সুস্থতার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তবে তা স্বাস্থরক্ষার মূল উপায় নয়। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার, পরিমিত বিশ্রাম এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন। ঔষধ ও চিকিৎসারও প্রয়োজন আছে, তবে তা রোগ-ব্যধির নিরাময়ের জন্য। অতএব তা ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজন। শুধু ঔষধ সেবন করে স্বাস্থ্য রক্ষার প্রচেষ্টা হাস্যকর। এই মুলনীতি শুধু শারীরিক সুস্থতার ক্ষেত্রে নয়, নৈতিক ও চারিত্রিক সুস্থতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই শিশুর জীবন ও চরিত্র গঠনের জন্য প্রথম প্রয়োজন সুশিক্ষা। এটি তার ভালো গুণগুলিকে বিকশিত করবে এবং স্বভাবের মন্দ প্রবণতাগুলিকে দমন করবে। তাই চিন্তা ও হৃদয় এবং রুচি ও কর্মকে পরিশুদ্ধ করে একজন প্রকৃত মানুষরূপে তাকে গড়ে তুলবে। এজন্য শিশু-কিশোরের জীবন গঠনে সুশিক্ষা ও সঠিক তরবিয়তের প্রতি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত।
শিশুরা পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শেখে, তাই তার চারপাশের পরিবেশে সুশিক্ষার উপাদান থাকা অপরিহার্য। পিতা-মাতা ও ভাই-বোনের আচরণ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা ও আত্মীয়-স্বজনের ব্যবহার শিশুর চরিত্র গঠনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এরপরও শিশুকে হাতে ধরে ধরে অনেক কিছু শেখাতে হয়। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি নিয়মকানুন, যেমন মিসওয়াক করা, পবিত্রতা রক্ষা করা, বাইতুল খালা থেকে বের হওয়ার আগে তা ভালোভাবে পরিষ্কার করা, হাত-পায়ের নখ কাটা, খাবার আগে ও পরে ভালোভাবে হাত ধোয়া, পরিপাটিভাবে খাবার গ্রহণ করা, বইপত্র ও কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রাখা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, মেহমানের সমাদর করা, ছোটখাটো কাজে পিতামাতার সহযোগিতা করা, কাজের ছেলে-মেয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, সহপাঠী ও প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয়গুলো শিশুকে হাতে ধরে শেখাতে হয়। সবকিছু সে নিজে নিজে শিখবে, এমন মনে করা ঠিক নয়। সবাই সব কিছু নিজে নিজে শেখে না। আমরা বড়রাও কি সব কিছু নিজে নিজে শিখি!? এজন্য শেখানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে শেখানোর পদ্ধতি কী হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে।
শিক্ষাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি শিরোনামে বলা হয়েছে। শিশু কোনো অসমীচীন আচরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে শাসনের দণ্ড হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়।
এই নীতি অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ধৈর্য্যসাপেক্ষ। কারণ এমন বিষয় মোটেই কম নয় যেখানে বড়দের মনে হতে পারে যে, এই সামান্য বিষয়টাও কি বলে দিতে হয়? প্রতিদিন ভোরে মিসওয়াক করবে-এটা ক’বার বলা যায়? এ তো সাধারণ রুচির বিষয়? সব ঠিক, কিন্তু আগে তো তার মধ্যে রুচিটা তৈরি করতে হবে।
এজন্য এই ছোট ছোট বিষয়গুলোও বার বার শেখানোর প্রয়োজন পড়ে। প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ আদব-কায়েদায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা পর্যন্ত পিতামাতাকে ধৈর্য্যের সঙ্গে শেখাতে হবে। এরপর শুধু পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট হবে। বাচ্চাকে প্রথমে শান্তভাবে বোঝাতে হবে, তার মধ্যে গুরুত্বের অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে। অন্যথায় বিরক্তি বা শাসন উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। কারণ যার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করা হচ্ছে তার মধ্যে যদি বিরক্তির হেতু বোঝার-যোগ্যতাই না থাকে তাহলে সে একে অযৌক্তিক বিরক্তি বলে ধরে নেবে। সে ভাববে যে, আমার সঙ্গে শুধু খারাপ ব্যবহার করা হয়, আমাকে আসলে দেখতে পারে না। শুধু শিশু-কিশোরদের বেলায় নয়, সকল অধীনস-দের বেলায় এটা সত্য। স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি শুধু বিরক্তই হন, কিন্তু তার বিরক্তির কারণ খুলে না বলেন কিংবা বিরক্তির যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে না পারেন তাহলে স্বাভাবিকভাবে স্ত্রী ভাবতে পারে যে, সে আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। একই ভাবে স্ত্রী যদি তার বিরক্তির কারণ স্বামীকে বোঝাতে না পারেন তাহলেও স্বামীর মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে।
অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে, একটি বিষয় আপনার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আপনার অধীনস্তদের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয় তখন প্রথম কাজ হবে তাকে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানো। আর তা একদিনে, এক বার বলার দ্বারা নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধারণের বিকল্প নেই। এই ক্ষেত্রগুলো আসলে আল্লাহর পক্ষ হতে পরীক্ষার ক্ষেত্র এবং আখিরাতের পুঁজি সঞ্চয়ের ক্ষেত্র।
মূলকথায় ফিরে যাই। শিশুর তা’লীম ও তরবিয়তের বিষয়ে দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে, প্রাত্যহিক জীবনের আচরণগত বিষয় ছাড়াও শিক্ষার আরো অনেক বিষয় রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শিশুর হৃদয়বৃত্তিকে জাগ্রত করা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে, বর্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থায় এই বিষয়টি চরমভাবে অবহেলিত। কিছু ‘এটিকেট’ বা আচরণগত ভদ্রতা শিক্ষা দেওয়াকেই যথেষ্ট মনে করা হয়। অথচ অন্তরের পরিশুদ্ধি হচ্ছে আচরণের বিশুদ্ধতার নিয়ামক শক্তি।
এটা ঠিক যে, মানুষ মাত্রেরই হৃদয় আছে, অতএব হৃদয়-বৃত্তিও আছে, কিন্তু হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রথমত সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এজন্য পরিচর্যা না হলে তা বিকশিত হয় না। আর শৈশবেই যদি তা বিকশিত না হয় তাহলে বয়োপ্রাপ্ত হওয়ার পর তা বিকশিত করা কঠিন। এজন্য শিশুর সঙ্গে সাহাবা-তাবেয়ীন ও সালাফে সালেহীনের হৃদয়বৃত্তির বিভিন্ন ঘটনা আলোচনা করে তাদেরকে দয়া-মায়া, সহানুভূতি ও সহনশীলতা ইত্যাদি গুণের সঙ্গে পরিচিত করে তুলতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল, শিশুর সঙ্গে সহৃদয় আচরণ করে সহৃদয়তার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। মুখের কথার চেয়ে বাস্তব আচরণের প্রভাব অনেক বেশি হয়ে থাকে। তবে আলোচনার প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না, বিশেষত শিশুরা তাদের গুরুজনের কথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করে। গুরুজন যদি অবিশ্বাস করতে না শেখায় তাহলে শিশুরা গুরুজনের কথায় অবিশ্বাস করে না। শিশুদের বিশ্বাস রক্ষা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।
শিক্ষার পাশাপাশি শিশুর আচরণগুলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করাও পিতামাতা ও মুরব্বীর কর্তব্য।
শিশুর যে আচরণ থেকে মমতা ও সহানুভূতি প্রকাশ পায় তা উৎসাহিত করা এবং যে আচরণে হিংস্রতা ও নির্দয়তা প্রকাশ পায় তা ধীরে ধীরে সংশোধন করা উচিত। এ বিষয়ে অবহেলা করা চরম ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে। কোনো শিশুকে যদি দেখা যায় যে, অসহায় মানুষ দেখলে তার কষ্ট হয় তাহলে তার এই মানসিকতার মূল্যায়ণ করা উচিত এবং তার শিশু-হৃদয়ে সহানুভূতির যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে তা পরিচর্যার মাধ্যমে বিকশিত করা উচিত। এ প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের পূর্বসূরীদের জীবনী আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে। পক্ষান্তরে কোনো শিশুকে যদি দেখা যায়, পশু-পাখীকে কষ্ট দিয়ে বা কাজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করে আনন্দ পাচ্ছে তাহলে তখন থেকেই তার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। জুলুম-অত্যাচার যে অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং জালিম ও অত্যাচারীকে যে আল্লাহ তাআলা তাআলা ঘৃণা করেন-এই বোধ তার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা থেকে জালিমের পরিণতি আলোচনা করে তার কোমল মনে জুলুমের প্রতি ঘৃণা ও ভয় জাগিয়ে তুলতে হবে।
বলাবাহুল্য যে, তা একদিনেই হয়ে যাবে না, ধীরে ধীরে বার বার বোঝানো হলে তার কোমল মন বিষয়গুলিকে গ্রহণ করবে এবং তার আচরণে পরিবর্তন আসবে। শাসনের আগে এই কর্তব্যটুকু পালন করা মুরব্বী ও পিতামাতার কর্তব্য। এ বিষয়ে উদাসীন হওয়ার সুযোগ আমাদের নেই।