রোহিঙ্গা শিবিরে মসজিদ প্রতিষ্ঠা কেন
: আপনারা ওখানে কী কাজ করছেন?
: আমরা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছি..।
: মসজিদ করেছেন? মসজিদের কী দরকার? তারা নামায তো নিজ নিজ ঘরেও পড়তে পারবে।
যার সাথে আমার কথা হচ্ছিল তিনি একজন নামাযী মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে পড়েন বলেই জানি। অথচ মসজিদ প্রতিষ্ঠার নাম শুনেই তিনি এমনই বিরক্ত হলেন যে, আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। মসজিদ করার পাশাপাশি ঘর তৈরি, টিউবয়েল বসানো, টয়লেট-বাথরুমের ব্যবস্থাসহ আরও যেসব কাজ করা হচ্ছে সেগুলোতে পৌঁছার আগেই তিনি ‘মসজিদের কী দরকার’ বলে কথা কেটে দিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, বাংলাদেশের শত শত মাদরাসা-মসজিদ রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় শিবিরে সেই শুরু থেকেই মানবিক সেবায় নিয়োজিত আছে। আত্মপ্রচার বিমুখ এসব প্রতিষ্ঠান যে অকৃত্রিম ভালোবাসায় টেকনাফ-উখিয়ার দুর্গম পাহাড়-উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছে, উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাদ্য-পানীয় বিতরণ ও তাদের নারী-শিশুসহ নিরাশ্রয় মানুষজনকে রাস্তার দুধার ও খোলা আকাশের তল থেকে তেরপলের একটুখানি ছায়ায় ঠাঁই দেওয়ার যে নিরবচ্ছিন্ন শ্রম তারা ব্যয় করেছে মানবিক সেবার ইতিহাসে তা অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল-উপদল এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সাহায্য-সংস্থাও ওখানে কাজ করছে। কিন্তু দেখার মত চোখ যার আছে এবং স্বচ্ছ-সুস্থ বোধ-অনুভবও রাখে, তার বিলক্ষণ বুঝতে পারার কথা, তাদের সাথে উলামা ও উলামাভক্ত মুসল্লীদের কাজের চরিত্রগত কত পার্থক্য। কষ্টার্জিত অর্থ-সম্পদ ও বাপদাদার ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে যারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে, যারা বৃদ্ধ মা-বাবাকে রেখে কিংবা তরুণ পুত্রসন্তান হারিয়ে নিজেকে অলক্ষ্যের পথে ছুঁড়ে মেরেছে এবং যারা স্বামী হারিয়েছে, ভাই-বেরাদার খুইয়েছে, ইজ্জত হারানোর যন্ত্রণায় ভুগেছে, এমনকি নাড়িছেঁড়া বুকের ধনকে আগুনে পোড়ানোর দৃশ্য পর্যন্ত যাদের দেখতে হয়েছে, সেই হতভাগ্য নর-নারীদের পাশে ছুটে তো সকলেই গেছে, কিন্তু সে যাওয়াকে আত্মপ্রচারের উপলক্ষ্য না বানিয়ে, সব রকম প্রচার মাধ্যমে ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘আমিও কিছু করেছি’-এর জানান না দিয়ে এবং বিপন্নের পাশে দাঁড়ানোকে ক্যামেরাবন্দী করার মানসিকতা পরিহার করে কেবলই ব্যথিতের বেদনা ভাগাভাগি করে নেওয়ার তাগিদে যে যাওয়া, তার সাক্ষাৎ উলামা ও তাদের সাহচর্যধন্যদের ছাড়া আর কোথায় কতটুকু পাওয়া গেছে?
