প্রচলিত ‘ইঞ্জিল শরীফ’ কুরআনে বর্ণিত ইঞ্জিল নয়
আবু মাইসারা মুনশী মুহাম্মাদ মহিউদ্দিন
তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও কুরআনসহ নবীদের প্রতি নাযিলকৃত সকল কিতাব ওহী। সবই আল্লাহ তাআলার কালাম। তবে ধর্মীয় ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণে একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআনে কারীম ছাড়া অন্য সকল আসমানি কিতাব বিকৃতির শিকার হয়েছে। কোনোটিই তার মূল অবস্থায় বাকি থাকেনি। তাই আমাদের ভালোভাবে জেনে রাখা দরকার যে, আসমানি কিতাব তাওরাত বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের পুরনো নিয়মের প্রথম পাঁচ পুস্তক (আদিপুস্তক, যাত্রাপুস্তক, গণনাপুস্তক, লেবীয় পুস্তক ও দ্বিতীয় বিবরণ অথবা অন্য শব্দে পয়দায়েশ, হিজরত, লেবীয়, শুমারী ও দ্বিতীয় বিবরণ) নয়; বরং তাওরাত হচ্ছে সেই কিতাব, যা ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে দান করেছেন। যবুর কিতাবও বাইবেলের পুরনো নিয়মের ‘সামসঙ্গীত’ বা ‘গীতসংহিতা’ নয়; বরং আল্লাহ তাআলা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের উপর যে কিতাব নাযিল করেছেন তা হচ্ছে যবুর শরীফ। তেমনি আসমানি কিতাব ইঞ্জিল বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের নতুন নিয়ম কিংবা নতুন নিয়মের প্রথম চারটি কিতাব (মথি সুসমাচার, মার্ক সুসমাচার, লূক সুসমাচার ও যোহন সুসমাচার) নয়; বরং ইঞ্জিল সেই কিতাব, যা আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা ইবনে র্মাইয়ামকে ওহীর মাধ্যমে দান করেছেন এবং ঈসা আলাইহিস সালাম তা বনী ইসরাঈলের মাঝে প্রচার করেছেন।
মোদ্দাকথা, বাইবেলের পুরনো নিয়ম ও নতুন নিয়ম (প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফ)-এর কোনো গ্রন্থই ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত গ্রন্থ নয়। এগুলো পরবর্তীদের রচনা। কিন্তু এ রচনাগুলোর মূলকপিও খ্রিস্টানদের কাছে সংরক্ষিত নেই। এগুলোর রচয়িতা কে বা কারা, তাও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। বাইবেলের গ্রন্থগুলোর রচয়িতাদের ব্যাপারে খ্রিস্টানদের যেসব আলোচনা তাদের ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বের কিতাবাদিতে পাওয়া যায় তার সবটুকুই অনুমান ও ধারণাভিত্তিক-এ কথা খোদ খ্রিস্টান পণ্ডিত ও গবেষকগণও স্বীকার করেন। প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফের লেখকগণ কেউ ঈসা আলাইহিস সালামের হাওয়ারী ছিলেন না। তা ছাড়া এ গ্রন্থগুলো যাদের বলে দাবি করা হয় তাদের পর্যন্তও কোনো ‘মুত্তাসিল সনদ’ বা অবিচ্ছিন্ন-সূত্র খ্রিস্টানদের কাছে বিদ্যমান নেই।
। দুই।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদের মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন যে, কিতাবীরা আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত কিতাবে বিকৃতি সাধন করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিকৃত অংশ আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের অংশ নয়। আর যতক্ষণ বিকৃত অংশ নির্দিষ্ট করা না হবে বিকৃতি-মিশ্রিত কিতাবের উপর বিশ্বাস করা জায়েয হবে না। কিতাবীরা নিজেরা কিতাব রচনা করে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলে প্রচার করেছে-এ কথাও আল্লাহ তাআলা কুরআনের মাধ্যমে জানিয়েছেন।
