রবিউল আখির ১৪৩৯   ||   জানুয়ারি ২০১৮

দুআয়ে মাগফিরাতের আবেদন

الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد: বিগত কয়েক মাসে অনেক উলামা-মাশায়েখ ইনতিকাল করেছেন। পাঠকবৃন্দের কাছে তাঁদের সকলের জন্য দুআয়ে মাগফিরাতের দরখাস্ত করছি। ১. গত ১৪ সফর ১৪৩৯ হিজরী/৪ নভেম্বর ২০১৭ ঈসাব্দ শনিবার দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার প্রবীণ উস্তায হযরত কাতেব ছাহেব হুযূর ইনতিকাল করেছেন। হযরতের নাম ছিল সুলাইমান আরমান। তবে সবার কাছে তিনি কাতেব ছাহেব হুযূর নামেই পরিচিত ছিলেন। হস্তলিপি, ‘শের’ রচনা ও আবৃত্তি ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততা। শুনেছি, ইনতিকালের সময় তাঁর বয়স ছিল ৯৭ বছর। রাহিমাহুল্লাহু তাআলা রাহমাতান ওয়াসিয়া। ২. হাফেয মাওলানা যাকারিয়াও গত ২০ নভেম্বর ২০১৭ ঈসাব্দ সোমবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে গেছেন। মিরপুর আরজাবাদ মাদরাসায় তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীতে পল্লবী আফতাবুদ্দীন মাদরাসার যিম্মাদার ছিলেন। তার মূল পরিচয় ছিল, তিনি ধানমণ্ডি সাত নম্বরের বড় মসজিদের ইমাম ও খতীব ছিলেন। তাঁর আব্বাজান ডক্টর ইসহাক ছাহেবের ইনতিকালের পর আমার অনুরোধে তিনি তাঁর আব্বাজানের উপর সংক্ষিপ্ত একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সে প্রবন্ধ আলকাউসারে প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েক বছর যাবৎ তিনি অসুস্থ ছিলেন। আফসোস! আমার খেয়াল হয়নি, নয়তো তাঁর কাছ থেকেই তাঁর আত্মজীবনী শুনে হেফাযত করতাম। কারণ, দেশ বিদেশের অনেক উলামা -মাশায়েখের সঙ্গে তাঁর মুলকাত হয়েছিল। জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউনেও তিনি দরস হাসিল করেছেন। সেখানে হযরত মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মাদ ইউসূফ বানূরী রাহ.-এর সাহচর্যেও ধন্য হয়েছেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আহসানুত তাকাসীম ফী মা‘রিফাতিল আকালীম’ কিতাবটি আমি সর্বপ্রথম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ.-এর কুতুবখানায় দেখেছি। হাফেয মাওলানা যাকারিয়া রাহ. ও তাঁর আব্বার কুতুবখানায় অবশ্যই দুর্লভ কিছু কিতাব থাকবে। আল্লাহ তাআলা এই কুতুবখানাটির হেফাযত করুন। ৩. হযরত মাওলানা জমীরুদ্দীন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (নানূপুরী হযরত)-এর বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা ইউসূফ ছাহেব, মুহতামিম, দারুল উলূম শাহ নগর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। তিনিও গত ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ হিজরী/৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ঈসাব্দ বৃহস্পতিবার আখেরাতের মুসাফির হয়ে গেছেন। এমনিতে তো কয়েকবার হযরত থেকে ইসতিফাদার সুযোগ হয়েছে। তবে গত বছর তাঁর মাদরাসার অদূরে অবস্থিত বাড়িতে হাযির হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি একসময় জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগে পড়াশোনা করেছেন। সেসময় হযরত সদর ছাহেব রাহ. তাঁকে একবার চিল্লায় পাঠিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত এই ধারার তাবলীগী খেদমতের সাথেও যুক্ত ছিলেন। তালীম, সুলূক ও ইহসান, দাওয়াত ও তাবলীগ এবং ওয়ায ও বয়ান এই সব ধরনের দ্বীনী খেদমতের সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক ছিল। এই সব ধরনের কাজেই তিনি অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর প্রতি নানুপুরী হযরতের অনেক আস্থা ছিল। তাঁর নসীহত খুবই মূল্যবান হত। এক নসীহত তো একেবারে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তিনি বলতেন, ইজাযতনামা মূলত তাসাওউফের মকতবের ভর্তি ফরম। মকতবে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়ে গেল, তাই যেমন শোকর আদায় করা উচিত তেমনি মজবুতভাবে মেহনত অব্যাহত রাখা