হযরতজীগণের হেদায়েতের আলোকে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে ব্যক্তি নয় কাজই মুখ্য
রাইয়ান বিন লুৎফুর রহমান
আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন। [দ্র. সূরা মায়িদা (৪) : ৩] কিয়ামত পর্যন্ত তিনি নিজে এই দ্বীন এবং এই দ্বীনের সূত্র হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। [দ্র. সূরা হিজর (৪৯) : ৯] তিনি এই ঘোষণাও করেছেন যে, এই দ্বীনকে অন্য সকল ধর্ম ও মতাদর্শের উপর বিজয়ী করবেন। [দ্র. সূরা সফ (৬১) : ৯]। এই দ্বীনের হেফাযত ও সংরক্ষণ এবং এর প্রচার-প্রসারের জন্য যখনই যে ধরনের খেদমতের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাঁর কিছু বান্দার অন্তরে সে প্রেরণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নববী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন আঙ্গিকে খেদমতে দ্বীন ও নুসরতে দ্বীনের যত কাজ হয়েছে সেদিকে তাকালে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যত কাজ হয়েছে, সবই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে গায়েবী ব্যবস্থাস্বরূপ ছিল এবং যাঁদের দ্বারা এসকল বিশাল বিশাল কর্ম সম্পাদন হয়েছে, তাঁরা শুধু উসীলা বা মাধ্যমই ছিলেন। এটা যেন আল্লাহর রাসূলের এই হাদীসেরই বাস্তব রূপ- ‘আল্লাহ তাআলা সর্বদা এই দ্বীনের মধ্যে কিছু চারা রোপণ করতে থাকেন, যাদেরকে তিনি তাঁর আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করেন।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৭৮৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩২৬
বিগত শতাব্দীতেও আল্লাহ তাআলা এতদঞ্চলে এ ধরনের অসংখ্য নমুনা কায়েম করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে দাঈ ইলাল্লাহ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত তাবলীগ জামাত দ্বারা সমগ্র বিশে^ মুসলিম উম্মাহ অসাধারণ উপকার লাভ করেছে, হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. তাঁর এই দাওয়াতী নেযামের নিরাপদ ভবিষ্যতের লক্ষ্যে বেশ কিছু উসূল ও নিয়মের পাবন্দ ছিলেন, সাথীদেরকেও পাবন্দ বানিয়েছিলেন। বিশেষ করে অতীতের বিভিন্ন দ্বীনী তাহরীক থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, কোনোভাবেই এই দাওয়াতী মেহনত যেন তাঁর ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে পরিচালিত না হয়। কেননা এতে ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথে আন্দোলনেরও অপমৃত্যু ঘটার আশংকা থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাবলীগী জলসা ও ইজতিমাসমূহে যিনি বয়ান করেন তাঁর নাম ঘোষণা করা হয় না। উদ্দেশ্য এটাই যে, এই মেহনতের কর্মীগণ যাতে কাজের পরিবর্তে কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তি বিশেষকেই যেনো মূল লক্ষ্য না বানিয়ে ফেলে এ প্রসঙ্গে এই দাওয়াতী মেহনতের তিন প্রাণপুরুষ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ., হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ., হযরত মাওলানা ইনআমুল হাসান রাহ.-এর কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হল।
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নূমানী রাহ. লিখেছেন-
مولانا کی سيرت وسوانح کے سلسلے ميں ہم عرصے تک متأمل رہے، مولانا اس کی ہميشہ تاکيد فرماتے رہے کہ ان کی دعوت کو ان کی شخصيت کے سا تھ وابستہ نہ کيا جائے ، وہ کسی طرح اس کے روادار نہ تھے کہ ان کی شخصيت کی طرف دعوت دی جائے اورآ خر ميں اس کو بھی پسند کرتے تھے کہ دعوت کے تعارف کے سلسلے ميں ان کا نام بھی لياجائے، يہ احتياط، تواضع، بے نفسی اور اخلاص کے علاوہ اہم دينی مصالح پر مبنی تھی۔
