স্মরণ রাখুন কর্মের লক্ষ্য, জীবনের উদ্দেশ্য
মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ
আমরা সবাই চাই অর্থপূর্ণ জীবন। অর্থহীন জীবন কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু কীভাবে জীবন অর্থপূর্ণ হয় এ বিষয়ে অনেকের সঠিক ধারণা নেই। আল্লাহ তাআলার অপার করুণা, ইসলামের শিক্ষার দ্বারা তিনি আমাদের দান করেছেন অর্থপূর্ণ জীবনের সংজ্ঞা ও সন্ধান। আর একমাত্র তাঁরই তাওফীকে আমরা পরিচালিত হতে পারি সফল-সার্থক জীবনের পথে।
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ .
জীবন তো আর কিছু নয়, বিশ্বাস ও কর্মের সমষ্টি। জীবন অর্থপূর্ণ হওয়া মানে কর্ম ও বিশ্বাস অর্থপূর্ণ হওয়া। কাজেই অর্থপূর্ণ জীবনের অধিকারী হতে হলে অর্থপূর্ণ কাজ করতে হবে।
অর্থপূর্ণ কাজ কি খুব কঠিন? আমার মাঝে কি নেই ভালো কাজের যোগ্যতা? এই সব প্রশ্নের আবর্তে পাক না খেয়ে চলুন আমরা বিষয়টি সহজভাবে চিন্তা করি। অর্থাৎ মহৎ ও অর্থপূর্ণ কাজ উদ্ভাবন করার বদলে আমরা আগে চিন্তা করি, সচরাচর যে কাজগুলো করে থাকি সেগুলোকেই কীভাবে অর্থপূর্ণ করে তোলা যায়।
প্রতিদিন কত কাজই তো আমরা করি, যেসবের ব্যাপারে আলাদা চিন্তার গরজও বোধ করি না। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম-বিশ্রাম, চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনা-কাটা, পড়া-শোনা, দেখা-সাক্ষাৎ, স্ত্রী-সন্তানকে সময় দেওয়া ইত্যাদি আরো কত কী। এসব আমাদের নিত্যদিনের কর্ম। বলা যায়, কর্মের এই চক্রেই আমাদের জীবন ও সময় আবর্তিত; জীবনের সিংহভাগ নিঃশেষিত। একবার ভাবুন দেখি, জীবনের এই প্রাত্যহিক কাজগুলোকেই যদি অর্থপূর্ণ করে তোলা যায় তাহলে কত সহজেই না আমাদের জীবন হয়ে উঠতে পারে অর্থপূর্ণ, মহিমাপূর্ণ!
কিন্তু কী সে উপায়, যার দ্বারা এই সকল কাজও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে? সেই উপায়টি হচ্ছে, কর্মের প্রেরণা ও উদ্দেশ্য ঠিক করে নেওয়া। জী, সহীহ নিয়ত, তথা সঠিক উদ্দেশ্য ও নির্ভুল প্রেরণার দ্বারা আমাদের প্রাত্যহিক কাজগুলোও পেতে পারে আলাদা মাত্রা; জীবনের ছোট-ছোট কাজগুলোও হয়ে উঠতে পারে মহিমাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ।
জীবনকে অর্থপূর্ণ করার এ এক বিকল্পহীন ব্যবস্থা, অন্যদিকে তা এক সহজ স্বাভাবিক উপায়ও বটে। কারণ প্রাত্যহিক কাজগুলোকে তো জীবন থেকে ছাঁটাই করা যাবে না, সে চিন্তা সমীচীনও নয়। তাহলে যে পথে এই কাজগুলোও তাৎপর্যপূর্ণ ও কল্যাণপূর্ণ হয় সে পথই অন্বেষণ করা যুক্তিযুক্ত। আর তা হচ্ছে, কর্মের লক্ষ্য ও জীবনের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করা এবং সকল কাজে তা চেতনায় জাগ্রত রাখা।
এই উপায় অবলম্বনের দ্বারা অতি সাধারণ একজন মানুষও উঠে যেতে পারেন সফলতার শিখরে, পেয়ে যেতে পারেন ব্যর্থতার গ্লানি থেকে নাজাত ও মুক্তি।
এই মহান শিক্ষাই দান করেছেন আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এই বিখ্যাত বাণীতে-
إِنّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّياتِ وَإِنّمَا لِكُلِّ امْرئٍ مَا نَوَى.
