখা যায়নি। জেরুজালেম সংক্রান্ত এই ঘোষণা বিশ^মোড়লের প্রেস্টিজ রক্ষার কোনো ছুতা কি না তা ভবিষ্যতই বলে দিবে।
উত্তর কোরিয়ার প্রতি আমাদের বাড়তি কোনো আবেগ নেই, কিন্তু জেরুজালেম আমাদের গভীর আবেগের জায়গা। হাজার বছর ধরে এই ভূখ- ছিল নবী-রাসূলগণের পুণ্যভূমি, হকের দাওয়াত ও হক-বাতিলের যুদ্ধের এক খোলা ময়দান। বর্তমানেও এই ভূখ-টি বিশে^র কুফরী ও তাগূতী শক্তির চরম লাঞ্ছনার ক্ষেত্র। এই ভূমি নিরন্তর উন্মোচন করে চলেছে সভ্যতা ও মানবাধিকারের ভেক ধারণকারীদের প্রকৃত চেহারা। এই বাস্তবতাটুকুই খানিকটা আলোচনা করবার জন্য এই নিবন্ধের অবতারণা।
এই আকাশ-ভূমির স্রষ্টা আল্লাহ। তিনিই এর প্রকৃত মালিক। কাজেই এখানে তাঁরই ইবাদত হতে হবে এবং তাঁরই ফরমাবরদারি জারি থাকতে হবে। এই পয়গাম দিয়ে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং এক আল্লাহর ইবাদতকারী ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর হুকুম-আহকামকে শিরোধার্যকারী উম্মাহ তৈরি করেছেন। অন্যদিকে বিতাড়িত শয়তানও তার দাওয়াত অব্যাহত রেখেছে এবং মানবজাতিকে তাওহীদ থেকে বিচ্যুত করে শিরকের দিকে এবং আল্লাহর ফরমাবরদারি থেকে বিচ্যুত করে তার নাফরমানীর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এভাবে হক ও বাতিলের দ্বন্দের সূচনা হয়েছে এবং তা অব্যাহত থেকেছে। পৃথিবীর যে পবিত্র ভূখণ্ডে ইসলাম তথা আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণের দাওয়াতের বাহক অনেক নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে সেটি হচ্ছে বাইতুল মাকদিস ও এর আশপাশের অঞ্চল। এ অঞ্চল তাই এক বরকতময় অঞ্চল। আর এ কারণেই কিয়ামত পর্যন্ত নবী রাসূলগণের প্রকৃত অনুসারী তাওহীদের শিক্ষা ধারণকারী মুমিন মুসলমানের কাছে এই ভূমি বরকতের এবং এর ইতিহাসের সাথে যুক্ত তাদের আদর্শিক শেকড়।
এই ভূখ-ের প্রকৃত উত্তরাধিকারী তারাই, যাঁরা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর বিধানের সামনে সমর্পিত এবং সত্যিকার অর্থে নবী-রাসূলগণের শিক্ষার উত্তরাধিকারী। তারা হচ্ছেন একমাত্র মুসলিম উম্মাহ, যারা পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান এনে আল্লাহর আনুগত্য করেছেন। এখানে অন্য কারো ধর্মীয় উত্তরাধিকার দাবি করার সুযোগ নেই।
এই ভূখণ্ডের উপর নানা ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় অধিকার রয়েছে বলে যে কথাটি এখন ব্যাপক প্রচারিত তা একটি অতি সরল সমীকরণ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম তো সেটিই, যেটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যে ধর্মে আল্লাহর বাণী ও বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সংরক্ষিত। যে ধর্ম পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের শিক্ষা ও আদর্শের ধারাবাহিকতা।
এখানে শিক্ষা ও আদর্শই মূল, বংশ বা গোত্রের দাবি এখানে হাস্যকর। ইবরাহীম আ.-এর সর্বশেষ আদর্শিক উত্তরসূরি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারীগণ। কুরআন মাজীদ কত স্পষ্ট ভাষায় এই সত্য বর্ণনা করেছে-
اِنَّ اَوْلَی النَّاسِ بِاِبْرٰهِیْمَ لَلَّذِیْنَ اتَّبَعُوْهُ وَ هٰذَا النَّبِیُّ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ اللهُ وَلِیُّ الْمُؤْمِنِیْنَ .
নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে তারা ইবরাহীমের ঘনিষ্টতম, যারা তাঁর অনুসরণ করেছে এবং এই নবী ও যারা ঈমান এনেছে। আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৬৮
এইটুকু বুঝলে একথা বোঝাও কঠিন নয় যে, আল্লাহর নবী হযরত মূসা আ.-এর প্রকৃত উত্তরসূরি কারা? হযরত মূসা আ.-এরও প্রকৃত উত্তরসূরি শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মত। হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-
نَحْنُ أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ
‘তোমাদের চেয়ে আমরাই (হযরত) মূসা আ.-এর বেশি হকদার।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৩৪)
কারণ তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের যে পয়গাম নিয়ে পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরাম এসেছিলেন সেই পয়গামের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর এ কারণেই পূর্ববর্তী সকল নবী ও রাসূলের উপর ঈমান আনা ও তাদের মর্যাদা রক্ষা করা ইসলামে অপরিহার্য। পক্ষান্তরে ইহুদী সম্প্রদায়ের ইতিহাস- নবীগণের শিক্ষার বিরোধিতা ও নবী-রাসূলের শানে চরম ধৃষ্টতার ইতিহাস। এখানে সেসব দৃষ্টান্তের বিশদ উল্লেখের অবকাশ নেই। কাজেই ইহুদীদের মুখে নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারের দাবি নিতান্তই হাস্যকর।
ইমামুল মিল্লাতিল হানীফিয়্যাহ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বিবরণ কুরআন মাজীদে স্পষ্ট ভাষায় এসেছে-
وَ اِذِ ابْتَلٰۤی اِبْرٰهٖمَ رَبُّهٗ بِكَلِمٰتٍ فَاَتَمَّهُنَّ قَالَ اِنِّیْ جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ اِمَامًا قَالَ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ قَالَ لَا یَنَالُ عَهْدِی الظّٰلِمِیْنَ .
এবং স্মরণ কর যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন এবং তা সে পূর্ণ করেছিল। আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করছি। সে বলল, আমার বংশধরদের থেকেও। আল্লাহ বললেন, আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। -সূরা বাকারা (২) : ১২৪
কাজেই আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত জালিমেরা কখনোই মানবজাতির নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে না। এ হচ্ছে স্পষ্ট ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ।
ঐতিহাসিক দিক থেকেও এই ভূখণ্ডের উপর ইহুদীদের কোনো অধিকার নেই। এ বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা যায়। কিন্তু আপাতত তার প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের দেশের স্যেকুলার অনেক লেখকও মৌলিকভাবে তা আলোচনা করেছেন। তাদের আলোচনায়, যুক্তি-তর্কে অনেক ভুলভ্রান্তিও রয়েছে তবে মৌলিকভাবে ইহুদীদের অন্যায় দাবির প্রতিবাদে যা বলেছেন তার সবটা ভুল নয়। দৈনিক প্রথম আলোতে ‘জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের উন্মাদ খেলার পরিণাম’ শিরোনামে ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন-
‘...জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েলের দাবির ভিত্তিটা নাকি ঐতিহাসিক। পশ্চিমাদের অনেকেও মনে করে থাকেন, মিসরীয় দাসত্ব থেকে পালিয়ে হজরত মূসার নেতৃত্বে ইহুদিরা তৎকালীন কানান দখল করে বসত করে। ইহুদিদের ঈশ্বর এই ভূখ- তাদের উপহার দিয়েছেন। এখানেই তাদের সোলোমন ও ডেভিড (আরবি ভাষায় সোলায়মান ও দাউদ) শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। কিন্তু ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করলে তারা দুই হাজার বছরের জন্য উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। যে অল্পসংখ্যক ইহুদি সেখানে থেকে গিয়েছিল, সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমান বিজেতারা তাদের বহিষ্কার করে। এই দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে ইহুদি রক্ত আর কারও সঙ্গে মেশেনি, তারা রয়ে গেছে দুই হাজার বছর আগের মতোই খাঁটি বিশুদ্ধ এবং ইহুদিরা চিরকালের জন্য এক ও অখ- ‘জাতি’। চূড়ান্তভাবে ইউরোপে ইহুদি গণহত্যার পর ‘ইহুদিরা দেশহীন মানুষ হিসেবে মানুষহীন দেশ ফিলিস্তিনে ফিরেছে।’ তাদের প্রতিশ্রুত ইসরায়েল লোহিত সাগর থেকে শুরু করে জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত হবে একদিন। অর্থাৎ জর্ডান-সিরিয়ার বিরাট অঞ্চলসহ সমগ্র ফিলিস্তিনই হলো তাদের স্বপ্নের ইসরায়েল। এটাই তাদের সংবিধানে বলা আছে। আর এই মহান ইসরায়েল রাষ্ট্রের চিরকালীন অজেয় রাজধানী হলো জেরুজালেম।
‘বারবার পশ্চিমা গণমাধ্যম, ইতিহাস, বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সাহিত্যে এবং অবশ্যই হলিউডি চলচ্চিত্রে এই গল্প অকাট্য ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইহুদিদের ওপর শত শত বছর ধরে অত্যাচার ও গণহত্যা চালানো পাশ্চাত্য তার অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে সর্বদাই ইসরায়েলের অন্যায্য দাবির ব্যাপারে রাজি অবস্থায় থাকে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ ও ভূমি কবজায় রাখতে ইসরায়েলের মতো ধারালো অস্ত্র তো তাদের লাগবেই।
‘যা হোক, এই গল্পে বাদ সেধেছেন ইতিহাসবিদেরা। তাঁদের প্রধানতম হলেন তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক শ্লোমো স্যান্ড।...