‘মুমিনগণ ভাই-ভাই’, ‘সমস্ত মুসলিম একদেহতুল্য’, ‘সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার’, ‘তোমরা সকলে এক আদম-সন্তান’ ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের এবংবিধ শিক্ষায় উজ্জীবিত যে উলামা তারা কখনও যন্ত্রণাকাতর মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে আপন কৃতিত্ব জাহিরের বিলাসিতা বানাতে পারে না। তাদের লক্ষবস্তু কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টি। সেই প্রাপ্তি কোনওভাবেই ক্ষুণœ হতে না পারে, সে ব্যাপারে তারা পূর্ণ সচেতন। তারা ভয় পায় আখিরাতের জবাবদিহিতাকে। তাই তারা যা করে একান্ত নিষ্ঠার সাথে করে এবং নিজ কৃতকর্মকে নিতান্তই নগণ্য জ্ঞানের সাথে করে। সুতরাং ঢাক ঢোল না পিটিয়ে তারা প্রথমে নিজ নিয়ত খালেস করে নেয়, তারপর জরুরতের দিকসমূহ সনাক্ত করে, তারপর সেই দিকসমূহ আপন সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী পূরণের চেষ্টা করে।
বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে উলামা-মাশায়েখের কর্মতৎপরতায় তাদের এ বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। জাতিগত নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়ার শিকার এ জনগোষ্ঠীটির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য করণীয় সবকিছুই তারা আপন সামর্থ্য অনুযায়ী করে যাচ্ছে। খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থাকরণ, গৃহনির্মাণ প্রভৃতিতে তাদের ভূমিকাকে ছোট করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। বরং হিসাব করলে এ সব ক্ষেত্রে তাদের সম্মিলিত সরবরাহের পরিমাণ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনও দল বা সংস্থার বরাদ্দকেও হয়ত ছাড়িয়ে যাবে। অথচ বাহ্য বিচারে বা সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তারা এসব কাজে হাত না দিলেও পারতেন। ‘মোল্লার দৌড় যখন মসজিদ পর্যন্ত’-ই বলা হচ্ছে, তখন তারা মসজিদ নির্মাণের বাইরে অন্যসব কাজে অংশ নিতে যাবেন কেন, বিশেষত যখন অন্যরা সেসব কাজ নিয়েই ব্যস্ত আছে? কিন্তু তা সত্ত্বেও উলামায়ের কিরাম তথা মসজিদ-মাদরাসার পক্ষ হতে এসব কাজ করা হচ্ছে। কে কী করছে সেটা বড় কথা নয়, নিজ দায়িত্ব কর্তব্য কী সেই বিবেচনা থেকেই তারা তা করছেন। সেই সংগে অতিরিক্ত করছেন মসজিদ ও মকতব প্রতিষ্ঠার কাজ।
মসজিদ ও মকতব প্রতিষ্ঠার কাজকে যে যেই দৃষ্টিতেই দেখুক না কেন, মুসলিম জনগোষ্ঠীর যে কোনও স্থায়ী-অস্থায়ী লোকালয়ে এর প্রয়োজন পানাহারের মতই প্রাত্যহিক। আপন গৃহ নির্মাণের যে গুরুত্ব মসজিদ নির্মাণও তার সমান বা আরও বেশি গুরুত্ব বহন করে। কে না জানে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পর নিজ বাসস্থান তৈরিরও আগে যে ঘর তৈরি করেছিলেন, তা ছিল মসজিদই। অতপর মদীনা মুনাওয়ারায় যে ইসলামী সমাজ গড়ে ওঠে এবং ইসলামের প্রচার ও বিস্তারের ধারায় পর্যায়ক্রমে অর্ধজাহানব্যাপী যে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়, ওই মসজিদ গৃহই ছিল তার প্রাণকেন্দ্র। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পাশাপাশি কী না আনজাম দেওয়া হত ওই গৃহ থেকে। দূর-দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতী কাফেলা ও অভিযাত্রী বাহিনী প্রেরণ, বিভিন্ন এলাকা, গোত্র ও সরকারের পক্ষ থেকে আগত দূত ও প্রতিনিধিদলের সংগে সাক্ষাৎকার, জরুরি বিষয়ে পরামর্শ, অপরাধের বিচারানুষ্ঠান, সরকারী অর্থ বণ্টন এবং মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও অন্যান্য সমস্যাদি শ্রবণ ও তার সমাধান প্রদানসহ সর্বপ্রকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি ওখান থেকেই পরিচালিত হত। তখন মসজিদই ছিল উম্মতের কৃষ্টিকালচারের সূতিকাগার, চিন্তা-চেতনার বাতিঘর। শত শত বছরব্যাপী এ উম্মতকে প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি জাগ্রত অপরাজেয় জাতিরূপে উদ্দীপিত করে রেখেছিল সাদামাটাভাবে তৈরী ওই সিজদালয়ই।
আজ যখন বর্মী মগদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ আরাকানবাসী সবকিছু হারিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তখন কেবল থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের কর্তব্য, তারা কি কি হারিয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা। অতপর তারা তাদের সেই হৃত সম্পদসমূহ যাতে পুনরুদ্ধার করতে পারে সে ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা করা।
একথা তো সকলেই বোঝে যে, তারা প্রথমে স্বাধীনতা হারিয়েছে, তারপর নিজেদের নাগরিকত্ব হারিয়েছে এবং সবশেষে বাস্তুভিটা হারিয়ে এখন তারা পরভূমে আশ্রিত। মাঝখানে আরও যা হারিয়েছে তার ফিরিস্তি বড় লম্বা। বলাবাহুল্য, তারা যাতে এসব হারানো সম্পদ ফিরে পায় এবং নাগরিকত্বসহ আপনদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা সকলেরই কাম্য। এ ব্যাপারে যেসব প্রচেষ্টা চলছে তা যাতে আরও জোরদার ও গতিশীল হয় সে ব্যাপারে প্রত্যেকেরই আপন-আপন স্থান থেকে ভূমিকা রাখা উচিত। এ ভূমিকা রাখা প্রত্যেকের যেমন মানবিক তেমনি ঈমানী দায়িত্বও বটে।
তবে আমাদের ঈমানী দায়িত্বের পরিম-ল আরও দূরবিস্তৃত। তথাকথিত অহিংসবাদী হিংস্র বৌদ্ধদের দীর্ঘকালীন আগ্রাসনের কবলে পড়ে আরাকানী মুসলিমগণ কি কেবল রাজ্য ও বাস্তুহারাই হয়েছে। আরও মূল্যবান সম্পদ-ঈমান ও ইসলামের পাঠাভ্যাস থেকে যুগ-যুগব্যাপী বঞ্চিত থাকার ফলে তারা ব্যাপকভাবে দ্বীনী মূল্যবোধও হারিয়ে ফেলেছে। স্থূল না হওয়ার কারণে বিষয়টি যদিও সাধারণের অগোচরে, কিন্তু উলামায়ে কিরাম, দ্বীনের সতর্ক প্রহরা যাদের পদগত দায়িত্ব, এ বিষয়ে বেখবর থাকতে পারেন না। আরাকানী মুসলিমদের সব হারানোর তালিকায় দৃষ্টিপাত করলে তারা এই দেখে স্তম্ভিত ও আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন যে, একদার দ্বীনী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আখলাক-চরিত্রে সম্মৃদ্ধ জনগোষ্ঠীটির এ কী অধঃপতন।
এ অধঃপতনের সূচনা হয়েছে পরাধীনতার যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার দিন থেকে। কালক্রমে তারা যেখানটায় পৌঁছে গেছে তার চিত্র বড় হতাশাকর। এখানে যার ফিরিস্তিদান বাঞ্ছনীয় নয়। তবে একথাও সত্য যে, পরাধীন জীবনের এটাই অনিবার্য পরিণতি, যদি না আত্মোৎকর্ষ ও জাতীয় অগ্রগতির ব্যাপক উদ্যোগ থাকে। মগের মুল্লুকটি তো সেই প্রচেষ্টারও কণ্ঠরোধ করে রেখেছিল। তাই বলে আমরা তো আমাদের দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারি না এবং ওই নিষ্পেষিত জাতিটি যে আর কখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না এমন কথাও কেউ বলতে পারে না। তারা যতদিন এখানে আছে, ততদিন তারা আমাদের সম্মানিত অতিথি। আর অতিথির যথার্থ সেবা সেটাই, যা তাদের প্রয়োজন মোতাবেক হয়।