কর্মসমূহ তো নিয়তেরই সাথে। আর প্রত্যেকের জন্য আছে তা-ই যার সে নিয়ত করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১
মানুষের জীবন জুড়ে যত কাজ, যত প্রকারের কর্ম, তার পরিচয় ও পর্যায় নির্ণিত হওয়ার ক্ষেত্রে নিয়তের রয়েছে গভীর ভূমিকা। দু’জনের বাহ্যত অভিন্ন কর্মও সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যায় নিয়তের কারণে। নিয়তের এই প্রভাব পরিব্যাপ্ত আমাদের জীবনের সকল কর্মে। আহার-নিদ্রার মতো একান্ত ব্যক্তিগত কাজ থেকে শুরু করে বিয়ে-শাদী, জীবিকা উপার্জন, পরিবারের ভরণ-পোষণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন, দাওয়াত-জিহাদ, ইবাদত-বন্দেগী পর্যন্ত সবকিছুই নিয়তের বিধান ও প্রভাবের অধীন। বিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে জীবনের সকল কাজ পরিণত হয় নেক আমল ও ছাওয়াবের কাজে। পক্ষান্তরে অন্যায় অশুদ্ধ নিয়তের কারণে ইবাদত-বন্দেগী ও বাহ্যত দ্বীনী কাজগুলোও হয়ে যায় অর্থহীন, মূল্যহীন; বরং শাস্তি ও আল্লাহর অসন্তষ্টির কারণ।
কাজেই জীবনকে সফল ও অর্থপূর্ণ করার প্রথম উপায় হচ্ছে, প্রতিটি কাজের নিয়ত ও উদ্দেশ্য ঠিক করা। আর এটাই হচ্ছে মুমিন-জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ لَا شَرِیْكَ لَهٗ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ.
বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনও শরীক নেই আমাকে এরই হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং আনুগত্য স্বীকারকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম। -সূরা আনআম (৬) : ১৬২
এই যে কুরআনী শিক্ষা- ‘আমার জীবন ও মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য’, এতেই আছে জীবনের সকল কর্মের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বর্ণনা।
হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. এক জায়গায় এই আয়াতের ভাব ও মর্ম এভাবে বয়ান করেছেন-
‘মুমিন-জীবনের বিভিন্ন অংশ পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়; বরং তা একটি একক, যার সকল অঙ্গে বিরাজমান ইবাদতেও ছওয়াব প্রত্যাশার অভিন্ন প্রাণসত্তা। ঈমান ও ইয়াকীন এবং আল্লাহর হুকুমের তাবেদারিই হচ্ছে সকল কর্মের পথপ্রদর্শক। ইখলাস, সহীহ নিয়ত, আল্লাহ তাআলার রেযামন্দির সত্যিকারের প্রত্যাশা ও আম্বিয়ায়ে কেরামের নির্দেশিত নিয়মে সম্পন্ন হওয়ার দ্বারা জীবনের সকল অঙ্গন এবং কর্ম ও তৎপরতার সকল ক্ষেত্রই ‘ঈমানী যিন্দেগী’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। (দুস্তূরে হায়াত)
তো সূরাতুল আনআমের এই আয়াত হচ্ছে মুমিন-জীবনের কম্পাস। এরই আলোকে স্থির করুন কর্মের লক্ষ্য ও জীবনের উদ্দেশ্য। অতপর সকল কাজে এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্মরণ ও সজীব রাখুন।
কীভাবে স্মরণ করবেন? ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও প্রয়োজন পূরণের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশাকে কীভাবে মেলাবেন?
চলুন, নিছক নীতিগত আলোচনার চেয়ে আমরা বিষয়টি দেখি আমাদের পূর্বসূরিদের বাস্তব জীবন থেকে। আমাদের কাছে তো আছে সর্বোত্তম জীবনাদর্শের জ্যোতির্ময় দৃষ্টান্তরাজি।
ঘুম ও বিশ্রামকেও ‘নিয়ত’-এর দ্বারা মহিমান্বিত করার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত রয়েছে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত দুই সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল রা. ও আবু মূসা আশআরী রা.-এর একটি কথোপকথনে, যা ইমাম বুখারী রাহ. ‘কিতাবুস সহীহ’-এ বর্ণনা করেছেন।
মুআয ইবনে জাবাল রা. হযরত আবু মূসা আশআরীকে জিজ্ঞাসা করলেন-
يَا عَبْدَ اللهِ، كَيْفَ تَقْرَأُ القُرْآنَ.
