গত ২রা নভেম্বর বেলফোর ঘোষণার শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপন করেছে ইসরাইল। ব্রিটেনের বর্তমান সরকারও এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ২ নভেম্বর সন্ধ্যায় লন্ডনের ল্যানচেস্টার হাউজে আয়োজিত ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু ও দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে এই উদ্যাপনের বিরোধিতা করে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ঐ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। জেরেমি মনে করেন, এই ঘোষণার শতবর্ষপূর্তিতে গর্ব করার কিছু নেই; বরং এটা যুক্তরাজ্যের জন্য লজ্জাজনক। কারণ বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তীনী জাতিকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। (মিড্লইস্ট আইয়ের সূত্রে নয়াদিগন্ত, ৩ নভেম্বর, ২০১৭)
ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন যে কথাটি বলেছেন তার কিছু ভাব সম্প্রসারণ প্রয়োজন।
Balfour Declaration বা বেলফোর ঘোষণার নামকরণ সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোরের নামানুসারে। ২ নভেম্বর ১৯১৭ আর্থার বেলফোর ফিলিস্তীনে একটি ইহুদী-আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জায়নিস্ট লিডার Lord Rothsehild -কে যে চিঠি লিখেছিলেন তা-ই বেলফোর ডিক্লারেশন নামে পরিচিত। পরবর্তীতে জায়নিস্ট তৎপরতা ও তৎকালীন বিশ্বশক্তিসমূহের সমর্থনে এই চিঠি ফিলিস্তীনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের লীগ অব নেশন্সের দলীলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক ‘স্বীকৃতি’ লাভ করে। অথচ ন্যায়, যুক্তি ও মানবতা সকল বিচারেই এই ঘোষণা ছিল এক লজ্জাজনক ও কলঙ্কিত ঘোষণা। তা ছিল একটি ভূখণ্ডের বৈধ অধিবাসীদের উৎখাত করে সেই জায়গায় অন্যদের প্রতিষ্ঠিত করার এক অবৈধ প্রতিশ্রুতি। উপরন্তু এই প্রতিশ্রুতিও ছিল এমন এক পক্ষ থেকে, যাদের ঐ ভূখণ্ডে কোনোরূপ অধিকার নেই।
এই অন্যায় ও অবৈধ প্রতিশ্রুতিই ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হয়েছে ফিলিস্তীনে । এই ঘোষণা যেমন ব্রিটিশ ইতিহাসের এক কলঙ্কিত ঘোষণা, তেমনি তা বাস্তবায়নের ইতিহাসও মিথ্যাচার, শঠতা ও অঙ্গীকারভঙ্গের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। বিষয়টি মোটামুটিভাবে বোঝার জন্য ঐ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু পূর্ব-ধারণা আবশ্যক।
১৯১৭ সালে আর্থার বেলফোরের এই ঘোষণারও অনেক আগে নেপোলিয়ান বেনাপোর্ট (১৭৬৯-১৮২১) এই অঞ্চলে ইহুদী বসতি স্থাপনের কথা বলেছিলেন। এটা ১৭৯৯ সালে তার মিশর আক্রমণের সময়কার ঘটনা। এর পেছনে কার্যকর ছিল ইহুদীদেরকে ঔপনিবেশিক স্বার্থে ব্যবহারের চিন্তা। মূলত ঐ সময় থেকেই ফিলিস্তীন অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শ্যেনদৃষ্টির শিকার হয় এবং ইহুদী-তোষণ নীতি গ্রহণ করা হয়।
১৮৭৮ সালে সাইপ্রাস এবং ১৮৮২ সালে মিশর দখলের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এসকল অঞ্চলের সাথে ভারতবর্ষ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলোতে যোগাযোগের জন্য সুয়েজখালের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কাজেই এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষায় প্রয়োজন ছিল এক বিশ্বস্ত মিত্রের। এটা যেমন উসমানী সালতানাতের পরে অনুরূপ আরেকটি ইসলামী শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা রোধের জন্য প্রয়োজন ছিল তেমনি ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যও প্রয়োজন ছিল।
১৯০৫ থেকে ১৯০৭ সময়কালে লন্ডনে ইতিহাস, রাজনীতি, ভূগোল, খনিজসম্পদ প্রভৃতি নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের যে গোপন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষা ও মুসলিমবিশ্বকে দ্বিধাবিভক্ত ও পদানত রাখার কৌশল হিসাবে একটি ‘বিভাজক রাষ্ট্রের’ ধারণা পেশ করা হয়। এই সম্মেলনের প্রস্তাবনা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যাম্বেল ব্যানারম্যানের কাছে উপস্থাপিত হয়েছিল, যাতে সুপারিশ করা হয়েছিল, ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে সুয়েজখালের নিকটবর্তী কোনো স্থানে একটি শক্তিশালী ‘বিভাজক রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা একইসাথে হবে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর বৈরী এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের মিত্র।
