বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমরা যে বাসায় থাকি তার দ্বিতীয় তলায় একটি অনুষ্ঠান ছিল। ওই বাসার ভদ্রমহিলা বেশ অমায়িক। তিনি আমার বাচ্চাদের আদর করেন, ওরাও তাঁকে নানু বলে ডাকে। তাই তাঁর অনুরোধে অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। অতিথিদের অনেকে পরিচিত। তাদের মধ্যে বরের মামীও ছিলেন। কনের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে কথা উঠতেই তিনি বললেন, ‘ওরা খুব মডার্ন। ছেলের পরিবারের সাথে বনবে না। আর ভাই, অন্যের কথা বলছি কেন? আমি নিজেও কি সুখে আছি? এদের সঙ্গে কত কষ্টে ম্যানেজ করে চলেছি! সবাই কি তা পারে?’
আমি বললাম, ‘কী অসুবিধায় পড়েছিলেন, যা ম্যানেজ করতে কষ্ট হয়েছে?’
তিনি বললেন, ‘আমাদের ফ্যামিলিতে দাড়ি-টুপি এবং নেকাব-বোরকার চল নেই। আমার স্বামী অবশ্য আধুনিক, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজন ধার্মিক টাইপের। জানেন, বিয়ের পার্টিতে পর্যন্ত বোরকা পরে যেতে হয়েছে আমাকে! (বোরকা মানে মুখ-খোলা ‘আধুনিক’ বোরকা)। তাই বলছিলাম, ওদের কালচার আমাদের সঙ্গে মেলে না।’
এরপর আর তার সঙ্গে আলাপ জমেনি। তিনিও অন্য দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমিও বাসায় চলে এলাম। কিন্তু তার কথাগুলো ভুলতে পারিনি।
দুই.
কিছু দিন পরের ঘটনা। ঢাকা শহরেরই একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। ‘আধুনিক’ এবং ‘শিক্ষিত’। পরিবারের বড় ছেলে ভালো উপার্জন করে। দুই মেয়ের ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। শুধু ছোট ছেলেটিকে নিয়ে সমস্যা। সেও উচ্চ শিক্ষিত, তবে বেকার। তাই বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং ফেসবুক-ইন্টারনেটে সময় কাটানো ছাড়া আর যে কাজটি তাকে করতে হত তা হচ্ছে চাকুরি খোঁজা। কিন্তু বহু জায়গায় ধর্ণা দিয়েও যখন চাকরি হল না তখন তার মাথায় চাপল যে, বিদেশে যাবে। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়? নিজেরও উপার্জন নেই, আত্মীয়-স্বজনও বেকার যুবককে বিশ্বাস করে না। টাকা চাইলে বাসা থেকে বলা হয়, তোমার উপর ভরসা করা যায় না। শেষে কোনো দিকে আশার আলো দেখতে না পেয়ে ছেলেটি চরম সিদ্ধান্ত নিল। ঘুমের বড়ি খেয়ে সে আত্মহত্যা করল।
তিন.
ছেলেটি আমার পূর্ব-পরিচিতা ঐ মহিলার ছোট ভাই, যিনি বলেছিলেন, ধার্মিক মানুষের সাথে তাদের মেলে না। ছেলেটিকে আজিমপুর কবরস্তানে দাফন করা হল। সবাই চিন্তিত, আত্মহত্যা করে যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তার স্থান কোথায় হবে! একপর্যায়ে জানা গেল, ওর কবরের পাশেই একজন হাফেযে কুরআনের কবর। যে ভদ্র মহিলা আমাকে পুরো ঘটনাটা শুনিয়েছেন, এখানে এসে তার চোখের তারায় আমি দেখতে পেলাম একটুখানি আশার আলো। কিন' এতে আনন্দিত হতে পারিনি; বরং খুব কষ্ট হয়েছে। আহা! কবরের জীবন সম্পর্কে যার এত উৎকণ্ঠা, সামান্য খরকুটো অবলম্বন করেও যার এমন বাঁচার আকুতি সে কেন সময় থাকতে নিজেকে শোধরায় না? কেন আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয় না? ওরা যদি নাস্তিক হত তাহলে কোনো কথা ছিল না, কিন্তু যাদের অন্তরে আছে ঈমানের বীজ, তারা কেন চলে উল্টো পথে, যার সমাপ্তি কুফর ও নাস্তিকতায়?
চার. আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থার এ এক চরম দৈন্য যে, তা আমাদের না দেয় দুনিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, না আখিরাতের মুক্তি ও সফলতার নিশ্চয়তা। তবু কেন আমাদের মোহ কাটে না? এখন তো প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে হত্যা, ও আত্মহত্যার খবর,। চোখে পড়ে স্কুলগামী ছোট ছোট মেয়েদের নির্যাতিতি হওয়ার সংবাদ। আমরা আসলে কীসের অপেক্ষায় এমন স্থবির হয়ে রয়েছি? এই নির্জীবতার সত্যিই কোনো তুলনা নেই।