স্ব দে শ : স্বাধীন দেশে সীমান্তের স্বাধীনতাই প্রশ্নবিদ্ধ
খসরূ খান
স্বাধীনতার পর থেকে সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনা বছর জুড়েই ঘটছে। প্রায় মাস দেড়েক যাবত এ ধরনের ঘটনার মাত্রা বেড়ে গেছে বহু গুণ। এপ্রিল মাসের শেষ দিকেও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের পক্ষে সরকারী নীরবতার বিষয়টি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী বড় দেশের প্রতি অনুগত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের আচরণও থাকছে বেদনাদায়ক। এ চিত্রের একটি নির্মোহ মূল্যায়ণ প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে।
প্রথম আলো ৯ এপ্রিল ২০১০ শুক্রবার ১২ পাতায় ছেপেছে আসিফ নজরুলের একটি নিবন্ধ। শিরোনাম ‘স্বাধীন দেশ, পরাধীন মন।’ সে নিবন্ধের একটি অংশ তুলে ধরা হল।
সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের উপর প্রামাণ্য রিপোর্ট করেছিলেন লন্ডন ভিত্তিক চ্যানেল ফোর-এর জোনাথন রাগম্যান। এই রিপোর্ট করেন তিনি ২০০৯ সালের আগস্টে। পরম বন্ধু দুই সরকার তখন দুই দেশে। অথচ এরই মধ্যে আধা বছরে খুন হয়েছে ৬০ জনের বেশি বাংলাদেশী। রাগম্যানের বর্ণনা, যে তিনটি গ্রামে আমরা গিয়েছি, স্থানীয় লোকেরা ভীড় জমিয়েছে তাদের মৃত স্বজনদের ছবি নিয়ে। ক্যামেরার সামনে বারবার বলতে চেয়েছে, কতজন কৃষক আর রাখাল মারা গেছে বিএসএফ-এর গুলিতে। রাগম্যান ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়ার ছবি তুলেছেন। বিএসএফ-গার্ড পোস্টের উঁচু করা বন্দুক দেখিয়েছেন। গুলিবিদ্ধ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমাদের সাংবাদিকদের কাছেই ভিড়তে দেওয়া হবে না এসব রিপোর্ট করতে। কিন্তু আমাদের কলামিস্ট আছেন, আলোচক আছেন, টকশো আছে। সেখানে এর প্রতিবাদ হয় কালেভদ্রে। এমনকি সেখানেও বিস্ময়করভাবে বলে উঠেন কেউ কেউ অবৈধভাবে বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত পার হয় বলেই নাকি বিএসএফ গুলি করে! অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে গেলে আর কোন সীমান্ত রক্ষীরা গুলি করে বিনা নোটিশে? ইসরাইল পশ্চিম তীর বাদে আর কোনো সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয় এত মানুষ? কোন দেশ বছরের পর বছর বিনা কিংবা ভুয়া প্রতিবাদে মেনে নেয় এমন করুণ মৃত্যু? ভারত-পাকিস্তান নাকি শত্রু দেশ। সেখানে বিএসএফ সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া পাকিস্তানীদের গ্রেফতার করে, গুলি করে না। এই মাত্র দুই দিন আগে বিএসএফ-এর ক্রোকোডাইল ইউনিট ভারতের জলসীমা থেকে গ্রেফতার করেছে পাকিস্তানী ছয় জেলেকে। গুলাগুলির ঘটনা সেখানেও ঘটে কখনো কখনো। কিন্তু পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে অধিকাংশ সময় ঘটে গ্রেফতারের ঘটনা। আমরা কখনো গ্রেফতারের খবর পাই না। সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ফাঁকা গুলির খবর পাই না। পাই শুধু বুকে কিংবা মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর। খুন হয় মাঠে গরু চরাতে যাওয়া যুবক। বাবার আহার নিয়ে যাওয়া কিশোরী। ফসল দেখে ফিরে আসার পথে বৃদ্ধ। খুন হয় বৈরী সরকারের আমলের মানুষ। বন্ধু সরকারের আমলের মানুষ। খুন হওয়া এই মানুষেরাও ছিল এই দেশের মানুষ। নির্বাচনে নিশ্চয়ই এরাও ভোট দিয়েছিল আওয়ামীলীগ আর বিএনপিকে। মহা শক্তিধর এই দুই দল ব্যস্ত থাকে পরস্পরকে ধ্বংস করার কাজে। সীমান্তে মানুষ খুন হলে বিএনপি ফাঁকা প্রতিবাদ করে। আওয়ামীলীগ কাকুতি মিনতি করে। ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের গুলিতে মরতেই থাকে বাংলাদেশের মানুষ। সারা পৃথিবীতে এমন বন্ধুত্বের নজির অন্য কোথাও আছে কি? আছে নজির বাংলাদেশের মতো এমন নতজানু পররাষ্ট্রনীতির?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কে দেবেন আমরা জানি না। শুধু বলতে পারি সীমান্তের এই করুণ অবস্থা দেখলে মনে হতেই পারে স্বাধীন দেশের সীমান্তে স্বাধীনতার কোনো নমুনা থাকতে নেই। মনে হতেই পারে স্বাধীনতা এসে গেলে স্বাধীনতা রক্ষা নিয়ে ভাবাভাবির কোনো প্রয়োজন হয় না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে মনে এমন ধারণার জন্ম হওয়াই উচিত নয়।