শাওয়াল ১৪৩৮   ||   জুলাই ২০১৭

পৈতৃক মীরাছ ও যৌতুক

প্রফেসর মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ

অনেক দিন থেকে মেয়েদের উত্তরাধিকার ও যৌতুক সম্পর্কে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছিলাম। কেননা, একদিকে যেমন মেয়েরা আল্লাহ তাআলার বিধানগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে যৌতুকের জাঁতাকলে তারা আজ নিষ্পেষিত। পত্র-পত্রিকায় যৌতুক সম্পর্কে প্রায়ই লেখালেখি হয় এবং এর অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। দেশে এ বিষয়ে আইন ছিল না অথবা ক্ষেত্রবিশেষে আইনের প্রয়োগ হয়নি, তা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এতে বিশেষ সুফল হচ্ছে না। ফলে সবাই হতাশায় আছেন।

আমরা সকলে জানি, যৌতুক প্রথার প্রচলন সর্বাগ্রে হয়েছিল হিন্দু সমাজে। হিন্দু সমাজে মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। সেই কারণে সেখানে যৌতুক প্রথার প্রচলন হয়েছে। আমাদের ইসলাম ধর্মে তো মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মেয়েদের এ অধিকার চিরকালের জন্য বিধানগত করে দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে মুসলমান সমাজ ধর্মকর্ম থেকে বেশ দূরে চলে যাওয়ায় মুসলিম মহিলারাও কার্যত বহু ক্ষেত্রে উক্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপরদিকে দেখা যায়, মুসলিম সমাজে যৌতুকের চাহিদা, বরং এর জোরদার পদক্ষেপ। তবে কি মুসলিম জাতির মেয়েদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং যৌতুকের অভিশাপের মধ্যে কোনো যোগসূত্র ধারণা করা যায়?১

। ২।

কয়েক বছর পূর্বে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে মাসিক ‘মুঈনুল ইসলাম’ নামে ধর্ম ও তাহযীব বিষয়ক একটি মাসিক পত্রিকা স্বয়ং মাদরাসার পরিচালক-এর সম্পাদনায় বের হয়। পত্রিকাটির ১ম সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে মেয়েদের মীরাছ সম্বন্ধে সম্পাদক সাহেব পবিত্র কুরআনের ভাষ্য এমন সুন্দরভাবে তুলে ধরেন যে, আমরা পাঠকবৃন্দ চমৎকৃত হই।

তিনি তাঁর সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখেন, “পিতৃবিয়োগের পর পৈতৃক সম্পদ ভাই বোনদেরকে, দাদা লোকান্তরে তার ত্যাজ্য সম্পদ বাপ-চাচা ফুফুদেরকে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য হিসাবে দিয়ে দেওয়া দূরের কথা, নারীদের প্রাপ্য সম্পদে আজ তাদের কোন অধিকার আছে বলেও স্বীকার করা হচ্ছে না। ইসলামে এ স্বত্বাধিকারের গুরুত্ববহ ভূমিকা সর্বজন বিদিত। এই  অধিকারকেই মীরাছ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মীরাছ বা ত্যাজ্য সম্পদ বণ্টন একদিকে যেমন মানবাধিকার সম্পর্কিত, অন্যদিকে তা মহাস্রষ্টার অপরিহার্য নির্দেশও বটে। কিন্তু আজ মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন তো দূরের কথা, তার স্বীকারোক্তিটুকু পর্যন্ত সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে।

পিতার মৃত্যুতে ক্ষমতাবান পুত্র তার সবটুকু সম্পদই গ্রাস করে নিচ্ছে। কোথাও বা ভাইয়েরা একযোগে গোটা সম্পদ আত্মসাৎ করে ফেলছে। ভাইয়েরা দাপট খাটিয়ে বোনদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে দিচ্ছে। কোনো বোন সম্পদের দাবি করলে তাকে দাপটে নিশ্চুপ করে দেওয়া হয়। এতে শেষ পর্যন্ত তার পৈতৃক ভিটায় আসাটাই বন্ধ হয়ে যায়। বোন যদি তার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ করতলগত করে নেয় অথবা নিজের প্রয়োজনে বিক্রি করে দেয়, তাহলে তাদের মানসপট থেকে বোনের অস্তিত্বটুকু মুছে ফেলে। চিরদিনের জন্য ছিন্ন করে দেয় আত্মীয়তার বন্ধন। যে জামাতা স্ত্রীর প্রাপ্য পৈতৃক সম্পত্তি করায়ত্ত করে, মুছে যায় তার কপাল থেকে শ্বশুরালয়ের আদর-আপ্যায়নটুকু।

এ বিষয়ের উপসংহার তিনি লেখেন, ‘এ সব থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আদর-আপ্যায়ন, আত্মীয়তার বন্ধন সবকিছুই তার প্রাপ্য সম্পদের বিনিময় মাত্র। অথচ এদের এমন সব বন্ধু-বান্ধব রয়েছে, যাদের সাথে সম্পদের কোনো সম্বন্ধ নেই বা ছিলও না। তার আনন্দ-ভোজে, চা-টেবিলে, ঈদ-উৎসবে এরা কখনো বঞ্চিত হয় না। বঞ্চনার স্রোতে ভেসে যায় আত্মীয়-স্বজন। এই কি মানবতা? রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করতে দ্বিধা হয় না। কিন্তু সাধারণ পরিচয়ের মানুষ সর্বদাই সমাদৃত।’

। ৩।

এ স্থলে আমি (প্রবন্ধকার) নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি আমার গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের। এক বোন তার স্বামীর সহযোগিতায় নিজ ভাইয়ের কাছ থেকে ওয়ারিসী সম্পত্তি নিয়ে গেছে। ভাই নিজ মেয়ের বিয়ের প্রাথমিক আলোচনায় প্রতিবেশীদের নিয়ে পুকুর-পাড়ে বসেছে। বাড়ীর কাছে বলে দাওয়াত ছাড়াই সেই ভগ্নিপতিও এসেছেন। নাস্তার সময়। ভাই আর সকলকে ঘরে ডেকে নিয়ে চা-নাস্তা করিয়েছেন, কিন্তু ভগ্নিপতিকে ডাকেনি, নাস্তাও খাওয়ায়নি। সকলেই বুঝতে পেরেছে। তিনি বোনের সহযোগী হয়ে তার সম্পত্তি নিয়েছেন বলে এই ব্যবহার- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন। বোনের সঙ্গে সম্পর্ক এই শুনেছি যে, বোন বাপের বাড়ির মায়ায় কখনো ভাইয়ের কাছে আসত। কিন্তু ভাই বোনকে তার ঘরে ঢুকতেই দিত না, আপ্যায়ন তো দূরের কথা। বোন দুঃখে কাঁদতে থাকত। এমতাবস্থায় চাচাত ভাই-বোনেরা তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলত, ‘বোন! আমাদের ঘরে এসে বস এবং আমাদের কাছে দু একদিন থেকে যা। কিন্তু এতে তার সান্ত¡না কোথায়, কেঁদে কেঁদে স্বামীর বাড়ি চলে যেত।

দুনিয়ার লোভ কী সাংঘাতিক জিনিস! বোনের সম্পদ খেতে না পারায় রক্তের সম্পর্ক পর্যন্ত ছিন্ন!

