রজব ১৪৩৮   ||   এপ্রিল ২০১৭

অমানবিক : ধিক! শত ধিক!!

শাহ মুহাম্মাদ

মাঘের ক্রান্তিকাল। বসন্ত আসি আসি করছে। দ্বিপ্রহরেও সূর্যের অসহনীয় তাপ। চাঁদপুরের একটি বিদ্যালয়ে খুশির আমেজ। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উপলক্ষে নানা আয়োজন। এদিক-সেদিক রঙিন ফিতে উড়ছে। মাঠের একপাশে শামিয়ানা। তার নিচে সারি সারি আসনে উপবিষ্ট অতিথি ও দর্শকবৃন্দ। স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সভাপতির আসন অলংকৃত করে আছেন।

মধ্যমাঠে শিশুদের একটুখানি জটলা। স্কুলের স্কাউট সদস্যরা কোনোকিছুর কসরত করছে। খানিক বাদে বিষয়টা পরিষ্কার হল। শিশুরা দুই সারিতে মুখোমুখী হয়ে একে অন্যের হাতে হাত রেখে মানবসেতু তৈরি করেছে। উপস্থাপক এটাকে পরিচয় দিয়েছেন প্রতীকি পদ্মাসেতু বলে । আরেক শিশু সারি সারি হাতের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে সেতুর পাটাতন রচনা করল। আর সেতুর দ্ইুপাশে দুই শিক্ষার্থী উঁচু হয়ে হাত ও হাঁটু মাটির ওপর রেখে আরোহণ ও অবতরণের সিঁড়ি বনে গেল। ব্যস, কোনো রকম কেউ এটা পাড়ি দিলেই সেতুর ষোলকলা পূর্ণ হয়।

বিরল সম্মান ও কৃতিত্বের এই কর্মখানা আঞ্জাম দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হল অনুষ্ঠানের মোস্ট ইম্পর্টেন্ট পার্সন সভাপতি মহোদয়কে। প্রথমে একটু গাইগুঁই করলেও সবার অনুরোধে নিমরাজি হলেন। তিনি একজন জনপ্রতিনিধি। তাঁর দুই নয়ন মানে এলাকাবাসীর উন্নয়ন। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নই তো পরম আরাধ্য তাঁর জীবনের! অতএব এতগুলো মানুষের অনুরোধ তিনি কীভাবে উপেক্ষা করেন!!

সুতরাং সেতুর পাটাতন অমসৃণ এবং ভিত্তি নড়বড়ে হলেও কেবল জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি রাজি হলেন। এবং শেষতক কোনোরূপ দুর্ঘটনা ছাড়াই নির্বিঘ্নে নির্ঝঞ্ঝাটে প্রবল করতালির মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পদ্মাসেতু সফলভাবে পাড়ি দিলেন। আর সাথে উন্মুক্ত করে দিলেন বিতর্ক আর নিন্দার প্রশস্ত এক দরজা।

বার্ষিক প্রতিযোগিতার যেমন খুশি তেমন সাজো পর্বে শিশুরা চাষা-চাষী যেমন সাজতে পারে তেমনি পদ্মাসেতু-মানবসেতুও বানাতে পারে। তাই বলে সভাপতি সাহেব শক্ত চপ্পলসমেত অমন বিশাল দেহ নিয়ে শিশুদের নরম কোমল পিঠ মাড়িয়ে যাবেন! নৈতিকতার এ কেমন সংজ্ঞা? রুচি ও শিষ্টাচারের কেমন অধঃপতন হলে শিশুদের কাঁধ ও পিঠকে মাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?!