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রাহ.-এর জীবন-চরিত সংকলন প্রশ্নে দীর্ঘদিন আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কেননা সবসময় তিনি দাওয়াতকে তাঁর ব্যক্তিত্বের সাথে যুক্ত না করার কথা জোর তাগিদ দিয়ে বলতেন, তাঁর ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে মানুষকে দাওয়াত দেয়া কোনোক্রমেই তিনি বরদাশত করতেন না। এমনকি শেষদিকে তো দাওয়াতের পরিচিতি প্রসঙ্গেও তাঁর নাম উল্লেখ করা হোক- এটা তিনি অপছন্দ করতেন। বিনয়, আত্মবিলোপ ও ইখলাস ছাড়াও এ ধরনের সতর্কতা অবলম্বনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বীনী হিকমতও ছিল। (ভূমিকা : হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. আওর উনকী দ্বীনী দাওয়াত, পৃ. ৩৬)
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, এ বিষয়ে বড় হযরতজীর অবস্থান কতটা মজবুত ছিল। শুধু তিনি নন, দ্বিতীয় হযরতজী মাওলানা ইউসুফ রাহ.-ও এই উসূলের বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। কোনোভাবেই এই দাওয়াতী মেহনত এবং তাবলীগী ইজতিমাসমূহ যাতে তাঁর ব্যক্তিত্বনির্ভর না হয়ে যায় এদিকে খুবই সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। এ বিষয়ে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তৎক্ষণাৎ সাথীদের সাবধান করে দিতেন। একবার এক ইজতিমা অনুষ্ঠিত হওয়া হযরতজীর উপস্থিতির উপর নির্ভর করছিল। অংশগ্রহণ না করলে ইজতিমার আয়োজকদের অসন্তুষ্টির আশংকা ছিল। এই প্রেক্ষাপটে হযরতজী ইউসুফ ছাহেব রাহ. এক গুরুত্বপূর্ণ পত্র লেখেন, যা নিচে উল্লেখ করা হল। তিনি লেখেন-
کئی دن کی رد وقدح وصلاح ومشورے کے بعد استخا رہ کر کے اور کراکے یہی چیز سمجھ میں آئی کہ اپنی ذات پر جو اجتماعات کا رخ پرتا چلا جارہا ہے اگر چہ اس ميں فوری طور پڑ اجتماع کے موقع پر احباب ميںعمومی تأثر پید ا ہوجا تا ہے اور اوقات کی تفریغ کی بھی عام مجمع ميں صورت پیدا ہو جاتی ہے مگر اس کی بقا کےلئے اس ما حول کے پرا نے احباب کے يہاں آنے کی صورتيں قابو نہيں آتيں۔ اسلئے اس عمل کے سطحی ہو نے اور اپنے نازک اصولوں سے ہٹ جانے کا قوی خطرہ ہے جوخير کے متوجہ ہونے اور رحمت کے دروازے کھلنے کے بجا ئے مضرت اور شرکے متوجہ ہونے کا بھی ذريعہ بن سکتا ہے علاوہ ازيں ايک کام جو اس زما نے میں عنقا ہے جماعت کی ايک مخصوص جد وجہد کے ذريعے اسکی شکليں اللہ رب العزّت بڑھا رہے ہيں جماعت اور مخصوص جدو جہد سے ذہن ہٹ کر شخصيّت اورتقريروں کی طرف ذہنوں کے امالہ کی صورتيں اجتماعات سے پيدا ہورہی ہيں جوشخص اور کام دونوں کی اضاعت کے مرادف ہے اور خطرے کا باعث ہے، دوچار دن میں ان ساری شکلوں اور نزاکتوں پر کيسے ايک مجمع کو ڈالا جاسکتا ہے جن کی رعايت کے بيرا يہ کام اپنے ميں رحمتوں کو لئے ہوئے نہيں ہے، بندہ کی غير موجود گی اگر چہ طبائع پر شاق ہے مگر جماعت کی محنت کے لئے ايک موقع ہے۔
কয়েকদিন যাবৎ আলোচনা-পর্যালোচনা ও পরামর্শের পরে ইসতেখারা করে এবং অন্যদের দ্বারা করিয়ে এই কথাই বুঝে এসেছে যে, ইজতিমাসমূহের রোখ যে (আমার) নিজের দিকে হচ্ছে, এতে যদিও তাৎক্ষণিকভাবে ইজতেমায় সাথীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব হয় এবং আম-মজমায় সাথীদের সময় ফারেগ করারও সুরত পয়দা হয়, কিন্তু এটা অব্যাহত থাকার জন্য এই মেহনতের পুরান সাথীদের এখানে আসার বিষয়টা সীমার ভিতরে থাকে না।
এ কারণে এর মধ্যে সাতহিয়্যাত বা অগভীরতা পয়দা হওয়ার এবং এর নাযুক উসূলসমূহ থেকে বিচ্যুত হওয়ার পূর্ণ আশংকা থাকে, যা কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়া এবং রহমতের দরজা খোলার পরিবর্তে ক্ষতি এবং অনিষ্টের দিকে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও একটি কাজ, যা বর্তমান যামানায় একেবারে দুর্লভ, জামাতের বিশেষ চেষ্টা-প্রচেষ্টায় এর পরিধি দিন দিন আল্লাহ বৃদ্ধি করছেন, এই অবস্থায় জামাত এবং বিশেষ চেষ্টা-প্রচেষ্টা থেকে সরে এসে ইজতিমাগুলোতে বিশেষ ব্যক্তি ও বিশেষ বয়ানের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা সাথীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, যা ব্যক্তি এবং কাজ উভয়টির জন্য ক্ষতিকর এবং ধ্বংসাত্মক। দুই-চার দিনের মেহনতে মজমাকে এসব উসূল ও মানসিকতার উপর কীভাবে উঠানো যেতে পারে, যা লক্ষ না করলে এই কাজ আমাদের জন্য রহমত নিয়ে আসবে না? আমার অনুপস্থিতি যদিও অনেকে মন মেনে নিতে পারছে না, কিন্তু এখন জামাতওয়ার মেহনতের মওকা তৈরি হল। (সাওয়ানেহে হযরত মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী রাহ., পৃ. ৭৫৪-৭৫৫)