। ৪।

মুসলিম সমাজেও মেয়েদের এই বঞ্চনার করুণ চিত্র পাঠকদের সামনে তুলে ধরার পর বিজ্ঞ সম্পাদক পবিত্র কুরআনের আলোকে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, মেয়েদের এই বঞ্চিতি আল্লাহর বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বঞ্চনাকারীরা হবে বিশ্ব ¯্রষ্টার কাছে ধিকৃত ও শাস্তিপ্রাপ্ত।

তিনি তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের প্রমাণে কুরআনের যে কয়েকটি আয়াত পেশ করেছেন, আমরা তা পেশ করছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন-

لِلرِّجَالِ نَصِیْبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدٰنِ وَ الْاَقْرَبُوْنَ وَ لِلنِّسَآءِ نَصِیْبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدٰنِ وَ الْاَقْرَبُوْنَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ اَوْ كَثُرَ ؕ نَصِیْبًا مَّفْرُوْضًا.

পিতামাতা ও আত্মীয়বর্গের পরিত্যক্ত সম্পদে পুরুষদেরও অংশ রয়েছে, নারীদেরও অংশ রয়েছে। সম্পদ কম হোক বা বেশি হোক। এক নির্ধারিত অংশ। -সূরা নিসা (৪) : ৭

আল্লাহ তাআলা আরো ঘোষণা করেন-

لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْاُنْثَیَیْنِ

(পরিত্যাক্ত সম্পদে) একজন পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের সমপরিমান। -সূরা নিসা (৪) : ১১

অতপর বিজ্ঞ আলেম উক্ত আয়াতগুলির ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এ আয়াত দুটিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের প্রাপ্য সম্পদের অংশগুলিকে স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন। এ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা নিতান্ত জঘন্য পাপ ও মানবাধিকার পরিপন্থী।

সূরা নিসার ১১ নং আয়াতে মৃত ব্যক্তির ছেলেমেয়ে ও পিতামাতার মীরাছ বণ্টনের নীতিও বর্ণিত হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اٰبَآؤُكُمْ وَ اَبْنَآؤُكُمْ لَا تَدْرُوْنَ اَیُّهُمْ اَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا  فَرِیْضَةً مِّنَ اللهِ  اِنَّ اللهَ كَانَ عَلِیْمًا حَكِیْمًا.

তোমাদের যে বাপ-দাদারা ও সন্তানেরা আছে, তোমরা সঠিকভাবে জানতে পার না যে, তাদের কোন্ ব্যক্তি তোমাদের (দ্বীনী বা পরকালীন) উপকার করার অধিকতর নিকটবর্তী। এই বিধান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সাব্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন সর্বজ্ঞ, হেকমতওয়ালা। (বায়ানুল কুরআনের অনুসরণে)

যেহেতু মানুষের এই বিষয় জানা নেই যে, এদের মধ্যে কার দ্বারা উপকার হবে এবং কতটুকু উপকার হবে, ত্যাজ্য সম্পত্তির অংশ নির্ধারণে মানুষের হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। আল্লাহ তাআলা যার যে অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তারই অনুসরণ করা উচিত। কেননা, তিনিই সকল বিষয় সম্বন্ধে অবহিত এবং সেইসঙ্গে বড়ই হেকমতওয়ালা। (তাফসীরে উছমানী অনুসরণে)

প্রসঙ্গত এতিমদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা অতি কঠোর ভাষায় ঘোষণা করেন-

اِنَّ الَّذِیْنَ یَاْكُلُوْنَ اَمْوَالَ الْیَتٰمٰی ظُلْمًا اِنَّمَا یَاْكُلُوْنَ فِیْ بُطُوْنِهِمْ نَارًا   وَ سَیَصْلَوْنَ سَعِیْرًا.

যারা এতিমের (পিতৃহারা অসহায়দের) সম্পদ জুলুম করে ভক্ষণ করে (আত্মসাৎ করে) তারা নিশ্চয়ই তাদের পেট আগুনে পরিপূর্ণ করছে। অতি শীঘ্রই তারা জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে। -সূরা নিসা (৪) : ১০

এ আয়াতে কারিমায় এতিমের ধন দৌলত আত্মসাৎ করার ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে।

এ ছাড়া কার কত অংশ তা বর্ণনা করার পর উপসংহার হিসাবে আর একটি আয়াত বর্ণিত হয়েছে, যার সারমর্ম মীরাছ সম্পর্কীয় সব কয়টি আয়াতের সাথে সম্পৃক্ত। দুটি আয়াতে কারিমায় মীরাছ বণ্টনের বর্ণনা করে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ইরশাদ করেন-

تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ  وَ مَنْ یُّطِعِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ یُدْخِلْهُ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا  وَ ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ، وَ مَنْ یَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ یَتَعَدَّ حُدُوْدَهٗ یُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِیْهَا وَ لَهٗ عَذَابٌ مُّهِیْنٌ.

এগুলো (মীরাছ সম্পর্কীয় আহকাম ও এতীম সম্পর্কীয় নির্দেশাবলি) আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সীমা। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুগত হবে তাকে এরূপ জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, যার তলদেশে প্র¯্রবণসমূহ প্রবাহিত। অনন্তকাল তারা জান্নাতে বসবাস করবে। (আর) জান্নাতবাসী হওয়াই শ্রেষ্ঠতম সাফল্য। অপর পক্ষে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর অবাধ্য হবে এবং সীমা (আহকাম-নির্দেশাবলি) লংঘন করবে। তাকে প্রজ্বলিত জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সে তথায় চিরকাল অবস্থান করবে। তার (সীমালংঘনকারীর) জন্য অপমানজনক শাস্তি রয়েছে। -সূরা নিসা (৪) : ১৩

মুসলমান সমাজ যদি দোযখের শাস্তির ভয়াবহতা চিন্তা করত, তবে তারা এমন কর্ম করতে পারত না। আল্লাহ তাআলা আমাদের এমন কর্ম থেকে রক্ষা করুন।

