সংস্কৃতি : উৎসব
যথারীতি নানা রকমের হৈ-হট্টগোলের ভেতর দিয়েই কাটল ১৪২৪ বাংলা সনের প্রথম দিনটি। একইসাথে ঘটল অপ্রীতিকর নান ঘটনা। তবুও এই ধারা অব্যাহত রাখতেই হবে! একেই বোধহয় হুজুগ বলে। যাই হোক, দিনটি যেহেতু পার হয়েছে এবং চারপাশের হট্টগোলও স্তিমিত হয়েছে তাই এখন শান্তভাবে কিছু চিন্তা-ভাবনা করা যাক।
নির্জনে শান্ত হয়ে বসলেই হৃদয়ের গহীনতম প্রদেশ থেকে যে কথাগুলো ভেসে আসে তা হচ্ছে, তুমি একজন মুসলিম। তোমাকে ফিরে যেতে হবে তোমার রবের কাছে। পৃথিবীতে তোমার জন্য বরাদ্দ সময়টুকু খুব বেশি নয়। প্রতি মুহূর্তে তা ক্ষয় হচ্ছে আর শেষ মুহূর্তটি এগিয়ে আসছে। কাজেই সময়-সম্পদের সঠিক ব্যবহার কর। হৈ-হট্টগোলে সময়-ব্যয়ের অবকাশ কোথায়?
পয়লা বৈশাখ উদযাপনের বিষয়টা আসলে কী? আমার আদর্শের সাথে এটা কতদূর সঙ্গতিপূর্ণ? মুসলিম-সমাজের আলো-বাতাসে লালিত-পালিত হওয়ার সুবাদে আমার যে সামান্য ধর্ম-জ্ঞান, ন্যায়-অন্যায় বোধ তার বিচারেই এটা কেমন?
এটা একটা উৎসব। কিন্তু উৎসব হলেই কি তা বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যায়? উৎসব সাধারণত দুই প্রকারের : ধর্মীয় উৎসব ও সাধারণ উৎসব। আমাদের ধর্মীয় উৎসব জুমা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, ইত্যাদি। আর সাধারণ উৎসবের মধ্যে আছে, বিয়ে-শাদী, ওলীমা-আকীকা ইত্যাদি।
ধর্মীয় উৎসব সুনির্দিষ্ট নিয়মে নির্ধারিত কর্ম-সম্পাদনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যেমন জুমায় খুতবা শুনি, দুই রাকাত নামায জামাতের সাথে আদায় করি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতেও আছে সালাত ও খুতবা। ঈদুল ফিতরে আছে সদাকাতুল ফিতর আর ঈদুল আযহায় কুরবানী। এই যে আমাদের ধর্মীয় উৎসব-এর সকল কাজকর্মে আমাদের ধর্মাদর্শই প্রতিফলিত। এককথায় বললে, তাওহীদ ও সুন্নাহ। তাওহীদ মানে এক আল্লাহর উপাসনা আর সুন্নাহ মানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ।
সালাত, খুতবা, সদকা, কুরবানী সবগুলো কাজেই তাওহীদ ও সুন্নাহ প্রতিফলিত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর ইবাদত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত পদ্ধতিতে ইবাদত।
অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় উৎসবগুলোতেও ঐসব ধর্মের মৌলিক বিষয়াদিই প্রতিফলিত। আর একারণে পৌত্তলিক জাতি ও সম্প্রদায়ের উৎসবের মূল কথাই হচ্ছে ‘শিরক’ ও ‘বিদআ’। আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যের উপাসনা আর মানব রচিত নিয়ম-নীতির অনুসরণ।
নীতি ও আদর্শের এই পরিষ্কার বৈপরীত্যের কারণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় উৎসবে কোনো মুসলিমের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। তবে হাঁ, দুই বা ততোধিক সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হতে পারে। কিন্তু সেটা তো ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেটা আদর্শের ব্যাপার নয়, সহাবস্থানের ব্যাপার। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অর্থ আদর্শ বিসর্জন দেওয়া নয়। অন্যরা তা দেয়ও না, ওদেরকে কেউ তা দিতেও বলে না। মুসলিমকেও তা দিতে বলা উচিত নয়, দেয়াও বৈধ নয়। আর সে কারণেই শুধু উৎসবের নামে ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কোনোভাবেই সমীচীন নয়। এ থেকে বোঝা যায় ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ কথাটা কী ভয়াবহ রকমের স্ববিরোধী। ধর্ম যদি ‘যার যার’ হয় তাহলে উৎসবও ‘সবার’ হতে পারে না। কারণ উৎসবটা ধর্মহীন হয় না। প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবে ধর্মাদর্শ খুব গভীরভাবে কার্যকর থাকে।