এদিকে জায়নিস্ট নেতৃবৃন্দেরও জানা ছিল যে, জয়নাবাদী এই আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য “ফিলিস্তীন অঞ্চলে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা”-এর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য পৃথিবীর বড় শক্তিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদী আন্দোলনের স্বার্থ এখানে একসূত্রে মিলিত হয়েছিল।
World Zionist Organaization -এর প্রধান থিয়োডোর হার্জেল (Theodor Harzl) ব্রিটিশ উপনিবেশমন্ত্রী জোসেফ চেম্বারলেনকে ১৯০২ সালেই বলেছিলেন, ফিলিস্তীনেই হতে হবে আমাদের রাজধানী। আর এটাই হতে পারে ঐ বিভাজন রাষ্ট্র, যা ব্রিটেনের স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করবে।
১৯১৪-১৯১৮-এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জায়নবাদ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে। একদিকে মার্কিন ইহুদী লবির মাধ্যমে আমেরিকাকে ব্রিটিশ মিত্রজোটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জায়নিস্ট শক্তির আনুকূল্য ব্রিটেনের প্রয়োজন ছিল অন্যদিকে খোদ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও তৎপর ছিল জায়নিস্ট লবি। ব্রিটেনের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারবার্ট স্যামুয়েল (H. Samuel) ছিলেন একজন জায়নবাদী ইহুদী । এছাড়া প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ খ. এড়ধৎম ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ছিলেন জায়নবাদী খ্রিস্টান। ১৯১৭ সালের মার্চে আমেরিকা ব্রিটিশ মিত্রজোটের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এর পরপরই ২রা নভেম্বর আসে বেলফোর ঘোষণা।
ফিলিস্তীনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক নীলনকশার আরো দলীল হচ্ছে ১৯১৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত Sykes-Picot Agreemant । এটি ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মাঝে সম্পাদিত একটি চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে বর্তমান ইরাকের সিংহভাগ অঞ্চল, পূর্ব জর্ডান ও ফিলিস্তীনের হাইফা ব্রিটেনের ভাগে আর লেবানন ও সিরিয়া ফ্রান্সের ভাগে দেওয়া হয়। আসতানা (ইস্তাম্বুল), বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালী দেওয়া হয় রাশিয়ার ভাগে। আর সব পক্ষের সমান আগ্রহ থাকায় ফিলিস্তীনকে রাখা হয় আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে। পরবর্তীতে ব্রিটেন ফিলিস্তীনে ম্যান্ডেট-কর্তৃত্ব গ্রহণ করে।
এখানে একটু কথা বলে নিই, ম্যান্ডেট-ব্যবস্থা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে উদ্ভাবিত একটি বিশেষ ব্যবস্থা। পরাজিত জার্মানী ও তুর্কীর শাসনাধীন বিভিন্ন অঞ্চল তৎকালীন বিশ্বসংস্থা লীগ অব নেশন্সের পক্ষ হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজয়ী মিত্রজোটের বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসন-নিয়ন্ত্রণে অর্পণের জন্য এই ব্যবস্থার উদ্ভাবন। এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছিল, এই সকল অঞ্চল যেহেতু রাজনৈতিকভাবে অনুন্নত তাই এদের স্বাধীন রাষ্ট্রের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য কিছু সময় এদেরকে উন্নত দেশসমূহের তত্ত্বাবধানে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল এই সকল অঞ্চলে বড় শক্তিগুলোর উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে ব্যাপক শোষণের দ্বার উন্মুক্ত করা। এই ম্যান্ডেট-ব্যবস্থার ধারা ও অঙ্গীকার এবং সেগুলো পদদলিত হওয়ার ইতিহাসও ব্রিটেনের লজ্জা ও কলঙ্কের ইতিহাস। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এই প্রেক্ষাপট সামনে রেখে যদি মক্কার শরীফ (গভর্নর) হোসাইন ইবনে আলীর সাথে কৃত ব্রিটিশ চুক্তি ও অঙ্গীকারগুলো স্মরণ করা হয় তাহলে বোঝা যাবে, এই প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের প্রতিটি শব্দ-বাক্য কী পরিমাণ শঠতা ও ধূর্ততাপূর্ণ ছিল।
জুলাই ১৯১৫ থেকে মার্চ ১৯১৬ পর্যন্ত হোসাইন-ম্যাকমেহন আলোচনার মূল বিষয় ছিল, সালতানাতে উসমানিয়ার বিরুদ্ধে হোসাইনের বিদ্রোহ ঘোষণা এবং এর বিনিময়ে হোসাইনের নেতৃত্বে ইরাক, শাম ও জাযীরাতুল আরবের অধিকাংশ ভূখণ্ডের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি। ১০ জুন ১৯১৬ শরীফ হোসাইন উসমানী সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ব্রিটেনের পক্ষ অবলম্বন করে। আর এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ কূটনীতি সফল হয়। এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ফিলিস্তীন অঞ্চলে অনুপ্রবেশ সহজ হয়ে যায়।