হে আল্লাহর বান্দা! আপনি কুরআন কীভাবে পড়েন?
আবু মূসা আশআরী রা. বললেন-
أَتَفَوّقُهُ تَفَوّقًا
দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায়। এরপর তিনিও প্রশ্ন করলেন-
فَكَيْفَ تَقْرَأُ أَنْتَ يَا مُعَاذُ؟
আচ্ছা আপনি কীভাবে পড়েন হে মুআয!
মুআয রা. বললেন-
أَنَامُ أَوّلَ اللّيْلِ، فَأَقُومُ وَقَدْ قَضَيْتُ جُزْئِي مِنَ النّوْمِ، فَأَقْرَأُ مَا كَتَبَ اللهُ لِي، فَأَحْتَسِبُ نَوْمَتِي كَمَا أَحْتَسِبُ قَوْمَتِي.
আমি রাতের প্রথম অংশে ঘুমাই। নির্ধারিত সময়ের ঘুম পুরা হবার পর উঠে নামাযে দাঁড়াই এবং কুরআন পড়ি, যে পরিমাণ আল্লাহ আমার জন্য লিখে রেখেছেন। তো আমি আমার ঘুমেও ছওয়াবের আশা রাখি যেমন আশা রাখি আমার নামাযের কারণে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৮৬, ৪০৮৮
অন্য বর্ণনায় তাঁর কথাটি এভাবে আছে-
أَنَامُ أَوّلَ اللّيْلِ وَأَتَقَوّى بِهِ عَلَى آخِرِهِ، وَإِنِّي لَأَرْجُو الْأَجْرَ فِي رَقْدَتِي كَمَا أَرْجُوهُ فِي يَقَظَتِي.
আমি রাতের প্রথম অংশে ঘুমাই এবং এর মাধ্যমে শেষ রাতে ওঠার শক্তি সঞ্চয় করি। আর আমি আমার নিদ্রার কারণেও ছওয়াবের প্রত্যাশা করি যেমন প্রত্যাশা করি জাগরণের কারণে। -আল মুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ২/৭৩, হাদীস ৬৬১৬; আল মুসনাদ, আবু আওয়ানা ৫/১০১ হাদীস ৭৯৫১; শুআবুল ঈমান বাইহাকী ২/৪০২, হাদীস ২২০০
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনীষী সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল রা.-এর জীবনাদর্শে পাওয়া গেল ঘুমের মতো প্রাত্যহিক বিষয়কেও উত্তম নিয়তের দ্বারা ছওয়াবের কাজে পরিণত করার নমুনা।
পৃথিবীতে আমরা যা কিছু ব্যবহার করি ও উপভোগ করি তার সবই আল্লাহর নিআমত। খাদ্য-পানীয়, আলো-বাতাস ও জীবন যাপনের সকল উপকরণ তাঁরই সৃষ্টি। আমাদের কর্ম-শক্তি ও চিন্তা-শক্তিও তাঁরই দান। কাজেই এইসকল নিআমতের ব্যবহারে আল্লাহর স্মরণ ও শোকরগোযারি আবশ্যক। আর জীবন জুড়ে সকল কর্মে রয়েছে আল্লাহর বিধান ও তাঁর পছন্দনীয় পন্থা। সেই বিধান ও পন্থার অনুসরণের দ্বারা আমাদের গোটা কর্মজীবনই হয়ে উঠতে পারে মহিমাপূর্ণ।
যদ্দুর সম্ভব শুরু করুন
খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো; ঘুম থেকে ওঠা, হাম্মামে যাওয়া, বের হওয়া; ঘরে ঢোকা, ঘর থেকে বের হওয়া ইত্যাদি ছোট ছোট প্রাত্যহিক কাজে রয়েছে আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহ। তা জেনে আমল করা কঠিন নয়। তবে গুরুত্ব ও আগ্রহ থাকতে হবে।
এছাড়া জীবনজুড়ে অসংখ্য বিষয় আছে, যেখানে শুধু নিয়তের প্রয়োজন। যেমন পরিবার-পরিজনকে সময় দেওয়া, সাক্ষাৎপ্রার্থীর কথা শোনা, মেহমানের সমাদর করা, যা আমরা সাধারণত করে থাকি। এইসব ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির, তাঁর বান্দাদের আনন্দদান ও তাদের হক আদায়ের নিয়তের দ্বারাই এ সকল কাজ নেক আমলে পরিণত হয়।
এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, জীবনের এক বিরাট অংশই এমন, যেখানে সঠিক নিয়ত ও সুন্নতের ইত্তিবা এখন থেকেই শুরু করা সম্ভব। এই সকল ক্ষেত্রে এই চর্চা এখনই শুরু করুন। আর যে বিষয়গুলো শরীয়ত ও সুন্নাহর অধীনে নিয়ে আসা অপেক্ষাকৃত কঠিন, যেমন কারো কারো ক্ষেত্রে আয়-উপার্জন, পর্দা-পুশিদা ইত্যাদি; ঐসব ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে, আল্লাহর বিধানে যা হারাম তাকে হারাম জানুন এবং অবশ্যই তা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করুন। সদিচ্ছা ও সঠিক চেষ্টা থাকলে উপায়ও অবশ্যই বের হয়ে আসবে। আর তখন সঠিক নিয়তের দ্বারা আয়-উপার্জনের সকল প্রয়াসই আমলে সালেহে পরিণত হবে।
বিখ্যাত মনীষী সাহাবী সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন-
إِنّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتّى مَا تَجْعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ.