উপরোক্ত চিঠি থেকেই বোঝা যায় হযরতজী ইউসুফ রাহ. তাবলীগী ইজতিমাগুলোতে মেহনত-মোজাহাদার পরিবর্তে বিশেষ ব্যক্তির উপস্থিতি এবং তাঁর বয়ানের প্রতি সাথীদের অত্যধিক গুরুত্বারোপকে কতটা অপছন্দ করেছেন এবং একে ব্যক্তি ও কাজ উভয়ের জন্য ধ্বংসাত্মক আখ্যায়িত করেছেন।
প্রথম দুই হযরতজীর ন্যায় তৃতীয় হযরতজী মাওলানা ইনআমুল হাসান রাহ.-ও এই তাবলীগী মেহনতকে তাঁর ব্যক্তির সাথে যুক্ত না করার প্রতি জোর তাকিদ করেছেন এবং ইজতিমাসমূহে তাঁর অনুপস্থিতিকে উপস্থিতি অপেক্ষা অধিক উপকারী বলেছেন।
১৩৯৬ হিজরী মোতাবেক ১৯৭৬ ঈসাব্দ সালে পরামর্শের ভিত্তিতে হযরতজী সিদ্ধান্ত নিলেন এই বছর বাংলাদেশের ইজতিমায় উপস্থিত হবেন না। সেই উপলক্ষে হযরতজী ইনআমুল হাসান রাহ. বাংলাদেশের আহলে শুরার উদ্দেশে (২১ রবিউল আওয়াল ১৩৯৬ হি. মোতাবেক ২৩ মার্চ ১৯৭৬ ঈ. তারিখে) একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র লিখে পাঠান, যা নিচে উল্লেখ করা হল। তিনি লেখেন-
بندہ نے تمام احباب سے بہت ہی زيا دہ را ئے لی آپ کے يہاں کے لئے، مگرکسی کی بھی را ئے نہ ہوئی۔ بندہ گو جسمانی حاضری نہ دے گا ليکن بندہ کی دعا اور دل کی پکار آپ کے سا تھ ہے۔ اللہ تعالی ہی کر نےوالاہے، بندہ آئے تب بھی اور نہ آئے تب بھی، بلکہ اپنی عدم حاضری بعض وجوہ سے حاضری سے زيادہ مفيد ہے، حاضری ميں مخلوق پر نظر آسکتی ہے، غير حاضری ميں صرف خالق پر نظر جمنے کا قوی امکان ہے، حاضری ميں بوجھ اوروں پر ہو سکتاہے، غير حاضری ميں سا را بوجھ آپ سب پر ہوگا جو تمام فتوحات غيب کے لئے مفتاح کا کام دے سکے گا۔
‘বান্দা আপনাদের এখানে আসার বিষয়ে সমস্ত আহবাবের রায় নিয়েছি। কিন্তু কোনো সাথী এখানে আসার পক্ষে মত দেননি। এ কারণে বান্দা এবার জিসমানীভাবে হাজিরা দিতে পারছি না। কিন্তু বান্দার দিল এবং দুআ আপনাদের সাথে থাকবে। বান্দা আসুক বা না আসুক তাতে কী আসে যায়, করবেন তো আল্লাহ তাআলা।
বরং অনেক দিক থেকে আমার অনুপস্থিতি, উপস্থিতি অপেক্ষা অধিক উপকারী। কেননা উপস্থিত হলে মাখলুকের উপর নযর আসতে পারে। কিন্তু অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে শুধু খালেকের উপর নযর থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আমি উপস্থিত হলে ভার অন্যের উপর থাকবে। অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে সমস্ত ভার আপনাদের উপর থাকবে, যা সমস্ত গায়বী মদদের চাবিকাঠি।’ (সাওয়ানেহে হযরতজী ছালেছ মাওলানা ইনআমুল হাসান রাহ. খ. ৩ পৃ. ১৭৮)
মোটকথা প্রত্যেক হযরতজী এই বিষয়ে ফিকিরমান্দ ছিলেন যে, এই তাবলীগী মেহনত যেন তাঁদের ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে পরিচালিত না হয়। বিশেষ করে ইজতিমাসমূহে তাঁদের উপস্থিতির প্রতি সাথীরা যেন অত্যধিক গুরুত্বারোপ না করে- এ বিষয়ে তাঁরা আরো বেশি সতর্ক ছিলেন। কিন্তু কেন যেন সাথিরা আজকাল বড়দের এই উসুল বোঝারই চেষ্টা করছে না, আল্লাহ মাফ করুন। কোনো কোনো সাথীর যবানে এমন কথাও শোনা যায়- ‘অমুক মুরব্বী যদি ইজতিমায় না আসেন তবে আমরা ইজতিমাই করব না।’ নাউযুবিল্লাহ। আবার কোনো কোনো সাথীকে দেখা যায়, কোনো মুরব্বী না আসলে ইজতিমার মাঠ ছেড়েই চলে যান। এই মেযাজ ও চিন্তা তিনই হযরতজীর মেযাজ ও চিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সবধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত হয়ে মধ্যপন্থার উপর অবিচল থেকে সবধরনের দ্বীনী খেদমত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।