শাওয়াল ১৪৩৮   ||   জুলাই ২০১৭

আমাদের রাজ্য শাসন-১৭

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

মুসলমানদের মাঝে বিশৃঙ্খলা ও হযরত উসমান রা.-এর শাহাদাত-২

হযরত উসমান রা. ছিলেন অত্যন্ত কোমল মনের মানুষ। এদিকে বড় বড় সাহাবীগণও পরলোক গমন করেছেন। যারা আছেন তাদের সবাই অল্প বয়সের। তাছাড়া নতুন ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যাই ছিল বেশি। ফলে এমন পরিস্থিতিতে ওমর রা.-এর মতো কোনো শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করাও ছিল বেশ কঠিন। অন্যদিকে ইহুদী ও  মুনাফিকরা তো ইসলামী শাসনব্যবস্থা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে ছিল সদা লিপ্ত। এ পরিস্থিতিতে উসমান রা. ও তাঁর প্রশাসনের লোকদের ব্যাপারে দুর্নাম রটানোর এক সুযোগ আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ও তার দল পেয়ে বসল। একটি সত্যের সাথে দশটি মিথ্যা মিলিয়ে তারা নানা ধরনের দুর্নাম রটাতে লাগল।

নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে বিভিন্ন শহরে একের পর এক পত্র পাঠাতে লাগল। যাতে পুরনো শহরগুলোর দুরবস্থা, শহরবাসীর উপর প্রশাসকদের অত্যাচার ইত্যাদির উল্লেখ থাকত। শহরের লোকেরা তো বাস্তব অবস্থা জানত না। তারা এসব চিঠি পড়ে আফসোস করত এবং বলত, আল্লাহর অশেষ শোকর যে, আমরা এহেন বিপদ থেকে নিরাপদ আছি। মোটকথা, কয়েক বছর ধরে সারা দেশে এসবেরই চর্চা হতে লাগল। একপর্যায়ে মদীনাতেও এ ধরনের খবর আসতে শুরু করে। লোকেরা উসমান রা.-কে বিষয়টি অবহিত করে বাস্তবতা উদ্ঘাটনের আবেদন জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উসমান রা. কয়েকজন বিশ^স্ত লোককে বিষয়টি তদন্তের জন্য প্রেরণ করেন। সবাই ফিরে এসে জানায় যে, কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। দেশের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে। দেশের সব কাজ আগের মতোই সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবেই চলছে।

কিন্তু সাবায়ীরা (আবদুল্লাহ ইবনে সাবার লোকেরা) অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালাতে থাকল। যার পরিণতিতে গোটা মুসলিম জাহানে হযরত উসমান রা. ও তাঁর প্র্রশাসনের লোকদের ব্যাপারে নানা দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ল। এমন কি মদীনাতেও এর চর্চা শুরু হয়ে গেল।

সমালোচনা যখন তীব্র আকার ধারণ করল তখন উসমান রা. সকল কর্মকর্তাদেরকে সমবেত হওয়ার আদেশ দিলেন।

সকলে উপস্থিত হলে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিষয়টা আসলে কী, আর এই অপপ্রচার কেন ছড়াচ্ছে? লোকেরা জানাল, স্পষ্টভাবে তো ঘটনার কিছুই জানা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে কোনো দুষ্টচক্র এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমাদের উচিত, এসব লোকদেরকে শেষ করে ফেলা। যেন এই ফিতনাও এখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু উসমান রা. ছিলেন অত্যন্ত নরম স্বভাব ও দয়ার্দ্র মানুষ। যথাসাধ্য তিনি রক্তপাত এড়াতে চাইতেন। তাছাড়া এখনো যেহেতু সাবায়ীদের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেনি তাই শুধু সন্দেহের বশে এত কঠিন কাজের অনুমতি দিলেন না। ফলে এই আগুন তুষের মতো জ¦লতে থাকল।

কিছুদিন পর কূফা, বসরা ও মিসর-তিন অঞ্চলের সাবায়ীরা মদীনা অভিমুখে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মদীনার বাইরে অবস্থান করতে থাকে। হযরত উসমান রা. বিষয়টি জানতে পেরে তাদেরকে ডেকে পাঠান। সব সাহাবীর উপস্থিতিতে তিনি তাদেরকে অভিযোগ উত্থাপন করতে বলেন। তারা তাদের অভিযোগগুলো উত্থাপন করলে উসমান রা. নিজেই তাদের সব অভিযোগের পূর্ণ উত্তর দিলেন এবং প্রকৃত অবস্থা তাদের সামনে তুলে ধরলেন। তাদের বড় অভিযোগ ছিল, উসমান রা. তাঁর প্রিয় ও আত্মীয়দের সাথে বিশেষ আচরণ কেন করেন। তিনি এর জবাবে বলেন, আমি আমার আত্মীয়দের সাথে যা কিছু করি সব আমার ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে করি। সরকারি সম্পদ থেকে একটি কড়িও আমি তাদেরকে দিই না। তাছাড়া আমার ব্যয় নির্বাহের জন্যও একটি পয়সা (বেতন) সরকারি তহবিল থেকে গ্রহণ করি না।

এরপর তিনি বললেন, তোমাদের অভিযোগ যে, আমি মারওয়ান ইবনে হাকামকে কেন মক্কায় আসার অনুমতি দিয়েছি। আরে ভাই! এতে আমার দোষ কোথায়? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তো তাঁর জীবদ্দশায় অনুমতি দিয়েছেন। ফলে আমি তাকে বাধা দেওয়ার কে?

তোমাদের অভিযোগ যে, আমি অল্প বয়সীদেরকে প্রশাসক বানিয়ে দিয়েছি। এতে তো কোনো অন্যায় করিনি। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উসামা রা.-কে অল্প বয়সেই অনেক বড় বড় ও বয়োবৃদ্ধ সাহাবীদের আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। অথচ তখন তার বয়স ছিল মাত্র সতের বছর।

আর আমি যাদেরকে আমীর বানিয়েছি তাদের যোগ্যতা, জ্ঞান-বুদ্ধি, দ্বীনদারী ও ঈমানদারী ইত্যাদি যাচাই করেই তাদেরকে আমীর বানিয়েছি।

তোমাদের অভিযোগ, আমি আবদুল্লাহ ইবনে সা‘দকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কেন প্রদান করেছি। অথচ তোমরা জান যে, কাউকে পুরস্কার ও বিশেষ মর্যাদা প্রদানের অধিকার খলীফার রয়েছে। আর সে আফ্রিকা বিজয়ে বিশেষ অবদান রেখেছে। এতে খুশি হয়েই এই পুরস্কার তাকে প্রদান করা হয়। কিন্তু এরপরও লোকদের অসন্তোষের কথা বিবেচনা করে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হল।

মোটকথা, হযরত উসমান রা. এক এক করে তাদের আনীত সব অভিযোগের পূর্ণ জবাব প্রদান করলেন এবং প্রতিটি জবাবের ব্যাপারে সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করে এর সত্যায়ন চাইলেন যে, তা সঠিক কি না? সকলেই সঠিক ও যথার্থ বলে তাঁকে সমর্থন করলেন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

(ভাষান্তর : আবদুল্লাহ ফাহাদ)

 

 

advertisement