সফর ১৪৩৯   ||   নভেম্বর ২০১৭

অবক্ষয় : নারীত্বের অবমাননা

গোলামে এলাহী

দেশে নৈতিক স্খলন ও ধর্ষণ-নির্যাতনের ভয়াবহ বিস্তারের মধ্যেই শোনা গেল, বাংলাদেশ বিশ^সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে। বহুদিন থেকেই বাংলাদেশে চলছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় নানা ধরনের প্রতিযোগিতা। এতে শেষ পর্যায়ে দু’চারজন বিজয়ী হলেও প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে পরিচালিত হয় বাছাই তৎপরতা, যার সাথে যুক্ত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মেয়ে। এইসব প্রতিযোগিতার খবর ও অনুষ্ঠান ফলাও করে প্রচার করা হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। যার পাঠক-দর্শক দেশের সকল শ্রেণির সব বয়েসের নারী-পুরুষ। গোটা দেশে অবক্ষয়-অশ্লীলতা বিস্তারের এটা যে কত বড় উপায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এরই ধারাবাহিকতায় আরো এক ধাপ এগিয়ে এবার আয়োজন করা হয়েছে ‘মিসওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতা। উদ্দেশ্য, ১৮ নভেম্বর চীনের সানাইয়া শহরে অনুষ্ঠেয় ৬৭ তম মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার জন্য বাংলাদেশী প্রতিযোগী নির্বাচন। দেশব্যাপী প্রচার-প্রচারণা, নিবন্ধন ও বাছাইয়ের পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারের নবরাত্রী মিলনায়তনে আয়োজিত হয় মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ -এর গ্র্যান্ড ফিনালে। এতে নানা কিছুর পর একজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে।

‘নানা কিছুর পর’ কথাটির তাৎপর্য সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন।

এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস ডাই ভার্সিটি প্রোগ্রামের কর্মসূচি সমন্বয়ক একজন নারী লিখেছেন, ‘সুন্দরী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বয়স একটা শর্ত হতে পারে, কিন্তু প্রার্থীর বৈবাহিক অবস্থা এক্ষেত্রে সত্যিই অত্যন্ত রুচিহীন একটি শর্ত এবং তা হাস্যকরও বটে। প্রশ্ন আসে মনে, তাহলে কি বিবাহের মাধ্যমে একজন নারীর সৌন্দর্যের পরিসমাপ্তি ঘটে? আর যদি অবিবাহিত শর্ত জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে নারীর কুমারিত্বকে ইঙ্গিত করা হয় তবে তা একজন নারীর জন্য যে কতটা অপমানজনক, বলার অপেক্ষা রাখে না।’ (প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর, ২০১৭)

এজাতীয় আয়োজন অনুষ্ঠানের পেছনে যে কুৎসিত ব্যাপার-স্যাপারগুলো থাকে, তা সাধারণত আলো ঝলমলে অনুষ্ঠানস্থল এবং আয়োজক-উপস্থাপকের পাট-ভাঙ্গা উপস্থাপনায় প্রকাশিত হয় না। এগুলো সাধারণত পর্দার পেছনের ব্লু রুমের বিষয়াশয়। কিন্তু দক্ষিণ হস্তের কর্মে পাকা হয়ে ওঠার আগে যেমনটা হয়, দু-চার বার ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে, এই রকমেরই একটা ব্যাপার এখানেও ঘটেছে। বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই, বিচারকদের রায় এক রকম, উপস্থাপকের ঘোষণায় অন্য রকম, আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের বক্তব্য আরেক রকম- এই সব থেকে ঐ অপরিপক্কতার দিকটিই ফুটে উঠেছে।

বাংলাদেশে এই পাপের ধারার সূচনা করল অন্তর শোবিজ ও অমিকন এন্টারটেইনমেন্ট নামক দুটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেরা এদেশে এই পাপের পথিকৃত হয়ে রইলেন। দুনিয়া-আখেরাতে এর অনিষ্ট এদের বহন করতে হবে। হাজার হাজার মুসলিম তরুণ-তরুণীকে বিপথগামী করবার এই পাপ যে কী ভয়াবহ তা অবশ্যই একদিন তারা উপলব্ধি করবেন। দেশের দায়িত্বশীলেরাও এর দায় এড়াতে পারবেন না। ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী চেতনা যদি কারো নাও থাকে, অন্তত সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের বাস্তবতা সম্পর্কে এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বীনদার মানুষের চেতনা সম্পর্কে তো সচেতনতা থাকা উচিত। অন্তত এই বিচারেও তো এইসব পাপ-অনুষ্ঠান বর্জন ও প্রতিরোধ করা ছিল তাদের কর্তব্য। কিন্তু প্রতিরোধ তো দূরের কথা, তাদের কারো কারো পক্ষপাতটাই যেন এসবের দিকে। যুক্তি ও শক্তির একটা সাপোর্টও তাদের দিতে দেখা যায়।