তুমি আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য যে খরচই করবে এর বিনিময় (আল্লাহর তরফ থেকে) পাবে। এমনকি যা কিছু স্ত্রীর মুখে তুলে দাও তারও। -সহীহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান, হাদীস ৫৬; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল অসিয়্যাহ, হাদীস ১৬২৮
উল্লেখ্য, ইমাম বুখারী রাহ. হাদীসটি ‘কিতাবুল ঈমান’ বা ‘ঈমান-অধ্যায়ে’ এনেছেন। কারণ, সব কাজে আল্লাহর রেযামন্দির নিয়ত রাখা ঈমানের এক উঁচু বৈশিষ্ট্য।
বিখ্যাত তাবেয়ী যুবাইদ ইবনুল হারিছ আলইয়ামী রাহ. বলেন-
يَسُرّنِي أَنْ يَكُونَ لِي فِي كُلِّ شَيْءٍ نِيّةٌ حَتّى فِي الْأَكْلِ وَالنّوْمِ.
অর্থাৎ আমার কাক্সিক্ষত বিষয় এই যে, সব কিছুতেই আমার ‘নিয়ত’ থাকুক; এমনকি আহার-নিদ্রাতেও। -শুআবুল ঈমান ৫/৩৫০; সিফাতুস সফওয়াহ ৩/৯৯
বলাবাহুল্য, এ যার জীবনাদর্শ তার সকল দৌড়ঝাঁপ হবে নেক আমল, হয়ে উঠবে সফল ও অর্থপূর্ণ।
ইবাদত-বন্দেগীকে সপ্রাণ করুন
ঈমানের পর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ইবাদত-বন্দেগী। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামায, যিকির-তিলাওয়াত, আদইয়ায়ে মাসনূনা, রমযানের ফরয রোযা, অন্যান্য সময়ের নফল রোযা, যাকাত-সদাকা, হজ¦-কুরবানী, ইতিকাফ ইত্যাদি ইবাদত আমরা সাধারণত আদায় করি। এটি আমাদের কর্মের এক উল্লেখযোগ্য অংশ। এই ইবাদত-বন্দেগীকে যদি সপ্রাণ করা যায় তাহলে জীবনের এই উল্লেখযোগ্য অংশটি হয়ে উঠবে অর্থপূর্ণ, মহিমাপূর্ণ। উপায় হিসেবে এখানেও আসছে ঐ শিরোনাম- ‘লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্মরণ রাখা’।
হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ ‘দুস্তূরে হায়াত’-এ লেখেন-
“আমরা অনেকেই সহীহ হাদীসে বর্ণিত অযুর দুআ, মসজিদে ঢোকা ও বের হওয়ার দুআ, হাম্মামে যাওয়া, হাম্মাম থেকে বের হওয়ার দুআ, ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার দুআ, সকাল-সন্ধ্যার যিকির, সফরে যাওয়ার ও সফর থেকে ফেরার দুআ নিয়মিত পড়ে থাকি; কিন্তু আশঙ্কা জাগে, এই আমলটিও হয়তো উদাসীনতা ও অমনোযোগিতার সাথে, আধুনিক উপমা দিয়ে বললে, অনেকটা টেপ রেকর্ডারের মতো উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আমলের যে সওয়াব ও ফযীলত বয়ান করেছেন, আল্লাহর কাছে এর যে গুরুত্ব ও মর্যাদা এবং আখেরাতে এর যে সুফল ও উপকারিতা তার স্মরণ ও আগ্রহ ছাড়াই শুধু মৌখিকভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। অথচ শরীয়তে আছে ইবাদতের সাথে ইবাদতের সওয়াব ও ফযীলতের স্মরণ ও বিশ্বাসের কথাও। ইসলামের কিছু সর্বজনবিদিত ফরয-ওয়াজিব ইবাদতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এই শর্তের উল্লেখ হাদীস শরীফে আছে।
‘সহীহ হাদীসে এই বাণী বর্ণিত হয়েছে-
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতিসমূহের উপর বিশ্বাস রেখে, সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে রমযানের রোযা রাখে তার পেছনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৬০
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ .
যে (আল্লাহর প্রতিশ্রুতিসমূহের উপর) বিশ্বাস রেখে এবং ছওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে শবে কদরে ইবাদত করবে তার পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০১
তো এখানে ‘ঈমান’ ও ‘ইহতিসাব’ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিশ্রুতিসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও ছওয়াবের প্রত্যাশা- এই দুটো বিষয় স্পষ্টভাবে আছে। কিন্তু আমাদের অনেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে খুব একটা খেয়াল করেন না। অথচ এর মাধ্যমেই কোনো কাজ অভ্যাসবশত করা আর ইবাদত হিসেবে করার মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। এই বেখেয়ালির কারণে অনেক ইবাদত, এমনকি ইসলামের চার রোকন- সালাত, যাকাত, সওম ও হজ্ব পর্যন্ত পর্যবসিত হয় একটি গতানুগতিক ও প্রাণহীন কর্মে।
‘আম মুসলমানের সাথে সাহাবায়ে কেরাম ও নেককার মুমিনদের পার্থক্যের এক বড় দিক এই স্মরণ ও বিস্মৃতি। অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত এই ফযীলতসমূহের প্রতি তাঁদের থাকে পূর্ণ বিশ্বাস আর হৃদয়ের গভীরে থাকে তা অর্জনের গভীর প্রত্যাশা। ফলে তাদের আমল-ইবাদত সম্পন্ন হয় এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা থেকে এবং এই প্রত্যাশা ও বিশ্বাসের সাথে। পক্ষান্তরে সাধারণজনের অবস্থা হয় এর চেয়ে ভিন্ন।
‘যেমন ধরুন, অযু, যা দৈনিক বারবার করা হয়, আমাদের অনেকেরই জীবনে যা একটি গৎবাঁধা যান্ত্রিক কর্মমাত্র; কিন্তু সাহাবা ও সালাফের জীবনে তা এমন ছিল না। তাঁরা যখন অজু করতেন তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী তাঁদের হৃদয়ে জাগ্রত থাকত-
إِذَا تَوَضّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ - أَوِ الْمُؤْمِنُ - فَغَسَلَ وَجْهَهُ خَرَجَ مِنْ وَجْهِه كُلّ خَطِيئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْه مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ -، فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلّ خَطِيئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ -، فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلّ خَطِيئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلَاهُ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ - حَتّى يَخْرُجَ نَقِيّا مِنَ الذّنُوبِ.
যখন কোনো মুসলিম কিংবা (বলেছেন) কোনো মুমিন অজু করে- যখন সে আপন মুখম-ল ধৌত করে তখন মুখম-ল থেকে ঐ সমস্ত গুনাহ ঝরে যায়, যা সে চোখের দ্বারা করেছে। যখন সে হাত ধৌত করে তখন পানির সাথে অথবা (বলেছেন,) পানির শেষ ফোঁটার সাথে ঐ সকল গুনাহ ঝরে যায়, যা সে হাত দ্বারা করেছে। এমনকি সে গুনাহসমূহ থেকে পাক সাফ হয়ে যায়। যখন সে পা ধৌত করে তখন পানির সাথে অথবা (বলেছেন) পানির শেষ ফোঁটার সাথে ঐ সকল গুনাহ ঝরে যায়, যার দিকে সে হেঁটে গেছে। এভাবে সে গুনাহ থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪
‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংবাদের উপর তাঁদের এমনই ইয়াকীন ও প্রত্যয় ছিল, যেন সবকিছু সচক্ষে দেখছেন- সেই প্রতিশ্রুত সওয়াবের আকাক্সক্ষা নিয়ে ঐ কাজ তাঁরা করতেন। একই অবস্থা ছিল যখন তারা কোনো মুসলিম ভাইয়ের সাথে মুচকি হেসে সাক্ষাৎ করতেন এবং আনন্দ ও প্রফুল্লতা প্রকাশ করতেন। একই অবস্থা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে, আয়-উপার্জনে ও পেশাগত কাজকর্মে। এককথায় যা-ই তারা করতেন ঐ আজর ও ছাওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় করতেন। ফলে তাঁদের ইবাদত যেমন প্রকৃত ইবাদত হত তেমনি প্রাত্যহিক কাজগুলোও হতো ত‘আত ও আল্লাহর ফরমাবরদারি।...” (দুস্তূরে হায়াত ২২৩-২২৪)
হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. যা বলেছেন তা সূরা আনআমের ঐ শিক্ষারই কিছু ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক নমুনার বিবরণ, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ...
