সফর ১৪৩৯   ||   নভেম্বর ২০১৭

প্রসঙ্গ রোহিঙ্গা মুসলমান : পরিস্থিতি ও করণীয়

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য তেমন কোনো ইতিবাচক খবর এখনো আসছে না। বাংলাদেশ অভিমুখে এখনো অব্যাহত রোহিঙ্গা মুসলমানের ঢল। মগ ও  সেনাবাহিনীকে টাকা-পয়সা দিয়ে কোনোভাবে যারা এতদিন টিকে ছিলেন তারাও আর থাকতে পারছেন না। বাড়ি ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ছেড়ে তাদের দেশত্যাগ করতে হচ্ছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখনো রয়েছেন বাংলাদেশের পথে।

নদী পার হতে গিয়ে নৌকাডুবিতেও অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন। ইয়াবা-অস্ত্র আসছে এমন সংবাদে বিজিবিও মাঝে মাঝে কঠোরতা আরোপ করছে। অবশ্য বিজিবি পরে জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের কাছে এমন কিছু পাওয়া যায়নি। ওদিকে মিয়ানমারে চলছে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের পাশাপাশি বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের অপতৎপরতা। অবশিষ্ট মুসলিমেরাও যেন দেশ ছেড়ে চলে যায়, আর যারা ইতিমধ্যে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে গেছে তারা যেন ফেরৎ আসতে না পারেÑএজন্য তারা চালিয়ে যাচ্ছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। সবকিছু মিলিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য কোনো আশার আলো এখনো দেখা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসঙ্ঘসহ বিশ^ সম্প্রদায় এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ব্যর্থ। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস নানা কারণে কিছু কথা বললেও তেমন কোনো পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে খোদ জাতিসঙ্ঘের বিরুদ্ধেই বেরিয়ে আসছে মারাত্মক সব অভিযোগ। দ্যা গার্ডিয়ান বলছে, জাতিসংঘ অনেক আগেই ‘দ্যা রোল অব দ্যা ইউনাইটেড নেশন্স’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করেছিল, যাতে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার নির্ভুল আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এই সুপারিশ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সংস্থাটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তার আদেশে রিপোর্টটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছিলেন বিশ্লেষক রিচার্ড হোরসে। এতে বলা হয়েছিল, ‘রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী কঠোর ও নির্বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

২৫ আগস্টের হামলার পর এই আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়। ঐ হামলার পরপরই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের উপর। এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারে সংস্থাটির সিনিয়র কর্মকর্তা রেনাটা লক ডেসালিয়েনের তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ।

পত্রিকাটি আরো বলেছে যে, কমপক্ষে ৮০ হাজার শিশু ভয়াবহ খাদ্য সংকটে ভোগার সংবাদও মিয়ানমারের অনুরোধে চেপে গিয়েছিল জাতিসংঘ।

এদিকে গত ১৬ অক্টোবর দৈনিক মানব জমিন একটি রিপোর্ট করে, যার শিরোনাম ছিল, ‘রাখাইনে শিল্পপার্ক, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা, প্রকল্প নিয়ে হতাশা চীনের।’

এই রিপোর্টে রাখাইন রাজ্যকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। এ পরিকল্পনা অনুসারে রাখাইনের পাশেই কিউক ফিউ অঞ্চলে যে স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কথা তাতে আছে, রাখাইনে একটি শিল্পপার্ক ও গভীর সমুদ্র বন্দর। মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউ থেইন সেইনের অধীনে এই গভীর সমুদ্র বন্দরে চীনের শতকরা ৮৫ ভাগ ও মিয়ানমারের ১৫ ভাগ  মালিকানা অনুমোদিত হয়।  এই বৃহৎ প্রকল্পকে দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস আখ্যায়িত করেছিল মিনি সিঙ্গাপুর হিসেবে। এই প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করা  হয়েছিল ২০১৫ সালে। তাতে বিজয়ী হয় চীনের সিআইটিআইসি গ্রুপের নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম।

আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাখা, আরাকানের অধিবাসী রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়া, অবশেষে গণহত্যার মাধ্যমে তাদের বাস্তুচ্যুত করা যে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই বিভিন্ন ধাপ, তা আর বুঝতে অসুবিধা হয় না। একইসাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যার পরও চীন-ভারতের মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ানো, জাতিসঙ্ঘে অবরোধ প্রস্তাবে ভেটো দান এমনকি গণহত্যার সকল আলামত প্রকাশিত হওয়ার পরও খোদ জাতিসঙ্ঘের ঐ সংক্রান্ত রিপোর্ট ও হুঁশিয়ারি ধামাচাপা দেয়া ইত্যাদি সব কিছুর ব্যাখ্যাই বের হয়ে আসে।

এসব কারণে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতার দিকটিও বড় হয়ে সামনে আসছে। বাংলাদেশে কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ এই আঞ্চলিক ও বৈশি^ক তৎপরতায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের পর বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। মিয়ানমারে যদি চীন, রাশিয়া ও ভারতের স্বার্থ থাকে বাংলাদেশে কি নেই? এরপরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য না থাকা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক।  সরকারের দায়িত্বশীলদের অনেকেই বলেছেন রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা সহকারে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কাজের কিছু করতে না পারলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি উল্টো কিছু কথাবার্তা বলার বীরত্ব দেখিয়েছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির নেতৃত্বে গঠিত সংসদীয় কমিটির বক্তব্য জাতিকে হতাশ করেছে। গণমতের বিপক্ষে গিয়ে তারা বক্তব্য দিয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। অবশ্য  অর্ধেকের বেশি অনির্বাচিত লোক নিয়ে গঠিত সংসদে  যে জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আবেগ-অনুভূতি প্রতিফলিত হবে না, এটাই স্বাভাবিক। এটা কি মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতায় পরাস্ত হয়ে নিরীহ নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের উপর বীরত্ব ফলানোর প্রয়াস?

আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতার আরেকটি নজির প্রকাশ পেল ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের মাধ্যমে। মিসেস সুষমা স্বরাজ এক দিনের ঝটিকা সফরে এসে যা বলে গেলেন অভিজ্ঞ মহলের মতে তা চরম হতাশাজনক। ঐ ভদ্র মহিলা এক বারের জন্যও মুখে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। বর্মী বাহিনী ও মগদের হত্যা-নির্যাতনের কথা তো অনেক দূরের বিষয়; বরং তার কথার ভাবে মনে হল তিনি ঐ মজলুম জনগোষ্ঠীকে শাসিয়ে গেলেন। অথচ এর পরও এ দেশের কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।

যাই হোক পরিস্থিতি যতই জটিল হোক, মুসলমানের হাল ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের করণীয় আমাদের অবশ্যই পালন করতে হবে। বাংলাদেশ কোনোভাবেই তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। সরকারের কর্তব্য, এই মজলুম মুসলমানদের পাশে থাকা। লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা মানুষের ¯্রােতে কিছু সমস্যা তৈরি হতেই পারে, সহিষ্ণুতা ও উদারতার সাথে এই সমস্যাগুলোর সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের ভেতরের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি যেভাবে মোকাবিলা করা হয় এইসব পরিস্থিতিও নিজেদের সমস্যা মনে করে সেভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। শৃঙ্খলা-তদারকি এবং দ্বীনী তালীমের বিস্তারের মাধ্যমে পরিস্থিতির অবনতি রোধ সম্ভব।

বর্তমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের অবস্থানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ যতদিন রোহিঙ্গা ভাইদের পাশে শক্তভাবে থাকবেন ততদিন রাষ্ট্রও তার আনুকূল্য অব্যাহত রাখতে বাধ্য হবে। এ কারণে জনগণকে তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারের দায়িত্ব, বেসরকারী ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করা এবং সহজ নিয়ম-কানুনের মধ্যে এই ইতিবাচক তৎপরতাকে সহায়তা দান করা। অপ্রয়োজনীয় শর্ত-শরায়েত দ্বারা দেশী উদ্যোগ-তৎপরতাকে নিরুৎসাহিত করার ফল ভালো হবার নয়। এতে বাইরের অপতৎপরতাসমূহ শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পেতে পারে।

এই সকল মজলুম মুসলমান, যারা একমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে বাস্তুহারা হয়ে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছেন তাদের দ্বীন ও ঈমান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হতে পারে এ বিষয়েও সচেতন থাকা কর্তব্য। তাদের খাদ্য-বস্ত্র, চিকিৎসা ও আবাসনের পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষা, মনোবল ও নৈতিকতা রক্ষা ও উৎকর্ষার চেষ্টাও অতি প্রয়োজন। আর এর জন্য শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে দ্বীনী তালীমের বিস্তারের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য যেমন মক্তব-মাদরাসার ধারাকে স্থায়ী ও শক্তিশালী করতে হবে তেমনি সকল বয়সীদের জন্য খ-কালীন দ্বীনী তালীমের উদ্যোগও নিতে হবে। একমাত্র দ্বীনী-শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের নৈতিকতা ও মনোবলের সুষম উন্নতি সম্ভব।

আশ্রয় শিবিরগুলোতে দ্বীনী তা‘লীমের বিষয়ে আরো কিছু লেখার ইচ্ছা থাকলেও ইতিমধ্যে মুহতারাম মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ছাহেবের লেখাটি এসে পৌঁছেছে। তিনি বিষয়টি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।

এরইসাথে প্রয়োজন হাজার হাজার এতিম শিশুর আলাদা ও মানসম্মত ব্যবস্থার। তাদের ভরণ-পোষণ ও শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ একান্ত কাম্য।

কাজ করা দরকার নারীদের মধ্যেও। মহিলাদের মাধ্যমে (হতে পারে শিক্ষিত রোহিঙ্গা নারী) তাদের জন্য তা‘লীম-তরবিয়তের আয়োজন করা খুবই প্রয়োজন। এছাড়া তাদের জন্য আলাদা শৌচাগার ও গোসলখানার এন্তেজামও দরকার।

গত কয়েক দিনের নি¤œচাপজনিত প্রবল বৃষ্টিতে শরণার্থী মুসলিমদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। জ¦র, সর্দি কাশির প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে ঘটেছে। বিভিন্ন সংগঠন সেবা দিয়ে গেলেও, বলাই বাহুল্য, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সামনে আসছে শীতের মওসুম। ঐ মওসুমকে সামনে রেখে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগও অতি প্রয়োজন। বিশেষত শীতে শিশু-নারী ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যেতে পারে। এ বিষয়েও প্রস্তুতি প্রয়োজন।

আমাদেরকে সমর্থন ও সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে ভেতরের-বাইরের প্ররোচনা দায়িত্বশীলদের ভূল পথে পরিচালিত করতে না পারে। সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার দিকে রুজু-করা ও কান্নাকাটি অব্যাহত রাখা অতি প্রয়োজন। আল্লাহর এই মজলুম বান্দাদের সেবায় যে ত্রুটি আমাদের দ্বারা হচ্ছে তা যেন তিনি ক্ষমা করেন এবং পূর্ণ ইখলাসের সাথে তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকার তাওফীক দান করেন।

 

 

 

advertisement