উৎসবের দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ সাধারণ উৎসবও কি ধর্মের প্রভাবমুক্ত হয় বা হতে পারে? আসলে হয় না, হতেও পারে না। একটু নির্মোহভাবে চিন্তা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। জীবন-যাপনের নানা অনুষঙ্গ যেমন, বিয়ে শাদী, জন্ম-মৃত্যু, আয়-উপার্জন, আতিথেয়তা ইত্যাদিকে উপলক্ষ করে যেসব পর্ব-উৎসব তাতে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের আছে আলাদা নিয়ম-নীতি, যা সাধারণত নিষ্ঠার সাথে পালিত হয়। আমাদের বিয়ে-শাদী, ওলীমা-আকীকা, কাফন-দাফন ইত্যাদি আমাদের ধর্মীয় নিয়ম অনুসারেই হয়ে থাকে। হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানেরা তা পালন করে তাদের নিজস্ব নিয়মে। কাজেই সাধারণ পর্ব-উৎসবকেও ধর্মের প্রভাবহীন মনে করার সুযোগ নেই।
এ হচ্ছে বাস্তবতার বৃত্তান্ত। আর ইসলামী বিধানের দিক থেকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বলতে হবে, জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গের মতো পর্ব-উৎসবের ক্ষেত্রেও রয়েছে হালাল-হারাম ও জায়েয-নাজায়েযের বিধান। উৎসব হলেই তা জায়েয-নাজায়েয বিবেচনার বাইরে চলে যায় এমন নয়।
পয়লা বৈশাখ উদযাপনের নামে উৎসবের যে নিয়ম ও ধারা প্রচলিত হয়েছে তা কি ইসলামী শিক্ষা ও বিধান পরিপন্থী বিষয়াদি থেকে মুক্ত? না, মুক্ত নয়।
প্রথমত, কোনো ক্যালেন্ডার অনুসারে বর্ষ-শুরুর দিবসটি উদযাপনের যে রীতি আজকাল দাঁড়িয়ে গেছে, সব কাজ ছেড়ে উদযাপনে লিপ্ত হয়ে পড়া, এটিই ইসলামী শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সময়ের মূল্য ও মর্যাদার কথা যদি বলি তাহলে তো সময়ের প্রতিটি অংশই মূল্যবান। প্রতিটি সকাল, প্রতিটি সন্ধ্যা, প্রতিটি দিবস মূল্যবান। আর তা মূল্যবান এই জন্য যে, যথার্থ কর্মে ব্যবহার করে এর দ্বারা সুফল ও কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব। তা মূল্যবান এই জন্য যে, এটি আল্লাহ তাআলার নিআমত। বান্দাকে দেয়া আল্লাহর অবকাশ। আর এ কারণে একজন মুমিনের জন্য প্রতিটি দিবস ‘নওরোয’। নতুন দিন। আনন্দের দিন।
এটি ফুরিয়ে যাওয়া তো উৎসবের ব্যাপার নয়। সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়া কি উৎসবের ব্যাপার? উৎসবের ব্যাপার নয়; এটি বরং হিসাব-নিকাশের ব্যাপার? জীবন থেকে একটি বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার অর্থ জীবনের অনেক বড় একটি অংশ ফুরিয়ে যাওয়া? আখেরাতে বিশ্বাসী কোনো বান্দা এই জীবন ফুরিয়ে যাওয়াকে উৎসবের ব্যাপার হিসেবে নিতে পারে না। তিনি এটিকে মুহাসাবা বা আত্মজিজ্ঞাসার ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করেন।
জীবনের যে অংশটি কেটে গেল তা কোন্ কাজে কাটল? ভালো কাজে কাটলে আলহামদু লিল্লাহ, এটা ফেরৎ আসবে। আর মন্দ কাজে কাটলে সংশোধন ও প্রত্যাবর্তন আশুপ্রয়োজন। কারণ, সময় থাকতে শুধরে নেয়াই শুভবুদ্ধির পরিচয়।
দ্বিতীয়ত, পয়লা বৈশাখের প্রচলিত উৎসবে গুনাহ ও পাপাচারের অনেক কিছু রয়েছে। পর্দাহীনতা, অশ্লীলতা, নাচ-গান ইত্যাদির কথা তো বলাই বাহুল্য। এগুলো যে গুনাহ তা কার না জানা আছে?