। ৫।

এবার আমরা আমাদের পূর্ব আলোচনায় ফিরে আসি। আমাদের বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয় এই যে, মেয়েদের মীরাছ থেকে বঞ্চিত এবং যৌতুকের প্রচলনের মধ্যে  যোগসূত্র রয়েছে। হিন্দু সমাজে মেয়েদের মীরাছ না থাকায় যৌতুক দিতে হয়। বর্তমানকালে অধিকাংশ মুসলমানও কুরআনের বিধান অমান্য করে মেয়েদের মীরাছ দিচ্ছে না বলে মুসলিম সমাজেও যৌতুক প্রথা ঢুকে পড়েছে।

বিয়ের সময় পাত্র মনে করে, ভবিষ্যতে পাত্রী তো তার পৈতৃক সম্পদ বা সম্পত্তির কিছু পাবেই না, সুতরাং এখন যা আদায় করে নেওয়া যায়। সমাজের প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই এই মানসিকতার সৃষ্টি হয়ে গেছে। পাত্রীর পিতাকে বিরাট বরপার্টির আপ্যায়ন খরচে বাধ্য করার পেছনেও এই মানসিকতাই কাজ করে। শহরের ধনী শ্রেণী থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও গরীব শ্রেণী পর্যন্ত এবং গ্রামেও সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে একই কথা একই চিন্তা- কী করে মেয়ের বাপ থেকে কী পরিমাণ আদায় করা যাবে। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায়, পাত্রী কী রকম সেটা বড় কথা নয়, বরং পাওনাটা কী পরিমাণ, তাই বড় ফিকির। বিয়ের ঘটকরাও আজকাল উভয় পক্ষের মাঝে এই দর কষাকষিতে ব্যস্ত ও মত্ত। কেননা, এখানে তাদেরও একটা শেয়ার আছে তো।

মুসলিম সমাজে কুরআন-হাদীসের বিধান অনুসারে মেয়েদের পৈতৃক উত্তরাধিকার প্রদানের নীতি যদি চালু ও প্রতিষ্ঠিত থাকত এবং পাত্র নিশ্চিত হতে পারত যে, তার স্ত্রী ভবিষ্যতে নিজ সম্পত্তির মালিক হয়ে ভোগ-দখল করতে পারবে, তাহলে শ্বশুর বাড়ীর মালামাল লাভের জন্য সে আদাজল খেয়ে লাগত না। সে ক্ষেত্রে যৌতুক শুধু দোষণীয় ও অবৈধই থাকত না, বরং সকলের কাছেই তা ঘৃণিত হত। আসলে মেয়েদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে পাপ সমাজে চালু হয়ে গেছে তা মানুষকে যৌতুকের পাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অতএব উক্ত বঞ্চিতি ও যৌতুকের মধ্যে একরকম যোগসূত্র বিদ্যমান।

। ৬।

মেয়েদের উত্তরাধিকার না দেওয়ার মানসিকতা বিশ্লেষণ করলে আমরা এর পেছনে অনেক কারণ খুঁজে পাই। প্রধান কারণ হচ্ছে, বিয়ের পর মেয়েকে তার বাপ-ভাইয়েরা অন্য বাড়ী অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার চিন্তা করে। সুতরাং তাকে সম্পদ দেওয়ার অর্থই অন্য বংশের মানুষের হাতে সম্পত্তি বের করে দেওয়া। আর এরকম চিন্তার পেছনে একটা হেতু আছে। তা হচ্ছে, মানুষ সাধারণত নিজ বংশের তথা ছেলের ঘরের নাতি-নাতনীদেরই আওলাদ বা সন্তান-সন্ততি মনে করে। আর মেয়ের ঘরের ছেলে-মেয়েদের শুধু আদরের নাতি-নাতনীই মনে করা হয়। আওলাদ জ্ঞান করা হয় না। অথচ আল্লাহ-রাসূলের দৃষ্টিতে আওলাদ বলতে শুধু ছেলের ঘরেরই নয়, বরং মেয়ের গর্ভজাত নাতি-নাতনীও আওলাদ হিসাবে পরিগণিত। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় নাতিদ্বয় হাসান রা. ও হোসাইন রা.-কে নিজের ‘আওলাদ’ বলেছেন। এ বিষয়টি আমি আমার সেরতাজ মুরব্বী ও উস্তাযে মুহাক্কিক শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. থেকে শুনেছি এবং তাঁর অনূদিত বুখারী শরীফের হাদীসের ব্যাখ্যায় দেখেছি।

উল্লেখিত বিষয়টি সম্বন্ধে মানুষ সচেতন ও অবহিত থাকলে মেয়ে ও মেয়ের ঘরের ছেলে-মেয়েদের উত্তরাধিকারী হিসাবে মনে করতে কষ্ট হত না। বড় কথা, মেয়ের পর তার সম্পত্তি কে বা কারা খাবে- এটা তো মেয়ের বংশীয় লোকদের চিন্তার বিষয় নয়। তাদের চিন্তা ও দায়িত্ব হচ্ছে, ভাই ভাইয়ের মধ্যে যেমন, ভাই বোনের মধ্যেও তেমন পৈতৃক সম্পত্তি আল্লাহর বিধান মত ভাগ করে প্রত্যেকের অংশ তার ভোগ-দখলে দিয়ে দেওয়া।

মেয়েদের মীরাছ না দেওয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠার পেছনে আরেকটি বিশেষ কারণ- পিতার কাছে ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তাটা খুবই প্রকট হয়ে থাকে। এই চিন্তার আতিশয্যে তিনি মেয়ের ভবিষ্যতের গোটা হক সম্পর্কে আত্মবিস্মৃত হয়ে যান। তার এই অবস্থা দৃষ্টে ছেলেদের মনেও পরবর্তীতে বোনদের হক বা পাওনা আদায়ের গুরুত্বটা কমে যায়। এমনও  দেখা যায়, পিতা ছেলেদের সুবিধা চিন্তা করে মেয়েদেরকে পৈতৃক অধিকার ছেড়ে দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। পিতার জীবদ্দশায় একে তো মেয়ে মালিকই নয়, দ্বিতীয়ত পিতার এই আবদার বা উৎসাহ। এমতাবস্থায় মেয়ে সংকোচে না নেওয়ার কথাই বলে দেয়। আর ভবিষ্যতে ভাইদের জন্য বোনদের না দেওয়ার পক্ষে এটা দলীল হয়ে দাঁড়ায়।

