আসুন ঈমান তাজা করি : ইসলামের ভাষায় কথা বলি
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
رَضِيتُ بِاللهِ رَبا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمّدٍ نَبِيا.
আমি খুশি, আল্লাহ আমার রব। আমি আমার রবকে চিনতে পেরেছি। তিনি আমাকে তাঁর পরিচয় দান করেছেন। তাঁর রুবুবিয়্যাতের উপর ঈমান আনার তাওফীক দান করেছেন। রুবুবিয়্যাতের হক শিক্ষা দিয়েছেন। এর শোকর আদায়ের পদ্ধতি শিখিয়েছেন।
আমি খুশি, ইসলাম আমার দ্বীন। ইসলাম আমার আকীদা ও ঈমান, ইসলাম আমার জীবনব্যবস্থা ও শরীয়ত।
আমার রব আমাকে ইসলামের হেদায়েত দিয়েছেন। ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং কামিল তাহযীব তা বোঝার তাওফীক দান করেছেন। আমি এর উপর অটল অবিচল থাকতে চাই। এর উপর বেঁচে থাকতে চাই। এর উপরই মরতে চাই।
إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَه وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ.
নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত, আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনও শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং আনুগত্য স্বীকারকারীদের মধ্যে আমি একজন।
আমি সন্তুষ্ট, আমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ তাআলা আমাকে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর উপর নাযিলকৃত শরীয়তের শিক্ষা দান করেছেন। তাঁর সুন্নাত ও উসওয়ায়ে হাসানা-উত্তম আদর্শের পথনির্দেশ করেছেন। ঈমান, আকীদা, শরীয়ত ও উসওয়ায়ে হাসানার সকল উৎস আমাদের জন্য আজও সংরক্ষণ করে রেখেছেন। স্থায়ীভাবে তা সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
رَضِيتُ بِاللهِ رَبا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمّدٍ نَبِيا.
আমি আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।
শোকর আদায়ের এই কালেমা, ঈমান তাজা করার এই আযীফা সকাল সন্ধ্যা অর্থ বুঝে, খুব মন দিয়ে তিনবার পাঠ করা উচিত।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা তিনবার এই কালেমা পাঠ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন সন্তুষ্ট করে দেবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৬৭১, সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৯৭৪৭
আজ যে বিষয়টি সবচে বেশি প্রয়োজন তা হল, নিজেদের ঈমান তাজা করা। ইসলামী আকীদার বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা। আমাদের জানা উচিত, কোন্ আকীদার দাবি কী এবং কোন্ কথা, কাজ বা দৃষ্টিভঙ্গি ঐ আকীদার খেলাফ। আমাদের পর্যবেক্ষণ করা উচিত, কর্মে ও জীবনে ঐ আকীদার কী প্রভাব থাকা উচিত, কিন্তু তা থাকছে না। আমাদের জানা উচিত, কোন্ আমলের দ্বারা ঈমান মজবুত ও সজীব হয়, যাতে সে আমলগুলো পালন করা যায়। আর কোন্ আমলের দ্বারা ঈমান দুর্বল হয়ে যায়, যার কারণে আমলে দুর্বলতা আসে, চরিত্রের অধঃপতন হয়, যাতে এ জাতীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