২৮ জুলাই প্রথম আলোতে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর এই বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে যে, ‘নারীরা তাদের মেধা, সৌন্দর্য, মনন এবং পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্য দিয়ে একটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। সুতরাং সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আমাদের অংশগ্রহণে কোনো অসুবিধা নেই।’

‘কোনো অসুবিধা নেই’ বলে তিনি আসলে কী জারি করলেন? ‘ফতোয়া’ না ‘ফরমান’? আর তা জারি করলেন কাদের উদ্দেশে? ‘আমাদের’ মানে কী? দেশের মানুষকে এরা কি তাদের ব্যক্তিগত যুক্তি-বুদ্ধির অন্ধ অনুসারী মনে করেন? অথচ ‘প্রগতিশলেরা’ও এখন আঁত্কে উঠছেন প্রগিতিশিলতার ফলাফল দেখে। দৈনিক প্রথম আলোতে ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন-

‘যখন আপনারা নন, আমরাই বিশ^সুন্দরী প্রতিযোগিতার নয়ছয় নিয়ে হায় হায় করে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন, ঠিক তখনই ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে। মেরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘরের তাকে রাখা হয় ফেলে দেওয়া হবে বলে। ঘটনা গত রোববারের। কিন্তু আমরা অনেকেই খেয়াল করিনি। আমাদের মূল্যবান আবেগ, সময়, বুদ্ধি তখন অকাতরে খরচ হচ্ছে। আমাদের নাক চাইছিল সৌন্দর্যের বাজারে ব্যবসার নতুন মসলার ঘ্রাণ পেতে। হাওয়াই মিঠাই যেভাবে টেনে লম্বা করা হয়, তার থেকেও বেশি টানাটানি চলল খবরটা। কিন্তু গরিব ঘরের এই শিশুটির কথা কেউ বলল না। ... মাছির মৃত্যু হয় রসাতলে। মধুর রসে পাখনা ভারী হয়ে তাতেই ডুবে সে মরে। আমাদের একদল রসাতলে ডুবছি , সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের শিশুদের-নারীদের-দুর্বলদের। আনন্দ-বিনোদনের সঙ্গে অন্যায়, চুরি, নৃশংসতা যে মাত্রায় মিশে গেছে, তা থামাতে হবে, কমাতে হবে। কীভাবে? সামাজিক জাগরণ চাই, পরিবারে পরিবারে সচেতন মা-বাবা, ভাইবোন চাই, শিক্ষক চাই সব স্কুলে, সাংবাদিক ও নেতা চাই সব দলে। এই বিপদ অন্য কারও নয়, আমাদের। আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে রসলোভী দস্যু, আমাদের নিজ নিজ মনও ভোগদস্যুতার উপযোগী হয়ে উঠছে। হাত দিতে হবে তাই গোড়ায়।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ৬ অক্টোবর, ২০১৭)

তাহলে কোনো অসুবিধা নেই কথাটার অর্থ কী? আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই সকল পুঁজিবাদী অনুষ্ঠানের সাপোর্ট আসছে বামপন্থী নেতৃত্ব থেকে। অন্তত বামপন্থী তাত্ত্বিক বিপ্লবীদের মুখে তো এসব মানায় না। নাকি ‘ক্ষমতার আফিম’ এদের একেবারেই  শেষ করে দিয়েছে? এ থেকেও এদের অবক্ষয়ের মাত্রাটা পরিমাপ করা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি কথা মনে পড়ে গেল। তিনি এক প্রসঙ্গে ইনু সাহেবকে সম্বোধন করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘জাসদের মুখ দিয়ে এখন গণতন্ত্রের কথা শুনতে হচ্ছে!’ (দৈনিক প্রথম আলো ৭ জুন ২০১৪)

জনাব লেনিনের ঐ বিখ্যাত বক্তব্যও এখন বোধহয় আর প্রাসঙ্গিক নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘বুর্জোয়া শিল্পী-সাহিত্যিক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তথাকথিত স্বাধীনতা উৎকোচ ও পৃষ্ঠপোষকতার দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা সোশালিস্টরা এই ভ-ামির মুখোশ উন্মোচন করে দিব। এইসব জঞ্জাল ছিন্নভিন্ন করে ছুড়ে ফেলব। এটা শ্রেণিহীন শিল্প-সাহিত্য অর্জনের জন্য নয়, (কারণ সেটা তো সোশালিস্ট সমাজেই সম্ভব) বরং ঐ তথাকথিত ‘স্বাধীন’ (শিল্প-)সাহিত্যের সাথে, যার স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ভ-ামি এবং যা বাস্তবে বুর্জোয়া পুঁজিপতিদেরই শিল্প-সাহিত্য, ঐ সত্যিকারের (শিল্প-)সাহিত্যের তুলনা করার জন্য, যার গভীর সম্পর্ক প্রলেতারিয়েতের সাথে।’ -ইকবাল কা খুসুসী মুতালাআ, পৃ. ১৫