উচিত। নতীজা তো সামনে, মৃত্যুর সময়। সুন্দর মৃত্যু হয় কি না। এমনিভাবে নতীজা প্রকাশ পাবে কবরে, হাশরে এবং আখেরাতের অন্যান্য ঘাঁটিতে। ৪. সিলেট দরগাহ মাদরাসার সাবেক উস্তাযে হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল বাসেত বরকতপুরীও দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ হিজরী/১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ঈসাব্দ শনিবার সন্ধ্যায় তাঁর ইনতিকাল হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি দরগাহ মাদরাসায় তাদরীসের খেদমতে ছিলেন। সেখানেই দুইবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছে। পরে জানতে পেরেছি, তিনি হযরত বানূরী রাহ.-এর শাগেরদ। জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউনে তিনি পড়াশোনা করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে মাগফিরাত নসীব করুন। তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন। ৫. বেশ পরে জানতে পেরেছি, চৌধুরীপাড়া মাদরাসার জোয়ান উস্তায মাওলানা মুতীউর রহমান ছাহেবও আর এই দুনিয়ায় নেই। জানতে পেরেছি, গত ৩ যিলহজ¦ ১৪৩৮ হিজরী/২৬ আগস্ট ২০১৭ ঈসাব্দ শনিবারে তিনি আমাদেরকে রেখে চলে গেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ভরপুর মাগফিরাত নসীব করুন। তাঁর পরিবার পরিজনের যিম্মাদার হয়ে যান- আমীন। ৬. গত ২৪ সফর ১৪৩৯ হিজরী সোমবারে কারী তায়্যিব রহ.-এর ছাহেবযাদা হযরত মাওলানা আসলাম কাসেমী রাহ. ইনতিকাল করেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ ওয়াক্ফ-এর নাযেমে তালীমাত ছিলেন। তাঁর অনূদিত ও রচিত কয়েকটি কিতাবও রয়েছে। সীরাত ও তারীখ তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল। শুনেছি মাকবারায়ে কাসেমীতে তাঁর দাফন হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর কবরে রহমতের বারিধারা বর্ষণ করুন। ৭. ডক্টর মুস্তফা আজমী রাহ.। গত বুধবার সকালে তিনিও পরপারে চলে গেছেন। তিনি ২ রবিউল আউয়াল (আমাদের এখানের চাঁদের হিসাবে ১লা রবিউল আউয়াল) মুতাবেক ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ঈসাব্দ তারিখে রাব্বে কারীমের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় তাঁর ইলমী কাজগুলোর মাধ্যমে। তিনি ‘সহীহ ইবনে খুযাইমা’ ও ‘সুনানে ইবনে মাজাহ’র তাহকীক ও তালীকের কাজ করেছেন। তাঁর কিতাব ‘মানহাজুন নকদ ইনদাল মুহাদ্দিসীন’ সমষ্টিগত বিচারে ভালো কিতাব। এছাড়া ‘দিরাসাতুন ফিল হাদীসিন নাবাবিয়্যি ওয়া তারীখি তাদভীনিহী’ও মাশাআল্লাহ এক ঐতিহাসিক ‘দলীল’। ইসতিশরাকের ফিতনা মোকাবেলায় এই উভয় কিতাবে অনেক ভালো তথ্য রয়েছে। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. ‘তাহকীকু ইসমাইস সাহীহাইন ওয়াসমি জামিইত তিরমিযী’তে জামে তিরমিযীর সেই গুরুত্বপূর্ণ নুসখার কথা উল্লেখ করেছেন, যা আজমী ছাহেবের কাছে সংরক্ষিত ছিল। আল্লাহ তাআলা যেন নুসখাটি হেফাযত করেন, যাতে তলাবা ও উলামায়ে কেরামের সেখান থেকে ইসতিফাদার সুযোগ হয়। আজমী রাহ.-এর জন্ম ১৩৫০ হিজরী/১৯৩২ ঈসাব্দতে। তিনি হযরত মাদানী রাহ.-এর শাগরেদ ছিলেন। খুব সম্ভব ১৩৭২ হিজরীতে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীসের তালিবে ইলম ছিলেন। মনে পড়ছে, আমাকে খতীব ছাহেব রাহ. (হযরত মাওলানা উবাইদুল হক রাহ.) বলেছিলেন, তিনি হযরত আজমী ছাহেব রাহ.-এর সহপাঠী ছিলেন। মাওলানা যুবায়ের আশরাফ ছাহেব আমাকে বললেন, খতীব ছাহেব রাহ.-এর দাওরা হয়েছে ১৩৬৬-৬৭ হিজরী শিক্ষাবর্ষে। তো হতে পারে তাঁরা কোনো কিতাবে সহপাঠী ছিলেন। কারণ, সেসময় জামাত ভিত্তিক পড়ার ব্যবস্থা কড়াকড়িভাবে চালু হয়নি। উল্লেখ্য, আজমী রাহ. মূলত হিন্দুস্তানের হলেও তাঁর কর্মজীবনের বড় অংশ সৌদি আরবের রিয়াদে কেটেছে। আল্লাহ তাআলা আখেরাতের সকল মুসাফিরকে ভরপুর মাগফিরাত নসীব করুন। তাঁদের দারাজাত বুলন্দ করুন। তাঁদের উত্তরসূরিদের সবরে জামীলের তাওফীক দান করুন- আমীন। -আবদুল মালেক

 

 

advertisement