আকাইদের (আকীদা-বিশ্বাস) সহীহ ও বিস্তারিত জ্ঞান না থাকার সবচে বড় কুফল এই হয় যে, মানুষ অবচেতন মনে ঈমান-পরিপন্থী কথা ও কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনকি ঈমান বিধ্বংসী চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ধারক হয়ে যায়। আর ঈমানের দুর্বলতা তো এর ন্যূনতম ফলাফল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, মানুষ ঈমানের হাকীকত বুঝবে এবং সেসব আকীদাগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগতি লাভ করবে যা মুসলিমকে অমুসলিমদের থেকে পৃথক করে। ঈমানের অবস্থান এবং ঈমানের সঠিক মর্যাদা অনুধাবন করবে, যেন এই নিআমতের হেফাযত, শোকর আদায় এবং এর উপর অবিচল থাকার ভাবনা জাগ্রত হয়। এমনটি না হলে তো ঈমানের দৃঢ়তা এবং ঈমানী মর্যাদাবোধ হারিয়ে যাবে। এটাই সর্বনিম্ন পরিণাম।
আমরা মুসলিম। ইসলাম হল, ঈমান ও আকীদা, শরীয়ত ও সুন্নতের সমষ্টি। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং স্বতন্ত্র তাহযীব। ইসলামের আছে নিজস্ব পরিভাষা। প্রত্যেক পরিভাষার আছে নির্দিষ্ট মর্ম। সেই পরিভাষা, নাম ও মর্ম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত।
ইসলাম কী? ইসলামের কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলো তাকে অন্য সকল ধর্ম থেকে বিশিষ্ট করে? মুসলিম উম্মাহর অবস্থান ও মর্যাদা কী? আজ যেন আমাদের এর জ্ঞানই নেই অথবা এই বিষয়ের অনুভূতি নেই।
আজ আমরা সবচে বেশি যে সর্বনাশের শিকার তা হল, ঈমানের মর্যাদা ও মূল্য আমাদের জানা নেই অথবা -নাউযুবিল্লাহ- জেনে বুঝে সে নিআমতের অবমূল্যায়ন করছি। এজন্য দেখা যায়, ঈমান-পরিপন্থী কাজ, কথা, চিন্তা সবকিছুই খুব সহজে গ্রহণ করে নিচ্ছি। ইসলামের কালেমা এবং ঈমান-আকীদার সাথে তার কোনো বিরোধই অনুভূত হয় না।
এ সর্বনাশের প্রভাব হল, আমরা যেন ইসলামী পরিভাষা এবং পরিভাষার ইসলামী ব্যাখ্যা আলোচনা করতেও -নাউযুবিল্লাহ- লজ্জাবোধ করছি। পরিষ্কার ও স্পষ্ট ভাষায় তা পেশ করারও যেন আমাদের সাহস নেই। শুধু এটুকু নয়, আমরা যেন নিজেদের ইসলামী পরিভাষার বদলে অন্যদের পরিভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখানেই শেষ নয়, এখন তো শাব্দিক সাযুজ্য অথবা মামুলি মিলের বাহানায় ইসলামী পরিভাষাকে অন্যদের চিন্তা ও চেতনার মর্ম পরানো হচ্ছে। যা ইসলামী আকীদা ও মূলনীতি বিকৃতির নিকৃষ্ট নমুনা। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
অমুসলিমরা ‘শান্তি’ শব্দ ব্যবহার করে। কিন্তু একমাত্র শান্তিদাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, যিনি এক, যাঁর কোনো শরিক নেই, যার এক নাম- আসসালাম-শান্তিদাতা, আলমুমিন-নিরাপত্তাদাতা-তার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর প্রতি ঈমান নেই। তাঁর সঙ্গে মহব্বত নেই। তাঁর অবতীর্ণ ইলমে ওহীর প্রতি বিশ্বাস নেই। এজন্য ‘শান্তি’র যে ইসলামী মর্ম এবং যা শান্তির প্রকৃত মর্ম সে জ্ঞান থেকে তারা বঞ্চিত। এখন যদি কোনো মুসলিম তাদের সাথে সুর মিলিয়ে ‘শান্তি’ পরিভাষা ব্যবহার করে তাহলে এরচেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা, নাশোকরি ও আত্মমর্যাদাহীনতা আর কী হতে পারে? এরপর যদি এই অর্থেই বলা হয়, ইসলাম শান্তির ধর্ম তাহলে এর চেয়ে বড় বিকৃতি আর কী হতে পারে?
