অসাম্প্রদায়িকতা : ইতিবাচক
চারদিকের অসংখ্য অসুন্দর ঘটনার মধ্যেও যে লুকিয়ে থাকে কিছু সুন্দর গল্প তা আমরা মাঝে মাঝেই জানতে পারি। জানতে পেরে আনন্দিত হই এবং আশাবাদী হই। এরকমই একটি সুন্দর গল্পের অনুভূতি পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই।
মাগুরা জেলার শালিথা থানাধীন একটি ইউনিয়নের নাম গঙ্গারামপুর। এই ইউনিয়নের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এটি ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন ও স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই স্কুলের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কৃষ্ণ গোপাল ভট্টাচার্য। ৩৫ বছর শিক্ষকতার পর তিনি অবসরে যান। এরপর থেকে অসুস্থতা ও দারিদ্র তার নিত্যসঙ্গী। শিক্ষকের এই অবস্থা তার এক ছাত্রের মনে রেখাপাত করে। তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন, যার ক্যাপশন ছিল ‘স্যারের অসুস্থতা’। এটা মাস দুয়েক আগের কথা। একপর্যায়ে পোস্টটি নজরে পড়ে তার আরেক ছাত্র মুহাম্মাদ রহমান মৃধার। ১৯৮৫ সালে সুইডেনে পাড়ি জমানো রহমান মৃধা দুই বছর গঙ্গারামপুর স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেন, ‘পোস্টটি নজরে পড়ার পর আমি খুবই লজ্জিত হলাম, আমি তাঁর ছাত্র একথা ভাবতেই মনে হচ্ছিল, মরে যাই।’ এরপর এই কৃতার্থ ছাত্রটি সুইডেন থেকে তার শিক্ষকের খোঁজখবর নিতে থাকেন। তিনি বলেন, আমি স্যারকে আবেদন করি তাকে একটি বাড়ি করে দিব। স্যার কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। অবশেষে জোর আবদার করি এবং নিজের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ ভিক্ষা চাই। এতে স্যার অনুমতি দেন।
রহমান মৃধা উদ্যোগ নেয়ার পর আরো অনেকে এগিয়ে আসেন তার সাথে শামিল হওয়ার জন্য। গত ২ অক্টোবর সকাল ১০ টায় মাগুরা জেলা প্রশাসক, মনোখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে প্রিয় শিক্ষকের বাড়ি নির্মাণের শুভ উদ্বোধন করেন তার ছাত্ররা। (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৮ অক্টোবর, ২০১৭)
প্রিয় পাঠক! গল্পটি নিশ্চয়ই আপনারও ভালো লেগেছে। আমরা মুহাম্মাদ রহমান মৃধা ও তাঁর বন্ধুদের অভিনন্দন জানাই, শিক্ষকের প্রতি এই কর্তব্যবোধ ও কৃতজ্ঞতাবোধের পরিচয় দেয়ার জন্য। এটি যেমন মমতা ও মানবতার এক সুন্দর দৃষ্টান্ত তেমনি কৃতজ্ঞতা ও কর্তব্যবোধেরও অনুসরণীয় উদাহরণ।
মুহাম্মাদ রহমান মৃধা তার অনুভূতিও প্রকাশ করেছেন সুন্দর ভাষায়- ‘আমি গোটা বিশে^র ছাত্রদের জানিয়ে দিতে চাই, স্যারের মতো মহৎ ব্যক্তিত্ব, যারা যুগের পর যুগ নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবায়, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে জ্ঞানের আলো বিতরণ করেছেন তাদের জীবনের শেষ সময়টি যেন দুরূহ কায়-ক্লেশের জীবন না হয় সে জন্যই আমার এই উদ্যোগ’।
পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবে যেখানে আজ অনেক প্রবীণ-প্রবীণারই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে অতি নিঃসঙ্গতায় সেখানে এই অনুভূতি সত্যিই সুন্দর। এই চেতনা সব জায়গায় ছড়িয়ে যাক। আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক-উস্তাযের শেষ জীবনটি যেন নিঃসঙ্গতার জীবন না হয়, সন্তান-সন্ততি, ছাত্র ও গুণগ্রাহীদের সাহচর্যে তাদের জীবনের শেষ যেন হয়ে ওঠে আনন্দের ও তৃপ্তির এই চেষ্টা আমাদের সবারই থাকা উচিত।
একইসাথে কৃতার্থ সন্তানের এটাও কি ভাবা উচিত নয় যে, উপকারীর পরকালীন জীবনটিও কীভাবে সুখী হতে পারে? বিষয়টি কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল? আসলে অপ্রাসঙ্গিক নয়। আখিরাতের জীবন এক বাস্তবতা। ঐ জীবনের মুক্তি ও নাজাত মানুষমাত্রেরই অতি বড় প্রয়োজন। সেই নাজাতের পথ ঈমান ও ইসলাম। একারণে মমতা ও মানবতার যে প্রেরণা থেকে একজন হৃদয়বান মানুষ কারো সেবায় এগিয়ে আসেন সেই একই প্রেরণা থেকে ঐ মানুষটির পারলৌকিক মুক্তির চিন্তা-ভাবনা করাও কর্তব্য।
যে মানুষগুলো তাদের গোটা জীবন ব্যয় করেছেন সৃষ্টির সেবায় তারাই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন তার লা-শরীক স্রষ্টার সাথে শিরকের মহা অপরাধে অপরাধী হয়ে তা ভাবতেও মন ভেঙ্গে যায়। আহা! যে মানুষগুলো অর্জন করেছেন তাদের ‘হাতে-গড়া’ ছাত্রদের ভালবাসা তারা যদি লা-শরীক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভেও সমর্থ হতেন, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন!
গল্পের ছাত্র-শিক্ষক সবার প্রতি শুভকামনা, করুণাময় আল্লাহ তাঁদের জীনবকে সুখ-শান্তিতে ভরে দিন এবং সকলকে সিরাতে মুসতাকীমে পরিচালিত করুন- আমীন।
ليس يزري السوادُ بالرجلِ الشهم + ولا بالفتى الأديبِ الأريبِ
إن يكن للسواد فيك نصيبٌ + فبياضُ الأخلاقِ منكَ نصيبي
অর্থাৎ গুণ ও যোগ্যতার শুভ্রতাই বড় শুভ্রতা আর চিন্তা-চেতনার কৃষ্ণতাই প্রকৃত কৃষ্ণতা। কাজেই মেধা, মনন ও চরিত্র-সুষমা যে অর্জন করেছে তার গায়ের কালো রং দোষের হতে পারে না। আর এ কারণেই তোমার গাত্র বর্ণ-নয়, আমি গুণগ্রাহী তোমার চারিত্রিক শুভ্রতার।
আসলে বর্ণবাদই হচ্ছে এক ঘোর কৃষ্ণতা। এই কৃষ্ণতা থেকে যে মুক্ত সবাই তার শুভ্র উদার ব্যবহার লাভ করবে। কোনো কৃষ্ণ বর্ণের মানুষও তার সংকীর্ণ আচরণের শিকার হবে না। যদি হয় বুঝতে হবে তার ভেতরটা কৃষ্ণতামুক্ত নয়। কাজেই ঐ কালো বর্ণের মানুষটির কৃষ্ণতার উপর নয়, তার মাতম করা উচিত নিজের ভেতরের কৃষ্ণতার উপর।
দেখুন, পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী, বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে বিভেদ-বিভক্তির যে কূটচাল অব্যাহত রেখেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে মুসলিম জনপদগুলোতে যে আগুন প্রজ্জ্বালিত করেছে এ আগুন তাদের জনপদেও ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মতো। আসলে অগ্নি থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গই ঝরে, ফুল ঝরে না। প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেদের প্রজ্জ্বালিত এই আগুন থেকে মার্কিনীদের কে রক্ষা করবে।