হিংসা : চুলার আগুন যেমন
মানবেতিহাসের শুরুর দিককার কথা। পৃথিবীতে মানব পরিবার বলতে তখনো কেবলই হযরত আদম আলাইহিস সালামের পরিবার। হযরত হাওয়া রা.-এর সঙ্গে তাঁর সংসার। তাঁদের সন্তান জন্ম নিত জোড়ায় জোড়ায়Ñএক ছেলে এক মেয়ে। তাদের জন্যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ নিয়ম ছিল এমনÑজমজ ভাইবোন পরস্পর বিয়ে করতে পারবে না। যাদের জন্ম আগে-পরে, তারা একে অন্যকে বিয়ে করতে পারবে। হযরত আদম আলাইহিস সালামের দুই ছেলের নাম ছিল হাবীল ও কাবীল। কাবীলের সঙ্গে যে বোনের জন্ম হয় সে ছিল অধিক সুশ্রী। তাই নিয়ম ভেঙ্গে কাবীল তাকেই বিয়ে করতে চায়। আর নিয়ম টিকিয়ে তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী ছিল হাবীলও। দ্বন্দ্ব নিরসনে তাদেরকে কুরবানী করতে বলা হল। যার কুরবানী কবুল হবে সে-ই তার উক্ত বোনকে বিয়ে করতে পারবে। এর পরের কাহিনী পবিত্র কুরআনের ভাষায়Ñ
اِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَ لَمْ یُتَقَبَّلْ مِنَ الْاٰخَرِ قَالَ لَاَقْتُلَنَّكَ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِیْنَ لَىِٕنْۢ بَسَطْتَّ اِلَیَّ یَدَكَ لِتَقْتُلَنِیْ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیْكَ لِاَقْتُلَكَ اِنِّیْۤ اَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعٰلَمِیْنَ...
যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, কিন্তু তাদের একজনের পক্ষ থেকে তা কবুল করা হল এবং অপরজনের পক্ষ থেকে কবুল করা হয়নি। সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করে থাকেন। তুমি যদি আমাকে হত্যা করার জন্যে আমার দিকে তোমার হাত বাড়িয়ে দাও, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তোমার দিকে আমার হাত বাড়াব না। আমি অবশ্যই বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহকে ভয় করি। অবশ্যই আমি চাই, তুমি আমার পাপ এবং তোমার পাপ বহন কর, এরপর তুমি দোজখিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আর এটাই জালেমদের শাস্তি। অবশেষে তার মন তাকে ভাই-হত্যার বিষয়ে প্ররোচিত করল, এরপর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। Ñসূরা মায়িদা (৫) : ২৭-৩০
পবিত্র কুরআনের বর্ণনানুসারে, এই হচ্ছে পৃথিবীতে সংঘটিত প্রথম হত্যাকা-। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম অপরাধ। প্রথম এই হত্যাকা-ের পেছনের কারণও আমরা উপরোক্ত আয়াতসমূহে দেখতে পাই, ‘তোমার কুরবানী কবুল হয়েছে আর আমারটি হয়নি’Ñএই চিন্তা থেকেই কাবীলের মনে হিংসা জমাট বাঁধতে থাকে আর এর পরিণতিতেই সে তার ভাই হাবীলকে হত্যা করে। যে হিংসা মানুষকে দিয়ে পৃথিবীতে পাপের সূচনা করাল, সে-ই হিংসা জগতে আরও কত শত-সহ¯্র অনিষ্ট ঘটিয়েছে তার হিসাব কে জানে!
ইতিহাসের আরও পেছনের পাতায় আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইবলিসের যে ঔদ্ধত্য ও অহংকারের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, উল্লেখিত হয়েছে তার অভিশপ্ত হওয়ার কথা, তার মূলেও তো একই হিংসা। কুরআনের ভাষায়Ñ
قَالَ اَرَءَیْتَكَ هٰذَا الَّذِیْ كَرَّمْتَ عَلَیَّ.
সে বলল, দেখুন তো, এই কি সেই সৃষ্টি, যাকে আপনি আমার ওপর মর্যাদা দান করেছেন? Ñসূরা ইসরা (১৭) : ৬২
ফলাফল তো এইÑআকাশের প্রথম অপরাধ আর জমিনের প্রথম অপরাধ সবটার মূলেই এই হিংসা। এর জঘন্যতা তাই আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্ন হল, হিংসা কী?