এরই মাঝে একটুখানি ছন্দপতন ঘটে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে জারের পতনের কারণে। ১৯১৭-এর অক্টোবর বিপ্লবের পর ঝুশবং-চরপড়ঃ চুক্তি প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং নভেম্বরের বেলফোর ঘোষণাও এক সপ্তাহের মধ্যেই জনসমক্ষে চলে আসে। এতে আরব বিদ্রোহীরা বড় রকমের ধাক্কা খায় এবং মিত্র জোটের সাথে সহযোগিতা চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু গোড়া থেকেই যেহেতু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চুক্তি-অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি সবই ছিল শঠতা ও মুনাফেকী এবং নিজেদের নীলনকশা বাস্তবায়নের হাতিয়ারমাত্র, কাজেই এসব অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে এবং সেগুলো আরো দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করতে তাদের কোনো অসুবিধা ছিল না। ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন কি ‘লজ্জাজনক’ বলে এসবকেও বুঝিয়েছেন?
শরীফ হোসাইন ও অন্যান্য আরব বিদ্রোহী নেতাদের আশ্বস্ত করবার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নানা কৌশল গ্রহণ করে। ১৯১৮-এর জানুয়ারিতে কায়রোয় অবস্থিত ব্রিটিশ আরব সংস্থার প্রধান ডেভিড জর্জ হোগার্থকে এই আশ্বাস দিয়ে পাঠানো হয় যে, ফিলিস্তীনে ইহুদী আগমন এ অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে না! তদ্রূপ জুন ১৯১৮ সিরিয়ান নেতৃবৃন্দকেও এই আশ্বাস দেওয়া হয় যে, ব্রিটেনের অধিকৃত ভূখ-সমূহ অর্থাৎ দক্ষিণ ফিলিস্তীন ও দক্ষিণ ইরাকে তথাকার জনগণের ইচ্ছা অনুসারেই শাসন পরিচালিত হবে। ১৯১৮-এর ১৫ই জানুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী খ. এড়ধৎম এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন যে, ফিলিস্তীন, সিরিয়া, ইরাক ও জাযীরাতুল আরবের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ঐসকল ভূখণ্ডে স্বদেশী শাসন প্রতিষ্ঠার অধিকার ব্রিটেন স্বীকার করে। এ বছরেরই ৮ ফেব্রুয়ারি স্বয়ং আর্থার বেলফোর ব্রিটেন ও মিত্র জোটের পক্ষ হতে হোসাইন ইবনে আলীকে এই মর্মে তারবার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘ব্রিটিশ সরকার আরবের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সমর্থন করে পূর্বের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে। যে সকল আরব ভূখ- এখনো স্বাধীনতা অর্জন করেনি যুদ্ধের পর তাদেরকে স্বাধীনতা প্রদান করা হবে।’ বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর ১৯১৮ সালের ৭ নভেম্বর এ্যাংলোফরাসি ঘোষণা প্রকাশিত হয়। তাতেও উসমানী সালতানাতের অধীনে থাকা আরব ভূখ-গুলোর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
এই সকল ঘোষণা ও অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে বারবার ফিলিস্তীনে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
আরেকটি বড় দলীল হচ্ছে, লীগ অব নেশন্সের নীতি ও প্রতিশ্রুতিসমূহ, যার ভিত্তিতে ফিলিস্তীনে ব্রিটিশ-ম্যান্ডেটের আইনী ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐসকল নীতি ও উদ্দেশ্যের কিছু কথা নিম্নরূপ :
ক. এই সকল জাতিসত্তার উন্নতি-অগ্রগতি সভ্যতার কাঁধে অর্পিত এক পবিত্র আমানত।
খ. ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব হচ্ছে, ঐ ভূখণ্ডের অধিবাসীরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত ‘শুধু পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান’।
গ. ম্যান্ডেট-রাষ্ট্র নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডের অধিবাসীদের ইচ্ছাই মৌলিক।
বলাই বাহুল্য যে, এই সকল মৌখিক ও লিখিত নীতি ও অঙ্গীকার শুধু কূটকৌশলই ছিল। বাস্তবে উদ্দেশ্য ছিল, উসমানী সালতানাতের অধীনে একতাবদ্ধ আরব ভূখ-কে টুকরো টুকরো করা এবং আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের সংযোগস্থলে একটি বৈরী ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যার নীলনকশা অনেক আগেই প্রস্তুত ছিল। জেরেমি করবিন কি ‘লজ্জাজনক’ বলে এই সকল অঙ্গীকারকেও স্মরণ করেছেন?