কোনো কোনো পিতা এমন পথ অবলম্বন করেন, যা তার পরকালীন ধ্বংসের পথ। তার ছেলেদের বা অন্যান্য আত্মীয়ের প্ররোচনায় হোক, অথবা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হোক, তিনি তার কন্যাদের যৎসামান্য দিয়ে বা একেবারে মাহরূম করে ছেলেদের নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। শহরে হলে একমাত্র বাড়িটা ছেলের নামে লিখে দিয়ে কিছু খানি জায়গা মেয়েদের নামে রেখে যান। বাড়ীর মূল্য যদি কোটি টাকা হয়, খালি ও নি¤œ ভূমির দাম সেক্ষেত্রে কয়েক লাখ টাকা হয়। যেখানে শরীয়তে এক ভাইয়ের অংশ দুই বোনের অংশের সমান নির্ধারিত, সেখানে ভাইয়ের অংশ বোনের অংশের দশ-বিশ গুণ হতে দেখা যায়। এ তো না দেওয়ার মতোই। জেনে রাখুন, পরকালে সেই ব্যক্তি বড় হতভাগা হবে, যে অন্যের দুনিয়া লাভবান করার জন্য নিজের আখেরাত ক্ষতিগ্রস্ত করে। অর্থাৎ ছেলের দুনিয়ার স্বার্থে নিজের পরকাল নষ্ট করে। এই ছেলে পরকালের ভয়াবহ অবস্থায় হয়ত আল্লাহ তাআলার দরবারে পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলবে, আমার পিতাই বোনদের ঠকিয়ে আমাকে অনেক বেশি বা সব দিয়ে দিয়েছিলেন।

আল্লাহ তাআলা এহেন ধ্বংসাত্মক পাপ থেকে উম্মতকে রক্ষা করুন- আমীন!

। ৭।

এমন কিছু পিতা অবশ্যই আছেন, যারা মেয়েদের হক বা পাওনা সম্পর্কে সচেতন। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ মেয়েদের জন্য আলাদা সম্পদ (ঘরবাড়ি বা জাগাজমি) করে যাওয়ার পক্ষপাতী। তাদের যুক্তি, ছেলেদের সঙ্গে মেয়েজামাইদের বনিবনা হবে না। বাহ্যত বিষয়টা সংসারবুদ্ধির বটে তবে এতে মূলত ছেলেদের অগ্রগামিতাকেই লালন করা হয়ে থাকে। পরবর্তী ভবিষ্যৎ ফাসাদের প্রতিরোধকল্পে পিতা জীবদ্দশাতে কিছু করে যেতে চাইলে তার ত্যাজ্য সম্পত্তি কীভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বণ্টিত হলে উত্তম হবে, তা তাদেরসহ বসে চিন্তাভাবনা করে সে  মতো তার সমাজ বা আত্মীয়দের বলে অথবা ওসিয়ত করে যেতে পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বণ্টন ব্যবস্থায় যেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো বেইনসাফী বা পক্ষপাতিত্ব না হয়।

সমাজে আরেকটি অবিচারসূলভ ব্যবস্থা অহরহ আমাদের অভিজ্ঞতায় আসে। সেটি এই যে, কারো কারো একাধিক স্ত্রী থাকে। স্বামী তার প্রত্যেক স্ত্রীর নামে কিছু কিছু সম্পত্তি লিখে দেন, কিন্তু সমান হারে নয়। অথবা একজনকে কিছুই না দিয়ে আরেকজনকে দেন। ফলে তার ছেলেমেয়েদের অনেকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়। এর জন্য পিতার ত্রুটিপূর্ণ ও অদূরদর্শী ব্যবস্থাই দায়ী। কোনো কোনো পিতা মৃত্যুশয্যায় স্ত্রী বা ছেলেদের প্ররোচনায় ছেলেদের নামে লিখে না দিলেও স্ত্রীর নামে লিখে দিয়ে যান- এই আশঙ্কায় যে, বিবাহিত মেয়েরা যেন তাড়াতাড়ি তাদের মীরাছ না নিতে পারে।

ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তার আতিশয্যে মেয়ের হক কম দেওয়া বা না দেওয়ার প্রবণতাধারী পিতার স্মরণ রাখা উচিত, আল্লাহ তাআলা সকলের রিযিকের মালিক। তিনি পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন-

وَ مَا مِنْ دَآبَّةٍ فِی الْاَرْضِ اِلَّا عَلَی اللهِ رِزْقُهَا

যমীনে বিচরণকারী যত প্রাণী আছে, সকলের রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর উপর (অর্থাৎ, আল্লাহ অনুগ্রহ করে সকলের রিযিক নিজের দায়িত্বে রেখেছেন)। -সূরা হুদ (১১) : ৬

সে মত আল্লাহ ছেলের ভবিষ্যৎ রুজীর দায়িত্ব পিতার উপর চাপাননি। পিতার জীবদ্দশায় তার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ কামাই করার দায়িত্বই তার উপর ওয়াজিব, এর অতিরিক্ত নয়। আমাদের মুহাক্কিক উস্তায শায়খুল হাদীস রাহ.-এর খেদমতে বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি বলেন, কুরআন-হাদীসের কোথাও দেখা যায় না যে, ছেলের ভবিষ্যৎ রুজীর দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা পিতার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন। বরং রাযযাক হিসাবে আল্লাহ এ দায়িত্ব তাঁর নিজের উপরই রেখেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত থানভী রাহ.-এর দরবারে নবাগত শিক্ষার্থীদের পরিচয়-পত্র হিসাবে একটি ছাপানো ফরম পূরণ করতে হত। সেই ফরমের একটি ঘরে লেখা ছিল-

آپ كے پاس كوئى موروثي زمين تو ہے نہيں

আপনার নিকট (কারো) কোনো ওয়ারিসী সম্পত্তি নেই তো?

অর্থাৎ বোন-ফুফু অথবা অন্য কারো উত্তরাধিকার সম্পত্তি তার দখলে থেকে থাকলে তা পাওনাদারকে পৌঁছিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত হযরত তাকে বায়আত বা শাগরেদ হিসাবে গ্রহণ করা তো দূরের কথা, নিজ দরবারে থাকতেই দিতেন না। কেননা, অপরের হক নষ্ট করে অন্যের সম্পদ না-হকভাবে খেয়ে আল্লাহর পথের পথিক হওয়া যায় না। এই ছিল উল্লেখিত মনীষী মহামান্য আলেমের নীতি ও আদর্শ।

আমাদের যুগশ্রেষ্ঠ ওলীয়ে কামেল হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ. লেখেন, ভাই যদি বোন-ফুফুর কাছে সম্পত্তি না দেওয়ার জন্য মাফ চায় এবং তারা মাফ করে দেয় তবুও মাফ হয় না, কারণ এটা লৌকিকতা মাত্র, অন্তর থেকে মাফ করা নয়।

