রবিউল আউয়াল ১৪৩৯   ||   ডিসেম্বর ২০১৭

অবক্ষয় : ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য

সম্প্রতি আমাদের সমাজে কিছু কিছু পরিবারে এমন সব ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে, যার সাথে আমাদের আবহমানকালের জীবনধারার কোনো মিল নেই। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ও অপসংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের ফলে ভয়াবহ বিকারের নানা উপসর্গ তো একে একে প্রকাশিত হচ্ছিলই, এখন রোমহর্ষক যে বিষয়টির একাধিক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে তা হচ্ছে, প্রবৃত্তির তাড়নার কাছে মাতৃ-মমতারও পরাজয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরকীয়ার ঘটনা জেনে ফেলায় মায়ের হাতে সন্তান নিহত হওয়ার ঘটনা দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। যে জাতির বিকার এই পর্যায়ে নেমে আসে তার ভবিষ্যত সত্যিই অন্ধকার। কাজেই এই ব্যধির আশু-চিকিৎসা প্রয়োজন। মায়ের কোল মানব-শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। এই আশ্রয় টুটে যাওয়ার অর্থ- মানবজাতির ভবিষ্যত ছিঁড়ে যাওয়া তাসবীহের দানার মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া। শোনা যায়, প্রাণী জগতের কোনো কোনো প্রাণীর শাবক জন্মাবার পর পুরুষ প্রাণীটি ঐ শাবকগুলোকে খেয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু মায়ের আশ্রয়েই শাবকগুলো রক্ষা পায় এবং বেড়ে ওঠে। মানবশিশুরও সুরক্ষা ও বেড়ে ওঠার জন্য মাতৃমমতা এক বিকল্পহীন বিষয়। কিন্তু বর্তমান ঈমান-আমলহীন জীবনব্যবস্থা মানবজাতির এই নিরাপদ আশ্রয়টিকেও তছনছ করে দিচ্ছে। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে প্রভাবক যে গুণ ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে সন্তানের প্রতি মমতা অন্যতম। এক হাদীসে তিনি বলেছেন- نِسَاءُ قُرَيْشٍ خَيْرُ نِسَاءٍ رَكِبْنَ الإِبِلَ، أَحْنَاهُ عَلَى طِفْلٍ، وَأَرْعَاهُ عَلَى زَوْجٍ فِي ذَاتِ يَدِهِ কুরাইশের নারীগণ আরবের শ্রেষ্ঠ নারী। কারণ তারা সন্তানের প্রতি সর্বাধিক মমতাময়ী এবং স্বামীর সম্পদের সর্বাধিক হেফাযতকারী। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫২৭ দেখুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীসে শ্রেষ্ঠ নারীদের শুধু দুটি গুণ উল্লেখ করেছেন, যার প্রথমটি হচ্ছে সন্তানের প্রতি গভীর মমতা। এই মমতা যার যত বেশি তার শ্রেষ্ঠত্বও তত বেশি। এটা যেমন নারীর নিজের সম্পদ তেমনি জাতিরও মহাসম্পদ। এই মমতার কারণেই সহজ হয় সন্তানের জন্য মায়ের পরম আত্মত্যাগ। মুসলিম নারীর এই ত্যাগ কখনো বৃথা যায় না। এরই মাধ্যমে তিনি লাভ করেন আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি। মানুষের প্রত্যেক শ্রেণীর জন্য রয়েছে স্বীয় দায়িত্ব হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বিভিন্ন উপায়। নারীর জন্য এক বড় উপায় হচ্ছে, পরম মমতায় সন্তানের লালন-পালন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. মাতৃমমতার এক অনিন্দ্যসুন্দর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একদিন আমার কাছে এক মিসকীন নারী এল। সঙ্গে তার দুটি কন্যা। আমি তাকে তিনটি খেজুর দিলাম। সে দুই মেয়েকে দুটি খেজুর দিল। তৃতীয় খেজুরটি নিজের মুখে দিতে যাবে এমন সময় দেখল, ক্ষুধার্ত মেয়ে দুটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তখন তৃতীয় খেজুরটিও দুই ভাগ করে দুই মেয়েকে দিয়ে দিল। উম্মুল মুমিনীন বলেন, এই ঘটনায় আমি খুবই আপ্লুত হলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে এলে তাঁকেও জানালাম। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন- إِنّ اللهَ قَدْ أَوْجَبَ لَهَا بِهَا الْجَنّةَ، أَوْ أَعْتَقَهَا بِهَا مِنَ النّارِ আল্লাহ তাআলা ঐ খেজুরটির বিনিময়ে তার জন্য জান্নাত অবধারিত করে দিয়েছেন। অথবা বলেছেন, ঐ খেজুরটির বিনিময়ে তাকে জাহান্নাম থেকে নাজাত দিয়েছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩০ এই হাদীস থেকে পাওয়া যাচ্ছে যে, মাতৃমমতা নারীর এক মহাসম্পদ। তার জান্নাতে যাওয়ার এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়ার এক বড় উপায়। মাতৃমমতার মহিমা বোঝার জন্য এ-ই যথেষ্ট যে, এর উপমা দিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝিয়েছেন আল্লাহর রহমতকে। বুখারী ও মুসলিমে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু যুদ্ধ-বন্দী উপস্থিত হল। দলে একটি নারী ছিল, যে কোনো শিশুকে পেলেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দুধ পান করাচ্ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মমতার দৃশ্য দেখে সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, বলতো, এই নারীটি কি তার সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করতে পারে? সাহাবীগণ বললেন, পারতপক্ষে সে তা করবে না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- لله أَرْحَمُ بِعِبَادِهِ مِنْ هَذِهِ بِوَلَدِهَا আপন সন্তানের প্রতি এই নারীর যে মমতা আপন বান্দাদের প্রতি আল্লাহর মমতা তার চেয়েও বেশি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৫৪ মাতৃমমতার কী মহিমা! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর এই পবিত্র বস্তুটির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার রহমতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাহলে তাঁর উম্মত ও অনুসারী হিসেবে এই মহাসম্পদের মূল্যায়ন ও বিকাশে সচেষ্ট হওয়া কি আমাদের কর্তব্য হয়ে যায় না? যে জাতি এই সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে তাদের দুর্ভাগ্যের কোনো শেষ থাকবে না। পৃথিবীর সকল নিআমতের মতো এই নিআমতও আল্লাহরই দান। আল্লাহর বিধান পালনের দ্বারাই এই নিআমত অর্জিত হতে পারে এবং উত্তম স্বভাব-চরিত্র গঠিত হতে পারে। কুরআন মাজীদের এক জায়গায় আল্লাহর নবী হযরত ইয়াহইয়া আ.-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে- وَّ حَنَانًا مِّنْ لَّدُنَّا وَ زَكٰوةً وَ كَانَ تَقِیًّا. তাকে আমি দান করেছিলাম আমার পক্ষ থেকে মমতা ও পবিত্রতা। আর সে ছিল মুত্তাকী। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ১৩ এই আয়াতের ‘আমার পক্ষ থেকে’ কথাটির ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মনীষী রবী‘ রাহ. বলেছেন- لا يملك عطاءها أحد غيرنا অর্থাৎ আমি ছাড়া আর কেউ তা দান করতে পারে না। -আদ্দুররুল মানসূর, সুয়ূতী ৫/৪৮৬ কাজেই এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মাতৃমমতার মতো কল্যাণপূর্ণ প্রেরণা, যা পরিবার ও সমাজের এক রক্ষাকবচ, তা একমাত্র আল্লাহরই দান। তাই এর রক্ষা ও বিকাশের পথও সেটিই, যা আল্লাহ তাআলা নির্দেশ করেছেন। সেই পথ ত্যাগ করে অন্য কোনো পথ গ্রহণ করা, তা প্রগতি, নারী-মুক্তি কিংবা নারী-স্বাধীনতা যে নামেই হোক তা যেমন নারীর নিজের জন্যও আত্মঘাতী তেমনি পরিবার ও সমাজের জন্যও চরম বিধ্বংসী। এই ভিন্ন পথ নারী ও সমাজকে বঞ্চিত করবে মাতৃমমতার মতো পরম নিআমত থেকে। এরই মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে মায়ের হাতে সন্তান হত্যার মতো রোমহর্ষক ঘটনা। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। বস্তুত ঈমান ও আমলে ছালেহই হচ্ছে ঐ পথ, যার দ্বারা বিকশিত হয় মানবের মানবতা, বিকশিত হয় উন্নত ও অনন্য গুণাবলী। অন্যথায় সে হয়ে পড়ে পশুরও অধম। আল্লাহ তাআলার এই বাণী কতই না সত্য- لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِیْۤ اَحْسَنِ تَقْوِیْمٍ ثُمَّ رَدَدْنٰهُ اَسْفَلَ سٰفِلِیْنَ اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَلَهُمْ اَجْرٌ غَیْرُ مَمْنُوْنٍ. অর্থাৎ আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে। অতপর আমি তাকে পরিণত করি হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে। কিন্তু তাদেরকে নয়, যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ। এদের জন্য তো আছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার। -সূরা ত্বীন (৯৫) : ৪-৫

 

 

advertisement