‘স্যান্ড দেখিয়েছেন, বনি ইসরায়েল বলে যাদের কথা বাইবেলে বলা হয়েছে, আজকের ফিলিস্তিনি আরবেরাই (মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান মিলিয়ে) তাদের বংশধর। ভাষাতাত্ত্বিক ও ডিএনএ মিলের প্রমাণ তিনি হাজির করেছেন। হজরত ইব্রাহিমের বংশধরেরাই দিনে দিনে বংশবৃদ্ধি করে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়িয়েছে, এমন ধারণাও ঠিক নয়।
স্যান্ডের দাবি, দুই হাজার বছর ধরে ইহুদিরা এক জাতিভুক্ত ছিল না। বরং আরব ইহুদিরা আরবদের মতো, ইউরোপীয়রা ইউরোপীয় বংশধর এবং ইথিওপীয় কিংবা ভারতীয় ইহুদিরা যার যার জাতিরই বংশধর। আজকের ইহুদিদের রক্তে বহু জাতির রক্ত প্রবাহিত, জাতিগত বিশুদ্ধতার ধারণা তাই বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল।
এমনকি ইহুদি ধর্মগ্রন্থেও পবিত্র নগরীতে বসবাসে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছিল। কেননা, পবিত্র মাটিতে বসতি হলে পাপ ঘটার আশঙ্কা থাকে। ১৯ শতক পর্যন্তও ইহুদিদের কল্পনাতেও জেরুজালেমে ফিরার আকাক্সক্ষা দেখা যায় না। কেবল বৃদ্ধরা মৃত্যুর আগে জেরুজালেমে আসত, পবিত্র মাটিতে কবর পাওয়ার আশায়। মুসলমানরা যেভাবে মক্কায় কবর পাওয়ার পুণ্যের আশা করে, সেভাবেই।
‘সুতরাং ইসরায়েল সকল ইহুদীদের আদি বাসভূমি ছিল না, কেবল আরব ইহুদীরাই সেখানকার লোক।
‘স্লোমো স্যান্ড দেখিয়েছেন, একটি ইহুদী রাজ্য সত্যিই উচ্ছেদ হয়েছিল তবে সেটা কোনো আরবভূমি থেকে নয়। বরং পূর্ব ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলের তুর্কি বংশোদ্ভূত খাজাররা একসময় দলে দলে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেছিল, সেখানে তাদের রাজত্বও ছিল। এদের বংশধরদেরই ইউরোপের ভূরাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে আরবের বুকে শূলের মতো বিঁধিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। (প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭)
আমাদের দায়ীগণের এক কর্তব্য বর্তমান সভ্যতার অন্যায়-অবিচারের এই দৃষ্টান্তগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর মাজলুমিয়াতকে যুক্তি ও আবেগের সাথে তুলে ধরা এবং নিজেদেরকে ও গোটা উম্মাহকে ঈমান ও তাকওয়ায়, ইলম ও আমলে ঐ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা, যার নমুনা ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। শুধু এ পথেই আল্লাহ তাআলার মদদ ও নুসরত হাসিল হতে পারে।