। ৮।

আমাদের মনে রাখা উচিত, মেয়েরা স্বভাবতই লাজুক ও জন্মগতভাবে দুর্বল হয়ে থাকে। তারা ভাই-বেরাদার ও গোষ্ঠীর লোকদের অসন্তুষ্টির ভয় করে এবং তাদের সম্পর্কচ্ছেদের চিন্তায় দুর্বল হয়ে পড়ে ও অসহায় বোধ করে। মীরাছ নেওয়ার কারণে বাপের বাড়ীর মানুষের নারাযী-অসন্তুষ্টি, এমনকি মেয়ের সাথে এবং তার শ্বশুর বাড়ীর লোকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের তিক্ত অভিজ্ঞতা সমাজে রয়েছে বলে মেয়েরা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি নিতে সংকোচ বোধ করে ও লজ্জিত হয়। এই উত্তরাধিকার না নেওয়া ও না দেওয়ার ব্যাপারটা সমাজে এতই প্রসার লাভ করেছে যে, বর্তমানে আমাদের দেশে বাপের বাড়ীর সম্পত্তি নেওয়াকে আয়েব ও দোষের কাজ মনে করা হয়। তাই বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েদের কাছে মীরাছের কথা উঠলে তারা সহজেই না করে দেয়। আর ভাই যদি মাফ চায় তবে তো কথাই নেই। মাফ করে দেয়। এই মাফ করাকেই হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. লৌকিকতা বলে মাফ হয় না- বলেছেন।

মুহাক্কিক আলেম ও আল্লাহওয়ালাগণ বলেন, মেয়েরা নিতে না চাইলেও তাদের সম্পত্তি ভাইদের সঙ্গেকার এজমালী সম্পত্তি থেকে আলাদা করে বোনদের ভোগ-দখলে দিয়ে দিতে হবে। পৃথকভাবে হাতে পাওয়ার পর যদি বোন তার ভাইকে হাদিয়া বা তোহফাস্বরূপ ফেরত দেয় তবে উলামাদের মতে তখন নিতে দোষ নেই।

। ৯।

হযরত হাকীমুল উম্মত মাওলানা থানভী রাহ.-এর খলীফা বাংলাদেশ ও পাক-ভারত উপমহাদেশের সকল স্তরের মানুষের শ্রদ্ধাভাজন, ওলীয়ে কামেল হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক ছাহেব রাহ.-এর সঙ্গে ব্যক্তিগত পত্রালাপে আমি অধম উল্লেখিত মাসআলাটি জানতে পেরেছি। আমাদের সকলের জন্য নিঃসন্দেহে এ একটি দলীল এবং এ বিষয়ের উপর সর্বশেষ কথা।

আমি তাঁর খেদমতে (এসলাহী পত্রে) লিখেছিলাম, বোনদের ওয়ারেসী সম্পত্তি তাদের আমি দিয়ে দিয়েছি। তবে তারা নিজেদের খুশিতে প্রত্যেকের সামান্য কিছু অংশ আমার জন্য ছেড়ে দিতে চায়, যেহেতু একমাত্র ভাই হিসাবে আমার বাসায় তারা ও তাদের ছেলেমেয়েরা সর্বদা আসা-যাওয়া ও পানাহার করে। এর জওয়াবে তিনি ধমকের সুরে আমাকে জিজ্ঞাস করেন-

دوسرے مہمانوں سے تمہارا كيا معاملہ ہے؟

‘অন্য মেহমানদের সঙ্গে তোমার কী মোয়ামালা?’ (তারাও কি তোমাকে হাদিয়া তোহফা দিয়ে তোমার কাছে পানাহার করে?)

তোমার বোন-ভাগনে-ভাগনীর চেয়ে বড় মেহমান তোমার কাছে আর কে? তাদের শরয়ী হক  (পৈতৃক সম্পত্তি) সম্পূর্ণটা এজমালী সম্পত্তি থেকে বের করে তাদের দিয়ে দাও। তাদের অবশিষ্ট অংশ তারা নিতে না চাইলে তুমি বলে দাও, আমি তা রাখতে অপারগ। তারা তাদের হাতে ও ভোগ-দখলে পাওয়ার পর কেউ যদি তোমাকে হাদিয়া বা তোহফাস্বরূপ ফেরত দেয়, তবে তখন নিতে দোষ নেই।’

আমি এক কিতাবে পড়েছি, মুত্তাকী  ও মুহাক্কিক মনীষীগণ পরামর্শ দিয়ে বলেন, বোন নিতে না চাইলে তাকে তুমি উপহারস্বরূপ শাড়ী, কাপড় ইত্যাদি কিনে দাও। মেয়েরা বাপের বাড়ীর বস্তু-সামগ্রীতে খুব খুশী হয় এবং গৌরব করে অন্যদের দেখায়। মোটকথা, ভাইয়ের দেওয়া জিনিসপত্রে সে আনন্দিত হয়। এভাবে তুমি তাকে মাঝেমধ্যে কিছু দিতে থাক। এতে সে খুশী হতে থাকবে। তারপর সুযোগ বুঝে তাকে বল, বোন! আমি তো তোমার সম্পত্তি থেকেই তোমাকে দিচ্ছি। সুতরাং তোমারটা তোমার হাতেই নিয়ে নাও, আমি কতদিন বাঁচি না বাঁচি আল্লাহ তাআলাই জানেন ইত্যাদি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এভাবে মেয়েদের লৌকিকতা ঘুচিয়ে তাদেরটা তাদের দিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত তারা খুশীই হয় এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

এখন চিন্তা করুন, আল্লাহওয়ালাগণ কী তরীকা অবলম্বন করছেন, আর আমরা কোন্ পথে চলছি। আমরা বোন-ফুফুদের ব্যাপারে গলা উঁচু করে আত্মপ্রসাদ নিয়ে বলে থাকি, ‘বোন-ফুফুর কী মায়া, কত উদারতা; তারা মাফ করে দিয়েছেন!’ আসলে আমরা এমন পথ করে দিই যাতে তারা লৌকিকতার শিকার হয়ে তাদের অধিকার ছেড়ে দেয়, মাফ চাইলে মাফ করে দেয়। দ্বীনদার পরহেযগারগণ মেয়েদেরটা তাদের দিয়ে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেন। আর আমরা না দেওয়ার কূটকৌশল অবলম্বন করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেদায়েত দান করুন এবং আল্লাহওয়ালাদের বাতলিয়ে দেওয়া পথ অবলম্বন করার তাওফীক দান করুন- আমীন!