আফসোস! কিতাবীরা মূল তাওরাত, যবুর ও ইঞ্জিল তো সংরক্ষণ করতে পারেনি, এমনকি এগুলোর বিকৃতি-যুক্ত নুসখাগুলোও সংরক্ষণ করতে পারেনি। তাদের হাতে এখন যা আছে তা বাইবেল, ঐশীগ্রন্থ নয়।
বাইবেল নামে তাদের কাছে যা রয়েছে তাও কিন্তু আপন অবস্থায় নেই। তাতেও তারা পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন করেছে। তারা বাইবেলে যে পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন করেছে তাও শাব্দিক ও অর্থগত উভয় প্রকারেই হয়েছে। শাব্দিক বিকৃতির অর্থ হচ্ছে শব্দের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন করা-চাই তা এক শব্দের স্থলে অন্য শব্দ বসিয়ে হোক বা কোনো শব্দকে বিলুপ্ত করে কিংবা কোনো শব্দ বৃদ্ধি করে। আর অর্থগত বিকৃতির অর্থ হচ্ছে শব্দের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন না করে বাক্যের মূল অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাখ্যা করা।
এই অর্থগত বিকৃতির বিষয়টি খ্রিস্টান পণ্ডিত ও গবেষকগণও স্বীকার করেন। তাদের মতে পুরনো নিয়মের পুস্তকগুলোর যেসব পদে ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, ইহুদিরা সেগুলোতে অর্থগত বিকৃতি সাধন করেছে। এমনিভাবে প্রটেস্ট্যান্টগণ স্বীকার করেন যে, পোপের অনুসারীরা (ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা) বাইবেলের পুরনো ও নতুন উভয় নিয়মের বিভিন্ন পদের বিকৃত ব্যাখ্যা করেছে। পোপের অনুসারীরাও এই অভিযোগ প্রটেস্ট্যান্টদের দিকে আরোপ করেছে। সুতরাং বাইবেলের পুরনো ও নতুন নিয়মে অর্থগত বিকৃতির বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত।
রইল বাইবেলের শাব্দিক বিকৃতি। বাইবেলে শাব্দিক বিকৃতিও হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। কখনো এক শব্দকে অন্য শব্দ দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে। বাক্যের মধ্যে অতিরিক্ত শব্দ সংযোজন করা হয়েছে। বাক্য থেকে কিছু শব্দ বিয়োজন করা হয়েছে। কখনো আবার বাক্য বা বাক্যাংশকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। কখনো পুরো ঘটনাকেই সংযোজন কিংবা বিয়োজন করা হয়েছে। এসবই বাইবেল ও প্রচলিত ইঞ্জিলের শাব্দিক বিকৃতির বিভিন্ন রূপ। প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত ধর্মগ্রন্থের বিশুদ্ধতা ও সূত্র-বিষয়ক গবেষকগণ সঠিক ও সুদৃঢ় প্রমাণভিত্তিক দাবি করেছেন যে, ইহুদি-খ্রিস্টানগণ তাদের ধর্মগ্রন্থে শাব্দিক বিকৃতি সাধন করেছেন এবং অনেক আধুনিক খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান গবেষকও শাব্দিক বিকৃতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
। তিন।