তাদের শান্তির মধ্যে নাহী আনিল মুনকার-অসৎ কাজ থেকে বারণ করার নাম নিশানাও নেই। তাদের শান্তির মধ্যে সুদ কেবল বৈধ নয়, বরং সুদপ্রীতিও তাতে দাখেল। অথচ কুরআনের ঘোষণায় তা ‘হারব’-আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা। তাহলে আল্লাহর কাছে যা ‘হারব’ ও যুদ্ধ তা তাদের কাছে ‘সিলম’ ও শান্তি। তাদের শান্তির মধ্যে তো খোদাদ্রোহীতাও অপরাধ নয়। এছাড়া আজকালের পশ্চিমা শান্তি তো আরো অনেক কিছু। তো কোনো মুসলিম কীভাবে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই পরিভাষা ব্যবহার করতে পারে? এরপর আবার কী করে সেই শব্দে ইসলামের পরিচয় পেশ করতে পারে?
মুমিনের দুআ ইবাদত, যা তাওহীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনপূর্ণ স্থান। আল্লাহমুখিতা ও আল্লাহর উপর ভরসার বড় প্রকাশক্ষেত্র। কিন্তু কোনো মুমিন দুআতে কোনো মুশরিকের ইকতিদা করার প্রয়োজন মনে করলে, তার দুআয় কোনো মুশরিকের আমীন বলার প্রয়োজন মনে করলে এরচেয়ে আত্মমর্যাদাহীনতা এবং তাওহীদের পরিচয়ের ব্যাপারে অজ্ঞতা আর কী হতে পারে?
যারা আল্লাহকে আল্লাহ বলে ডাকতে পারে না, আল্লাহ বলে তাঁর কাছে চাইতে পারে না, আল্লাহর বান্দা হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে জানে না, যারা আল্লাহদ্রোহিতায় অটল থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এমন লোকের প্রার্থনায় যদি এক আল্লাহয় বিশ্বাসী মুমিন শরিক হওয়ার প্রয়োজন মনে করে, তাহলে দুআর মতো নিআমতের এরচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন আর কী হতে পারে? তাওহীদের আকীদার এরচেয়ে বেশি অমর্যাদা আর কী হতে পারে?
যে উম্মতের নবীকে আল্লাহ তাআলা জগতবাসীর জন্য রহমত বলে উপাধী দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
وَمَاۤ اَرْسَلْنٰکَ اِلَّا رَحْمَۃً لِّلْعٰلَمِیْنَ.
আমি আপনাকে জগতবাসীর জন্য কেবল রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ১০৭
যে উম্মতের নবী খ্রিস্টান সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে লিখেছেন- أسلم تسلم ইসলাম গ্রহণ কর, শান্তিতে থাকবে।
সেই উম্মতের কোনো সদস্যের যদি কোনো মুশরিক খ্রিস্টান থেকে শান্তির বার্তা আহরণ করার প্রয়োজন হয় তাহলে কোন্ ভাষায় তার জন্য আফসোস করব?
যার কাছে বিশ্বশান্তির বার্তাই নেই, যে ইসলামের মহাদৌলত থেকে বঞ্চিত, সে কীভাবে হতে পারে শান্তির পতাকাবাহী? তার মিথ্যা দাওয়াতে কীভাবে উৎসাহ পেতে পারে কোনো মুসলমান? কোনো মুমিন কীভাবে এমন পতাকাবাহীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারে? বিশ্বশান্তির বার্তা বহনের সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গলসমাচারের আহ্বান! এত সুস্পষ্ট বৈপরীত্যও মুমিন ধরতে পারে না?! মুমিনের শান তো হল-
المؤمن لا يخدع ولايخدع.