 

। ১০।

আলোচনা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী করি, কথার পিঠে কথা চলে আসে। শহরের বাসিন্দাদের কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছেন, গ্রামে না হয় ফসলের জমিজমা ও বাড়িঘর ভাগ করে ভাই বোনদের মধ্যে দেওয়া যায়, কিন্তু শহরে যাদের এক বাড়ি, তারা তা কী করে ভাগ করে নেবে? উত্তরে আমি সোজা কথায় বলেছি, দুই-তিন ভাই থাকলে তারা যেমন বাড়ী ভাগ করে নেয়, বোন এক বা একাধিক থাকলে তারাও ভাইয়ের অর্ধেক করে নেবে। আর পিতা তো কেবল বাড়ীই রেখে যায় না, সাথে আয়-রোজগারের ব্যবস্থাও থাকে- কোনো দোকানপাট, কলকারখানা, কোনো মার্কেট, বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি।

মোটকথা, যে কোনো সম্পদ রেখে যায় তাতে কন্যারও অংশ থাকবে। কোনো পিতা চাকুরিজীবী, চাকরি শেষে তিনি পেনশনের টাকা উঠিয়ে মরে গেলে তাতেও কন্যার অংশ থাকবে। অর্থাৎ তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সব কিছুতে ছেলে-মেয়ে উভয়ই যথাহারে অংশ পাবে।

দোকানপাটের অংশ যদি মেয়ে না নেয় তবে হিসাব করে বাড়ীর অংশ থেকে সে বেশি নেবে। তারপর ইচ্ছা করলে সে তার পরিবারসহ বাসায় থাকতেও পারে অথবা তার বাসার অংশ ভাড়াও দিতে পারে। বিষয়টি সহজ করে বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ পেশ করছি :

হযরত শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. অধমের শ্রদ্ধেয় উস্তায ও মান্যবর শ্বশুর ছিলেন। তিনি পাঁচ ছেলে ও আট মেয়ে রেখে যান। তাঁর ওফাতের পর ছেলেরা বোনদের নিয়ে মজলিসে বসে যায়। ভাইয়েরা বোনদের বলল, আমরা যেমন ছেলে হিসাবে আব্বার ওয়ারিস, তোমরাও মেয়ে হিসাবে তাঁর ওয়ারিস। এরপর তারা গাড়ি বাড়ি দোকানপাট সবকিছুর বর্তমান বাজারমূল্য ধরে হিসাব করে। আম্মার দুই আনি ধরে এবং ভাইবোনদের অংশ কুরআনের বিধান মতে সাব্যস্ত করে। তারপর তাদের কে কোন্ তলার কোন্ দিক দিয়ে নেবে তা নির্ধারিত হয়। উল্লেখ্য, তার আগেই সকল ভাড়াটিয়া উঠিয়ে দেওয়া হয়। গাড়ির মূল্য সাব্যস্ত করে তা ছেলেদের মাঝে দিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি সকলের মধ্যে বণ্টিত হওয়ার পর সে মত বাটোয়ারা রেজিষ্ট্রি করে ফেলা হয়। এখন মেয়েদের কেউই সে বাড়ীতে বসবাস না করলেও যার যার অংশ নতুন করে ভাড়া দিয়ে তারা আর্থিক সুবিধা ভোগ করছে। তাদের দ্বিতীয় একটি বাড়ি সুবিধাজনক ছিল না বলে তা বিক্রি করে দিয়ে বোনদের টাকায় একটি প্লট রাখা হয়েছে এবং ভাইদের অংশের টাকা তারা তাদের একটি বাড়ি করায় ব্যয় করেছে।

আলহামদু লিল্লাহ! হযরত শায়খুল হাদীস ছাহেব রাহ.-এর ছেলেরা তাদের বোনদের ওয়ারীস সম্পদ কড়ায়-ক্রান্তিতে হিসাব করে এমন সুন্দরভাবে তাদের হস্তগত করে দিয়েছে যে তা শহরবাসী লোকদের জন্য প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

। ১১।

হযরত শায়খুল হাদীস ছাহেব রাহ.-এর  সঙ্গে অধমের আত্মীয়তা হওয়ার প্রথম দিনে আমি তখনো বোনদের পৈতৃক সম্পদ বণ্টন করে দেইনি। শ্বশুর-আব্বা আমাকে তাগিদ করছিলেন, বোনদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করার জন্য। কিন্তু অধমের মধ্যে শিথিলতা লক্ষ করে একদিন বললেন, যে ভাইবোনদের সম্পত্তি বের করে দেয়নি তার বাড়ীতে আমাদের আকাবির হযরত দাওয়াত খেতেন না। আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম, এ কথা দ্বারা তিনি আমাকে সতর্ক করছেন। আমি তখন থেকেই উঠেপড়ে লেগে গেলাম, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তাদের সম্পত্তি এজমালী সম্পত্তি থেকে আলাদা করে দেওয়ার জন্য। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমি তাঁর সতর্কীকরণের ফলে এ কাজ অনতিবিলম্বে সমাধা করতে পেরেছি। শেষের দিকে আমি তাদের একমাত্র ভাই বলে তারা তাদের প্রত্যেকের দু-তিন আনা করে রেখে দিয়েছেন। পূর্বে আমি উল্লেখ করেছি, আমার শায়েখ হযরত মাওলানা আবরারুল হক ছাহেব রাহ.-এর ধমকে আমি তাদের এটুকুও এজমালী সম্পত্তি থেকে বের করে তাদের হাতে সমর্পণ করেছি। আল্লাহ তাআলা সাক্ষী, হযরতে উস্তায ও হযরতে শায়েখের ওসীলায় আমি এ ফরজ কাজ সম্পন্ন করতে পারায় কী যে শান্তি, বরং প্রশান্তি অন্তরে অনুভব করছি তা বলে শেষ করতে পারব না। আল্লাহ তাআলা তাঁদের উভয়কে জান্নাতুল ফিরদাউসে উঁচু মাকাম দান করুন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমি আমার কিশোর বয়সে আমার গ্রাম থেকে অদূরে বিখ্যাত তললী ইসলামিয়া মাদরাসায় পড়তাম। মাদরাসার উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মরহুম আব্বাজানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং তিনি মাদরাসার সদস্য ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, পবিত্র রমযান মাসে মাদরাসার সকল ছাত্র-শিক্ষককে আব্বা দাওয়াত করে আমাদের বাড়ী আনতেন এবং সমারোহ করে তাঁদের ইফতার ও রাতের খাবার খাওয়াতেন। বাপজানের ইন্তেকালের পর বাড়ীর মুরব্বী আমার চাচাত ভাই ও আমি মিলিত হয়ে উলামায়ে কেরামকে দাওয়াতের পূর্ণ নেজামটি ধরে রাখার জন্য মাদরাসায় গিয়ে হুযুরদের খেদমতে ছাত্রদেরসহ দাওয়াতের দরখাস্ত পেশ করলাম। কিন্তু এবার তাঁরা আমাদের দাওয়াত রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানালেন। আসাতেযায়ে কেরামের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত আলেম হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহ.-এর শাগরেদ প্রখ্যাত আলেম মাওলানা শামসুদ্দীন ছাহেব রাহ.২ বললেন,

তোমার পিতার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এখনো তোমার নাবালেগ বোনদের জমি তোমার জমির সাথে রয়েছে, তোমরা একান্নভুক্ত আছ। সুতরাং নাবালেগদের অংশ থেকে আমাদের দাওয়াত খাওয়া জায়েয হবে না। এই বলে তিনি আমাদের বিদায় করলেন।