এ মুহূর্তে তাদের বড় প্রয়োজন তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করা। অর্থাৎ তাদের ভেতরে ঈমানী মূল্যবোধ জাগ্রত করা, তাদের অন্তরে শিক্ষার আলো জ¦ালিয়ে দেওয়া, তাদের মধ্যে বিদ্যাচর্চার চাহিদা সৃষ্টি করা, তাদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির প্রেরণা সঞ্চার করা ইত্যাদি। তা কিভাবে এসব কাজ করা যাবে? করা যাবে সেই উপায়ে, যেভাবে করা হয়েছিল মদীনা মুনাওয়ারায়। অর্থাৎ মসজিদকে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে।
দরকার প্রতিটি আশ্রয় শিবিরে একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠার। সাথে থাকবে কুরআনী মকতব। মসজিদগুলো হতে হবে ব্যস্ত-জাগ্রত ও কর্মমুখর। এমনিতে পাঁচ ওয়াক্তের জামাতও অনেক বড় প্রভাবক। ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এর ভূমিকা বিশাল। ঘরের ভেতর নামায পড়লে ফরয আদায় হয় বটে, কিন্তু প্রকৃত মু’মিনের নামায তা নয় এবং জামাতের নামাযে যে বিপুল শক্তি ও সুফল তাও একাকী নামায দ্বারা লাভ হয় না। তবে মসজিদের কাজ কেবল নামায আদায়ের মধ্যে সীমিত রাখা বাঞ্ছনীয় নয়। তা‘লীম ও তরবিয়াত অর্থাৎ শিক্ষাদান ও ব্যাক্তিগঠনও মসজিদের অন্যতম প্রধান কাজ। আমরা আমাদের মসজিদ থেকে এ মহান কর্মটি ছাঁটাই করে ফেলেছি। ফলে মানুষ সত্যিকার অর্থে আজ মসজিদমুখী নয়, এমনকি যারা জামাতে নামায পড়ে, তাদেরও বৃহৎ অংশ নয়। এর কুফল আমরা ভোগ করি। আমাদের সামাজিক অবক্ষয় কি আরাকান অপেক্ষা কম কিছু? দ্বীনের শিক্ষা ও ইসলামী আখলাক-চরিত্রের সাথে বৃহত্তম মুসলিম সমাজের সম্পর্ক কতটুকু? এর পরিণাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে অন্যদের দেখে সেই শিক্ষা আমাদের নেওয়া উচিত।
যা হোক আশ্রয় শিবিরগুলোর মসজিদ থেকে তাদের পুনর্গঠনের যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের শিশু ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা দেওয়া জরুরি। ইসলাম কাকে বলে, ইসলামের বুনিয়াদী বিশ^াস কি কি সুস্পষ্টভাবে তাদের তা শেখাতে হবে। ইবাদত-বন্দেগীতে তাদেরকে নিষ্ঠাবান করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। প্রত্যেক আরাকানী নারী-পুরুষ যাতে কুরআন মাজীদ পড়তে পারে এবং সুন্নতী জীবন-পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ মসজিদেরই কাজ। নববী আখলাক-চরিত্র ইসলামের প্রাণবস্তু। মসজিদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হবে মানুষের মধ্যে সেই আখলাক-চরিত্রের বিকাশ ঘটানো।
রোহিঙ্গা মুসলিমগণ কি সারা বিশ্বের করুণার পাত্র হয়ে থাকবে, না তারা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াবে? সেই দাঁড়ানোর লক্ষ্যে মসজিদের কর্তব্য হবে তাদের মধ্যে মূল্যবোধের রূহ ফুঁকে দেওয়া। সকল হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে তারা যাতে নবোদ্যমে পথ চলতে পারে তার রসদ তাদেরকে যুগিয়ে দিতে হবে। সেজন্য যেমন দরকার হবে তাদেরকে ঈমানের বলে বলীয়ান করে তোলা, তেমনি একটি শিক্ষিত ও জ্ঞানমনষ্ক জাতি হিসেবে তাদের গড়ে তোলা। সেই শিক্ষার হাতেখড়ি হতে হবে মকতব থেকেÑ শিশু ও বয়স্ক সকলেরই ক্ষেত্রে। অতপর একদল সুযোগ্য আলেম গড়ে