প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফের কী অবস্থা! খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ বলতে বিশেষভাবে বাইবেলের নতুন নিয়মের ২৭টি পুস্তিকার সমষ্টিকে বুঝানো হয়, যাকে বাংলায় ইঞ্জিল শরীফ ও নবসন্ধিও বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় নিউ টেস্টামেন্ট। আরবীতে আলআহ্দুল জাদীদ। আর বাইবেলের নতুন নিয়মের প্রথম চারটি পুস্তিকার প্রত্যেকটিকে বাংলায় সুসমাচার ও মঙ্গলসমাচার বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় গসপেল। আরবী ও উর্দূতে বলা হয় ইঞ্জিল। যেমন মথি সুসমাচার, মথি মঙ্গলসমাচার, গসপেল অফ ম্যাথিউ, ইঞ্জিলু মাত্তা, মাত্তা কি ইঞ্জিল ইত্যাদি। বুঝা গেল ইঞ্জিল শব্দটি (আরবী ও উর্দূ যে ভাষাতেই ব্যবহার করা হোক) ইংরেজি গসপেল ও বাংলা সুসমাচার শব্দের সমার্থবোধক; নিউ টেস্টামেন্ট বা নতুন নিয়মের সমার্থক নয়। বাইবেলের নতুন নিয়মের পুস্তিকার সমষ্টিকে ইংরেজিতে নিউ টেস্টামেন্ট বলা হয় আর প্রথম চারটিকে বলা হয় গসপেলস।
তেমনি নতুন নিয়মের পুস্তিকার সমষ্টিকে আরবীতে বলা হয় আলআহ্দুল জাদীদ আর প্রথম চারটিকে বলা হয় আনাজিল। নতুন নিয়মের পুস্তিকার সমষ্টিকে উদূর্তে বলা হয় আহাদ নামায়ে জাদীদ আর প্রথম চারটিকে বলা হয় আনাজিল। তবে বর্তমান বাংলাদেশের কিছু কিছু খ্রিস্টান সংগঠন নিউ টেস্টামেন্ট ও আলআহ্দুল জাদীদকে বাংলায় ইঞ্জিল শরীফ নামে প্রচার করছে এবং ২৭টি পুস্তিকার প্রত্যেকটি ইঞ্জিল শরীফের একেকটি খ- বা সিপারা নাম দিয়েছে।১ যেমন, প্রথম সিপারা : মথি, দ্বিতীয় সিপারা : মার্ক, পঞ্চম সিপারা : প্রেরিত, ২৭তম সিপারা : প্রকাশিত কালাম, প্রথম খ- : মথি, দ্বিতীয় খ- : মার্ক ইত্যাদি। কিন্তু আরবী ও উর্দূ ভাষায় ইঞ্জিল বলে নতুন নিয়মের শুধু প্রথম চারটি কিতাবকেই বুঝানো হয়। আর ইংরেজিতেও ইঞ্জিল শব্দের সমার্থবোধক শব্দ গসপেল বলে নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম চারটি কিতাবকেই বুঝানো হয়। তাহলে বাংলায় ইঞ্জিল শরীফের কেন এই অপব্যবহার? এ ধোঁকা বৈ কিছুই নয়, আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত আসমানি কিতাব ইঞ্জিলের প্রতি মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধকে কাজে লাগিয়ে ধোঁকা দেওয়ার পাঁয়তারা!
‘তফসিরুল ইঞ্জিল’ও এই ধোঁকারই একটি অংশ। মূলত এসবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবরচিত ও বিকৃত ‘নতুন নিয়ম’কে ‘ইঞ্জিল শরীফ’ এবং ‘নতুন নিয়মে’র ব্যাখ্যাগ্রন্থকে ‘তফসিরুল ইঞ্জিল’ বলে সরলমনা মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়া এবং আসমানি কিতাব ইঞ্জিল সম্পর্কে মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাসের ফায়েদা ওঠানো। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন।
। চার।
ধর্মীয় ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে আমরা বলতে পারি, মূল ইঞ্জিল এবং বিকৃতি ও নতুন করে রচনার ভিত্তিতে ইঞ্জিলের চারটি রূপ দাঁড়ায়। যথা :
এক. আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত প্রকৃত ইঞ্জিল।
দুই. নাযিলকৃত ইঞ্জিলের বিকৃতরূপ। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, বিকৃত অংশ আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের অংশ নয়।