পিতার মৃত্যুর পর নাবালেগ এতিম ভাইবোনদের নিয়ে কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে, এ প্রশ্ন আমাদের সমাজের কতজনের মনে আসে? কিন্তু সাহাবীগণ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুম রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে জওয়াব এসেছে-

وَ یَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْیَتٰمٰی  قُلْ اِصْلَاحٌ لَّهُمْ خَیْرٌ وَ اِنْ تُخَالِطُوْهُمْ فَاِخْوَانُكُمْ وَ اللهُ یَعْلَمُ الْمُفْسِدَ مِنَ الْمُصْلِحِ  وَ لَوْ شَآءَ اللهُ لَاَعْنَتَكُمْ   اِنَّ اللهَ عَزِیْزٌ حَكِیْمٌ

তারা আপনাকে এতীমদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন, তাদের (বিষয়গুলোর) সুব্যবস্থা করা (তাদের ব্যয় সম্পূর্ণ আলাদা করার চেয়ে) উত্তম। আর যদি তোমরা তাদের সাথে মিলেমিশে থাক (অর্থাৎ তাদের ব্যয়ভার একত্র করে নাও) তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই। আর আল্লাহ জানেন অনিষ্টকারী ও সংশোধনকারীকে। -সূরা বাকারা (২) : ২২০

অর্থাৎ আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এতীমদের মালের সংরক্ষণ ও সুব্যবস্থা। সুতরাং যেক্ষেত্রে পৃথক রাখলে এতীমদের লাভ হয়, সেক্ষেত্রে পৃথক রাখা। আর যেখানে একত্র থাকা কল্যাণকর, সেক্ষেত্রে তাদের খরচ একত্র করে নিলে কোনো ক্ষতি নেই; এক সময় তাদের জিনিস খাওয়া হলে আরেক সময় নিজের জিনিস তাদের খাইয়ে দেবে। আল্লাহ বেশ জানেন, এই একান্নবর্তিতার দ্বারা কার উদ্দেশ্য এতীমদের মালের খেয়ানত ও তা নষ্ট করা আর কার উদ্দেশ্য তাদের মঙ্গল ও উপকার করা। (তাফসীরে উসমানীর অনুসরণে)

এ তো হল এতীম ভাইবোনদের সঙ্গে দৈনন্দিন পারিবারিক ব্যবস্থার কথা। কিন্তু ভাইয়েরা দাওয়াতী মেহমান খাওয়াতে চাইলে, তা সম্পূর্ণ বয়স্কদের মাল থেকে খাওয়াতে হবে। নাবালেগ ভাইবোনদের সম্পদে হাত দেওয়া যাবে না।

। ১২।

মেয়েদের মীরাছ বা উত্তরাধিকার না দেওয়ার প্রবণতা ও মানসিকতা দুনিয়াদার মহলে তো কথাই নেই, দ্বীনদার মহলেরও কারো কারো মধ্যে উক্ত বিষয়ে শিথিলতা দেখা যায়। দ্বীনী ভাবধারার অধিকারী, ব্যক্তিগত জীবনে আমলী, এমন কি দ্বীনী খেদমতে নিবেদিত হয়েও তাঁরা বোন-ফুফুদের হক তথা হুকুকুল ইবাদ সম্বন্ধে গাফেল রয়েছেন। দুঃখ ও লজ্জার বিষয়, তাঁদের এই গাফলতি ও শিথিলতা সাধারণ ও দুনিয়াদার মানুষের জন্য বোন-ফুফুদের মীরাছ না দেওয়ার পক্ষে মদদ হিসাবে কাজ করে। অতএব তাঁদের দুই দিকের গুনাহের বোঝা বইতে হবে-

এক. নিজেদের হুকুকুল ইবাদ নষ্ট করার গোনাহ, দুই. তাঁদের দেখে সাধারণ মানুষের হুকুকুল ইবাদ নষ্ট করার গোনাহ। আল্লাহই ভালো জানেন।

। ১৩।

এবার প্রবন্ধের উপসংহারের দিকে চলে আসি। দেশের উলামায়ে কেরাম ও চিন্তাশীল শ্রেণী এবং সমাজকর্মীদের নিকট অনুরোধ এই যে, আমরা সকলে মিলে কী কর্মপন্থা অবলম্বন করলে আমাদের নারীদের বঞ্চনা ও গঞ্জনার কবল থেকে রক্ষা করা যাবে- সে সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করি এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনার ফলাফল দেশবাসীর সামনে তুলে ধরি। যাতে সমাজের সকলে অবগত হয়ে সামাজিক এই অবক্ষয় থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি এবং শরীয়তের মৃতপ্রায় একটি অকাট্য ফরয বিধানকে জীবিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।

আমি (অধম) মনে করি, পিতা নিজেই এই ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমরা প্রায় সকলেই ছেলেমেয়েদের পিতা। আমাদের দায়িত্ব এই যে, মুসলমান হিসাবে আমরা পবিত্র কুরআনে বিঘোষিত আল্লাহপ্রাপ্ত উত্তরাধিকার আইন ও বিধানের কথা ঘরে, পরিবারে ও সমাজে সকলের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকা এবং শরীয়তের এই ফরয বিধানের বিষয় ভুলে গিয়ে আমরা যে আমাদের মা-বোনদের জন্মগত অধিকার থেকে মাহরূম করে তথা হুকুকুল ইবাদ বিনষ্ট করে আল্লাহর গযবের পাত্র হচ্ছি এবং পরকালের কঠোর শাস্তির পথে অগ্রসর  হচ্ছি- এদিকে পরস্পরের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হওয়া।

পিতা হিসাবে আমরা আমাদের জীবদ্দশায় ঘরের পরিবার পরিজন বিশেষত ছেলেদেরকে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের কথা স্মরণ করিয়ে তাদের বোনদের হক সম্পর্কে বুঝাতে পারি এবং আমাদের মৃত্যুর পর তা যথাযথভাবে আদায় করে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে যেতে পারি। উল্লেখ্য যে, আমার এক বন্ধু আজিমপুর এরিয়ায় বিশাল বাড়ী নির্মাণ করেছেন। তাঁর এক ছেলে দুই মেয়ে। তিনি পূর্বের বাড়ী থেকে এ বাড়ীতে সপরিবারে ওঠার শুরু লগ্নেই দুই মেয়েকে মালিক বানিয়ে স্বামী ও বাচ্চাসহ পৃথক দুইটি তলায় উঠিয়েছেন। তিনি নিজে স্ত্রী ও ছেলেসহ পরে নিজের তলায় উঠেছেন। মেয়েদের প্রতি তাঁর এই উদারতা দেখে সমাজের সকলেই তাঁর প্রশংসা করেছেন।