এখানে মূলত তিনটা পক্ষ। সেতু তৈরিকারক শিশুদের দল, আরোহণকারী সভাপতি আর দুপাশ থেকে সহায়তাকারী অন্যান্য শিক্ষক ও আয়োজকবৃন্দ। এই ঘটনায় সরাসরি শিশুদের দায়ী করা মুশকিল। কারণ তাদের সহজাত মস্তিষ্কে এ ধরনের উদ্ভট কাজকর্মের আনাগোনা অস্বাভাবিক। এটা স্কাউট অথবা স্কুল কর্তৃপক্ষের আবিষ্কার, যা সরল শিশুদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তথাপি শিশুদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের মৌলিক একটা পার্থক্যবোধ থাকা জরুরি। যাতে জোরপূর্বক কোনো অন্যায় কাজ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলেও বিনয়ের সাথে তা অস্বীকার করতে পারে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হল একজন জনপ্রতিনিধি কতটা সহজে এমন জঘন্য কাজ করলেন! কথিত সেতুর পাটাতনে তাঁর ছেলেকে যদি শুইয়ে দেয়া হত তিনি কি আপন ছেলেকে মাড়িয়ে যেতেন? একই কাজ পরের ছেলের বেলায় কীভাবে করলেন!? এ ঘটনায় চারদিকে প্রবল সমালোচনা শুরু হওয়ার পর তিনি বলছেন, স্বেচ্ছায় এই কাজ করেননি। সবার অনুরোধেই তিনি মানবসেতুতে উঠেছেন। এমনকি সেতু পার হয়ে শিশুদের ৫০০০ টাকা পুরস্কারও দিয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিশুরা যদি তাঁর অমন ভারি শরীরের বোঝা বহনে অক্ষম হত এবং তিনি আকাশপাতাল প্রকম্পিত করে স্বপ্নের পদ্মাসেতুসমেত ভূপাতিত হতেন তখনও কি তাঁর পকেট হতে পুরস্কারের কড়কড়ে নোটগুলো বেরিয়ে আসতো? সেই পরিস্থিতির জন্য তিনি কাকে দায়ী করতেন!

সভাপতি সাহেব বলছেন, সেতুতে তিনি নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠেছেন। কিন্তু তাঁর মুখাবয়বে নিতান্ত অনিচ্ছার ছাপ ছিল একেবারে অনুপস্থিত; বরং সফলভাবে সেতু পাড়ি দেয়ার শেষ পর্যায়ে দন্তরাজি প্রর্দশন করে যে ভূবনভুলানো হাসি তিনি হেসেছেন, স্বয়ং নীল আর্মস্ট্রং চন্দ্রবক্ষে অবতরণের পরেও এমন হাসি দিয়েছেন কি না সন্দেহ।

তাছাড়া অবিবেচক কিছু মানুষ অনুরোধ করল অমনি তিনি তরতর করে সেতু বেয়ে শিশুদের কাঁধ পিঠ ও বাহু মাড়িয়ে উঠে গেলেন। বাস্তবতা যদি এমনই হয়, ভালোমন্দ বিবেচনা না করে মানুষের অনুরোধ চোখবুজে পালন করে যাওয়াই যদি তার স্বভাব হয় তবে তাঁর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ জনপ্রতিনিধিই যে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নন সে কথা ঘোষণা করে এক শিল্পপতির মত তাঁদের রোষের পাত্রে পরিণত হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।

একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি জেনে থাকবেন, আদালত শিশুদের কাঁধে অতিমাত্রায় ভারি স্কুলব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। তিনি হয়ত ভেবেছেন আদালত ভারি স্কুলব্যাগই না নিষিদ্ধ করেছে, শিশুদের কাঁধে আস্ত ভুড়িফাঁপা বয়স্ক মানুষের আরোহণ তো নিষিদ্ধ করেনি। অতএব তিনি তো বেআইনি কিছু করছেন না!