তিন. মানব-রচিত ইঞ্জিল। ঈসা আলাইহিস সালামকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার পর অজ্ঞাত কারো লিখিত ঈসা আলাইহিস সালামের কয়েকটি জীবনী। যেগুলোকে খ্রিস্টম-লী ঐশী অনুপ্রেরণায় লিখিত বিশ্বাস করে ঐশী প্রত্যাদেশ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
চার. মানব-রচিত ইঞ্জিলের বিকৃতরূপ। (খ্রিস্টানদের ভাষায় অজ্ঞাত লেখকদের লিখিত ইঞ্জিলের সম্পাদিত, সংযোজিত ও পরিমার্জিতরূপ) যা বর্তমানে ‘ইঞ্জিল শরীফ’ কিংবা নতুন নিয়ম নামে পরিচিত।
ইঞ্জিলের এ চারটি রূপের প্রথমটি অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত প্রকৃত ইঞ্জিলের প্রতিই মুসলমানগণ ঈমান রাখেন। তারা বিশ্বাস করেন, এ ইঞ্জিলই আল্লাহ তাআলার কালাম, যা তিনি তাঁর বান্দা ও রাসূল র্মাইয়াম-তনয় ঈসা আলাইহিস সালামের উপর নাযিল করেছেন। এতে হেদায়েত ও নূর ছিল এবং এই ইঞ্জিলের শরীয়ত বনী ইসরাঈলের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত এই প্রকৃত ইঞ্জিল খ্রিস্টানগণ হারিয়ে ফেলেছেন। আর বাকি তিন রূপের সবগুলোই মানবীয় হস্তক্ষেপের ফসল। তাই সেগুলো ভ্রান্ত ও আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়ার অযোগ্য।
মোটকথা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকারের ইঞ্জিলও খ্রিস্টানদের কাছে নেই। আজকাল আমরা বাইবেল ও ইঞ্জিল নামে যেসব পুস্তক দেখতে পাই তা হচ্ছে ইঞ্জিলের চার রূপের চতুর্থ রূপ অর্থাৎ মানবরচিত ইঞ্জিলের বিকৃতরূপ (খ্রিস্টানদের পরিভাষায় অজ্ঞাত লেখকদের লিখিত ইঞ্জিলের সম্পাদিত, সংযোজিত ও পরিমার্জিত রূপ)।
আরেকটি কথা বলা মুনাসিব মনে করছি, তা হচ্ছে- যদি ইঞ্জিলের তৃতীয় রূপ অর্থাৎ মানবরচিত ইঞ্জিল (অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনী) আজও খ্রিস্টানদের কাছে অবিকৃত অবস্থায় থাকত আর নিশ্চিতভাবে জানা যেত যে এর লেখক কে বা কারা, লেখকদের নির্ভরযোগ্য হওয়ার বিষয়টিও যদি গ্রহণযোগ্য সূত্রে জানা যেত এবং লেখক থেকে কোনো ‘মুত্তাসিল সনদ’ বা অবিচ্ছিন্ন-সূত্র খ্রিস্টানদের কাছে বিদ্যমান থাকত, তবে আর কিছু না হোক এর মাধ্যমে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রামাণ্যজীবনী জানা যেত। এর কাছাকাছি একটি উদাহরণ হচ্ছে বার্নাবাসের ইঞ্জিল। বার্নাবাসের ইঞ্জিলকে যদিও ওহী বা ঐশী গ্রন্থ বলা সম্ভব নয়, তবে এটুকু তো বলা যেতেই পারে যে, বার্নাবাসের ইঞ্জিল হচ্ছে ঈসা আলাইহিস সালামের অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনীগ্রন্থ।
। পাঁচ।
প্রচলিত ইঞ্জিল সম্পর্কে খ্রিস্টানগণ বড় আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার। তারা অনেক সময় প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তরে বলেন থাকেন, ঈসা আলাইহিস সালামই হলেন ইঞ্জিল অর্থাৎ সুখবর বা সুসংবাদ। তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কোনো কিতাব নয়, বরং ইঞ্জিল হল ঈসা আলাইহিস সালামের বাণী বা শিক্ষা, যা ‘ইঞ্জিল’ কিতাবে পাওয়া যায়। খ্রিস্টানদেরকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, ইঞ্জিল কিতাব চারটি কেন? হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উপর নাযিলকৃত ইঞ্জিল তো ছিল একটি কিতাব, চার ইঞ্জিল কোত্থেকে এল? এসব প্রশ্নের উত্তরে তাদের আত্মপ্রবঞ্চিত উত্তর হচ্ছে-