হিংসা হচ্ছে অন্যের ভালো কোনো কিছু দেখে তা ধ্বংস হওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার কামনা করা। কেউ ভালো পথে চলতে থাকলে কিংবা ভালো কোনো কাজ করতে গেলে সেখান থেকে সে ফিরে আসা, বাধাগ্রস্ত হওয়া কিংবা ব্যর্থ হওয়ার কামনা করা। এগুলোই হিংসা। এসব হচ্ছে হিংসার প্রথম ধাপ। এর একটা পর্যায় অবশ্য মানুষের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। অনেকটাই সৃষ্টিগত ও স্বভাবজাত। আল্লাহ তাআলা তো বলেই দিয়েছেনÑ
وَ اُحْضِرَتِ الْاَنْفُسُ الشُّحَّ.
মানুষকে কৃপণতাপ্রবণ করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। Ñসূরা নিসা (৪) : ১২৮
এ কৃপণতার প্রভাবে মানুষ যেমন অন্য কাউকে নিজের সম্পদ দিতে চায় না, ঠিক এ কার্পণ্যের কারণেই ‘অন্য কেউ ভালো অবস্থায় থাকুক’Ñএটা সে মেনে নিতে চায় না। মানুষের একটি স্বাভাবিক স্বভাব হচ্ছে, সে অবচেতনভাবেই কামনা করেÑসকল ভালো জিনিস তার কাছে এসে একত্রিত হোক, যাবতীয় অর্থ সম্মান প্রভাব-প্রতিপত্তি তার হাতে চলে আসুক ইত্যাদি। এ কামনার জন্যেই তো তার চাহিদা সবসময় ঊর্ধ্বমুখী। চাওয়া শেষ হয় না কখনো। এক চাহিদা পূর্ণ হল তো আরেক চাহিদা এসে হাজির। এক লক্ষ্য অর্জিত হল তো আরেক লক্ষ্যের পেছনে অবিরাম ছুটে চলা। এটা স্বাভাবিকতা। এখান থেকেই জন্ম নিয়ে থাকে হিংসাÑএ সম্মান কিংবা এ পদ অথবা এত এত অর্থ আমার কাছে না এসে তার কাছে কেন? তা আমার কাছে চলে আসুক। তা যদি না হয় কমপক্ষে তার কাছ থেকে হারিয়ে যাক। এটাই হিংসা।
পবিত্র কুরআনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বনী ইসরাঈল তথা ইহুদী-খ্রিস্টানদের আলোচনা। জাতি হিসেবে তাদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। তাদেরকে আল্লাহ তাআলা দান করেছিলেন অজ¯্র বড় বড় নিআমত। আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামের পবিত্র কাফেলার প্রায় সকলেই ছিলেন বনী ইসরাঈল গোত্রভুক্ত। তাদেরকে দেয়া হয়েছিল আসমানী অনেক কিতাব। কিন্তু এতকিছু পেয়েও তারা শোকরগুজার ছিল না। ছিল না আল্লাহ তাআলার হুকুমের পূর্ণ অনুগত। তাঁর বিধান তারা লঙ্ঘন করেছে। আসমানী কিতাবে হয়ত বিকৃতি ঘটিয়েছে, কিংবা তার ওপর আমল করা ছেড়ে দিয়েছে। নবীদেরকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। এমনকি তাদের হাতে প্রাণও গেছে অনেক নবীর। পরিণামে তারা আমাদের কাছে আজ আলোচিত অভিশপ্ত এবং আল্লাহর গজবে নিপতিত জাতি হিসেবে। তাদের কিতাবসমূহে শেষ নবীর কথা ছিল। তাঁর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বিবরণ ছিল। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা যখন শেষ নবী হিসেবে পাঠালেন, তখন তারা তাঁকে চিনতেও পারল। সে চেনাও কেমন? পবিত্র কুরআনের বর্ণনানুসারেÑনিজের ছেলেসন্তানকে মানুষ যতটুকু শক্তির সঙ্গে চেনে, তাদের চেনা ছিল আরও গভীর, আরও শক্তিমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেবলই ইসরাঈলী না হওয়ার কারণে তারা একদিকে তাঁর নবুওত মেনে নিতে অস্বীকার করে। উপরন্তু যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী হিসেবে মেনে নিয়েছে, তারা যেন এ সঠিক ও সরল পথ ছেড়ে আগের ভ্রান্ত ও বাঁকা পথে ফিরে যায়Ñতারা সে কামনাও করত। এর মূলে ছিল কেবলই হিংসাÑসঠিক দ্বীন আমরা মানি না তো তারা মানবে কেন? পবিত্র কুরআনের ভাষায়Ñ
وَدَّ كَثِیْرٌ مِّنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ لَوْ یَرُدُّوْنَكُمْ مِّنْۢ بَعْدِ اِیْمَانِكُمْ كُفَّارًا حَسَدًا مِّنْ عِنْدِ اَنْفُسِهِمْ مِّنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ.