মুমিন প্রতারণা করে না, কারণ তার মধ্যে ঈমান আছে। মুমিন প্রতারিত হয় না, যেহেতু তার মধ্যে সঠিক বোধ আছে।
আজ সবচে বেশি প্রয়োজন, তাওহীদের বাস্তবতা উপলব্ধি করা এবং তাওহীদ-পরিপন্থী বিষয়গুলোর জ্ঞান অর্জন করা। যদি কোনো মুমিনের তাওহীদের বিশ্বাসের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা সহজে জায়গা করে নেয়, তার কাছে তাওহীদের সাথে এই কুফরী মতবাদের কোনো বৈপরীত্যই অনুভূত না হয়, তাহলে সে কোনো অমুসলিমকে তাওহীদের দাওয়াত দিবে কীভাবে? এমন অসম্পূর্ণ তাওহীদ তো অমুসলিমদের কাছেও আছে।
কারও তাওহীদের মাঝে যদি ‘তাওহীদ ফিততাশরী’ই না থাকে অর্থাৎ সে যদি ধর্ম থেকে রাষ্ট্র পৃথক এই মতবাদের বক্তা হয় তাহলে এ নামের তাওহীদ তো পোপের কাছেও আছে। এমনকি তারা তো ‘তাসলীস’ তথা ত্রিত্ববাদকেও তাওহীদ নামে আখ্যায়িত করে!
মুমিনকে আল্লাহ তাআলা তাওহীদের কালেমা দান করেছেন। এরপর পুরো কুরআন জুড়ে এ কালেমার পরিপূর্ণ তফসীলও পেশ করেছেন; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জ্ঞানগত ও প্রয়োগগত শিক্ষার দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন। এরপর সাহাবায়ে কেরাম এই আমানত তাবেঈদেরকে পৌঁছে দিয়েছেন। এবং সব যুগের নবীর ওয়ারিস উলামায়ে কেরাম পূর্বসূরিদের থেকে শিখে পরবর্তীদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। فاللهم لك الحمد ولك الشكر প্রয়োজন শুধু এটুকুই যে, এ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং আপন করে নিতে হবে। আর নিজের মধ্যে তা প্রয়োগ করতে হবে।
আমাদেরকে জানতে হবে, ইসলাম মিল্লাতে হানীফিয়্যা তথা এক আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ধর্মের নাম। সব ধর্ম ও ইসলামবিরোধী ইজম ও ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামকে আল্লাহ তাআলার একমাত্র মনোনীত দ্বীন হিসেবে কবুল করার মাধ্যমেই মানুষ মুসলমান হয়। ইসলামকে আর দশটি ধর্মের মতো একটি ধর্ম, আর দশটি জীবন-ব্যবস্থার মতো একটি ব্যবস্থা মেনে নেওয়ার দ্বারা, এর কোনো একটি সৌন্দর্য আলোচনা করার দ্বারা না কেউ মুসলিম প্রমাণিত হয়, না মুমিন। যেমন, কেউ ইসলামকে এজন্য পছন্দ করে যে, তা শান্তি ও মানবতার ধর্ম এবং এদিক লক্ষ করেই সে ইসলামের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। অথবা কোনো ব্যক্তি এমন যে, জীবনযাপনের জন্য কোনো ধর্ম বা সভ্যতাকে জরুরি মনে করে, যেহেতু ইসলামের মাধ্যমেও ধর্ম ও সভ্যতার কাজ হাসিল হয়ে যায় এজন্য সে ইসলাম গ্রহণ করে-এভাবেও সে কখনো মুসলমান হতে পারবে না।
এমনই বুঝতে হবে রাসূলের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টি। রাসূলকে শুধু ভালো মনে করা, শান্তির দূত, মহাপুরুষ অথবা শত মহাপুরুষের মধ্যে সর্বপ্রথম মনে করার নাম ঈমান নয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনার অর্থ হচ্ছে, তাঁকে আল্লাহর নবী, আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী হিসেবে মানতে হবে। তার পবিত্র জীবনকে উসওয়ায়ে হাসানা-সর্বোত্তম আদর্শ মানতে হবে। তাঁর সুন্নাহকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাঁর সম্মান ও মর্যাদাকে ঈমান মনে করতে হবে। তাঁর সামান্য অপমানকে কুফর বুঝতে হবে।