জনাব লেলিন কি কল্পনাও করতে পেরেছিলেন, তার কমরেডেরা বুর্জোয়া শিল্প-সাহিত্যের ভ-ামি আর কী উন্মোচন করবে, পুঁজিবাদের লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে নিজেরাই ভ-ামির চূড়ান্ত করে ছাড়বে?! উল্লেখ্য, এবারের বিশ^সুন্দরী  প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে লেনিনের নিজের দেশ ‘গণচীনে’।

বর্তমানের ‘বিপ্লবী’ বামেরা তাদের নেতৃত্বের এই বুর্জোয়াপন্থী অবস্থানকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন, এটা তাদের দৃষ্টিতে ‘ধর্মত্যাগ’ কি না জানতে বড় ইচ্ছে করে।

এসকল পাপ-অনুষ্ঠানের আরেক ভ-ামি হচ্ছে, ‘প্রতিনিধিত্ব’ কথাটি। কে কার প্রতিনিধিত্ব করছে? কীসের প্রতিনিধিত্ব করছে? এই দেশের কোটি কোটি নারী নিজেদের দ্বীন, ঈমান এবং ইজ্জত-আব্রুকেই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মনে করেন। যথাসম্ভব পর্দা-পুশিদা রক্ষা করেন এবং পর্দাপুশিদার জীবনকেই শ্রদ্ধা করেন। শিল্প-সংস্কৃতির নামে প্রচলিত বেহায়াপনা ও উলঙ্গপনায় তারা বিশ^াসী নন। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী সমাজের সাথে তো এই প্রতারিত তরুণীদের কোনোই মিল নেই, না চেতনাগত না জীবনাচারগত। তাহলে কীভাবে এরা এই বৃহত্তর নারী-সমাজের, অতপর একটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি হয়ে গেল! দেশের বৃহত্তর নারী-সমাজের প্রতি এটি কি চরম অপমান নয়? এ তো শুধু প্রচারের জোরে একটি ক্ষুদ্র অংশের বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থানকে অন্য সবার উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস মাত্র। আয়োজকদের তথ্য অনুসারেই এই প্রতিযোগিতার জন্য নিবন্ধন করেছে মাত্র ২৫ হাজার মেয়ে। এই সংখ্যাটা বাংলাদেশী নারীদের কত পার্সেন্ট? এজাতীয় ঘটনাসমূহের গণবিচ্ছিন্নতার এটাও এক প্রমাণ।

এক শ্রেণীর লোক এই সকল অনাচার-অশ্লীলতাকে ‘সাহসিকতা’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। এর প্রতিবাদে একজন ‘প্রগতিশীল’ নারী লিখেছেন, অন্যান্য বছরের সংখ্যা যদি বাদও দেই তারপরও শুধু এই বছরেই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী নারীরা কি তাহলে বিশ^াস করেন সৌন্দর্যই সাহসিকতা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম? তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও সক্ষমতা প্রকাশের জন্য আমরা কি তাহলে অন্য কোনো মঞ্চ তৈরি করতে পারিনি? ... অবাক লাগে, আমরা আমাদের চিন্তার জগতকে কতটা সংকীর্ণ করে ফেলেছি। নিজেদের পণ্য রূপে অন্যের সামনে তুলে ধরতে এ ধরনের আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতায়, উৎসাহ প্রদানে কিংবা বিকৃত মন্তব্য প্রদানে আমাদের আগ্রহের কোনো সীমা নেই। তাই তো আজও দেখি তথাকথিত প্রগতিশীল ও শিক্ষিত সমাজের মাঝেও মেয়ের গায়ের রং কালো হওয়ার অপরাধে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা। (দৈনিক প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর, ২০১৭)

‘প্রগতিশীল’ নারী-সমাজের মধ্য থেকেই প্রতিবাদ ওঠা প্রমাণ করে যে, নারী উন্নয়নের পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের মধ্যেও এই ভ-ামি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।

আমরা আমাদের বিশ^াস ও আদর্শ থেকেই মনে করি, এসব আয়োজন অনুষ্ঠান নারীর পক্ষে চরম অবমাননাকর। নারীকে ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত করারই এক হীন প্রয়াস। এসবের দ্বারা চারিত্রিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাবে এবং নারী-নির্যাতন আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কাজেই এসবের বিরুদ্ধে  দেশের সর্বস্তরের নারী সমাজ ও নারীর প্রকৃত কল্যাণকামীদের অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। নারীর মেধা ও প্রতিভা বিকাশের ঐ ক্ষেত্র ও ধারা তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে নারী তার পর্দা-পুশিদা, ইজ্জত-আব্রু, মর্যাদা ও স্বকীয়তাসহ জাতি ও সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারেন। পশ্চিমা ও পুঁজিবাদী ধারায় যা কখনো সম্ভব নয়।

 

 

advertisement