তিনি এটাও জেনে থাকবেন, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-অতএব এই সুযোগে শক্ত জুতো দিয়ে শিক্ষার্থীদের পৃষ্ঠদেশ মাড়িয়ে তিনি হয়তো পরীক্ষা করছিলেন জাতির মেরুদ- কতখানি শক্ত হল।

যাই হোক, জনপ্রতিনিধির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা  তো মুশকিল। আদর্শ জাতি ও সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অথচ আলোচ্য ঘটনায় ঐ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জনপ্রতিনিধির তোষামোদ ও চাটুকারিতায়  যে ভূমিকা পালন করেছেন তা সত্যিই বেদনাদায়ক।

প্রথমত সভাপতিকে কথিত পদ্মাসেতুতে আরোহণের জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। এরপর দুপাশ হতে হাত ধরে নেতাকে সেতু পারাপারে সহায়তা করলেন। সর্বশেষ সফলভাবে সেতু পাড়ি দেয়ার জন্য তুমুল করতালির মাধ্যমে তাকে অভিবাদন জানালেন। শিক্ষকের এ কী চরিত্র!

কোথায় ছাত্রদের শেখাবেন অন্যায় প্রতিরোধের মন্ত্র, উল্টো নিজ ছাত্রদের সাথে অমানবিক আচরণে উল্লসিত হয়ে করতালিতে ফেটে পড়ছেন!

প্রধান শিক্ষক মহাশয় আরো কধাপ এগিয়ে। নেতার পক্ষে সাফাই গেয়ে বললেন; এটা নতুন কিছু না। প্রতি বছরই এমনটা হয়ে থাকে। নিন্দুকেরা এখন এটা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে।

বাঃ বাঃ কী চমৎকার! একটা অন্যায় বহুদিন ধরে চলে আসছে। সেটা বন্ধের চেষ্টা না করে উল্টো এটাকেই বৈধতার দলীল বানিয়ে বসেছেন। যেন একটা অন্যায় বহুদিন ধরে চলতে থাকলে সেটা ন্যায় হয়ে যায়!

কী বিচিত্র যুক্তি আমাদের প্রধান শিক্ষকের!!

খোলাসা কথা হচ্ছে, সরলমতি শিক্ষার্থীদের বলির পাঁঠা বানিয়ে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক নেতাদের মনোরঞ্জনের অপচেষ্টা নতুন কিছু না। এমন ঘটনাও ঘটেছে- মন্ত্রী মহোদয় স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তার দুপাশে গ্রীষ্মের উত্তপ্ত গরমের মধ্যে সারি বেধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ছাতিফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একাধিক ছাত্রছাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। পরের দিন জাতীয় দৈনিকগুলোতে ফলাও করে সে সংবাদ ছাপা হয়েছে। তথাপি শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি করা ঐসব লোকের চরিত্রে পরিবর্তন আসেনি। যেমন পরিবর্তন আসেনি চাঁদপুরের সাম্প্রতিক ঘটনার পরেও।

এত আলোচনা সমালোচনা আর নিন্দাঝড়ের পরেও লোকগুলোর কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙেনি। ২৯ শে জানুয়ারি হুবহু একই ঘটনা ঘটেছে জামালপুরের মেলান্দহে আরেকটি উচ্চবিদ্যালয়ে। আগেরজন হেঁটেছিলেন পিঠের ওপর দিয়ে আর স্কুলের  জমিদাতা এই নবাবজাদা হাঁটলেন কাঁধের ওপর দিয়ে। ইনি হয়ত ছাত্রদের সাথে একটু কৌতুক করে দেখলেন, স্কুলের জন্য জমি দান করলাম, ছাত্রদের কাঁধ কেমন শক্ত হল দেখা দরকার। যেই কাঁধ আমার মত একজন মানুষের ভার সইতে না পারে, বড় হয়ে কী করে ১৬ কোটি মানুষের বোঝা বইতে পারবে!

 

এইসব কৌতুকপ্রিয় চাটুকার শিক্ষক, পদলোভী ম্যানেজিং কমিটি আর রম্যরসিক পাতিনেতারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- আপন কর্মকাণ্ডে তাঁরা অনড়, পাহাড়সম অবিচল। শত নিন্দা, সমালোচনা অথবা মানবিক মূল্যবোধ কোনোকিছুই তাদের টলাতে পারবে না এতটুকুও। আহ, এই অবিচলতা যদি হত কল্যাণের পথে! এই অটলতা যদি হত দেশের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিতে!

 

 

advertisement