তৃতীয়ত, এতে আছে পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের সাথে নানা সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য, যা ইসলামী শিক্ষায় বর্জনীয়। এই সাধারণ বিষয়গুলো ছাড়াও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে বিশ্বাসগত, উচ্চারণগত এবং আচরণগত এমন সব ভয়াবহ বিষয়ও দেখা যায়, যা সরাসরি ঈমান বিধ্বংসী।
এই অবস্থায় একজন নিষ্ঠাবান মুসলিমের জন্য এতে অংশগ্রহণ বা সমর্থন কীভাবে অনুমোদিত হতে পারে?
এবারের পয়লা বৈশাখে ঢাবির চারুকলার কেন্টিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিকে একটি উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। কেন্টিনে ঐ দিন অন্যান্য খাবারের সাথে গরুর গোশতের তেহারি সরবরাহ করা হয়েছিল। এ নিয়ে ভাঙচুর, তুলকালামসহ নানা কিছু ঘটে গেছে। কে না জানে গরু হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এক সম্মানিত সত্তা তাই তাদের ধর্মীয় বিধানের রেয়াত করে পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠানকে ‘সর্বজনীন’ করার স্বার্থে গরুর গোশত যদি বাদ দিতেই হয় দিন, কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সেই সাথে এই প্রশ্নেরও জবাব দিন যে, মুসলমানের ধর্মেও তো নাচগান পর্দাহীনতা নিষেধ। তো এই সকল নিষিদ্ধ কর্মকা- থাকা অবস্থায় মুসলমানেরা এতে অংশগ্রহণ করবে কীভাবে? আর এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ নেই কেন? গরুর গোশত খেলে সমাজের যে ক্ষতি হয় পর্দাহীনতা ও অশ্লীলতার ক্ষতি কি তার চেয়ে অনেক কম? যাই হোক, ভাংচুর, তুলকালামের পক্ষে আমরা কখনো ছিলাম না, এখনো নই, কিন্তু এটুকু তো স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি যে, যে কারণে গরুর গোশতের তেহারি সরবরাহ হিন্দু বাঙালীদের কাছে আপত্তিকর হয়েছে ঐ একই কারণে এই উৎসবের নাচ, গান, পর্দাহীনতা মুসলিম বাঙালীর কাছেও আপত্তিকর।
এখানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নাজায়েয কর্মকা- সম্বলিত আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে উৎসবের রূপ দেয়া খুবই ভয়াবহ। উৎসবের কারণে ঐ সকল নাজায়েয কাজ সাধারণ্যে বিস্তার লাভ করে এবং নাজায়েযকে তখন আর নাজায়েয মনে হয় না। আর কে না জানে, নাজায়েয কাজে লিপ্ত হওয়ার চেয়েও বড় অপরাধ হচ্ছে নাজায়েযকে জায়েয মনে করা। এটা উৎসবের গুরুতরতার দিক।
সারকথা এই যে, কোনো উৎসব সরাসরি ভিন্ন ধর্মের ‘ধর্মীয়’ উৎসব না হলেই মুসলিমের জন্য বিধিসম্মত হয়ে যায় না। শুধু প্রকাশ্য শিরকই নয়, গুনাহ ও পাপাচারের পথে যাওয়াও মুসলিমের জন্য নিষিদ্ধ। আর সে কারণে এই পয়লা বৈশাখ উৎসবকে ‘সর্বজনীন উৎসব’ বলাটাও সম্পূর্ণ অর্থহীন!