আহলে কিতাবদের অনেকেই তাদের নিকট সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও হিংসাবশত কামনা করেÑতোমাদের ঈমান আনার পরও যদি তারা তোমাদের কাফের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারত! Ñসূরা বাকারা (২) : ১০৯
আরেকজনের কোনো নিআমত দেখে তা বিলুপ্তির কামনা করা হিংসার প্রথম ধাপ। এর পরের ধাপ হচ্ছে, মনে যখন কারও প্রতি হিংসা জন্ম নেয় তখন এর চাহিদা অনুযায়ী কাজ করা। তা হতে পারে তার কোনো ক্ষতি করার মধ্য দিয়ে, হতে পারে তার কোনো ক্ষতিতে আনন্দ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এসব যেহেতু তার কর্ম। তাই এর কারণে সে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবে তখনো, যদি সে তার হিংসার কথা মুখে প্রকাশ করে ফেলে। যতটুকু মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো প্রতি হিংসার ভাব উদ্রেক হওয়াÑতাতে গোনাহ হবে না।
তবে গোনাহ হোক আর নাই হোক, হিংসা অবশ্যই মানবচরিত্রের একটি মন্দ দিক। মনের হিংসার দাবিতে কেউ যদি অন্যায় আচরণ করে, ক্ষতি করার সুযোগ খোঁজে তাহলে তা যে নিন্দনীয়Ñতা কে অস্বীকার করবে! হিংসা যে মানুষকে অন্যায়ে উৎসাহিত করেÑতাও জানা কথা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিখিয়েছেন হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনাÑ
وَ مِنْ شَرِّ حَاسِدٍ اِذَا حَسَدَ.
এবং (আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে। Ñসূরা ফালাক (১১৩) : ৫
আর যদি বিষয়টি এ পর্যায়ে না গড়ায়, হিংসা কারও মনের গভীরেই লালিত হতে থাকে, তাহলে তাও নিন্দনীয়। আরবী ভাষার উক্তিÑ
الحاسد يحترق بنار الحسد.
অর্থাৎ হিংসুক হিংসার আগুনে জ্বলে। কারণ হিংসা কারও কোনো ক্ষতি করতে পারে না। যাকে এগিয়ে যেতে দেখে কেউ হিংসা করছে, সে তো এগিয়েই যায়। হিংসা তার এগিয়ে চলার গতি রোধ করতে পারে না। কারও মনে সৃষ্ট হিংসা যদি অন্য কারও নিআমতকে বিনাশ করতে পারত, তাহলে তো জগতের কেউই ভালো কিছু হাছিল করতে পারত না। দাঁড়াতে পারত না কারও সম্মান প্রতিপত্তি সুনাম যশ খ্যাতি সুসন্তান অর্থ বিদ্যাবুদ্ধি দ্বীনদারী পরহেজগারি কিছুই। কথায় বলে নাÑশকুনের দুআয় গরু মরে না! আত্মচিন্তায় বিভোর শকুনের কামনা যেমন গরুর মৃত্যু ডেকে আনে না, তেমনি হিংসুকের হিংসাও কারও নিআমত ছিনিয়ে নিতে পারে না। হিংসাকে অগ্রাহ্য করে প্রতিনিয়ত যখন কেউ এগিয়ে চলে তখন বাড়তে থাকে হিংসার আগুন। সে আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হতে থাকে হিংসুকের অন্তর। কথা হল, হিংসার আগুন কি শুধু হিংসুকের অন্তরকেই জ্বালায়? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে আমরা এর উত্তর পাইÑ
إِيّاكُمْ وَالْحَسَدَ فَإِنّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النّارُ الْحَطَبَ أَوْ قَالَ الْعُشْبَ.
তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থেকো। কারণ হিংসা নেক আমলসমূহকে গ্রাস করে নেয়, যেভাবে আগুন গ্রাস করে লাকড়ি (অথবা ঘাস)। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯০৫
শুকনো ঘাস আর লাকড়ি যেমন আগুনের সামনে অসহায়, হিংসার আগুনের সামনে মানুষের নেক আমলও তেমনি অসহায়। হিংসার আগুন গ্রাস করে নেয় ব্যক্তির যাবতীয় নেক আমল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেক হাদীসে হিংসাকে তুলনা করেছেন পানির সঙ্গে। দুই হাদীসের দুই উপমা বাহ্যত বিপরীতমুখী মনে হলেও এ বিবেচনায় তো অবশ্যই একÑআগুন যেমন লাকড়ি আর ঘাসকে জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়, পানিও তেমনি আগুনকে নিভিয়ে দেয় মুহূর্তেই। আগুনের সামনে লাকড়ি আর ঘাসের প্রাচুর্য যেমন কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, পানির সামনেও আগুনের বিশালতা উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। হাদীসের ভাষ্য এমনÑ
إِنّ الْحَسَدَ يُطْفِئُ نُورَ الْحَسَنَاتِ.
সন্দেহ নেই, হিংসা নেক আমলসমূহের নূর ও আলোকে নিভিয়ে দেয়। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯০৬
হিংসা তাই সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। এ হিংসা কোনো মুমিনের চরিত্র হতে পারে না। হাদীসের বক্তব্য এমনইÑ
لَا يَجْتَمِعَانِ فِي قَلْبِ عَبْدٍ الْإِيمَانُ وَالْحَسَدُ.
কোনো বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না। Ñসুনানে নাসাঈ, হাদীস ৩১০৯
অবশ্য হিংসার একটি রূপ এমনও, যেখানে কারও অমঙ্গল কামনা নেই। কারও ভালো কোনো কিছু দেখে তার বিনাশ নয়, বরং নিজের জন্যেও অর্জিত হোক অনুরূপ ভালো ও কল্যাণÑএই কামনা রয়েছে সেখানে। প্রথমটিকে আরবীতে বলে ‘হাসাদ’ আর পরেরটিকে বলা হয় ‘গিব্তা’, বাংলায় যাকে আমরা বলি ‘ঈর্ষা’। এই ঈর্ষা দোষণীয় কিছু তো নয়ই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে প্রশংসনীয়ও। ঈর্ষা অনেক সময় আমলের আগ্রহ সৃষ্টি করে। নেক কাজে উদ্ধুদ্ধ করে। ভালো কাজে ও কল্যাণকর ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। মুমিন বান্দা যখন কাউকে বারবার হজ্ব-উমরা পালন করতে দেখে কিংবা অল্প বয়সে কাউকে বায়তুল্লাহ যিয়ারতের সৌভাগ্য হাসিল করতে দেখে, সে তখন আবেগে আপ্লুত হয়, তার মনে ঈর্ষা জন্ম নেয়Ñএ সৌভাগ্য যদি আমারও হাসিল হতো! এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ
لاَ حَسَدَ إِلاَ عَلَى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْكِتَابَ وَقَامَ بِهِ آنَاءَ اللّيْلِ وَرَجُلٌ أَعْطَاهُ اللهُ مَالاً فَهْوَ يَتَصَدّقُ بِهِ آنَاءَ اللّيْلِ وَالنّهَار.
হিংসা (অর্থাৎ ঈর্ষা) কেবল দুই ব্যক্তিকেই করা যায়Ñআল্লাহ যাকে কুরআন হিফ্জ করিয়েছেন আর সে রাতের বিভিন্ন প্রহরে নামাযে দাঁড়িয়ে তা তিলাওয়াত করে, আর যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন এবং সে তা দিনে-রাতে দান করে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৫
কথা হল, এ ঈর্ষাকে তো আমরা প্রশংসিত হিংসাও বলতে পারি। কিন্তু যে হিংসা নিন্দনীয়, যে হিংসা তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয় আমাদের যাবতীয় অর্জন, আগুনের মতোই গ্রাস করে নেয় আমাদের নেক আমল, যা পানির মতো নিভিয়ে দেয় ঈমান ও আমলের নূর, কারও মনে যখন তা দেখা দেবে তখন তা প্রতিহত করার উপায় কী? অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো এখানেও প্রিয় নবীজীর প্রিয় কথামালাই তো আমাদের জন্যে চূড়ান্ত নির্দেশনা। এক হাদীসে তিনি বলেছেনÑ
دَبّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمْ: الحَسَدُ وَالبَغْضَاءُ...
পূর্ববর্তী জাতিসমূহের রোগব্যাধি তোমাদের কাছেও এসে পৌঁছেছে। তা হল হিংসা-বিদ্বেষ। এটা মু-িয়ে দেয়। আমি চুল মু-ানোর কথা বলছি না। বরং তা দ্বীনকে মু-িয়ে দেয়। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, যতক্ষণ তোমরা ঈমান না আনবে ততক্ষণ জান্নাতে যেতে পারবে না। আর যতক্ষণ পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি না হবে ততক্ষণ তোমাদের ঈমানও পূর্ণ হবে না। আমি তোমাদের বলে দিইÑকীসের মাধ্যমে তা অর্জিত হবে? তোমরা তোমাদের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ২৫১০
আরেকটি হাদীসে তাঁর নির্দেশনা এমনÑ
لاَ تَقَاطَعُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَحَاسَدُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا.
তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না, একে অন্যের পেছনে লেগে থেকো না, একে অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না। বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও, পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৩৫
হাদীস দুটির বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। হিংসা-বিদ্বেষ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, সৃষ্টি করে দূরত্ব ও শত্রুতা।
উল্লেখিত দ্বিতীয় হাদীসে যেমন এসবকে দূরে ঠেলে দিয়ে পরস্পর মিলেমিশে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠনের নির্দেশনা রয়েছে, প্রথম হাদীসে তেমনি এ ভ্রাতৃত্ববোধকে জাগ্রত করা এবং সর্বদাই একে সজাগ ও সচেতন রাখার জন্যে বেশি বেশি সালামের কথাও বলা হয়েছে। সালামের প্রচলন যখন বেশি হবে পারস্পরিক হৃদ্যতা ও ভালোবাসা তখন সৃষ্টি হবেই। আর হৃদয় দিয়ে যখন কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারবে, তখন আর তার ভালো কোনো কিছু দেখে সে কুঞ্চিত হবে না, তার মনে হিংসা দানা বাঁধবে না, বন্ধুর ভালো জিনিসটির বিনাশ কামনা করবে না। তাই কারও প্রতি যদি মনে হিংসা জন্ম নেয় বিশেষভাবে তার সঙ্গে যদি সালাম-কালাম বাড়িয়ে দেয়া যায়, মহব্বত সৃষ্টির লক্ষ্যে তাকে কিছু হাদিয়া দেয়া যায় তাহলে তা হিংসার ঘায়ে মলমের মতো কাজ করতে পারে। মনকে হিংসামুক্ত রাখার জন্যে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দুআটিও সবিশেষ উল্লেখযোগ্যÑ
رَبِّ تَقَبّلْ تَوْبَتِى وَاغْسِلْ حَوْبَتِى وَأَجِبْ دَعْوَتِى وَثَبِّتْ حُجّتِى وَاهْدِ قَلْبِى وَسَدِّدْ لِسَانِى وَاسْلُلْ سَخِيمَةَ قَلْبِى.
প্রভু আমার! আপনি আমার তওবা কবুল করুন, আমার পাপরাশি ধুয়ে দিন, আমার ডাকে সাড়া দিন, আমার দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করুন, আমার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন, আমার যবানকে সঠিক রাখুন আর আপনি আমার অন্তরের যাবতীয় কলুষতা দূর করে দিন। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫১২