‘এটা আল্লাহর নাযিলকৃত ইঞ্জিল ঠিকই, কিন্তু তা ঈসার জীবনকালে একটি বই ছিল না; বরং তা ছিল একটি বাণী বা শিক্ষা। সেই শিক্ষা ‘ইঞ্জিল’ কিতাবের মধ্যে পাওয়া যায়। ...অন্যান্য নবী লিখিত বাণী (আল্লাহর কালাম) নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু হযরত ঈসার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তিনি নিজেই আল্লাহর জীবন্ত বাণী ছিলেন এবং এ জন্য তাঁর কিতাব (ইঞ্জিল) অপ্রধান, বরং হযরত ঈসাই প্রধান বাণী। ইঞ্জিল কিতাব হচ্ছে আল্লাহর জীবন্ত বাণীর জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে পাক-রূহের পরিচালনায় লিখিত সাক্ষীদের পবিত্র লিখিত বর্ণনা...।’
প্রচলিত ‘তফসিরুল ইঞ্জিলে’র ভূমিকার একটি বাক্য আরো বিস্ময়কর। তাতে লেখা হয়েছে, ‘প্রাথমিক যুগের ঈসায়ীরা পুরাতন নিয়মকেই তাদের পাক-কিতাব বলে গ্রহণ করেছিল। কারণ তখনও ইঞ্জিল শরীফ কিতাব আকারে লেখা হয়নি।’
তাহলে তো বলতে হবে ঈসা আলাইহিস সালামের কাছেও ইঞ্জিল কিতাব ছিল না?
এসব আত্মপ্রবঞ্চনার উত্তরের জন্য ঈসা আলাইহিস সালামের একটি কথাই যথেষ্ট। ঈসা আলাইহিস সালামের মুখের কথা কুরআনে এসেছে এভাবে-
قَالَ اِنِّیْ عَبْدُ اللهِ اٰتٰىنِیَ الْكِتٰبَ وَ جَعَلَنِیْ نَبِیًّا.
‘সে (শিশু ঈসা) বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন।’ -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৩০
। ছয়।
প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তরে খ্রিস্টানগণ যদিও এ কথাই বলেন যে, ‘ঈসা আলাইহিস সালাম ইঞ্জিল লাভ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা ঈসার জীবনকালে একটি বই ছিল না, বরং তা ছিল একটি বাণী বা শিক্ষা। সেই শিক্ষা বর্তমান ‘ইঞ্জিল’ কিতাবের মধ্যে পাওয়া যায়।’ কিন্তু তারাই আবার পরক্ষণে বলে বেড়ান, ‘ইঞ্জিলের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। ইঞ্জিলকে আসমানী কিতাব বলা হয়েছে। আল্লাহর কালাম বলা হয়েছে । আরো বলা হয়েছে হেদায়েত ও নূর।’ খ্রিস্টানদের এই বিপরীতমুখী দাবি প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। একদিকে বলা হচ্ছে ইঞ্জিল কোনো কিতাব নয়, অন্যদিকে দাবি করা হচ্ছে ইঞ্জিলের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। অথচ স্বীকৃত সত্য হল কুরআনে কারীমে যে ইঞ্জিলের কথা বলা হয়েছে তা আল্লাহর নাযিলকৃত একটি কিতাব। কুরআন নিজেই এ বিষয়ের সাক্ষ্যদাতা। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব কখনোই ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনী নয়, খ্রিস্টানদের কাছে স্বীকৃত ও প্রচলিত ‘ইঞ্জিল শরীফ’ নয়।
সারকথা, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উপর নাযিলকৃত ইঞ্জিল একটি কিতাব ছিল। তা তাঁর জীবনকালেও ছিল এবং এই ইঞ্জিলের কথাই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং আমরা বলতেই পারি, প্রচলিত ‘ইঞ্জিল শরীফ’ কুরআনে বর্ণিত ইঞ্জিল নয়।