তোলার পাশাপাশি উন্নত মানের বস্তুগত শিক্ষায়ও তাদের এগিয়ে নেওয়া চাই। দ্বীনী শিক্ষা তথা উলামার মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় ও আদর্শিক জীবনের পরিচর্যা হবে আর প্রযুক্তি ও বস্তুগত শিক্ষার মাধ্যমে তাদের বৈষয়িক জীবন পরিপুষ্ট হবে। এ উভয়ের সম্মিলন দ্বারাই একটি উন্নত ও জীবন্ত জাতির প্রতিষ্ঠালাভ সম্ভব। দ্বীনী শিক্ষা বর্জনের পরিণাম একটি জাতির আদর্শবিবর্জিত পাশবিকতায় পর্যবসিত হওয়া আর প্রযুক্তিগত শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার পরিণাম নিজেদেরকে অন্যের কৃপাপাত্রে পরিণত করা, আজকের মুসলিমবিশ^ যা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, অবশ্য টের পাওয়ার মত অনুভূতি যদি অবশিষ্ট থাকে।
এই উভয় ধারার শিক্ষায় মসজিদকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। অন্যথায় দুই ধারার শিক্ষা দ্বারা স্বতন্ত্র দুটি শ্রেণি তৈরি হয়ে যায়, যার একটি অপরটির প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে থাকে, যেমনটা আজ চারদিকে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আরাকানী জাতির ভেতর কাজ করতে গিয়ে এ বিষয়ে সতর্ক থাকা সবিশেষ জরুরি। কেননা আমরা চাই তারা আপন জন্মভূমিতে ফিরে যাক। কিন্তু সেই যাওয়াটা যদি একাত্মতার সাথে না হয়, তবে পুনরায় একই পরিণতির শিকার হওয়ার আশংকা প্রবল। সুতরাং বিভেদ-বিভক্তির চোরাপথ বন্ধ করেই কাজ করতে হবে।
মসজিদে আরও যে কাজ করতে হবে, তা হচ্ছে এ জনগোষ্ঠীর ভেতর সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা। তারা সম্পূর্ণ এক বৈরী পরিবেশের বাসিন্দা। বৌদ্ধ-মগেরা একটি নাস্তিক জাতি। অপরদিকে মুসলিমগণই পৃথিবীর সত্যিকারের একত্ববাদী আস্তিক জাতি। মায়ানমারে তারা নেহাত সংখ্যালঘু। এহেন প্রতিকূল পরিবেশে বসবাস করতে হলে কোনও রকম হঠকারিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। অফুরন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কাজে লাগাতে হবে বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতাকে। নিজেদের মেলে ধরতে হবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে ইসলামের ভুবনজয়ী আদর্শ। এর জন্য তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে কথায় ও কাজে একটি দাওয়াতী জাতিরূপে।
হাঁ, মুসলিমগণ তো দাওয়াতী জাতিই। দাওয়াতী প্রচেষ্টা জাতীয় অগ্রগতির নিয়ামক। মুসলিমগণ যতদিন তাদের এ বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছিল, ততদিন তারা একটি অগ্রগামী জাতি হিসেবেই সম্মানজনক জীবন যাপন করছিল। তখন তাদের সংখ্যালঘুত্ব তাদের ধ্বংস করতে পারেনি। বরং তখন অন্যরাই তাদেরকে সমীহ করে চলেছে। বিপর্যয় শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই, যেদিন তারা তাদের এ বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করেছে। সুতরাং আরাকানী জনগোষ্ঠীর বাঁচার তাগিদেও তাদের মধ্যে দাওয়াতী রূহ ফুঁকে দেওয়া দরকার। তারা যদি সেখানে গিয়ে হিকমত ও জ্ঞানবত্তা এবং কৌশল ও মমত্ববোধের সংগে দাওয়াতী জীবনধারা জারি রাখতে পারে, তবে অসম্ভব নয় তাতার জাতির মত একদিন আজকের নিপীড়ক বৌদ্ধজাতিও ইসলামের সেবক জাতি হিসেবে নতুন ইতিহাসের গোড়াপত্তন করবে। আল্লাহ তাআলার পক্ষে এটা কঠিন কিছু নয়। তিনিই তাওফীকদাতা।