বল, আমার নামায, আমার ইবাদত...।
জীবনের সকল কর্মের সূচনায় এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে স্মরণ করুন এবং এরই দাবি অনুসারে ঐ কাজটি সম্পন্ন করুন। আপনার কাজটি হয়ে উঠবে অর্থপূর্ণ ও মহিমাপূর্ণ।
জীবনের নানা অবস্থা কীভাবে মহিমান্বিত হয়
উর্দূতে একটি পংক্তি আছে-
زمانہ بيك حال رہتا نہیں + گذشتہ زمانہ پهر آتا نہیں
সময় কখনো এক অবস্থায় থাকে না। আর যে সময় যায় তা আর ফিরে আসে না।
মানুষের জীবন নিত্য পরিবর্তনশীল। সুখ-দুখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা, সফলতা-ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা অবস্থা নিয়েই জীবন। এই নানা রূপ-অবস্থার মধ্য দিয়েই জীবন এগিয়ে চলে এবং সময় ফুরোতে থাকে। জীবনের অনভিপ্রেত অনাকাক্সিক্ষত অবস্থাগুলোকে জীবন থেকে বিয়োগ করা যায় না। এগুলো জীবনেরই অংশ। এই অবস্থাগুলোও কি মহিমান্বিত ও কল্যাণপূর্ণ হতে পারে? এমন কোনো উপায় কি আছে, যার দ্বারা জীবনের এই অংশটিও ইতিবাচক হতে পারে? সঞ্চয়ের খাতায় কিছু যোগ করতে পারে?
জী, সে উপায় আছে এবং তা মুমিনের জন্য। মুমিনের শুধু কর্ম নয়, তার জীবনের সকল অবস্থাই হতে পারে মহিমাপূর্ণ ও কল্যাণপূর্ণ। ‘অবস্থা’ বলতে বোঝাচ্ছি জীবনের ঐসকল অনুষঙ্গ যা সরাসরি কর্ম নয়, তবে এর সাথেও রয়েছে বিশ্বাস ও কর্মের সংযোগ। যেমন সুখ-দুখ, সুস্থতা-অসুস্থতা ইত্যাদি। এই সকল অবস্থাও কল্যাণপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং যথার্থ বিশ্বাস ও কর্মের দ্বারা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-
عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ، إِنّ أَمْرَهُ كُلّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرّاءُ شَكَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرّاءُ، صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ.
মুমিনের কী শান! তার সব কিছুই তার জন্য কল্যাণকর; যদি সে সুখ ও সচ্ছলতা লাভ করে তাহলে শোকরগোযারি করে। ফলে এই সুখ তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি অসুখ-অসচ্ছলতার শিকার হয় তাহলে সবর করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৯৯
সবর ও শোকরের যে শিক্ষা ইসলাম দান করেছে তার এক গভীর তাৎপর্য ও সুফল এই হাদীস থেকে পাওয়া যাচ্ছে। ইসলামের সকল শিক্ষাই তাৎপর্যমণ্ডিত, যদি আমরা আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি।
এইটুকু আলোচনা থেকেও বুঝে নেওয়া সম্ভব যে, আমাদের কারোর জীবনই অর্থহীন নয়। যে মানুষকে আল্লাহ সর্বোত্তম দৈহিক ও মানসিক গঠনে তৈরি করেছেন তার জীবন অর্থহীন হতে পারে না, যদি সে তার সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভ করে এবং তার আদেশ মান্য করে।