আমাদেরকে জানতে হবে, ইসলামই কেবল সত্যধর্ম। ইসলামই শান্তির নিশ্চয়তা দেয়। ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত হলেই অমুসলিমরাও শান্তি লাভ করতে পারে। অন্য কোনো ইজম, অমূলক ধর্ম, বিকৃত দ্বীন, তাদের শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না; শুধু দাবিই করতে পারে।
আমাদেরকে এও জানতে হবে, যার ধর্ম ভিত্তিহীন অথবা বিকৃত, যার শরীয়ত মানবরচিত, সে যা ইচ্ছা করতে পারে, যা ইচ্ছা বলতে পারে, যে কোনো পরিভাষা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু মুসলমান, যার ধর্ম সত্য, যার ধর্ম সুসংরক্ষিত, যার ধর্ম স্থায়ী, যার কাছে আছে স্থায়ী শরীয়ত, যার দ্বীন-শরীয়তের উৎস ওহীর জ্ঞান (কুরআন ও সুন্নাহ) সংরক্ষিত এবং কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে; সে হয়ে থাকে মর্যাদাশীল, গুরু-গম্ভীর, দায়িত্বশীল, সে হয়ে থাকে আমানত ও শাহাদাত বিশ্বস্ততা ও হকের সাক্ষ্যের বাহক। তার ধর্ম ইসলাম, যার বৈশিষ্ট্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ শব্দে ব্যক্ত করেছেন-
الإسلام يعلو ولا يعلى.
ইসলাম বিজয়ী হয়, বিজিত হয় না।
তাই ইসলামের অনুসারীর জন্য শোভা পায় না- যাচ্ছেতাই পরিভাষা ব্যবহার করা, যে কোনো শ্লোগানে কান দেওয়া। যে কারো পেছনে হাঁটা। আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনকে সব দিক দিয়ে পূর্ণতা দান করেছেন। এ দ্বীনকে অন্যের মুখাপেক্ষী ছেড়ে দেননি যে, তাঁর অনুসারীকে অন্যের পরিভাষা ব্যবহার করতে হবে, অন্যের সভ্যতা অবলম্বন করতে হবে। মুসলিমকে সবসময় মনে রাখতে হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ইরশাদ-
مَنْ تَشَبّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.
অর্থাৎ, যে কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদেরই একজন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১
এখন মুসলমানদের মুখ থেকে ‘আন্তধর্মীয় প্রার্থনা’ এ শব্দও শুনতে হচ্ছে। একজন একত্ববাদী মুমিনের জন্য এ শব্দ কতটা অপরিচিত ও অচেনা তা আল্লাহই ভালো জানেন। কে না জানে ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে এ ধরনের পরিভাষার দূরতম সম্পর্কও নেই। এটা তো তাওহীদের নিআমত থেকে বঞ্চিত অমুসলিমদের পরিভাষা। হ্যাঁ, ইসলামে একটি জিনিস আছে। তা হল, মুবাহালা। যার আলোচনা সূরা আলে ইমরানে এসেছে। এ সূরার ঐ আয়াতগুলো তিলাওয়াত করুন এবং অর্থ নিয়ে ভাবুন-
اِنّ مَثَلَ عِیْسٰی عِنْدَ اللهِ کَمَثَلِ اٰدَمَ خَلَقَهٗ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهٗ كُنْ فَیَكُوْنُ ﴿৫৯﴾ اَلْحَقُّ مِنْ رَّبِّکَ فَلَا تَكُنْ مِّنَ الْمُمْتَرِیْنَ ﴿৬০﴾ فَمَنْ حَآجَّکَ فِیْهِ مِنْۢ بَعْدِ مَا جَآءَکَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ اَبْنَآءَنَا وَاَبْنَآءَكُمْ وَ نِسَآءَنَا وَ نِسَآءَكُمْ وَاَنْفُسَنَا وَاَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَّعْنَتَ اللهِ عَلَی الْکٰذِبِیْنَ ﴿৬১﴾ اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ اِلٰهٍ اِلَّا اللهُ وَ اِنَّ اللهَ لَهُوَ الْعَزِیْزُ الْحَکِیْمُ ﴿৬২﴾ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَاِنَّ اللهَ عَلِیْمٌۢ بِالْمُفْسِدِیْنَ ﴿৬৩﴾ قُلْ یٰۤاَهْلَ الْکِتٰبِ تَعَالَوْا اِلٰی کَلِمَۃٍ سَوَآءٍ بَیْنَنَا وَبَیْنَكُمْ اَلَّا نَعْبُدَ اِلَّا اللهَ وَلَا نُشْرِکَ بِهٖ شَیْئًا وَّلَا یَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ ؕ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُوْلُوا اشْهَدُوْا بِاَنَّا مُسْلِمُوْنَ ﴿৬৪﴾ یٰۤاَهْلَ الْکِتٰبِ لِمَ تُحَآجُّوْنَ فِیْۤ اِبْرٰهِیْمَ وَمَاۤ اُنْزِلَتِ التَّوْرٰىۃُ وَالْاِنْجِیْلُ اِلَّا مِنْۢ بَعْدِهٖ ؕ اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ ﴿৬৫﴾ هٰۤاَنْتُمْ هٰۤؤُلَآءحَاجَجْتُمْ فِیْمَا لَكُمْ بِهٖ عِلمٌ فَلِمَ تُحَآجُّوْنَ فِیْمَا لَیْسَ لَكُمْ بِهٖ عِلْمٌ وَاللهُ یَعْلَمُ وَاَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ ﴿৬৬﴾ مَاکَانَ اِبْرٰهِیْمُ یَهُوْدِیًّا وَّلَا نَصْرَانِیًّا وَّلٰکِنْ کَانَ حَنِیْفًا مُّسْلِمًا وَمَا کَانَ مِنَ الْمُشْرِکِیْنَ ﴿৬৭﴾ اِنَّ اَوْلَی النَّاسِ بِاِبْرٰهِیْمَ لَلَّذِیْنَ اتَّبَعُوْهُ وَهٰذَا النَّبِیُّ وَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَاللهُ وَلِیُّ الْمُؤْمِنِیْنَ ﴿৬৮﴾.
৫৯. আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মত। আল্লাহ তাঁকে মাটি হতে সৃষ্টি করেন, তারপর তাকে বলেন, ‘হয়ে যাও’। ফলে সে হয়ে যায়।
৬০. সত্য সেটাই, যা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসেছে। সুতরাং তুমি সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
৬১. তোমার কাছে (হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ঘটনা সম্পর্কে) যে প্রকৃত জ্ঞান এসেছে, তারপরও যারা এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়, (তাদেরকে) বলে দাও, এসো, আমরা ডাকি আমাদের সন্তানদেরকে এবং তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে, আমরা আমাদের নারীদেরকে এবং তোমরা তোমাদের নারীদেরকে, আর আমাদের নিজ লোকদেরকে এবং তোমাদের নিজ লোকদেরকে, তারপর আমরা সকলে মিলে (আল্লাহর সামনে) কাকুতি-মিনতি করি এবং যারা মিথ্যাবাদী তাদের প্রতি আল্লাহর লানত পাঠাই।
৬২. নিশ্চয়ই এটাই (ঘটনাবলীর) প্রকৃত বর্ণনা। আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।
৬৩. তথাপী যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আল্লাহ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদেরকে ভালোভাবেই জানেন।
৬৪. (ইয়াহুদী ও নাসারাদের) বলে দাও যে, হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন এক কথার দিকে এসে যাও, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই রকম। (আর তা এই যে,) আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও কিছুকে শরীক করব না এবং আল্লাহকে ছেড়ে আমরা একে অন্যকে ‘রব্ব’ বানাব না। তথাপি যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও, সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম।
৬৫. হে আহলে কিতাব! তোমরা ইবরাহীম সম্পর্কে কেন বিতর্ক করছ, অথচ তাওরাত ও ইনজীল তো তাঁর পরে নাযিল হয়েছে। তোমরা কি (এতটুকুও) বোঝ না?