১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ ও মধ্য ফিলিস্তীন অধিকার করে। জেরুজালেমে প্রবেশ করে (৯ ডিসেম্বর ১৯১৭) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এলেনবি (অষষবহনু) বিজয় অনুষ্ঠানে যে বাক্যটি উচ্চারণ করেন তা হচ্ছে, ‘আজ ক্রুসেডের পরিসমাপ্তি ঘটল!’
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ বাহিনী উত্তর ফিলিস্তীন অধিকার করে এবং এর পরপরই অধিকৃত হয় পূর্ব জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন। এখানে যদি ফ্রান্সের সিরিয়া অধিকারের হৃদয়বিদারক কাহিনীটি পাঠকের সাথে ভাগাভাগী করতে পারতাম তাহলেও বুকের চাপা কষ্ট কিছুটা হালকা হত। সেটা অন্য কোনো অবসরের জন্য তোলা রইল। ১৯২২ সালে তৎকালীন লীগ অব নেশন্সের পক্ষ হতে ব্রিটেন ফিলিস্তীন অঞ্চলের ম্যান্ডেট লাভ করে। অবশ্য এর আগেই জুন ১৯২০ সালে সামরিক শাসনের স্থলে রাজনৈতিক শাসন চালু করা হয়। ফিলিস্তীনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের প্রথম হাইকমিশনার নিযুক্ত হন জায়নবাদী ইহুদী স্যার হারবার্ট স্যামুয়েল। (১৯২০-১৯২৫)। তিনি এবং পরবর্তী ব্রিটিশ হাইকমিশনারগণ ঐ নীলনকশাই বাস্তবায়ন করতে থাকেন, যা বেলফোর ঘোষণায় উচ্চারিত হয়েছিল।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের ছত্রছায়ায় ধাপে ধাপে ফিলিস্তীনে একটি জায়নিস্ট ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আরব জনগণ বুঝতে পারেননি তা নয়। কিন্তু তারা এমন এক আন্তর্জাতিক চক্রান্তের নিগড়ে আবদ্ধ ছিলেন যে, তা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে শুরু থেকেই ফিলিস্তীনী জনগণের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। ১৯৩৬-৩৯ এর ব্যাপক বিদ্রোহের কারণে মে ১৯৩৯ সালে ব্রিটেন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশে বাধ্য হয়, যাতে দশ বছরের মধ্যে ফিলিস্তীনের স্বাধীনতা এবং ৫ বছরের মধ্যে ইহুদী অনুপ্রবেশ বন্ধের অঙ্গীকার করা হয়, কিন্তু সেই দশ ও পাঁচ বছর ফিলিস্তীনী জনগণের জীবনে আজো আসেনি।
১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৪৮ সালে যে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাতে বিশ্বের তৎকালীন দুই পরাশক্তি আমেরিকা-রাশিয়া এবং বিশ্বের জাতিসমূহের ‘অভিভাবক সংস্থা’ জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ফিলিস্তীনের ৭৭% ভূমি ইহুদীদের দখলে চলে যায়। অথচ ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সূচনায় ফিলিস্তীন ভূখণ্ডের মাত্র ২% ছিল ইহুদীদের দখলে। এই হচ্ছে সেই স্বাধীনতা, যার প্রতিশ্রুতি আরব মুসলমানদের দেওয়া হয়েছিল। জেরেমি করবিন কি ‘লজ্জাজনক’ বলে এই সকল বাস্তবতাও স্মরণ করেছেন?
বলার মতো আরো অনেক কিছুই তো আছে। কিন্তু সবশেষে যে প্রশ্নটি করতে চাই তা হচ্ছে, মিস্টার করবিন! ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ আছে দাবি করে ইঙ্গ-মার্কিন জোট ঐ ভূখ-কে জ্বালিয়ে ছারখার করার পর এই কিছু দিন আগে আপনার দলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এটাকে একটা ভুল বলে স্বীকার করেছেন। আপনিও বেলফোর ঘোষণাকে একটি লজ্জাজনক বিষয় বলে স্বীকার করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব স্বীকারোক্তির দ্বারা ভুক্তভোগী জাতিগোষ্ঠীর বিন্দুমাত্রও উপকার হয়েছে কি? ষোলআনা স্বার্থ সিদ্ধির পর এই ‘সরি’ কথাটিও ব্রিটিশ শঠতারই আরেক নমুনা নয় তো?