আমাদের ত্যাজ্য সম্পত্তির সব কিছুর মধ্যেই ছেলেদের মতো মেয়েরাও যে অংশীদার এবং ছেলেদের পরস্পরের মধ্যে তা যেরূপ বণ্টিত হবে, ঠিক তদ্রƒপ মেয়েদের মধ্যেও যথাহারে বণ্টনযোগ্য। এই সত্য আমাদের ছেলেরা যেন উত্তমরূপে উপলব্ধি করতে পারে এবং ভবিষ্যতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বোনদেরকে তাদের অংশ দিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়। এরূপ মানসিকতা গড়ে তুলতে আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তদুপরি আমরা লিখিত ওসিয়ত রেখে যেতে পারি এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী সকলকে আমাদের ওসিয়ত সম্পর্কে অবগত করে পরবর্তীতে এ কাজে কার্যকরি সহযোগীতা করার জন্য তাদের অনুরোধ করে যেতে পারি। সম্ভাব্য সব দায়িত্ব পালন করার পরও যদি খোদা না করুন, আমাদের ছেলেরা বোনদের বঞ্চিত করে, তবে তারা নিজেরা হুকুকুল ইবাদ নষ্ট করার গোনাহতে পতিত হবে ও শাস্তিযোগ্য হবে। আল্লাহ তাআলার আদালতে আমরা পিতারা দায়মুক্ত থাকব।

হযরাতে উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনী এলম সম্পর্কে সচেতন মানুষের দায়িত্ব সম্বন্ধে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। নবীগণ আলাইহিমুস সালাম-এর ওয়ারিছ ও উত্তরসূরী হিসেবে সমাজে ধর্মীয় বিপ্লব আনয়নে যুগে যুগে তাঁদের ভূমিকাই সর্বাধিক শক্তিশালী ও কার্যকর প্রমাণিত হয়ে আসছে। আজও মৃতপ্রায় খোদায়ী বিধান ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত সুন্নতকে জীবিতকরণে আলেম সমাজের নেতৃত্বই দিগভ্রান্ত জনসাধারণকে পথের দিশা দেবে। তাঁদের পবিত্র যবান ও কলম, তাঁদের তকরীর ও তাবলীগ মুসলিম সমাজকে তার হারিয়ে ফেলা এই খোদায়ী বিধান ও জাতীয় ঐতিহ্যকে আবার আঁকড়ে ধরায় অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করবে। তাঁদের ছাত্রদেরকে পবিত্র কুরআনের সূরা নিসায় উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াত এবং ইসলামী ফারায়েয তথা উত্তরাধিকার আইনের প্রন্থটি পড়ানোর সময় তাদের এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে কার্যকর পন্থা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে, যাতে ছাত্ররা তাদের অবকাশ সময়ে নিজেদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী তথা গোটা সমাজকে এই বিধানটি সম্বন্ধে  সচেতন করতে পারেন। আসাতেযায়ে কেরাম নিজেদের খেদমতের পাশাপাশি তাঁদের ছাত্রদের দিয়ে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দিতে পারেন।

দেশের মসজিদগুলোর সম্মানিত ইমামগণও উল্লেখিত বিষয়ে বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিতে পারেন। তাঁরা মুসল্লীদের সামনে আলাপ-আলোচনায় বিশেষত জুমার দিনে খুতবাদানের আগে প্রদত্ত আলোচনায় কুরআন-হাদীসের আলোকে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে তাদের অবগত ও সচেতন করতে পারেন এতেও নিঃসন্দেহে বিরাট সুফল ফলবে ইনশাআল্লাহ।

দেশের ওয়ায়েজীন ও মুবাল্লেগীন যদি এ বিষয়টির প্রতি সুদৃষ্টি দান করেন, তবে তাঁদের ওসীলায় সমধিক খেদমত হতে পারে। তাঁরা নিজেদের ওয়াজ ও বক্তৃতার মাধ্যমে ইসলামের এই বিধান সম্পর্কে আল্লাহর বাণী ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিতে পারেন। খোদায়ী বিধানের কথা ¯্রােতাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়াই তো তাঁদের আসল কাজ। পালন করা না করা তাদের বিষয়।

আরো আছে সমাজসেবী ও চিন্তাশীল লোকদের দায়িত্ব। সমাজহিতৈষীগণ সমাজের লোকদের মধ্যে উল্লেখিত বিধান সম্বন্ধে জোরদার আলোচনা করে তার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন।

যারা ইসলামপ্রিয় লেখক ও সাহিত্যিক, তাঁরা তাঁদের লেখার মাধ্যমে এর অনুকূলে জনমত সৃষ্টি করতে পারেন এবং আল্লাহ তাআলার কাছে অশেষ ছওয়াবের অধিকারী হতে পারেন। সত্য বলতে গেলে, এ বিষয়ে লেখা ও ওয়াজ করা একরকম হয়ই না। পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যম এ বিষয় থেকে একরকম শূন্য বলা যায়।

এমতাবস্থায় আমরা যদি সকলে মিলে ইলমী ও আমলী সর্বাত্মক চেষ্টা নিই, তবে ইনশাআল্লাহু তাআলা মুসলিম জাতির মেয়েদের মীরাছ বা উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সেইসাথে যৌতুক প্রথার অবসান ঘটবে। ফলে আমাদের মা-বোনেরা যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের সঠিক মর্যাদায় সমাসীন হতে পারবেন।

। ১৪।

প্রবন্ধের উপসংহারও অনেক লম্বা হয়ে গেল। এখন উপসংহারের উপসংহার সেই আয়াত দিয়ে শেষ করছি, যে আয়াতের উল্লেখ প্রবন্ধের ভূমিকায় রয়েছে এবং  যে আয়াতে নারীদের উত্তরাধিকার আইন বিনষ্টকারী লোকদের পরকালীন দোযখের ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আয়াতটি এই-

تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ...وَ مَنْ یَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ یَتَعَدَّ حُدُوْدَهٗ یُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِیْهَا ۪ وَ لَهٗ عَذَابٌ مُّهِیْنٌ.

এগুলো (মীরাছ সম্পর্কীয় আহকাম) আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সীমা। ...যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে এবং (আল্লাহর বিধানের) সীমা লঙ্ঘন করবে, তাকে প্রজ্বলিত জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সে তথায় অনন্তকাল অবস্থান করবে। তার (সীমালঙ্ঘনকারীর) জন্য অপমানজনক শাস্তি রয়েছে। -সূরা নিসা (৪) : ১৩-১৪

যে বিধানের (তথা মীরাছ সম্পর্কীয় আহকামের) লঙ্ঘনকারী জাহান্নামে অনন্তকালীন শাস্তির যোগ্য হবে, সেই বিধান লঙ্ঘন এবং তার ভয়াবহ শাস্তি থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন- আমীন।

 

 

 

advertisement