৬৬. দেখ, তোমরাই তো তারা, যারা এমন বিষয়ে বিতর্ক করেছ, যে বিষয়ে কিছু না কিছু জ্ঞান তোমাদের ছিল। এবার এমন সব বিষয়ে কেন বিতর্ক করছ, যে সম্পর্কে তোমাদের মোটেও জ্ঞান নেই। আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।
ইবরাহীম ইয়াহুদীও ছিল না এবং খ্রিস্টানও নয়। বরং সে তো একনিষ্ঠ মুসলিম ছিল। সে কখনও শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
৬৭. ইবরাহীমের সাথে ঘনিষ্ঠতার সর্বাপেক্ষা বেশি হকদার লোক তারা, যারা তাঁর অনুসরণ করেছে এবং এই নবী (অর্থাৎ শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং সেই সকল লোক, যারা ঈমান এনেছে। আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক।’ -সূরা আলেইমরান (৩) : ৫৯-৬৮
৩ : ৬১ আয়াতে ইবতেহাল (মুবাহালা) এর কথা এসেছে। এই আয়াতের শানে নুযূল জানতে তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. দেখা যেতে পারে।
এ আয়াতগুলো নিয়ে ভাবতে থাকলে ইনশাআল্লাহ তাওহীদের বিশ্বাস দৃঢ় হবে। বুঝে আসবে, মুমিনের বিশেষ গুণ কী। বুঝে আসবে যে, মুসলিম মাত্রকেই এক আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হতে হবে। শুধু তার মুখের ভাষায় নয়, হৃদয় ও কর্মের ভাষাও এই হবে-
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ... إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي...
আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশম-ল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং অমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।
নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত, আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনও শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং আনুগত্য স্বীকারকারীদের মধ্যে আমি একজন।
এটাও জানতে পারবে, ত্রিত্ববাদীরা সবাই তাওহীদের নিআমত থেকে বঞ্চিত। তারা ঈসা আ. -এর মূল শরীয়ত ও শিক্ষা খুইয়ে বসেছে, তাঁর শিক্ষা থেকে সরে গিয়েছে। খোদ ঈসা আলাইহিস সালামের প্রকৃত পরিচয়ই তাদের কাছে নেই!
তাই ইহুদী-খ্রিস্টানদের মুক্তির একটিই পথ। আর তা হল, সব কুফরি থেকে মুক্ত হয়ে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আনা। তার উপর নাযিলকৃত কিতাব ও শরীয়ত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা।
মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও সফলতা এই যে, তারা ঐ পথ পরিহার করে চলবে, যে পথ থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে সতেরো বার আল্লাহর কাছে সে আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং সে পথে পরিপূর্ণরূপে উঠে আসবে, যে পথে পরিচালিত করবার জন্য প্রতিদিন আল্লাহর কাছে মিনতি করে, সে বলে-
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَلَا الضَّآ لِّیْنَ.
আমাদের সরল পথে পরিচালিত করুন। সে সকল লোকের পথে, যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন। তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি গযব নাযিল হয়েছে। এবং তাদের পথেও নয়, যারা পথহারা। -সূরা ফাতেহা (১) : ৬-৭
হাদীসে এসেছে- الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ (যাদের উপর গযব নাযিল হয়েছে) হল, ইহুদী সম্প্রদায় এবং الضَّآلِّیْن (যারা পথহারা) হল, খ্রিস্টান সম্প্রদায়।