মাদার অব অল বোম্বস
জুলুম-নির্যাতনের আরো একটি কালো অধ্যায় রচনা করল আমেরিকা। পৃথিবীর গরিব দেশ আফগানিস্তানের উপর সবচেয়ে বড় অপারমাণবিক বোমা হামলাটি করে বসল। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩২ মিনিটে নানগরহার প্রদেশের আচিন জেলায় ওই বোমাটি ফেলা হয়। এর ওজন ছিল ২১ হাজার ৬০০ পাউন্ড অর্থাৎ ১১ টন। এ্যাটম বা পারমাণবিক বোমার পরে এটিকেই সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিধ্বংসী বলে মনে করা হয়। যার নাম মাদার অব অল বোম্বস। আফগানিস্তানেই প্রথমবারের মতো এই বোমাটি ফেলা হল। এ কারণে সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বহু হতাহতের আশংকা করা হচ্ছে।
পাঠকবৃন্দের হয়ত জানা আছে, মানব ইতিহাসে এ্যাটম বোমাও এই আমেরিকাই ব্যবহার করেছিল। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আমেরিকার যুদ্ধ বিমান বোয়িং বি-২৯ থেকে হিরোশিমার উপর ‘লিটল বয়’ নামের প্রথম এ্যাটম বোমাটি ফেলা হয়। যা মাত্র ৬ সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণ হরণ করে। আর আজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার মানুষকে। এর ঠিক তিন দিন পর ৯ আগস্ট জাপানের আরেক শহর নাগাসাকিতে ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের আরেকটি এ্যাটম বোমা ফেলে আমেরিকা। এই বিধ্বংসী বোমাটিও মুহূর্তেই ৭৪ হাজার নাগরিকের প্রাণ হরণ করে। এর মধ্য দিয়ে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় এবং মোট ২ লক্ষ ১৪ হাজার মানুষ নিহত হয়। এর পরপরই বিশ্বজুড়ে আমেরিকার এহেন নৃশংসতার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠে। চারদিকে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা ও নানা তর্কবিতর্ক। আমেরিকাকে আখ্যা দেওয়া হয় মানবতার শত্রু। প্রাচ্য থেকে পশ্চিম সর্বত্রই এই নৃশংসতার বিরোধিতা করে। এমনকি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতেও হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়। উঠে আসে এমনসব বর্ণনা ও চিত্র, যার ফলে পাষাণ হৃদয়ও মোমের মতো গলে যায়। এসবের কারণে এই আশা জাগ্রত হয়েছিল যে, ভবিষ্যতে আর কখনো মানুষের উপর এমন বর্বরতা ও নৃশংসতা হবে না। আর এমনটাই তো হওয়া উচিত ছিল যে, মহাপ্রলয় পর্যন্ত আমেরিকা অনুতপ্ত থাকবে। কিন্তু তারা বর্বরতা থেকে ফিরে আসেনি; বরং আগের চেয়েও বেশি হিংস্র হয়ে উঠে। পৃথিবীর ইতিহাসে চোখ ফিরালে দেখা যায়, ১৯৪৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত গোটা পৃথিবীতে মোট ১১৯টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে প্রকাশ্যেই বারুদের ব্যবহার হয়েছে। বাড়িঘর জ্বলেছে, শহরে পর শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে, লাশের স্তুপ জমেছে। আর আহতদের আর্তনাদ ও আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বস্তুত এসব যুদ্ধের পেছনে ছিল একটিই মাত্র দেশ- আমেরিকা। যার কিছু যুদ্ধ তো আমেরিকা নিজেই লড়েছে, কিছু যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করেছে আর কিছু যুদ্ধে তাদের সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। আর যেগুলোতে আমেরিকা সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি তাতেও হতাহতদের রক্তের দাগ আমেরিকার আঁচলেই দৃশ্যমান ছিল। এসব যুদ্ধে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৯০ লক্ষ ৭৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। যার বিস্তারিত বিবরণ সংশ্লিষ্ট বইপুস্তকে রয়েছে।
এটি একটি তিক্ত বাস্তবতা যে, গোটা মানব ইতিহাসে বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহে যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তার ৭৮ শতাংশই হারিয়েছে গত সাড়ে ৫শ বছরে। আর বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত হয়েছে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ যুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই চার বছরে পঙ্গু ও আহতদের ছাড়াই ইউরোপের সাড়ে চার কোটি মানুষ নিহত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। এই ছয় বছরে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সোয়া ছয় কোটি মানুষ নিহত হয়। বস্তুত এ যুদ্ধগুলো আমেরিকা, ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই বাঁধিয়েছিল। মাইকেল ম্যন (Michael Mann) এর ‘দ্যা ডার্ক সাইড অব ডেমোক্র্যাসি’ (The dark side of Democracy)-এর তথ্য অনুযায়ী আমেরিকায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ৫০ বছরে তারা ১০ কোটির বেশি রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করে। বস্তুত আমেরিকা ১০ কোটি মানুষের রক্তের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। পক্ষান্তরে ইসলামী ইতিহাসের সুদীর্ঘ পনের শ বছরে ১০ লক্ষ মানুষও নিহত হয়নি। ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন বিপ্লবেও ৮ কোটির বেশি মানুষ নিহত হয়। ল্যাটিন আমেরিকাতেও বিপ্লব আনার জন্য ২ কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্থই হল, পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় যুদ্ধ এর আগে কখনো হয়নি। এই উভয় যুদ্ধে সামগ্রিকভাবে ১১ কোটির বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বস্তুত আমেরিকা তার স্বাধীনতা লাভের দিন থেকেই হিংস্রতা ও বর্বরতার পথ বেছে নিয়েছে। ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী বিশে^র বিভিন্ন দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ২২৭ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। মাত্র ২৩৯ বছরের মধ্যে ২২০ বারের বেশি সংঘর্ষে জড়ানোর এই হার যে কোনো দেশের সংঘর্ষের তুলনায় অনেক বেশি। আর এতে হতাহতের সংখ্যা তো অত্যধিক বেশি। তা এভাবে যে, চেঙ্গিস খানের উপর ৩৪ মিলিয়ন ও হালাকু খার উপর ৪ মিলিয়ন মানুষ হত্যার দায় চাপানো হয়। তৈমুর লংয়ের রক্তপিপাসু তরবারিতে ঝরেছে ২৪ মিলিয়ন মানুষের রক্ত। এদিকে জার্মান নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারকে বলা হয় ২১ মিলিয়ন প্রাণের হন্তারক। এ সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩ মিলিয়ন। অথচ আজ পর্যন্ত আমেরিকার ১৭১.৫ মিলিয়ন মানুষ হত্যার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত। কেননা, রেড ইন্ডিয়ান ১০০ মিলিয়ন, আফ্রিকান ৬০ মিলিয়ন, ভিয়েতনামী ১০ মিলিয়ন, ইরাকী ১ মিলিয়ন ও আফগানী ০.৫ মিলিয়ন মিলে মোট সংখ্যা হয় ১৭১.৫ মিলিয়ন। এবার আপনিই বলুন, ৭৩ মিলিয়ন মানুষ হত্যাকারীদের যদি ‘মানবতার হন্তারক’ আখ্যা দেওয়া হয় তাহলে ১৭১ মিলিয়নের বেশি মানুষের প্রাণ হরণকারী আমেরিকাকে কী নাম দেওয়া উচিত?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও আমেরিকা ২৪টি দেশের উপর বোমা হামলা চালিয়েছে। এ সবক’টি যুদ্ধের পেছনেই ছিল আমেরিকা। সবগুলোতেই ব্যবহার হয়েছে আমেরিকার অস্ত্র। অথচ এসব যুদ্ধের কোনোটি এমনও ছিল যে, আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাত্র একটি ফোন কলেই যুদ্ধ বন্ধ হতে পারত এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ ভয়াবহ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ব্যবস্থা হত। কিন্তু ফোন তো দূরে থাক, উল্টো যুদ্ধ অবস্থায়ও আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমনসব ভাষণ-বিবৃতি দিতে থাকে, যার ফলে যুদ্ধটাও বৈধতা পেয়ে যায়। আর বৃহৎ ও প্রভাবশালী অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোও উভয় দেশ ও উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে-গোপনে সমরাস্ত্র ও প্রয়োজনীয় যুদ্ধ-সরঞ্জাম সরবরাহ করে গেছে।
বর্তমান সময়েও বিশ্বজুড়ে ৬৮টি বিরোধ রয়েছে, যা গোটা পৃথিবীর শতকরা ৪৩ ভাগ জীবনোপকরণ কব্জা করে রেখেছে। অথচ এসব বিবাদ খুব সহজেই মীমাংসা করা সম্ভব। কিন্তু বিশ্বশক্তি বিশেষত আমেরিকা এর মীমাংসাই চায় না।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার প্রণীত নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এ বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে সারা বিশে^ আমাদের একক কর্তৃত্ব চলবে। যেখানেই আমেরিকার স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন হবে সেখানেই তার পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার থাকবে, নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এর মাধ্যমে আমেরিকা মূলত তার ‘বিশ্ব মোড়লি’ বহাল রাখতে চায়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বর্তমান পরাশক্তি আমেরিকা আজ যে দাবি করছে, এক সময়ের পরাশক্তি কায়সার-কিসরারও একই দাবি ছিল। অথচ আজ তাদের নাম-নিশানাও নেই। ১৯৪৫ সালের আগে জার্মানিদেরও দাবি ছিল- সারা বিশে^ কর্তৃত্ব করার অধিকার শুধু জার্মানির। ১৯৫০-এর পরে রাশিয়াও আসে এই অবস্থানে। ১৯৯০ সালের পর আমেরিকাও এমনটিই ভাবতে বসেছে। আর এ পথে তারা সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করছে মুসলমানদেরকে। কিন্তু পৃথিবীর বাস্তবতা বলে, আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হুমকি হল মার্কিন সাম্রজ্যবাদ।
প্রিয় পাঠক! লক্ষ্য করুন, আফগানিস্তানের উপর ২০০১ থেকে, ইরাকের উপর ২০০৩ থেকে আর সিরিয়ার উপর ২০১২ থেকে আজ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পুরোদমে অব্যাহত আছে। উন্মত্ত আমেরিকা কোনোক্রমেই নিবৃত্ত হচ্ছে না। কিন্তু আমেরিকার মনে রাখা উচিত, সকল দম্ভ-অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণকারী যে মহান সত্তা তিনি সকল পঙ্কিলতা প্রত্যক্ষ করছেন।
[একটি বিদেশী দৈনিক থেকে অনূদিত অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]